শুরু হল মৃন্ময়ী মাতৃপ্রতিমার সৃজন।
।।দেবীবরণ।।
রথের দিন গরানকাঠ পুজো করে প্রতিমার কাঠামো বাঁধা শুরু হল। জন্মাষ্টমীর দিন বসানো হল মা-দুর্গার মস্তক। বসুন্ধরার মায়ের নাম কমলা। যিনি বসুন্ধরার ছোট ভাইয়ের প্রসবের সময় মারা যান। বসুন্ধরার বয়েস তখন ১০। বসুন্ধরা মামার বাড়ি ছিল দাশগুপ্ত। ঢাকার নারায়ণগঞ্জের বর্ধিষ্ণু পরিবার। তাঁরাও বংশপরম্পরায় শিক্ষক। নারায়ণগঞ্জের দাশগুপ্ত বাড়িতে নিষ্ঠাভরে দুর্গাপুজো হতো। ছোটবেলার সে পুজোর স্মৃতি এখনও মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করে।
মা মারা যাবার পরও পুজোর সময়টা মুকুন্দ সেনগুপ্ত ছেলেমেয়েদের ঢাকার নারায়ণগঞ্জের দাশগুপ্ত বাড়িতে রেখে আসতেন। তবে স্ত্রীর মৃত্যুর পর মুকুন্দ সেনগুপ্ত আর শ্বশুরবাড়ির দুর্গাপুজোয় অংশ নিতেন না। দুর্গাপুজোর কটা দিন বাড়িতে একা থাকতেন মুকুন্দ সেনগুপ্ত। স্ত্রী কমলার ঠাকুরঘরে সারাটা দিন পুজোপাঠ করতেন। দিনে একবারই সামান্য ফলমূল খেতেন। লক্ষ্মী পুজোর পর গিয়ে আবার ছেলেমেয়েদের নারায়ণগঞ্জ থেকে ফরিদপুরের কোটালিপাড়ার বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসতেন। তাই নিজের বাড়িতে প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজনে বসুন্ধরা ঠাকুরমশাই-এর সঙ্গে আলোচনা করে ঢাকার মামারবাড়ির পুজোর সব নিয়মকানুন অনুসরণ করলেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে।
বিনয়কান্তি মায়ের দুর্গা পুজো করার ইচ্ছের কথা জানত না তাই বাড়ি তৈরির সময় উঠোনের কোণে এখনকার ঠাকুরদালান তখন ছিল না। প্রথম বছর পুজোর সময় ঠাকুরঘরে পঞ্চঘট স্থাপনা হয়েছিল। লম্বা উঠোনের খানিকটা অংশ ম্যারাপ করে তার মধ্যে প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়েছিল। পরের বছর বসুন্ধরা ভিলায় ঝাড়বাতি লাগানো ঠাকুর দালান তৈরি হল। ঠাকুরদালানের খিলানের পরেও সামনে বেশ খানিকটা চাতালের পর উঠোনে নামার সিঁড়ি। পাশে একটি মাঝারি মাপের বেলগাছকে ঘিরে বেদী করা।
কিন্তু প্রথম পুজোর রীতি মেনে তারপর থেকে প্রতিপদে পঞ্চঘট ঠাকুরঘরেই বসানো হতো। ষষ্ঠী নয় ঢাকা নারায়ণগঞ্জের দাশগুপ্ত বাড়ির রীতি মেনে, বসুন্ধরা ভিলাতেও পঞ্চমীতে বোধন। দেবী বোধনের আগে বাড়ির পুরুষেরা নতুন ধুতি-গেঞ্জি পরে মাথায় নতুন গামছা বেঁধে পঞ্চঘট ঠাকুরঘর থেকে ঠাকুরদালানের পাশে বেলতলার বেদীতে গিয়ে রাখত। পুরাণ অনুযায়ী কৈলাস থেকে দেবী দুর্গা এসে এই বেলতলায় বিশ্রাম করেন। তাই পঞ্চমী এবং ষষ্ঠীর সন্ধিক্ষণে, বাড়ির বউরা অলংকৃত হয়ে মাকে আবাহন করতে আসে। বেলতলা থেকে আবার পুরুষরা মাথায় করে পঞ্চঘট নিয়ে যায় ঠাকুরদালানে প্রায় সম্পূর্ণ দেবী প্রতিমার সামনে। সধবারা শঙ্খ ও উলুধ্বনি দিয়ে বেলতলা থেকে ঠাকুরদালানে পৌঁছলে, ঢাক বেজে ওঠে। কাঁসরঘন্টা উলুধ্বনি শঙ্খধ্বনির মধ্যে ধূপধুনোর ধোঁয়ায় ঠাকুরদালানে বড় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো হয়। ঠাকুর ঘরে জাগ-প্রদীপ জ্বলে প্রতিপদ থেকে আর ঠাকুর দালানে বোধন থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত। শান্তির জল দেবার পর সেই দুই প্রদীপ নেভানো হতো। পাঁচদিন বাদে লক্ষ্মীপুজো হতো ঠাকুরঘরে।
