শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


সেদিন বিকেলে চাঁদপুর শহরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখব বলে একটা রিকশ ভাড়া করলাম৷ এবার সঙ্গী সঞ্জয় বর্মন বলল, ‘আগে চলুন নদীর দিকটা ঘুরে আসি৷’ মেঘনার সঙ্গে ডাকাতিয়া নদীর জল মিলেমিশে একাকার৷ নদীতীরে বসার সুন্দর ব্যবস্থা৷ গরমে নদীর মিষ্টি বাতাসে প্রাণ জুড়ায়৷ মেঘনার জলে সূর্যাস্ত মনে রাখার মতো৷

নদীর ধারে ভিড় মন্দ নয়৷ কেউ কেউ নৌকা ভাড়া করে নদীভ্রমণের সাময়িক সুখ উপভোগ করছে৷ বিকাশ শিকদারের সঙ্গে পরিচয়৷ চাঁদপুরের রূপালি ব্যাঙ্কে প্রথম পোস্টিং৷ উপজেলা নাজিরপুরের ঘুষকাঠি গ্রামে বাড়ি৷ গ্রামের তিনদিকে নদী—কালীগঙ্গা, বলুয়া ও খরস্রোতা সন্ধ্যা৷ বিকাশ বললেন, ‘ছোট্টবেলা থেইকা নদীর বেষ্টনীতে বড় হইছি৷ তাই এই জায়গাখানা ভালোই লাগতাছে৷’

বিকাশের দিদি দীপালির বছর পাঁচেক আগে বিয়ে হয়েছে৷ ভগ্ণিপতি ব্যাবসা করেন৷ বিকাশের কাছে শুনলাম, ঘটকের মাধ্যমেই গ্রামে-গঞ্জে হিন্দু ছেলে-মেয়েদের বিয়ে হয়৷ দুই বন্ধু হাবিব ও সাকেতের সঙ্গে বসে গল্প করছিলেন বিকাশ৷ কলকাতায় যাওয়ার খুব ইচ্ছা ওঁর৷ বাবার মুখে কলকাতার গল্প শুনেছেন৷

বিকাশের বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকের মতো গ্রাম ছেড়ে সপরিবারে কলকাতার এক শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন৷ গ্রামের বহু বাড়ি রাজাকাররা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছিল৷ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি আবার গ্রামে ফিরে আসেন৷ তবে তাঁর জমিজমা বেদখল হয়নি৷ দু’ফসলি আট-দশ বিঘা জমি৷

চাঁদপুর পৌরসভায় ৪৫ হাজার হিন্দু ভোটার৷ তাঁদের ছেলে-মেয়েদের ধরলে প্রায় ৬০ হাজার হিন্দুর বসবাস৷ এখানকার মহিলারা নির্ভয়ে অফিস-কাছারি করেন, স্কুল -কলেজে পড়াশুনো করেন৷ চাঁদপুরে মিজানুর চৌধুরি সড়কের উলটোদিকে বড় কালীমন্দির৷ এখানেই অ্যাডভোকেট নরেশ মজুমদার, রতন চন্দ্র দাস প্রমুখের সঙ্গে কথাবার্তা হল৷ কালীমন্দিরের বারান্দায় জনা পঞ্চাশেক মহিলা বসে রয়েছেন৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই মায়ের সন্ধ্যারতি শুরু হবে৷

নরেশবাবু বললেন, ‘চাঁদপুরের হিন্দুরা বুক ফুলাইয়া থাকে৷ আপনাগো কলকাতা থেইকা এই জায়গার হিন্দুরা বেশি প্রতাপশালী৷ পুরানো বাজারে ঘোষপাড়া, দাসপাড়া, হরিসভা মন্দির, লোকনাথ মন্দির, রামঠাকুরের মন্দির সব ঘুইরা দেখলেই জানতে পারবেন৷’

মন্দিরের সম্পাদক সুভাষচন্দ্র রায়, তপন ভঞ্জ, দিলীপকুমার কর এঁদের সঙ্গেও কথাবার্তা হল৷ দিলীপবাবু মুক্তিযোদ্ধা৷ ট্রেনিং নিয়েছিলেন আগরতলায়৷ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন ১৯৯৫ সালে৷ বললেন, ‘চাঁদপুরের পরিবেশ ভালো৷ এখানে মৌলবাদী কম৷ তবে জমি-জমা লইয়াই গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে গণ্ডগোল বানধে৷ এই চাঁদপুর তো একদা হিন্দু এলাকাই ছিল৷’

