সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


জনকনন্দিনী সীতা স্থির করে নিয়েছেন রামের সঙ্গে বনবাসে যাবেন তিনিও। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে রামের সম্মতিও পেয়েছেন। রাজ্যপ্রাসাদের সমস্ত সুখ, সম্পদ, বিলাসিতা ছেড়ে চলে যেতে হবে তাঁদের নির্বান্ধব, ভয়াল অরণ্যে। যাওয়ার আগে রামের নির্দেশে সাধু সজ্জন, আশ্রিত জন, ব্রাহ্মণদের সীতা দান করে দিলেন নিজের বহুমূল্য বসন, ভূষণ। বনবাসে যেতে হবে নিজের যা কিছু সম্পদ, সেসব ত্যাগ করে, দান করে, নিঃস্ব হয়ে। সীতার মনে এর জন্য খেদ নেই। দান শেষে হাসিমুখে, প্রসন্ন অন্তরে তিনি চললেন গুরুজনদের কাছ থেকে বিদায় নিতে।

কিন্তু প্রাণের অধিক প্রিয় ভাই লক্ষ্মণ কী করবেন? রাম ডেকে নিলেন তাঁকে। আদেশ দিলেন, তাঁরা যতদিন না ফিরে আসছেন, ততদিন দুই মা কৌশল্যা ও সুমিত্রার সযত্নে ভরণপোষণের দায়িত্ব লক্ষ্মণের। রামের মনে বড় শঙ্কা, তিনি চলে গেলে ঐশ্বর্যমদমত্তা কৈকেয়ীর অধীনস্থ রাজার অবজ্ঞার পাত্রী হয়ে অনাদরে অবহেলায় দিন কাটাতে বাধ্য হবেন তাঁরা। ভরতও রাজ্য পেয়ে বিমাতাদের ভুলে যাবেন।
লক্ষ্মণ অগ্রজের এ নির্দেশে তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি তো আশৈশব রামের সহচর, তাঁর শিষ্যসম। রামের থেকে দূরে জীবনের এত দীর্ঘ সময় কাটানো যে কল্পনার অতীত তাঁর কাছে। রাম-সীতার পায়ের কাছে বসে পড়লেন তিনি— “মা কৌশল্যার অধীনে কয়েক হাজার গ্রাম রয়েছে। তিনি নিজেদের ভরণ পোষণ যথেষ্টই করতে পারবেন। আর ভরত? তিনি রাজ্য পালন করলেও জানবেন যে, ভবিষ্যতে সে রাজ্য আপনার হবে। কাজেই, আপনার ভয়েই তিনি মা কৌশল্যা আর সুমিত্রার অমর্যাদা করবেন না। আমাকে আপনি ছেড়ে যাবেন না। আপনি ছাড়া এ রাজ্যপাট আমার সইবে না। বনবাসে আমি হব আপনার শিষ্য, আপনার ভৃত্য, আপনার সহায়। আপনাদের আগে আগে অস্ত্র-শস্ত্র, খন্তা-কোদাল, ফলমূলের পেটিকা নিয়ে চলব আমি। আপনাদের জন্য বনের ফল-মূল, গাছের ফুল,পাতা, যত প্রয়োজনের সামগ্রী কে জোগাড় করবে আমি ছাড়া? আপনি বনবাসে বৈদেহীর সঙ্গে আনন্দে সময় কাটাবেন। আমি থাকবো আপনার অতন্দ্র প্রহরী হয়ে। আমাকে আপনার সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দিন— ‘আর্য শিষ্যো’স্মি দাসো’স্মি ভক্তো’স্ম্যনুগতস্তথা।’ আর্য, আমি যে আপনার শিষ্য, আপনার অনুগত দাস। আপনি প্রসন্ন মনে আমাকে নিয়ে চলুন।”