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব-৪৪: বসুন্ধরা এবং…
পানে হোক বা রান্নায়, মশলার রাজা এলাচের এই সব গুণাগুণ জানতেন?
হোমিওপ্যাথি: অর্শে কষ্ট পাচ্ছেন? রেহাই পেতে জেনে নিন কী করবেন, কী করবেন না
বসুন্ধরা ভিলায় বড় বড় মাটির জালায় গঙ্গার জল আনা হয়। ছেলেরা নয়, সেই গঙ্গার জলে বাড়ির চৌহুদ্দির মধ্যে নবপত্রিকা স্নান করায় বাড়ির মেয়েরা। একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপরাজিতা হলুদ অশোক ধান ইত্যাদি অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেলসহ বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হতো। তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে কাঠের আসনে দাঁড় করিয়ে শুরু হতো সপ্তমী পুজো। প্রতিপদের প্রথমদিন থেকেই বসুন্ধরা ভিলায় পুজো শুরু। সেইদিন থেকে বাড়িতে নিরামিষ।নবমীর দিন হোমের পরে বাড়িতে মাছ খাওয়া হয়। বাড়ির ছেলে এবং ভাগ্নেরা মায়ের ভোগ রান্নার যোগাড় ও তদারক করে থাকে। ভাত, খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, মাছ, পায়েস, মিষ্টি, চাটনি সমস্ত কিছুই মায়ের সামনে ভোগে দেওয়া হয়। বিশেষ করে সপ্তমীর দিন লাউ ঘন্ট, অষ্টমীর দিন শাকের ঘন্ট, নবমীর দিন হোমের পর আমিষ রান্নায় ভেটকি ঘন্ট, চিংড়ি মাছের মালাইকারি নিবেদন করা হয়।
যোগা-প্রাণায়াম: কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন? প্রাণায়ামে হবে শ্বাসকষ্টের উপশম, জেনে নিন কীভাবে করবেন
খাবার থেকে পোড়া গন্ধ বেরচ্ছে? চিন্তা না করে সহজেই সমস্যার সমাধান করুন এই সব উপায়ে
অন্দরসজ্জার ভোল পাল্টাতে গাছ লাগান, ভবে এই বিষয়গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখুন
দশমীতে বরণের সময় বাড়ির সধবা বৌরা মাছভাত খেয়ে মুখে পান দিয়ে লালপাড় সাদাশাড়ি শাঁখা সিঁদুর পরে মাকে বরণ করেন। বরণের সময় প্রত্যেকের মুখে পান থাকা আবশ্যক এবং মাছ না খেয়ে কোনওভাবে ঠাকুর বরণ করা যায় না। দাশগুপ্ত বাড়ির অনুসরণেই বিসর্জনে রওনা দেবার আগে বসুন্ধরা, স্বর্ণময়ীকে তার মাথার চুল প্রতিমার পায়ে বেঁধে দিতে বলেছিলেন। মামারবাড়িতে বিশ্বাস করা হতো আগামী বছরও যাতে দেবী মা এই গৃহে আসেন সেই জন্য তাঁকে এই ভাবে গৃহকর্ত্রী বেঁধে রাখেন। এরপর কনকাঞ্জলি দিয়ে মা’কে বিদায় জানান হয়।
বিসর্জনের পরে একেকটি বেল পাতার উপর গঙ্গাজল ছুঁইয়ে আম্রপল্লব দিয়ে বাড়ির সকলকে লিখতে হয় “শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়”।
দশভুজা: যে গান যায়নি ভোলা— প্রাক জন্মদিনে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য…/১
ইংলিশ টিংলিশ: সবাই যদি বলে ‘very beautiful’, তুমি বলে দ্যাখো ‘ravishing’ বা ‘magnificent’!