পুরানো বাজারে দুশো-আড়াইশো হিন্দু ব্যবসায়ী৷ কারও চাল-ডালের ব্যাবসা, কারও গুড়ের ব্যাবসা, কারও মুদি দোকান৷ আবার কারও চাল ও তেলের মিলও আছে৷ রতনবাবুর কথা অনুযায়ী চাঁদপুরে দুর্গাপুজো ও সরস্বতীপুজোর বিসর্জনের শোভাযাত্রা নাকি দেখার মতো৷

বড় কালীমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা ১২৮৫-তে৷ পুনর্নির্মাণ ১৪০০ বাংলা৷ পয়লা বৈশাখে চাঁদপুর বড় রেল স্টেশনে তিনদিন ধরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়৷
মায়ের সন্ধ্যারতি মহিলাদের উচ্চ উলুধ্বনির মধ্য দিয়ে শেষ হল৷ এরপর মন্দির প্রাঙ্গণে শনিপুজোর প্রসাদ সকলকে হাসিমুখে বিতরণ করলেন দুই গৃহবধূ প্রিয়াংকা ঘোষ এবং বিভা বর্ধন৷ দু’জনেই বললেন যে, কয়েকদিনের মধ্যেই এখানে শ্মশানকালীর পুজো হবে৷ দু-তিন হাজার মানুষ ঢাকঢোল বাজিয়ে শোভাযাত্রা করে শ্মশানে যায়৷ শ্মশানকালীর পুজো করে ‘হরিবোলা সমিতি৷’ দেখলে আপনার ভালা লাগত৷ বললাম, ‘ইচ্ছা থাকলেও সে উপায় আমার নেই৷ কারণ, ভিসার মেয়াদ ফুরোবার আগে আরও কয়েক জায়গায় যেতে হবে৷’

বিকেল থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা৷ কালীমন্দির থেকে যখন বেরলাম ঘন ঘন মেঘের গর্জন৷ টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হল৷ একটা রিকশ নিয়ে নতুন বাজারে শ্রীশ্রীগোপাল জিউর আখড়ায় পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি৷ পথে ঢাকা ঔষধালয়ের বিরাট দোকান৷ প্রতিষ্ঠাতা এক কৃতী বাঙালি অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষ৷ আখড়ার মন্দিরটি বড়ই সুন্দর৷ গর্ভগৃহে মনোহরণকারী শ্রীশ্রীগোপাল জিউর বিগ্রহ৷ রাধা-কৃষ্ণের মূর্তিদুটিও অতীব সুন্দর৷ এই মন্দির প্রায় সোয়াশো বছর আগে নির্মাণ করা হয়৷

মন্দিরের প্রেসিডেন্ট দুলাল কর্মকার বললেন, ‘পয়লা বৈশাখে গণেশপূজা এই আখড়ার অন্যতম বড় উৎসব৷ শীতলাপূজা, রথযাত্রা, বাৎসরিক নারায়ণ পূজা, জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা, দুর্গাপূজা কোনও না কোনও উৎসব মন্দিরে লাইগাই আছে৷’

চাঁদপুর শহরে দুর্গাপুজোর সংখ্যা গোটা পনেরো৷ প্রতিমা নিরঞ্জন ডাকাতিয়া নদীতে৷ আর সরস্বতীপুজোয় ব্যান্ডপার্টি বাজিয়ে যখন প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রা বেরয়, তখন নাকি সারা শহরের কাজকর্ম একরকম বন্ধ হয়ে যায়৷

শুনলাম, এই মন্দিরে দোল উপলক্ষে টানা পাঁচদিন উৎসব৷ সবথেকে বড় উৎসব এটাই৷ ৪ লক্ষ টাকা বাজেট৷ চাঁদপুরের হিন্দুরা হাত খুলে চাঁদা দেন৷ প্রতিদিন দেড়শো কেজি অন্নভোগ ভক্তদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়৷

দুর্গাপুজোর বাজেট দেড় লক্ষ টাকা৷ সরস্বতী পুজোর বাজেট ৩০ হাজার টাকা৷ প্রতিদিন ভোর ৬টায় গোপাল জিউর আখড়া খোলে৷ দুপুর ২টো থেকে ৪টা মন্দির বন্ধ৷ তারপর রাত ৯টায় আবার মন্দির বন্ধ হয়৷ সকাল-সন্ধ্যায় আরতি ও কীর্তন প্রতিদিন৷