“বেশ, তাহলে তুমিও চলো। লক্ষ্মণ, তুমি বরং প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসো।” আর দ্বিধা করলেন না রাম। সেই কোন শিশুকালে লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়েই তো তিনি যাত্রা করেছিলেন সিদ্ধাশ্রমের উদ্দেশ্যে। ঋষি বিশ্বামিত্রের তত্ত্বাবধানে সেসব দিন কেটেছিল তাঁদের। কখনো ভয়াল অরণ্য, কখনও নদীর তীর কিংবা ঋষিদের তপোবনে দিন কেটেছিল তাঁদের। লক্ষ্মণকে একদিনের জন্যও আলাদা করেননি তিনি। দুজনে আজও যেন অভিন্ন হৃদয়। তাঁকে সঙ্গে পেয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করেন রাম।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৫: বনবাসের সঙ্গী সীতা

ছোটদের যত্নে: আপনার সন্তান কি প্রায়ই কাঁদে? শিশুর কান্না থামানোর সহজ উপায় বলে দিচ্ছেন ডাক্তারবাবু

ডায়েট ফটাফট: না খেয়ে নয়, বরং খেয়েই কমান ওজন! কী কী খেলে মেদ ঝরবে? দেখুন ভিডিয়ো

কিন্তু লক্ষ্মণের অন্তঃপুরের কাহিনী যে কবির মুখে একবারও উচ্চারিত হল না। এমন দুঃখবিচ্ছেদের দিনেও বিদায়কালে স্ত্রী ঊর্মিলার এতটুকু কণ্ঠস্বর রাজপুরীতে কোথাও ধ্বনিত হল না। আশ্চর্য সংযমে কবি সমগ্র মহাকাব্য জুড়ে সে দুঃখিনী নারীর বিরহবেদনার অশ্রুজলকে নীরবতার আবরণে আবৃতই রেখেছেন।

অভিষেকের সাজো-সাজো রবে মুখরিত ছিল রাজপ্রাসাদ। এখন সেখানে বনবাস যাত্রার প্রস্তুতি। দীর্ঘ অরণ্যবাসে অপরিহার্য হল অস্ত্র-শস্ত্র। তার ব্যবস্থা হল রামের আদেশে। রাজা জনককে বরুণ যে দুটি মহাশক্তিধর দিব্যধনু দিয়েছিলেন, সেদুটির অবস্থান এখন অযোধ্যার রাজপ্রাসাদে। আচার্যের গৃহে সুরক্ষিত আছে জনকের কাছ থেকে পাওয়া অভেদ্য দুটি খড়্গও। আছে আরও দিব্যধনু, তুণীর, বর্ম। লক্ষ্মণ নিয়ে এলেন সেসব অস্ত্রসম্ভার। কিন্তু যাত্রার আগে আরও একটি কর্তব্য রয়েছে তাঁদের। তা হল নিজেদের ধনসম্পদ দান করে নিঃস্ব হওয়া। তবেই তাঁরা বনবাসের অধিকারী হয়ে উঠবেন। দুই ভাই এবার দানযজ্ঞে ব্রতী হলেন। তাঁদের সুহৃদ, ভক্ত, ভৃত্য, অল্পধন ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ, সজ্জন— কেউই বঞ্চিত হলেন না সে সম্পদের ভাগ থেকে।
আরও পড়ুন:

জিম-ট্রিম: আকর্ষণীয় ট্রাইসেপ চাই? রইল সহজ সমাধান

ইংলিশ টিংলিশ: I talk কিন্তু he talks কেন হয়? সঙ্গে আরও জেনে নাও be এবং have verb-এর সঠিক প্রয়োগ

বাইরে দূরে: প্যারিস, ইউট্রেকট, আমস্টারডাম হয়ে ব্রাসেলস—স্বপ্নের ভ্রমণ ডেসটিনেশন/১

