রবিবার ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


চোখের সামনে গঙ্গার অপার জলরাশি। আকুল হয়ে ছুটে চলেছে সে সাগর পানে। নদীর ওপারে ঘন সবুজ সীমারেখা। গভীর অরণ্যের অস্পষ্ট ছবি। এখানেই রথ যাত্রা শেষে শুরু করতে হবে প্রকৃত বনবাস জীবন। সুমন্ত্রকে বিদায় দিয়ে ভারাক্রান্ত মনে এগিয়ে চলতে হবে পিতৃসত্য রক্ষার উদ্দেশ্যে। রাম এগিয়ে এলেন নদীর কাছে। দেখতে পেলেন, গঙ্গাতীরে বাঁধা আছে এক সুন্দর সাজানো-গোছানো নৌকা। মনঃস্থির করে ফেললেন তিনি।

অনুজ লক্ষ্মণকে বললেন, এ নৌকাতেই ওপারে যাব। তুমি আগে সীতাকে ধীরে ধীরে নৌকায় ওঠাও। নিষাদপতি গূহর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নৌকায় উঠলেন রাম। অশ্রুসজল চোখে তীরে দাঁড়িয়ে রইলেন নিষাদপতি। নৌকা এগিয়ে চলল দক্ষিণতীরের দিকে। সেখানে গুল্ম-লতায় আচ্ছাদিত, নানা ফুলের সম্ভারে সুসজ্জিত, পাখ-পাখালির কলকাকলিতে মুখরিত গভীর ভীষণ অরণ্যানী অপেক্ষারত তাঁদের জন্য।
ওদিকে আঁধাররাজপুরীতে বিষাদকালো মুখে ফিরে এলেন সুমন্ত্র। পার হয়ে এলেন তিনি বহু দেশ, নদী, গ্রাম, নগর। কলকোলাহলশূন্য, নিরানন্দ জনপদে এখনও বিছিয়ে আছে বিষণ্ণতা। আর অযোধ্যাপুরী? এ যেন পদ্মফুলে ঢাকা বিশাল সরোবর, কিন্তু পদ্মের সবটুকু সৌন্দর্য ঝরে গিয়ে ম্লান, হতশ্রী তারা।

নিষ্প্রভ রথ অযোধ্যার প্রবেশদুয়ার পার করে ঢুকছে দেখেই ছুটে গেল তার দিকে জনস্রোত। প্রজারা জানতে চায়, রামের খবর— কোথায় আছেন তিনি, কেমন আছেন তাঁরা সকলে। তারা জানতে পারে, গঙ্গা পার হয়ে তিনি পৌঁছে গিয়েছেন দক্ষিণ তীরে। শুনে হতাশায় কেঁদে ফেলে প্রজারা। মনের মধ্যে ক্ষোভও পুঞ্জীভূত হতে থাকে কারো কারো। শোকমগ্ন সুমন্ত্র রথ নিয়ে এগিয়ে চলেন, কানে ভেসে আসে নানা কটূক্তি, “রামকে গভীর অরণ্যে ফেলে নির্লজ্জ সুমন্ত্র ফিরে এসেছে রাজপুরীতে।” অবিশ্বাস, হতাশা, নিষ্ফল ক্রোধে বিচারহীন ভাবনা গ্রাস করে জনতাকে।

অবশেষে সাতমহলা রাজবাড়িতে হতশ্রী রাজভবনে শোকজর্জর রাজার সামনে এসে দাঁড়ালেন সুমন্ত্র। চারদিকে থেকে ভেসে আসছে রাজমহিষীদের বিলাপ— ‘সুমন্ত্র এখন কৌশল্যার সামনে দাঁড়াবেন কীভাবে? কী বলে সান্ত্বনা দেবেন পুত্রবিরহী মাকে?’ সে সব শোকক্লান্ত কণ্ঠস্বর পার হয়ে এবার সুমন্ত্র মুখোমুখি দাঁড়ালেন অযোধ্যাপতির।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৯: নদীর তীর, বনের পথ, শোক সামলে ছুটল রথ…

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১: অমৃতের সন্ধানে…

মাঝখানে কয়েকদিনের ব্যবধান। সুমন্ত্র দেখলেন, এর মধ্যেই রাজার শরীর যেন আরও জরাজীর্ণ, ক্লান্ত। শোকের ভার যেন ক্রমেই দুর্বহ হয়ে উঠছে তাঁর কাছে। প্রিয় পুত্রকে বিদায় দিয়ে দশরথ সেদিন আর ফিরে যাননি কৈকেয়ীর রাজভবনে। প্রবল ক্ষোভের তপ্ত লাভা যেন বেরিয়ে এসেছিল কৈকেয়ীর প্রতি—“পাপীয়সী কৈকেয়ী, তোমাকে আমি আর দেখতে চাই না। তোমাকে পত্নীরূপেও আমি মনে রাখতে চাই না। আমি তোমাকে ত্যাগ করলাম। আর তোমার ভ্রৃত্য, ভৃত্যার দল, তাদেরও আমি প্রভু নই আর। কৈকেয়ী, ভরত এই সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য পেয়ে যদি আহ্লাদিত হয়। তবে সে যেন আমার মৃত্যুর পর আমার উদ্দেশ্যে জল, পিণ্ডাদি দান না করে। ভরতের দান আমি গ্রহণ করব না। কৈকেয়ী, তুমি সফল হও। আমার মৃত্যুর পর রাজ্য শাসন কর। আমি রামকে নির্বাসনে পাঠিয়ে বেঁচে থাকতে পারব না।”