রমজান মাসে আরতির সময় একটু অদলবদল করা হয়, নামাজের পর আরতি৷
দুলালবাবুর দাদা অরবিন্দ কর্মকার বললেন, ‘চাঁদপুরে রথযাত্রার আলাদা গুরুত্ব৷ সারা শহরে রথ লইয়া পরিক্রমা হয়৷ উলটা রথেও খুব আনন্দ হয়৷ তবে একটা কথা কমু, শহরে কিছু বুঝবেন না, গ্রামের অবস্থা সত্যই খারাপ৷ চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, বগুড়া, নোয়াখালি প্রভৃতি জায়গায় গাঁয়ের হিন্দুরা একতরফা মার খাইছে৷ আইজকার ‘জনকণ্ঠ’ কাগজখান পইড়া দেখেন, ৩০০ বছরের পুরানা হিন্দু মন্দির ভাইঙা দেওয়া হইছে৷ গ্রামে একলগে পনেরো-বিশ ঘর হিন্দু থাকলে তবুও তাদের মনে সামান্য হইলেও সাহসখান থাকে৷’
আরও পড়ুন:

বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে, পর্ব-৪১: কালীবাড়ি হলেও এখানে কোনও কালীমূর্তি পুজো করা হয় না

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৫: বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র— বইয়ের জন্য ভালোবাসা

বিপর্যস্ত শিয়ালদহ শাখার রেল পরিষেবা, দুই ট্রেনের ধাক্কার জেরে বাতিল ১৮টি লোকাল, সবই ট্রেনই চলছে দেরিতে

অঝোর বৃষ্টি৷ থামার কোনো লক্ষণ নেই৷ আখড়ার অফিসে কথাবার্তা হল নিরঞ্জন পাল, বাপী পাল, মনোরঞ্জন ঘোষ এঁদের সঙ্গে৷ ওঁরা বললেন, ‘গাঁ-গঞ্জে অ-সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি নেহাত কথার কথা৷ হিন্দুদের মইধ্যে ইউনিটি(unity) আরও বাড়াইতে হইব৷ গভর্নমেন্টের বিচার বইলা কিছু নাই৷ কিল খাইয়া আমাগো কিল হজম করতে হইতাছে৷ বাংলাদেশের হিন্দুদের কোত্থাও স্থান নাই৷ আমরা আছি সবচাইতে বিপদে৷ একটা গণ্ডগোল লাগুক, তখন বোঝা যায় কী অবস্থা এই দ্যাশটার!’

নিরঞ্জনবাবুর বয়স যখন ১৯ বছর, তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন৷ এখন তাঁর ৬১ বছর৷ মুক্তিযোদ্ধাদের সরকার থেকে মাসে মাসে পেনশন দেওয়া হয়৷ নিরঞ্জনবাবু ৩০০০ টাকা পেনশন পান৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় চিটাগাং ডিভিসন ছিল দু-নম্বর সেক্টর৷ ক্যাপ্ঢেন মাহবুব ছিলেন এই সেক্টরের প্রধান৷ বড় যোদ্ধা৷ নিরঞ্জনবাবু ছিলেন সাউথ ডিভিসনে৷ এর প্রধান ছিলেন সইফুল রহমান রতন৷ বর্তমানে তিনি এক গারমেন্টস কোম্পানির মালিক৷ ঢাকায় থাকেন৷

নিরঞ্জনবাবুকে লামডিং-এ গিয়ে রাইফেল ট্রেনিং ও গেরিলা ট্রেনিং নিতে হয়েছিল৷ অনেক মহিলা মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন৷ একেকটা গ্রুপে ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধা৷ নিরঞ্জনবাবু বললেন, ‘আজও সেই দিনগুলি আমার চক্ষে ভাসে৷ স্বপন সাহা আমাদের ক্যাম্পেই থাকত৷ চিটাগাং কলেজে পড়ত৷ বিধবা মায়ের একমাত্র পোলা৷ গ্রেনেড ট্রেনিং লইতে গিয়া মারা পড়ল৷ সেই সময় ইন্ডিয়া যেভাবে সাহায্য দিছিল, এ দ্যাশ এখন সব ভুইলা গ্যাছে৷ আমাগো লজ্জাও হয় না!’

