মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
ছোটবেলায় নাম ছিল শরৎনাথ। একবার খুব কঠিন অসুখে যায় যায় অবস্থা হলে বাড়ির বড়দের করা মানতে হরের প্রসাদে বেঁচে ওঠেন। তারপর নাম বদলে হয় হরপ্রসাদ। সেই নাম নিয়ে কলকাতায় পড়তে এসে জীবন বদলে যায়। প্রাচীন ভাষা সাহিত্যের পাশাপাশি পড়লেন ইংরেজিতে ইউরোপীয় ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি। সূক্ষ্ম মন তৈরি হল। সংস্পর্শে এলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রমেশচন্দ্র দত্ত, রাজেন্দ্রলাল মিত্রের। নিজস্ব মেধায় বঙ্কিমচন্দ্র, রাজেন্দ্রলালের স্নেহ পেলেন কিন্তু পোষাক-আশাকে তাঁদের কেতাদুরস্ত ভাব আয়ত্ত না করে হয়ে গেলেন বিদ্যাসাগরের মতো সাধারণ। জীবনযাপনে সাধারণ কিন্তু বিদ্যাজীবী হিসেবে অসাধারণ। বাবা, দাদার অনুপস্থিতিতে প্রায় অভিভাবকহীন ভাবে মানুষ হয়েছিলেন, পরিবারের কেউ তাঁর দায়িত্ব নেননি। এমন তিনি নিজেই নিজেকে গড়ে তোলার সংকল্প নেন। প্রথমে বিদ্যাসাগরের ছাত্রাবাসে, তারপর ছাত্র পড়িয়ে নিজেই নিজের খরচ চালাতেন। সেই বালক বয়সে স্কলারশিপের টাকায় তহবিল গড়েছিলেন অন্যের উপকারের জন্য।
নিজের পড়াশোনায় যেমন দূরদর্শী তেমন ছাত্র পড়ানোর ক্ষেত্রে। ক্লাসে কখনও বই হাতে ঢুকতেন না। পড়ানোর বয়ান সব মুখস্থ থাকত। ছাত্রদের পড়াতে পড়াতে কালিদাসের কালে নিয়ে যেতেন। নিজেও কালিদাসের মেঘদূতে বর্ণিত নদীনালা, পাহাড়, পর্বতের খোঁজে বেশ কয়েকবার রামটেক গিয়েছিলেন। জীবন-সাহিত্য-ইতিহাস তাঁর চর্চা ও চর্যায় একাকার হয়ে গিয়েছিল। দরবারি ইতিহাসের পরিবর্তে তথ্যের জন্য লৌকিক স্তরে নেমে যেতেন। অপটু শরীরে অসম্ভব কষ্টসাধ্য পথে পায়ে হেঁটে তথ্য সংগ্রহ করেছেন দিনের পর দিন। সাধারণ মানুষের মধ্যে বসবাস করে দেশকে, দেশের মানুষকে বোঝার চেষ্টা করতেন। এই অন্ত্যজ, মেঠো সংস্কৃতির প্রতি বিশ্বাস থেকে বার বার বলতেন বেদ অপৌরুষেয় নয়। বেদকে তিনি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, বিবিধ কারণে, ভিন্ন ভিন্ন কবিদের রচিত প্রাচীন কবিতা ও গানের সংগ্রহ বলতেন। বরাবর সমাজবিদ্যাবিদ ও নৃতাত্ত্বিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হিন্দুদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নিয়ে মতামত দিয়েছেন ও লিখেছেন। নিজে দুই সন্ধ্যায় আহ্নিক করতেন, কিন্তু দীক্ষা গ্রহণে বিশ্বাসী ছিলেন না, বলতেন ওসব বৌদ্ধদের ব্যাপার।
আরও পড়ুন:
যোগা-প্রাণায়াম: পিসিওডি এবং পিসিওএস-এর সমস্যা? চিন্তা নেই যোগায় আছে সমাধান
‘নো মেকআপ লুক’ চাই? তাহলে ৫টি লিপস্টিক নিজের সংগ্রহে রাখতে পারেন
তাঁর একসময়ের সহকর্মী প্রখ্যাত অধ্যাপক রাধাগোবিন্দ বসাক (১৮৫৮-১৯৮২) উল্লেখ করেছিলেন, ‘সংস্কৃত কলেজে হরপ্রসাদ এমএ-র ছাত্রদের অশোকের লিপিমালা পড়াতেন এবং মূল্যবান টিকা টিপ্পনি লিখে দিতেন’। তাঁর প্রত্যক্ষ ছাত্র নয় এমন ছাত্ররাও সেইসব টিকা টিপ্পনি সংগ্রহ করতেন। সংস্কৃতের এতবড় অধ্যাপক, এত পড়াশোনা, বড় মাপের মানুষদের সঙ্গে ওঠাবসা, নিশ্চয় ছাএদের ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতেন না, এমন ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু আসল চিত্রটা ছিল অন্যরকম। ছাত্রদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে যেতেন—গাম্ভীর্যের দূরত্ব রাখতেন না। চেহারায় গম্ভীর দেখালেও আচরণে গাম্ভীর্যের আড়াল থাকত না। নানাজনের লেখায় তাঁর ছাত্র রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক মন্তব্য পাওয়া যায়।