রামের প্রিয়সখা ছিলেন বশিষ্ঠপুত্র সুযজ্ঞ। তাঁকে রাম দিলেন বহুমূল্য বস্ত্র ও অলঙ্কার, প্রচুর ধনধান্য, সহস্র ধেনু, শত্রুঞ্জয় নামক হাতি। সীতা তাঁর স্ত্রীকে দিলেন নানারকম রম্য বসন ভূষণ, পশমী চাদর বিছানো সোনার পালঙ্ক। অগস্ত্য, কৌশিক, গার্গ্য, শাণ্ডিল্য পেলেন নানাবিধ ধনরত্ন। রামের সখা চিত্ররথ নামে সারথি পেলেন নিজের অভিলষিত ধনসম্পদ। স্তুতিপাঠক, বিদূষক, বিভিন্ন ধরনের পরিচারক, অনুগত মল্লবীর, যোদ্ধাপুরুষদের জীবিকা নির্বাহের জন্য দেওয়া হল স্বর্ণমুদ্রা। কৌশল্যা ও সুমিত্রার সেবা-শুশ্রূষাকারী ভৃত্যরাও পেল দু’হাজার স্বর্ণমুদ্রা। কোনো অনুজীবী যেন তাঁদের অবর্তমানে অন্নকষ্টে না থাকে, এই মনোভাব নিয়ে তাঁরা দান করেছিল সব স্তরের মানুষদের মধ্যে। কিন্তু ধন লাভের আনন্দকে ছাপিয়ে গিয়েছিল ভৃত্যদের দুঃখ। ধন দান শেষে রাম শোকাকুল ভৃত্যদের সকলকে ডেকে যতদিন না তাঁরা ফিরে আসেন, ততদিন তাঁদের বাসগৃহ রক্ষণাবেক্ষণ দায়িত্ব দিয়ে গেলেন।

সব শেষে এলেন ত্রিজট নামক আঙ্গিরসগোত্রীয় এক ব্রাহ্মণ। অল্পবয়সী পত্নী আর অনেকগুলি পোষ্য নিয়ে তাঁর অভাবের সংসার। শীর্ণ দেহ ব্রাহ্মণের, গায়ে জড়ানো অতি জরাজীর্ণ একটি কাপড়ের খণ্ড। তাঁকে দেখে রামের মনে জেগে উঠল পরিহাসপ্রিয়তা। স্মিত হেসে বললেন, “আমার আর কিছু নেই তবে এক সহস্র ধেনু এখনও আছে। আপনি নিজে যতগুলি ধেনু রক্ষা করতে পারবেন, ততগুলি ধেনুই আপনার হবে।”
আরও পড়ুন:

খাই খাই: ভিন্ন স্বাদের চিকেন রেসিপি চান? ক্রিস্পি চিকেন বানাতে সময়ও লাগে কিন্তু খুব কম!

দশভুজা: অনন্যা— ‘অন্ধকারের উৎস হতে’

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৪: বনের পথে গল্প রাশি রাশি— যাত্রাপথ যত এগোয় তত অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে ওঠে পাণ্ডবদের

এ কথা শুনে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ শক্ত করে কোমরে কাপড়খানি বাঁধলেন, হাতের লাঠিটি নিয়ে তারপর ছুটতে শুরু করলেন গোরুদের পিছনে। সে দৃশ্য দেখে হেসে রাম থামিয়ে দিলেন বৃদ্ধকে। “থামুন, ব্রহ্মন, আমি একটু পরিহাস করেছি আপনার সঙ্গে। আপনাকে এই সমস্ত গাভী এদের পালক সহ দান করলাম।” সস্ত্রীক ত্রিজট রামের যশ গাইতে গাইতে ফিরে গেলেন। সাঙ্গ হল দানপর্ব।

এবার যাত্রার সূচনা হবে পিতা দশরথের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে। সীতাকে নিয়ে রাম লক্ষ্মণ নেমে এলেন রাজপথে। প্রজাদের দেখে রামের মুখে আজও স্মিতহাসির রেখা, কিছুতেই বুঝতে দেবেন না অন্তরের আলোড়ন। কিন্তু এ তো রাজপথ নয়, যেন জনসমুদ্র। বড় কষ্ট আজ জনপদবাসীর। তাঁরা অভিষেকের আনন্দ উদ্‌যাপনে মেতে উঠেছিলেন রাজপথ জুড়ে। আজ রাজপুত্রকে বিদায় দিতে হবে চোখের জলে। প্রজাদের শোকে বিলাপে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। জলাশয়ের জল শুকিয়ে গেলে জলচর প্রাণিদের যেমন কষ্ট, রাজপথ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রজাদের বুকেও সেই কষ্ট ঘনিয়ে উঠল। তাদের মাঝখান দিয়েই পথ করে নিয়ে তিনজন এসে পৌঁছলেন পিতার প্রাসাদে।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content