সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ঠাকুরবাড়ির ছোটরা মাকে পেত না। দাসদাসীদের কাছেই প্রতিপালিত হতো। রবীন্দ্রনাথের শ্যামের কথা, ঈশ্বরের কথা, অবনীন্দ্রনাথের পদ্মদাসীর কথা তো আমাদের অজানা নয়। অবনীন্দ্রনাথের পদ্মদাসী ছিল রাতের অন্ধকারের মতো কালো। ঘুমপাড়ানো ছড়া আউড়ে সে বাড়ির ছোটদের ঘুম পাড়াত। এত কালো যে অবনীন্দ্রনাথের মনে হতো, অন্ধকারে মিশে রয়েছে, উপস্থিতি টের পেলেও চোখে দেখা যেত না। রবীন্দ্রনাথ বা অবনীন্দ্রনাথ নন, ঠাকুরবাড়ি সকলেরই শৈশব-বাল্য এমনই বেদনাবিধুর। পিতৃদেবকে সেভাবে পেতেন না। এই না পাওয়াটা স্বাভাবিকই ছিল। ‘বনগাঁবাসী মাসি-পিসি’ও তাঁদের ছিল না। এসব না থাকার ফলেই বোধহয় ছোটরা পরস্পরের আরও কাছাকাছি হয়েছিল।
ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী।
একসময় বাড়ির ছোটরা অবনীন্দ্রনাথের কাছে প্রতিদিন সকালে জড়ো হতো, আগের দিন রাতে দেখা স্বপ্ন লিখে ফেলার তাগিদে। ঠাকুরবাড়ির ছোটরা বড়দের অনুসরণে একটি সমিতিও প্রতিষ্ঠা করেছিল। বড়রা যেমন ‘ড্রামাটিক ক্লাব’, ‘খামখেয়ালী সভা’ বা ‘বিচিত্রা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ঠিক তেমনই ছোটরা করেছিল ‘ভাই-বোন সমিতি’। ‘খামখেয়ালী সভা’ বা ‘বিচিত্রা’-র কথা আমরা কম-বেশি জানলেও এই অভিনব ‘ভাই-বোন সমিতি’ আড়ালেই রয়েছে। এই সমিতির আচার্য পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১২৯৫ বঙ্গাব্দের মাঘোৎসবের দিন ‘ভাই-বোন সমিতি’র পথ চলা শুরু হয়েছিল। কারা ছিল এই সমিতির সঙ্গে, এই কৌতূহল-প্রশ্ন মনে জাগা স্বাভাবিক। আচার্য দ্বিজেন্দ্রনাথ যে ‘উপদেশ’ দিয়েছিলেন, সেই উপদেশে রয়েছে অনেকেরই নাম। সেই নাম-তালিকার দিকে তাকিয়ে মনে হতেই পারে, পরবর্তীকালে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তাঁদের মনের রসদ একদা এই ‘ভাই-বোন সমিতি’ থেকে সংগৃহীত হয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘হিতু নীতু ক্ষিতু কৃতু, সুরেন বিবি বলু সুধী।/জ্যোৎস্না সরলা … কি আর বলব … সর্বগুণে গুণাম্বুধি।।’ ‘আচার্যের উপদেশ’ শিরোনামে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় এই কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লিখিত কবিতায় সামান্য কয়েকজনের নাম দ্বিজেন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন। ঠাকুরবাড়ির অধিকাংশ বালক-বালিকা কিশোর-কিশোরীই এই সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিল।
দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র- ভ্রাতুষ্পুত্রী- ভাগিনেয়-ভাগিনেয়ীদের নামের সংক্ষিপ্তকরণ করেছেন। এই নামেই তিনি স্নেহাস্পদ-স্নেহাস্পদাকে ডাকতেন। পাঠকের বোঝা সহজতর হবে, এই ভেবে আমরা পুরো নাম ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে দিচ্ছি, হিতেন্দ্রনাথ, নীতেন্দ্রনাথ, ক্ষিতীন্দ্রনাথ, কৃতীন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ, ইন্দিরা, বলেন্দ্রনাথ ও সুধীন্দ্রনাথ। কেন এই সমিতির প্রয়োজন, কী-বা উদ্দেশ্য ছিল, এ প্রসঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সাজাদপুর থেকে চিঠি লিখেছিলেন হিতেন্দ্রনাথকে। সে চিঠিতে আছে, ‘তোমরা যে ভাই-বোন সমিতি স্থাপন করেছ, তা থেকে নানান কথা আমার মনে আসছে… কৈ …তোমাদের এই বয়সে ভাই-বোন সমিতির মতো কোনও উচ্চতর কল্পনা তো আমাদের মাথায় আসেনি। সব ভাই-বোন মিলে জ্ঞানের চর্চা করা… বড় ভাই ছোট ভাইয়ের শিক্ষার ভার স্বেচ্ছাক্রমে গ্রহণ করা … পরস্পরের মধ্যে সদ্ভাব বর্ধন করবার চেষ্টা করা … জ্ঞানচর্চা ও কর্তব্য-সাধনের উচ্চতর আনন্দ এবং বিশুদ্ধ সংগীতের বিশুদ্ধ আমোদ বিশুদ্ধভাবে উপভোগ করা … এ প্রকার ভাব, সেকালে আমাদের মনে তো উদয় হয়নি।’
হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
শরীর গড়ার প্রয়োজনীয়তার কথা ঠাকুরবাড়িতে স্বীকৃতি পেয়েছিল। শরীরচর্চার নানা আয়োজন ছিল। কুস্তি শেখাতে কুস্তিগীর আসত, সে সংবাদ আমাদের অজানা নয়। ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘বালক’ পত্রিকায় ব্যায়াম নিয়ে লিখেছিলেন স্বয়ং সম্পাদিকা জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। উল্লিখিত চিঠির শেষে হিতেন্দ্রনাথকে সুপরামর্শ দিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন, ‘যেমন তোমাদের মধ্যে কেহ বা বিজ্ঞানশিক্ষা … কেহ বা সঙ্গীতশিক্ষা দিবার ভাগ নিয়েছ …। সেই রূপ কেহ যদি ব্যায়াম শিক্ষা দেওয়ার ভার গ্রহণ করে তো ভালো হয়।’ হিতেন্দ্রনাথকে সামনে রেখে বাড়ির সব ছোটদের তিনি বুঝিয়েছেন ব্যায়ামের প্রয়োজনীয়তা। ব্যায়ামের ব্যাপারে ইংরেজের সচেতনতার কথাও জানিয়েছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ইংরেজদের মতো আমরা এখনও ব্যায়ামের উপকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা সেরূপ সর্বান্তঃকরণে হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি, … তা যদি পারতাম তাহলে যেরূপ এখন আমরা সবাই নিয়মিত আহার করি, স্নানাদি করি, সেইরূপ প্রত্যহ ব্যায়ামও করতেম।’
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৫: রবীন্দ্রনাথ নিজের ডাক্তারি নিজেও করেছেন
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১: চায়ের দোকান থেকে বিশ্বজয়
হেলদি ডায়েট: আরও বেশি সুন্দর ও তরতাজা থাকতে নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই এই নিয়মগুলো মেনে চলুন
উদ্বেগের জন্য চুল পড়ছে, না কি চুল পড়ায় বাড়ছে উদ্বেগ? সমীক্ষা কী বলছে?
ভাই-বোন সমিতিতে আরও বেশি করে বাড়ির ছোটরা অংশ নিক, প্রয়াস সফল হোক, বড়রা তা নিয়ে সমবেতভাবে চেষ্টা করেছেন, ভেবেছেন। এই সমিতির চালানোর জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তা বড়রাই দিতেন। জানা যায়, ‘সমিতির খরচপত্রাদি বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে পাওয়া চাঁদার দ্বারা নির্বাহিত হতো।’ রবীন্দ্রনাথের ভাগিনেয় সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় মাসে মাসে যে চাঁদা দিতেন, সে-তথ্য রয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত হিসাবের খাতায়। সেই খাতা থেকে হিসেবের বিবরণ দিয়েছেন রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল।
ভাই-বোন সমিতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ-অনুগত্য ছিল। তিনি ছোটদের কতখানি ভালোবাসতেন, তা আমাদের অজানা নয়। ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও ভ্রাতুষ্পত্রী ইন্দিরার প্রতি তাঁর অনাবিল ভালোবাসার কথা আমরা জানি। নিজের সন্তান-সন্ততিদের প্রতি সুগভীর বাৎসল্য-ভালোবাসা শুধু নয়, ছিল গভীর দায়িত্ববোধ। ছোট্ট মাধুরীলতাকে তিনি রাতে উঠিয়ে গরম দুধ খাওয়াতেন। স্নান করিয়ে দিতেন। স্ত্রী মৃণালিনীকে লেখা এক চিঠিতে এই দায়িত্বপরায়ণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ছোটদের প্রতি যাঁর এমন ভালোবাসা, তিনি তো ছোটদের একান্তই নিজস্ব এই সমিতির প্রতি আনুগত্য দেখাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। দেখিয়েছিলেনও কবি। রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে ছোটদের উজ্জীবিত করেছেন। ভাইবোনের সমিতির ছোটরাও স্নেহ-সান্নিধ্য উদ্দীপিত হয়েছে।