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
একবার তিনি কোনও লিপির পাঠ সম্পর্কে শাস্ত্রীমশাইয়ের কাছে আলাদা মত জানতে আসেন। এই নিয়ে ছাত্র শিক্ষকের খানিক তর্কাতর্কি হওয়ায় শিক্ষক ছাত্রকে বাড়ি থেকে তাড়া করে বের দেন। রাখালদাস পালাতে পালাতে বলেছিলেন ‘আজ খুব খেপিয়ে দিয়েছি’। আবার গভীর শ্রদ্ধায় হরপ্রসাদের টেবিল দেখিয়ে তিনি সবাইকে বলতেন, ‘এই টেবিল থেকে আমরা ঝুড়ি ঝুড়ি লোক ডক্টরেট পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছি’। তাঁর দুই ছাত্র রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘পাথুরে প্রমাণ’ ঘরানাকে হরপ্রসাদ তর্কাতীত মনে করতেন না আবার ছাত্রদের ঠেলে সরিয়েও দিতেন না।
আরও পড়ুন:
ভারতীয় সাহিত্যের এই সাধক যখনই কলম ধরেছেন বাংলাভাষা ততই পদ্ধতিগতভাবে এগিয়েছে/২
দশভুজা: ‘ওগো তুমি যে আমার…’— আজও তাঁর জায়গা কেউ নিতে পারেনি/২
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৪: কবির দরজা সাধারণজনের জন্য সারাক্ষণই খোলা থাকত
সরস্বতী পুজোর সময় নৈহাটির বাড়িতে বড় করে পুজোর আয়োজন করা হতো। ছাত্ররা কলকাতা থেকে দল বেঁধে স্যারের বাড়িতে উপস্থিত হতো। তাদের আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি থাকত না। তাদের খাইয়ে স্যারের আনন্দ। একসময় স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকলেও পরে তা বৈরিতায় পরিণত হয়। কিন্তু সেইসব দিনেও নৈহাটি থেকে তাঁর জন্য বিশেষ মিষ্টি তৈরি করিয়ে পাঠাতেন। এই বিরোধের ফলে না তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে, না প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস বিভাগে পড়ানোর সুযোগ পেলেন ফলে ছাত্র গবেষক পরম্পরা তৈরি হল না। গুণীজনের সমাদরে সবার প্রথমে থাকতেন তিনি।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
বিশিষ্ট ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বিলেত থেকে ডি.লিট হয়ে এলেন। মাতৃভাষার ইতিহাসের উপর ‘ওরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজে’র মতো বিস্ময়কর বই লিখলেন। একমাত্র তিনি কলকাতার বিদ্বজ্জনেদের নিজের বাড়িতে ডেকে সুনীতিকুমারকে অভিনন্দিত করে, সংবর্ধনা জানালেন। এই উপলক্ষ্যে স্মরণীয় জলযোগের ব্যবস্থাও করেছিলেন।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-২২: রাইচরণ চরিত্রটা আমি করতে চাই, আমাকে এই চরিত্রটা করার সুযোগ দিন: উত্তমকুমার
স্বাদ-বাহারে: গরমে স্বাদ বদলাতে ঝটপট তৈরি করে ফেলুন এঁচোড়ের ডাল
ইংলিশ টিংলিশ: জানেন কি ‘night owl’ বা ‘early bird’ কাকে বলে? কিংবা তিনতলাকে কেন ‘second floor’ বলে?