নিরঞ্জন পালের মুখে মুক্তিযুুদ্ধের রোমহর্ষক গল্প শুনেছিলাম৷ ত্রিপুরার কাঠালিয়া ক্যাম্প থেকে পৌনে দুশো মুক্তিযোদ্ধার যে দলটি রাতের অন্ধকারে চুপিসাড়ে ঢুকে পড়েছিল তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে, সেই দলে নিরঞ্জনবাবুও ছিলেন৷ মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে চললেন ‘মতলব’ নামে এক জায়গার উদ্দেশে৷ না, পথে কোনও বাধা পাননি তাঁরা৷ ভোর হওয়ার আগেই মতলবে পৌঁছে গেল দলটি৷

মতলবের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ধনাগোদা নদী৷ মূল সড়কপথের ওপর সেতুটি ভেঙে দিলেন ওই মুক্তিযোদ্ধারা৷ যেভাবেই হোক পাক সেনাদের অগ্রগতি আটকাতে হবে৷ তাঁদের এই পরিকল্পনা কাজে দিল৷ পাকিস্তানি সেনারা মতলবে ঢুকতে বাধা পেল৷ ভোরের আলো ফুটল৷ বাধা পেয়ে পাক সেনারা গোলাগুলি ছুড়তে শুরু করে৷ প্রত্যুত্তর দিলেন মুক্তিযোদ্ধারা৷ তুমুল লড়াই! শেষপর্যন্ত সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করল৷ দু’পক্ষেরই বেশ কয়েকজন মারা গিয়েছিল, আহতও অনেকে৷

নিরঞ্জনবাবু বললেন, ‘দিনের পর দিন যুদ্ধ করছি৷ শুধু কি খান সেনারা? রাজাকাররাও সর্বত্র ত্রাস সৃষ্টি কইরা রাখছিল৷ কত মাইয়ারে ধইরা লইয়া গিয়া খান সেনাদের ভেট দিছে তারা, তার কি কোনও লিখাজোখা আছে? কত নারী, শিশু, বুড়া-বুড়ি অত্যাচার আর অসম্মানের হাত হইতে বাঁচনের লাইগা সমতল হইতে পাহাড়ে পলাইয়া গ্যাছে! সেইসব কথা ভাবতে বইলে কান্নায় বুকটা ফাইটা যায়৷ অথচ এই মুক্তিযুদ্ধের নাম কইরা পরে কোটি কোটি টাকা ইনকাম(income) করছে মেলা মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশে৷ কন এইসবের কী মানে হয়?’
নিরঞ্জন পালের প্রশ্ণের কোনও জবাব আমার কাছে ছিল না৷
আরও পড়ুন:

যোগা-প্রাণায়াম: মুখে বলিরেখা পড়ছে? জেনে নিন সহজ সমাধান

টলি-পরিচালকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ করে ফ্ল্যাটে আটকে রাখার অভিযোগ, জানালেন আরও এক তরুণী

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৩: আশা-যাওয়ার পথের ধারে ‘নবীন যাত্রা’ [১১/০৯/১৯৫৩]

আর এক মুক্তিযোদ্ধা জীবনকানাই চক্রবর্তীর সঙ্গে আশ্রমে উৎপল মহারাজ পরিচয় করিয়ে দেন৷ ভদ্রলোকের ৭৭ বছর বয়স৷ আজও চলাফেরা ও কথাবার্তা এক যুবকের মতোই৷ প্রচণ্ড বৃষ্টি মাথায় করে প্রায় ভিজতে ভিজতে রাত সাড়ে নটায় আশ্রমে এলেন জীবনবাবু৷ উৎপল মহারাজ আমাকে আগেই বলেছিলেন, জীবনবাবুকে চাঁদপুর জেলার মানুষ একডাকে চেনে৷

জীবনবাবু একসময় সরকারি ‘ছোট সুন্দর আমজাদ আলি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়’-এ মাধ্যমিক স্তরে ইংরেজি ও বাংলা পড়াতেন৷ ১৯৬৪ সালে মতলব-এ তাঁর শিক্ষকতা শুরু৷ এতটাই সৎ ও নির্লোভ তিনি, মুক্তিযোদ্ধার কোনো সরকারি শংসাপত্র নেননি৷ তাহলে বংশপরম্পরায় পায়ের ওপর পা তুলে সরকারি পেনশন পাওয়া যেত৷

জীবনবাবুর সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লেগেছিল৷ বললেন ‘দেশের জন্য যুদ্ধ করছি তাতেই আমার বড় আনন্দ৷ শংসাপত্রের কী প্রয়োজন?’