দার্জিলিংয়ে নতুন অ্যাডভেঞ্চার! টয় ট্রেন চলবে রাতেও, কবে থেকে?
১৪ বছর বয়সে বসুন্ধরার বিয়ে হয়েছিল। বিনয়ের জন্মের সময় তাঁর বয়স ১৬। আর বিনয়ের জন্মের ছ’মাস পর থেকেই দুর্ভাগ্যের কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল তাঁর জীবন। বাবা মারা যাবার পর ১২ বছরের বিনয়কান্তিকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বসুন্ধরা। একা। তারপর থেকে এতগুলো বছর অনবরত পরিস্থিতির সঙ্গে যুদ্ধ করে গিয়েছেন। দূর্গাপুজোর দিনগুলো রান্নাঘরের কোণেই কাটত বসুন্ধরার। গ্রে স্ট্রিটের বাড়িতে একটু স্বস্তি পেলেও বৈধব্যের আঘাতে বসুন্ধরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবে স্বর্ণ বাড়িতে আসার পর তাঁর জীবন স্বাভাবিক হতে শুরু হয়েছিল। নতুন ঠিকানা বসুন্ধরা ভিলায় পা দেবার পর তাই বসুন্ধরা এক নিটোল পরিবার গড়ে তুলতে চেয়েছে। চেয়েছে বিনয়কান্তি-স্বর্ণময়ী-সহ নাতি-নাতনীদের নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ। তাই পরিবারে দূর্গাপুজোর প্রচলন হল। যাতে মা দূর্গার কৃপা বসুন্ধরা ভিলা ও পরিবারের সকলের ওপরে বর্ষিত হয়।
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৫: বনবাসের সঙ্গী সীতা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪১: ঠাকুরবাড়িতে এসে সাহেব খেতেন ভাজা চিঁড়ের সঙ্গে কড়াইশুঁটি
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, ,পর্ব-৩৩: খালেবিলে, ধানখেতে, পুকুরে, নদীতে ঘুরে বেড়ানো ‘ম্যাজিশিয়ান’ জেব্রা ফিশ ভবিষ্যতে রোগ নিরাময়ে নতুন দিশা দেখাবে
১৯ বছর বয়সেই শান্তিলতার বিয়ের ঠিক হয়ে গেল। গগনকান্তি পরিবারের জুটমিলের ব্যবসা দেখত। তার তখনি বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। মেজছেলে বিকাশকান্তিকে অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য লন্ডন পাঠানো হতে পারে। উইলিয়াম পিটারসন নিজে উদ্যোগ নিয়ে লন্ডনে সে ব্যবস্থা করেছেন। বিনয়কান্তি প্রতিশ্রুতি মতো প্রতিমাসে উইলিয়াম পিটারসনের ঋণশোধ করছেন। যেদিন কোম্পানি হস্তান্তরিত হয়েছিল সেদিন কোম্পানির বাজারে যে অর্থমূল্য হওয়া উচিত, সেটাকেই বিনয়কান্তি কোম্পানির দাম হিসেবে ধার্য করেছিল। বসুন্ধরা ও স্বর্ণময়ীর গয়না বিক্রি করে যে সামান্য টাকা উনি সেই মুহূর্তে পিটারসেনকে দিতে পেরেছিলেন সেটা ছিল অগ্রিম। যে টাকাটা বাকি ছিল প্রতি মাসে তার কিস্তি ব্যাংকে জমা রাখে বসুন্ধরা গ্রুপ অফ কোম্পানি। বছরে একবার সেই টাকা স্টারলিং পাউন্ডের হিসেবে ব্যাংক মারফৎ উইলিয়াম পিটারসনের কাছে পৌঁছে যায়।