উদার মনের মানুষ ছিলেন, গুণীজনের সমাদর করতেন বলে প্রাচ্যবিদ্যার বহু বিদেশীয় পণ্ডিত যেমন সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাশিয়া) সংস্কৃতের প্রধান অধ্যাপক ফিদর ইপ্লোলিতোভিচ শ্চেরবাটস্কোই (১৮৬৬-১৯৪২), পারি (ফ্রান্স) বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক সিলভ্যাঁ লেভি (১৮৬৩-১৯৩৫), ওসলো ক্রিশিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের (নরওয়ে) ভারতীয় ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক স্টেন কোনো(১৮৬৭-১৯৪৮), বন বিশ্ববিদ্যালয়ের (জার্মানি) সংস্কৃতের অধ্যাপক হারমান জর্জ য়াকোবি (১৮৫০-১৯৩৭), জার্মান পণ্ডিত ইউলিয়াস য়োলি (১৮৪৯-১৯৩২), কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইংল্যান্ড) সংস্কৃতের অধ্যাপক সিসিল বেন্ডেল(১৮৫৬-১৯০৯), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ভাষার ‘বোডেন অধ্যাপক’ আর্থার অ্যান্টনি ম্যাকডোনেল(১৮৫৪-১৯৩০) প্রমুখ সকলেই তাঁদের গবেষণার কাজে হরপ্রসাদের কাছে কত গভীর ঋণে ঋণী, বলা যায় আবিশ্ব মনীষী সমাজ তাঁর উপর কতটা নির্ভর করতেন, তাঁদের পাঠানো চিঠিপত্র তার প্রমাণ বহন করত।
সিলভাঁ লেভি।
ছোটবেলা দারিদ্র্যের মধ্যে কেটেছিল, তাই হিসেব করে চলতেন কিন্তু কৃপণ ছিলেন না। কত দরিদ্র ছাত্রের পড়াশোনা, কত দুঃস্থ আত্মীয়কে সাহায্য করে গিয়েছেন আজীবন বলে শেষ করা যাবে না। অনেক সম্পত্তি ও জমিজমার মালিক হতে পেরেছিলেন কারণ তাঁর স্ত্রী হেমন্তকুমারী ব্যক্তিত্বময়ী ও দাপুটে স্বভাবের ছিলেন। লোকজন খাটিয়ে বিরাট সংসার, জমিজমা সামলাতে পারতেন। শরীরে অপটু হলেও অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন। বাড়ির জমির সবজি রান্না হলে খুব খুশি হতেন শাস্ত্রী মশাই। নিমফুল ভাজা খেতে খুব ভালবাসতেন। বলতেন, সম্রাট অশোকও নিমফুল ভালোবাসতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় তাঁর পরিচারক ছিলেন কালীপদ দাস। তিনি বলেছিলেন, ‘….ঢাকায় তিনি একাই থাকতেন। …. ছাত্ররা তাঁর বাড়িতে প্রায়ই আসত। মুসলমান ছাত্ররাও খুব আসত। সকলকে তিনি আদর করে খাওয়াতেন। পড়াশোনার কথা আলোচনা করতেন। প্রফেসারদের মধ্যে সুশীল দে, রমেশ মজুমদার, শহীদুল্লাহ সাহেব— এঁদের তাঁর বাড়িতে আসতে দেখেছি। সত্যেন বসু, জ্ঞান ঘোষ এঁরা রাস্তায় শাস্ত্রী মহাশয়কে দেখলে শ্রদ্ধা করে কথা বলতেন। …. তিনি ছোট বড় সকলকে সমানভাবে দেখতেন। … তিনি হিন্দু মুসলমান কোনও ভেদ করেন নাই। ঢাকা ইউনিভার্সিটির মুসলিম হলের ছেলেদের তিনি নানা ভাবে সাহায্য করেছেন।ঢাকা হল ও জগন্নাথ হল, এই দুই হলের ছাত্রদেরও তিনি সাহায্য করেছেন।
আরও পড়ুন:
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৭: পিতৃ সত্য রক্ষা, নাকি পিতার অনুনয়ে রাজ্যভার গ্রহণ?