তিনি সেদিন আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন৷ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যারা চায় না সেইসব সমাজবিরোধী মানুষের হাতে হিন্দু মহিলারাই যে ধর্ষিতা হন এমন নয়, মুসলমান মহিলারাও ধর্ষিতা হন৷ জীবনবাবুর মতে, আওয়ামি লিগের অনেক ভুলভ্রান্তি আছে৷ কিন্তু আজ বাংলাদেশের যেটুকু উন্নতি হয়েছে, সবটুকুই শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায়৷

জীবনবাবুর কাছেও মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনলাম৷ বললেন, ‘শুধু আমি নয়, আমার দুই সহ-মুক্তিযোদ্ধা যথাক্রমে মনির আহমেদ মনির এবং দুলাল চন্দ্র পোদ্দার মুক্তিযোদ্ধার কোনো শংসাপত্র লন নাই৷ দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে সাব-সেক্টর মধুমতী৷ ক্যাপ্ঢেন জহিরুল হক পাঠান তখন পাক আর্মির সুবেদার ছিলেন৷ তিনি উপরওয়ালার নির্দেশ মানতে রাজি হন নাই৷ পাকিস্তানি আর্মির আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন৷ তাঁরে শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হইল৷ এরপরই বিবেকের তাড়নায় জহিরুল হক মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখান৷ সাব-সেক্টর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হইছিল তাঁরে৷ এই কমাণ্ডারের অধীনে তিন-চারশো মুক্তিযোদ্ধা৷ তাঁদের অধিকাংশই পুলিশ, ই পি আর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)-এর লোকজন৷ স্টুডেন্টরাও ট্রেনিং লইতেছিল৷ আমাদের লিডার ছিলেন আবদুল রব মিঞা৷ হাজিগঞ্জে বাড়ি তাঁর৷ আরও একজন লিডার ছিলেন আবদুল করিম৷

প্রায় দিনই খান সেনাদের লগে লড়াই হইতাছিল৷ সে ভয়ানক লড়াই! ১৯৭১-এর ৮ ডিসেম্বর জাঠ রেজিমেন্টের অধীন ৯টা ট্যাঙ্কের বহর আর পদাতিক বাহিনী ৬০০/৭০০ জন মার্চ কইরা ঢুকল চাঁদপুরে৷ প্রথম ট্যাঙ্কেই আমি ছিলাম৷ আমার পরনে লুঙ্গি, হাফশার্ট৷ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে৷ অবশ্য তার আগেই মুক্তিবাহিনীর সৈনিকরা পুরান বাজারে ঢুইকা পড়ছিল৷’
আরও পড়ুন:

দার্জিলিংয়ে নতুন অ্যাডভেঞ্চার! টয় ট্রেন চলবে রাতেও, কবে থেকে?

হোয়াটসঅ্যাপ স্টেটাসে ফের নতুন চমক! ব্যবহারকারীদের জন্য আসছে আকর্ষণীয় ফিচার

আদানি গোষ্ঠীর হাতে এনডিটিভি-র রাশ! পরিচালন গোষ্ঠী থেকে ইস্তফা প্রণয় রায়ের, স্ত্রী রাধিকাও ছাড়লেন ডিরেক্টর পদ

ততদিনে ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঢুকে পড়েছে৷ স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের নেতৃবৃন্দ৷ বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান তখন পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে বন্দি৷ যশোর, বগুড়া, কুষ্ঠিয়া, রংপুর, পাবনা দিয়ে ঢুকেছে ভারতীয় মিলিটারি ট্রাকের কনভয়৷ একে একে ছিনিয়ে নিয়েছে পাকিস্তান সেনাদের দখল করে রাখা অঞ্চলগুলো৷ ওদিকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণেও পর্যদুস্ত পাক-সেনা৷ ভারতীয় সেনার আরেকটা দল চলে গেল ঢাকায়, মেঘনার শাখানদ ভৈরব দিয়ে৷

জীবনবাবু বললেন, ‘বাংলাদেশের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিছিলেন৷ কিন্তু মানুষটাই পরে পালটাইয়া গেলেন৷ এইটাই বোধহয় জগতের নিয়ম৷’

