শ্রীভরত হনুমান মিলন মন্দিরে শ্রীরামের পাদুকা পুজো।
অযোধ্যার দ্বিতীয় দিন সকালে আমরা বেরিয়ে পড়ি পনেরো কিলোমিটার দূরবর্তী নন্দীগ্রামের উদ্দেশ্যে। যাত্রাপথে সবুজ গাছপালা ও গ্রাম্য দৃশ্য উপভোগ করা যায়। নন্দীগ্রামে আমরা ভরতকুণ্ড দর্শন করি। কথিত আছে, শ্রীরামের ভাই ভরত রামকে ফেরাতে না পেরে চিত্রকুট থেকে প্রত্যাবর্তন করে ভরতকুণ্ড নামক প্রসিদ্ধ সরোবরের পাশে একটি স্থানে শ্রীরামের পাদুকাযুগল স্থাপন করে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। এই সরোবরে নিত্য আরতি হয় এবং সিমেন্ট বাঁধানো বেদীতে ভরতের পাদুকা আঁকা।
শ্রীভরত হনুমান মিলন মন্দিরে ভরত ও হনুমানের কণ্ঠ-আলিঙ্গন মূর্তি।
ভরতকুণ্ডের ঘাটের সামনে ঘণ্টা সজ্জিত তোরণটি বেশ সুন্দর। লোকশ্রুতি অনুযায়ী রাম ও সীতার বনবাস জীবন অবসানে রামচন্দ্র অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করবেন এই সংবাদ নিয়ে হনুমান নন্দীগ্রামে এসে ভরতের সঙ্গে মিলিত হন। ভরত-হনুমান মিলন মন্দিরটিতে গিয়ে অপার শান্তি লাভ হয়। ভরত-হনুমান মন্দিরে ভরতের সঙ্গে হনুমানের কণ্ঠ আলিঙ্গনের মূর্তিটি দেখে ভালো লাগে। এখানে সব সময় ভজনের সুর কানে ভেসে আসে। মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গিয়ে দেখি পাদুকাযুগল পূজিত হচ্ছে। স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশ।
অযোধ্যায় শ্রীভরত হনুমান মিলন মন্দির।
মন্দিরে ঢুকতেই পাশে দক্ষিণমুখী প্রাচীন ‘ভরত গুফা’। ভিতরে বিশেষ প্রশস্ত স্থান নেই। আধো আলো আধো অন্ধকার, শান্ত, শীতল পরিবেশ। কথিত আছে ভরত এখানে তপস্যা করতেন। বর্তমানে এটি মন্দির রূপে লক্ষিত হয়। এর বাইরের দেওয়াল গাত্রে তুলসীদাস রচিত কয়েকটি পঙক্তি হিন্দি অক্ষরে লিখিত। প্রাইভেট বাস ও প্রাইভেট গাড়ি করে অনেক তীর্থযাত্রীরা এখানে এসেছেন দেখলাম।
রামায়ণের কাহিনীগুলো এই ভাবে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠায় ফিরে গেলাম মহাকাব্যের পৌরাণিক যুগে। এর পর গেলাম নন্দীগ্রামের প্রাচীন রাম জানকী মন্দিরে, রাম, সীতা ও লক্ষ্মণের বিগ্রহ প্রত্যক্ষ করি। ভজনের সুর মনকে পবিত্র করে। এখানে শ্রীভরত কূপ থেকে জল পান করি। কথিত আছে, সাতাশটি নদীর জল এখানে এসে মিশেছে। আশ্রমের মতো পবিত্র পরিবেশ। পুরোহিতের আহ্বানে মন্দিরের ভিতরে ঢুকে নকুলদানা প্রসাদ পেলাম। অন্য মন্দিরের মতো এখানেও দানপাত্র ছিল।
আরও পড়ুন:
অযোধ্যা: প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রাণকেন্দ্র/১
ছোটদের যত্নে: হঠাৎই জ্বর, মুখে-হাতে ঘা হচ্ছে শিশুদের! কষ্টকর হলেও ভয়ের কিছু নেই, জেনে নিন কোন রোগের উপসর্গ এগুলি
কিছুতেই ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন? সকালে এই কাজগুলি করছেন না তো?