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৪: বাংলার শুঁটকি মাছের চাহিদা সর্বত্র, এখনকার বিশেষভাবে প্রস্তুত শুঁটকি অনেক বেশি নিরাপদ ও পুষ্টিগুণে ভরা
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৬: ভৃগুবংশে জন্ম নিলেন পরশুরাম— চরুবদলের ভুলে ক্ষত্রতেজ পেলেন তিনি
…প্রফেসার তো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অনেক ছিলেন, কিন্তু তাঁর মতো দয়ালু আর-কোনও প্রফেসার দেখি নাই।’ তাঁর উদার মনের আরও পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর একটি স্মরণীয় লেখা ‘মুসলমানগণের সংস্কৃত চর্চার ‘ (১২৯৫ বঙ্গাব্দ) মধ্য দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, মুসলমান রাজত্বে সংস্কৃতচর্চার সর্বনাশ হয়েছে, মুসলমানরা সমস্ত সংস্কৃত সাহিত্য শেষ করে দিয়েছে ‘একথা বাস্তবিক সত্য নহে’। দারাশিকোর কথা স্মরণ করিয়ে বলতেন, উপনিষদের মতো কঠিন গ্রন্থমালার আক্ষরিক অনুবাদ তিনি করেছিলেন, ফারসি অক্ষরে সংস্কৃত শব্দ লেখার মতো অসাধ্য সাধন করেছিলেন। তথ্যনিষ্ঠা ও যুক্তিবাদী মনের আলোয় সত্য চিনে নিতে পারতেন।
এমন সহৃদয়, হাসিখুশি, আন্তরিক মানুষটি স্ত্রী হেমন্তকুমারীর হঠাৎ মৃত্যুতে একদম বদলে গেলেন। হেমন্তকুমারী বেরিবেরি রোগে ভুগতেন, মৃত্যুর সময় হরপ্রসাদ কাছে থাকতে পারেন নি। সেই যন্ত্রণা, ক্ষোভ ক্রমে অপরাধবোধে পরিণত হয়েছিল। সেই ১৯০৮ সাল থেকেই প্রফুল্ল মেজাজের সদাহাস্য মানুষটি নিজের মধ্যে গুটিয়ে যান। একা থাকতেই ভালবাসতেন, নিজের কাজে ডুবে থাকতেন। নৈহাটির মূল বাড়িতে পরিবারের মধ্যে না থেকে কাছেই একটা ছোট বাড়িতে থাকতেন। সেই সময় তাঁর দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন পরিচারক রামলাল।
১৭ নভেম্বর ১৯৩১, নিত্যধন ভট্টাচার্য রোজের মত ডিকটেশন নিয়ে চলে যাওয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা পর রাতের খাওয়া শেষ করে শাস্ত্রী মহাশয় অসুস্থ বোধ করেন। পরিচারক রামলাল তাঁকে মেঝেতে মাদুর পেতে শুইয়ে বড় নাতি দেবতোষকে ডেকে নিয়ে আসতে আসতে তাঁর মৃত্যু হয়। নৈহাটিতে তাঁকে দাহ করা হয় তাই কলকাতায় খবর পৌঁছতে একদিন সময় লাগে। ১৯ নভেম্বর সব কাগজে হরপ্রসাদের প্রয়াণ ছিল অন্যতম প্রধান খবর। অমৃতবাজার পত্রিকা, বঙ্গবাণী, আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয় বেরোয়। সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার লিখেছিলেন, ‘শাস্ত্রী মহাশয় স্বভাবতই নীরবে অন্তরালে থাকিয়া কাজ করিতেন,…আত্মগৌরব প্রচারে তিনি একান্ত অনিচ্ছুক ছিলেন। …৭৮ বছর বয়সে জীবনের কর্ম্ম শেষ করিয়া ভীষ্মের ন্যায় তিনি বিশ্রাম গ্রহণ করিয়াছেন। আমরা বাঙ্গালা সাহিত্যের এই পিতামহের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বাঙ্গালী জাতির পক্ষ হইতে আমাদের শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদন করিতেছি।’—শেষ