পথের ধূলোর মধ্যে পড়ে আছেন রাজাধিরাজ। কৌশল্যা তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে নিজের বাসভবনে কোনোক্রমে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর জীবনে অনুতাপ ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১: নারী কি আলাদা? তাঁরা পুরুষদের সঙ্গে বসতে ভয় পান? তাহলে কি এত আয়োজন শুধু তাঁদের ভয় দেখাতে…

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৮: অবশেষে বৃদ্ধ চ্যবনমুনি শর্যাতিরাজার কন্যার পাণিপ্রার্থী হলেন

সুমন্ত্র দশরথের সামনে এসে পিতার উদ্দেশ্যে রামের পাঠানো বার্তা নিবেদন করলেন। রামের কথা যেন সত্যিই কানে ভেসে এল রাজার। উদ্ভ্রান্তচিত্ত শোকদগ্ধ রাজা আবার সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। রাজমহিষীরা ছুটে এলেন। কৌশল্যা, সুমিত্রা উঠিয়ে বসালেন রাজাকে।
এবার কৌশল্যা অস্থির হয়ে রাজাকে বললেন— “এই দূত অত্যন্ত কঠিন কাজ করে এসেছেন। আপনি এঁকে রামের সংবাদ জিজ্ঞাসা করুন। আর আপনি যদি এই নিষ্ঠুর কাজ করে লজ্জিত হয়ে থাকেন, তাহলে এখন মহারাজ লজ্জার সময় নয়। এখানে কৈকেয়ীও উপস্থিত নেই যে আপনি সন্ত্রস্ত হবেন। আপনি নির্ভয়ে জিজ্ঞাসা করুন, যে ওরা কোথায় আছে, কেমন আছে? কোথা থেকে সুমন্ত্রকে বিদায় দিয়েছে।”
আরও পড়ুন:

আপনার ছোট্ট সোনামণির সঙ্গে কোন কোন আচরণগুলি কখনওই করবেন না?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৬: ছোটদের, একান্তই ছোটদের ‘ভাই-বোন সমিতি’

দশরথ এবার কিছুটা সামলে নিলেন নিজেকে। সবিস্তারে জানতে চাইলেন রামের যাত্রাপথ, তাঁদের বর্তমান অবস্থান। জানতে চাইলেন, রাজার প্রতি তাঁদের দুঃখ কিংবা অভিমানের কথা। সুমন্ত্র একে একে সব বৃত্তান্ত বলতে লাগলেন, যেন এ এক চলচ্ছবি। শুনতে শুনতে আবার শোকসাগরে ডুবে যেতে থাকলেন রাজা দশরথ, কৌশল্যা, সুমিত্রা। এ

বার প্রবল ক্ষোভে ফেটে পড়তে লাগলেন কৌশল্যা। তীব্র ভর্ৎসনা করে রাজাকে বললেন— “মহারাজ, বলা হয়, মানুষের প্রথম গতি, আত্মা, দ্বিতীয় গতি আত্মজ, তৃতীয় গতি সাধুজন, চতুর্থ গতি ধর্মসঞ্চয়। আপনার ধর্মপরায়ণ, সত্যনিষ্ঠ পুত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে আপনি চারপ্রকার গতি থেকেই বিচ্যুত হয়েছেন। কৈকেয়ীর জন্য আপনার অর্জিত সব পুণ্যফল থেকে আপনি পতিত হলেন। কৈকেয়ীর হাতে শেষে রাজ্য তুলে দিয়ে এই রাজ্য, প্রজা, আপনার কীর্তি, স্বধর্ম এমনকি নিজেকেও শেষ করলেন। রাজ্যবাসীর মতো আমিও সপুত্রক শেষ হয়ে গেলাম।”

অসহায় মায়ের বুক থেকে উঠে আসা কর্কশ, নিষ্ঠুর বাক্য ক্রমশ রাজাকে শোকাভিভূত, মোহাচ্ছন্ন করে তুলল। বহুকাল আগের একটি ঘটনা হঠাৎ স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ক্রমশ। সে কি ঘটনা নাকি দুর্ঘটনা? না কি তার অন্তরালে নিহিত অমোঘ ভবিতব্য!—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content