জিজ্ঞাসা করলাম—আওয়ামি লিগ কি সবসময়ই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলে?
জীবনবাবু কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন৷ তাঁর বক্তব্য এরকম— ইলেকশনকে কেন্দ্র করে, জমি-জায়গাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে হরবখত কিছু না কিছু গণ্ডগোল লেগেই আছে৷ সাধারণত আওয়ামি লিগকে ভোট দেয় হিন্দুরা৷ আওয়ামি লিগ তবুও কিছুটা ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে চলে৷ তবে এই দলের কোনো কোনো নেতার মনোভাব হল, হিন্দুরা থাকলে ভোট পাব, গেলে জমি পাব৷ হিন্দুদের জমি-জায়গা দখলের ব্যাপারে আসলে নাকি আওয়ামি লিগ, বি এন পি, এমনকী জামাত-ই-ইসলামের স্থানীয় নেতাদের মনোভাবে বিশেষ ফারাক নেই৷ এসব ব্যাপারে তলে তলে একজোট হতে তাদের বেশিক্ষণ সময়ও লাগে না৷

জীবনবাবু দুঃখ করে বললেন, ‘হিন্দুরা মার খায়, মার দিতে পারে না৷ রুইখা দাঁড়াইতে পারে না বইলা ভিটা-মাটি থুইয়া ভারতে পলাইয়া যায়৷ আপনাগো দেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়৷ আমাগো এইখানে প্রতি আক্রমণের সুযোগ নাই হিন্দুদের! ২০০১ সালে ইলেকশনের পর খুলনা, বৃহত্তর বরিশালে হিন্দুদের উপর কী অত্যাচারটাই না হইছিল! তখন খালেদা জিয়ার বি এন পি ক্ষমতায় আসে৷

তাইরপর নব্বই দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার৷ আবার ইলেকশনের পর ২০০৮-এ সেখ হাসিনা ক্ষমতায় আইলেন৷ সামাজিক অবস্থা সামান্য হইলেও পালটাইল৷ শেখ হাসিনা আবার প্রধানমন্ত্রী হইছেন৷
ধর্মনিরপেক্ষতা অবলম্বনের চেষ্টা চালাইতেছেন৷ প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মহম্মদ হুসেইন এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বইলা ঘোষণা করেন৷ শুক্রবার ছুটির দিন ঘোষিত হয়৷ তবে আমার মনে হয়, বাংলাদেশ কক্ষনোই আর ধর্মের গোঁড়ামিতে যাইব না৷ আর জামাতপন্থীরা এককভাবে দাঁড়াইলে সারা দ্যাশে দুইটার বেশি সিট পাইব না৷’

জীবনবাবু আরেকটা দামি কথা বললেন৷ একসময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী ছিল বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশ৷ ভারত যে আমাদের শত্রুদেশ নয়, বরং মিত্রতার হাত বাড়িয়ে রেখেছে সবসময়, এখন যাঁরা বাংলাদেশ আর্মিতে আছেন, তাঁদের এই সহজ সত্যটা বোঝানো হয় না৷
জীবনবাবু এ কথাও বললেন যে, এখনকার প্রশাসনেও জামাতের লোকজন বহাল তবিয়তেই আছে৷
কোনোভাবেই তাদের সরানো যাচ্ছে না৷ ‘ওরা ছেলেদের হাতে বোমা তুইলা দেয়৷ সঙ্গে জন প্রতি পাঁচশোটা কইরা টাকা৷ অর্থের লোভ এড়াইতে পারে না অনেকেই৷ জীবনবাবুর মুখে শুনলাম, বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রচুর দুর্গাপুজো হয়৷ তবে রাঙামাটি ও বান্দারবনে কম পুজো৷
কেন?

কারণ, এগুলো পার্বত্য অঞ্চল৷ বান্দারবনের পূর্বদিকে লাফ নদী পেরলেই মায়ানমার অর্থাৎ ব্রহ্মদেশ৷ আবার রাঙামাটির পিছনেই ত্রিপুরা৷ পাকিস্তানের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের সময় রাঙামাটিতে কাপ্তাইল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হয় কর্ণফুলি নদীর উজানে৷ ত্রিপুরার লুসাই পাহাড় এই নদীর উৎস৷
উৎপল মহারাজের মুখে এই আশ্রমের সমাজসেবামূলক নানা কাজকর্মের কথা অনেক রাত অবধি শুনেছিলাম৷ উৎপল মহারাজের একান্ত ইচ্ছা এই প্রাইভেট আশ্রম বেলুড় মঠের স্বীকৃতিলাভ করুক৷

Skip to content