এমন সহৃদয়, হাসিখুশি, আন্তরিক মানুষটি স্ত্রী হেমন্তকুমারীর হঠাৎ মৃত্যুতে একদম বদলে গেলেন। হেমন্তকুমারী বেরিবেরি রোগে ভুগতেন, মৃত্যুর সময় হরপ্রসাদ কাছে থাকতে পারেন নি। সেই যন্ত্রণা, ক্ষোভ ক্রমে অপরাধবোধে পরিণত হয়েছিল। সেই ১৯০৮ সাল থেকেই প্রফুল্ল মেজাজের সদাহাস্য মানুষটি নিজের মধ্যে গুটিয়ে যান। একা থাকতেই ভালবাসতেন, নিজের কাজে ডুবে থাকতেন। নৈহাটির মূল বাড়িতে পরিবারের মধ্যে না থেকে কাছেই একটা ছোট বাড়িতে থাকতেন। সেই সময় তাঁর দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন পরিচারক রামলাল।
১৭ নভেম্বর ১৯৩১, নিত্যধন ভট্টাচার্য রোজের মত ডিকটেশন নিয়ে চলে যাওয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা পর রাতের খাওয়া শেষ করে শাস্ত্রী মহাশয় অসুস্থ বোধ করেন। পরিচারক রামলাল তাঁকে মেঝেতে মাদুর পেতে শুইয়ে বড় নাতি দেবতোষকে ডেকে নিয়ে আসতে আসতে তাঁর মৃত্যু হয়। নৈহাটিতে তাঁকে দাহ করা হয় তাই কলকাতায় খবর পৌঁছতে একদিন সময় লাগে। ১৯ নভেম্বর সব কাগজে হরপ্রসাদের প্রয়াণ ছিল অন্যতম প্রধান খবর। অমৃতবাজার পত্রিকা, বঙ্গবাণী, আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয় বেরোয়। সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার লিখেছিলেন, ‘শাস্ত্রী মহাশয় স্বভাবতই নীরবে অন্তরালে থাকিয়া কাজ করিতেন,…আত্মগৌরব প্রচারে তিনি একান্ত অনিচ্ছুক ছিলেন। …৭৮ বছর বয়সে জীবনের কর্ম্ম শেষ করিয়া ভীষ্মের ন্যায় তিনি বিশ্রাম গ্রহণ করিয়াছেন। আমরা বাঙ্গালা সাহিত্যের এই পিতামহের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বাঙ্গালী জাতির পক্ষ হইতে আমাদের শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদন করিতেছি।’—শেষ
* বিশেষ নিবন্ধ (Special Article)- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (Hara Prasad Shastri) : ড. বিদিশা মিশ্র (Bidisha Misra), সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। বিদিশা বাঙালি নৈয়ায়িক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য্যের গ্রন্থ কাব্যবিলাসের উপর গবেষণা করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রদেশের পত্রিকায় তাঁর শোধপত্রগুলো প্রকাশিত হয়েছে।