বিনয়কান্তির এই নিখাদ সততা গর্বিত করে মা বসুন্ধরাকে। নিশ্চিন্ত করে সহধর্মিনী স্বর্ণময়ীকে।
চেতলায় থাকত বেসরকারি কর্মী প্রবোধকুমার সেনগুপ্ত। বাবা ছিলেন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট। টালিনালার পাশে দোতলা বাড়ি। শারীরিক অসুস্থতার জন্য এখন আর কাজকর্ম করেন না। তবে তাঁদের বাড়ি ছাড়াও আরেকটা রোজগারের সূত্র কোম্পানির কাগজ বা শেয়ার ডিভিডেন্ট। প্রবোধ বড় ভাই আরও তিন ভাই রয়েছে। বসুন্ধরা পারিবারিক অবস্থা নিয়ে একটু খুঁতখুঁত করেছিল। বিনয়কান্তি মাকে বলেছিল, ‘আমরা কিভাবে শুরু করেছিলাম ভুলে গিয়েছ মা? ছেলেটি ভালো। তাকে প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিতে হবে।’ স্বর্ণময়ীও আপত্তি জানাতে পারেনি। ধুমধাম করে শান্তিলতার বিয়ে হল প্রবোধ সেনগুপ্তর সঙ্গে। বিয়ের আগে শান্তিলতার স্বামী প্রবোধ জানতেন বিনয়কান্তি দত্ত বড় ব্যবসায়ী। বিয়ের পর বসুন্ধরা ভিলার বৈভব দেখে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সব মানুষের সব সিদ্ধান্ত হয়তো সঠিক হয় না। কলকাতায় তখনকার পয়সাওয়ালা মানুষজনের ছেলেরা অসৎসঙ্গে পয়সা ওড়াত। শান্তিলতা সুন্দরী। শহরের অনেক ধনী পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু বিনয়কান্তি খোঁজখবর নিয়ে দেখেছিলেন, প্রায় সব পাত্রই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে। বড় হয়ে পৈতৃক ব্যবসায় যোগ দিয়েছে। বৈভবের জীবন-যাপন করছে। ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার মতো কাউকে খুঁজে পায়নি বিনয়। সম্ভবত শান্তিলতার ভবিষ্যৎ পাত্রের মধ্যে বিনয় তাঁর নিজের ছায়া খুঁজে পেতে চাইছিল। বিনয়কান্তি নিজে বা তারক নিয়োগী ভাগ্যের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে যেতে এসেছে। তাই বিনয় মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত পাত্র খুঁজছিল। তখনই প্রবোধের খোঁজ পাওয়া গেল। —চলবে
পুজোর ভোগ বিতরণ।
পরের পর্ব আগামী রবিবার
বিনয়ের নির্দেশ মেনে তারক নিয়োগী কাগজে বসুন্ধরা ভিলার সঙ্গে এই ঘটনার কোন সংযোগ উল্লেখ করতে দেননি। পুলিশ নিয়মমাফিক ময়নাতদন্ত করে দেহ সৎকারের জন্য দিয়েছিল গগন ও বিকাশকান্তিকে। প্রবোধের ভাইয়েরা ছিল। দেহ চেতলার বাড়ি থেকে কেওড়াতলা শ্মশানে দাহ হয়েছিল, বসুন্ধরা ভিলায় আসেনি। সবটা নিখুঁত ভাবে সামলে ছিলেন বাবু। তবে সবটা সামলাতে পারেননি। বারে বারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা শান্তিলতাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয়েছিল।
গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।