ভাই-বোন সমিতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ-অনুগত্য ছিল। তিনি ছোটদের কতখানি ভালোবাসতেন, তা আমাদের অজানা নয়। ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও ভ্রাতুষ্পত্রী ইন্দিরার প্রতি তাঁর অনাবিল ভালোবাসার কথা আমরা জানি। নিজের সন্তান-সন্ততিদের প্রতি সুগভীর বাৎসল্য-ভালোবাসা শুধু নয়, ছিল গভীর দায়িত্ববোধ। ছোট্ট মাধুরীলতাকে তিনি রাতে উঠিয়ে গরম দুধ খাওয়াতেন। স্নান করিয়ে দিতেন। স্ত্রী মৃণালিনীকে লেখা এক চিঠিতে এই দায়িত্বপরায়ণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ছোটদের প্রতি যাঁর এমন ভালোবাসা, তিনি তো ছোটদের একান্তই নিজস্ব এই সমিতির প্রতি আনুগত্য দেখাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। দেখিয়েছিলেনও কবি। রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে ছোটদের উজ্জীবিত করেছেন। ভাইবোনের সমিতির ছোটরাও স্নেহ-সান্নিধ্য উদ্দীপিত হয়েছে।
বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের উজ্জীবিত করার চেষ্টা, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সক্রিয় উৎসাহ-দান তো ছিলই, ভাই-বোন সমিতির মাথায় ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। এমনভাবেই পরিবারের অগ্রজরা ছোটদের মাথার উপর হাত রেখেছিলেন। তাঁদের আশীর্বাদ-পুষ্ট হওয়া সত্বেও ভাই-বোন সমিতি দীর্ঘজীবী হয়নি। মাত্র বছরখানেক ছিল এই সমিতির আয়ুষ্কাল। পরিবারের অধিকাংশজন ভাই-বোন সমিতিকে ঘিরে উৎসাহ দেখিয়েছেন, আশাব্যঞ্জক মন্তব্য করেছেন ঠিকই, আবার দু-একজন সমালোচনাও করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সেজদা হেমেন্দ্রনাথের পুত্র ঋতেন্দ্রনাথ এই সমিতিকে সেভাবে মূল্য দেননি। লঘু চালে ব্যাখ্যা করেছেন।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৬: পাতে নিয়মিত মাছ থাকলে রোগ থাকবে দূরে, শরীর হবে তরতাজা, কীভাবে খেলে পুষ্টিগুণ বজায় থাকবে?
চলো যাই ঘুরে আসি: মোহনার দিকে…
ছোটদের যত্নে: শিশুকে কোন ওষুধ কখন খাওয়াবেন? ওষুধ খাওয়ার সঠিক নিয়ম কী? জানুন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
ঋতেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘অলস বাবুমাত্রেরই জুড়ি গাড়িতে চেপে হাওয়া খাবার ইচ্ছে হয়। সাহিত্যপ্রিয় অলস বাবুরাও সেইরূপ কোনও এক সমিতির জুড়ি গাড়িতে চেপে সাহিত্যক্ষেত্রে বিচরণ করতে ইচ্ছা করেন। আমরাও বছরে বেড়াবার জন্য এইরকম একটি গাড়ি করেছিলুম, সেটা মধ্যে ভেঙে যাওয়াতে আবার সারিয়ে ফেলা গেছে। আমরা হচ্ছি বাবু, আমরা বেড়াতে যাব।… ঘোড়ার পিছনে যে দুজন করে সহিস থাকে তাও এর আছে। সেসব বিষয়ে কোনো ত্রুটি নাই, তবে যে বাবুরা দানরূপ দানা দেন, সেটা একবার দেখা ভালো যে সহিসরা ঘোড়াকে খাওয়ায় কিনা।’ মন্তব্যটি বড় বেশি তীর্যক। ভাই-বোন সমিতি ছিল তো ছোটদের। সেখানে কেন জুড়ি গাড়ির কথা আসছে, কেনই হাওয়া খাওয়ার কথা আসছে, তা বোধগম্য হয় না। এটা অবশ্য স্পষ্ট হয়, কেউ আগ্রহ-আনুগত্য দেখালেও বিরোধিতা করার লোকজনেরও অভাব ছিল না। পরিবারের কেউ কেউ চাননি, সে কারণেই ভাই-বোন সমিতি খুব সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারেনি। অবহেলায় অনাদরে তা বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের ছোটরা মিলেমিশে একত্রে আনন্দের সন্ধানে ব্রতী হয়েছিল, হঠাৎই মাঝপথে ছন্দপতন, গতিরোধ, এসবই ঠাকুরবাড়ির ছোটদের কাছে বেদনার কারণ হয়ে উঠেছিল।
ছবি সৌজন্যে: লেখক
ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (Tagore Stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।