ডায়েট টিপসঃ মাইগ্রেনের মুক্তি সঠিক ডায়েটেই, রোজকার খাদ্যতালিকায় রাখুন এই খাবারগুলি
নন্দীগ্রাম থেকে ফেরার পথে মণি পর্বতের কাছে টোটো দাঁড়াল। অযোধ্যা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে পঁয়ষট্টি ফুট উঁচুতে অযোধ্যার সব থেকে উচ্চ স্থান মণি পর্বত। এখানকার ধর্মীয় ও পৌরাণিক তাৎপর্য অনেকখানি। লোকশ্রুতি আছে মেঘনাদের সঙ্গে যুদ্ধে লক্ষণ যখন আহত হন, তখন তাঁকে সুস্থ করার জন্য সঞ্জীবনী ওষুধ নিতে হনুমান মণিপর্বতে এসেছিলেন। মণিপর্বতের বেশ অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে কয়েকটি মন্দির চোখে পড়ল, রাম, সীতা, হনুমান পূজিত হন। সকাল ছটা থেকে সন্ধ্যে ছটা পর্যন্ত খোলা থাকে। মণি পর্বতের চারিদিকে কিছুটা জঙ্গল ও কিছুটা জনবসতি লক্ষ্য করা যায়।
নন্দীগ্রামে ভরতকুণ্ড।
বিশ্বাস করা হয়, ভগবান বুদ্ধ অযোধ্যায় কয়েক বছর ছিলেন এবং ধর্ম সম্পর্কে এখানে শিষ্যদের উপদেশ দিয়েছিলেন। এখানে মহারাজ অশোক নির্মিত স্তূপ ও বৌদ্ধ মন্দির ছিল।
মণি পর্বতের ওপর থেকে অযোধ্যা শহরটিকে সুন্দরভাবে দেখা যায়। কাছেই ‘সুগ্রীব পর্বত’ নামে খ্যাত আর একটি পাহাড় আছে। মণি পর্বতের পাদদেশে রঙ বেরঙের চুড়ি বিক্রেতাদের ঘিরে মহিলারা ভিড় করে। পর্যটকদের ওপর এই সব ব্যবসার অর্থনীতি নির্ভর করে এ কথা বলাই বাহুল্য।
নন্দীগ্রাম থেকে ফিরে দ্বিতীয় দিন বিকেলে সরযূ নদীর তীরে টোটো করে পৌঁছে গেলাম সরযূ-র অর্থ যা প্রবাহিত হয় অর্থাৎ বাতাস। এই নদী উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। ঋগবেদে তিনবার (৪.৩০.১৮, ৫.৫৩.৯, ১০.৬৪) এই নদীর কথা উল্লিখিত হয়েছে। বেদ ও রামায়ণে সরযূর প্রাচীন তাৎপর্য আছে।
মণি পর্বতের ওপর থেকে অযোধ্যা শহরটিকে সুন্দরভাবে দেখা যায়। কাছেই ‘সুগ্রীব পর্বত’ নামে খ্যাত আর একটি পাহাড় আছে। মণি পর্বতের পাদদেশে রঙ বেরঙের চুড়ি বিক্রেতাদের ঘিরে মহিলারা ভিড় করে। পর্যটকদের ওপর এই সব ব্যবসার অর্থনীতি নির্ভর করে এ কথা বলাই বাহুল্য।
নন্দীগ্রাম থেকে ফিরে দ্বিতীয় দিন বিকেলে সরযূ নদীর তীরে টোটো করে পৌঁছে গেলাম সরযূ-র অর্থ যা প্রবাহিত হয় অর্থাৎ বাতাস। এই নদী উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। ঋগবেদে তিনবার (৪.৩০.১৮, ৫.৫৩.৯, ১০.৬৪) এই নদীর কথা উল্লিখিত হয়েছে। বেদ ও রামায়ণে সরযূর প্রাচীন তাৎপর্য আছে।
অযোধ্যায় সরযূ নদী।
‘রাম কি পায়দি’ স্থানটিতে সরযূর একাধিক ঘাট লক্ষিত হয়। নদীর ব্রিজের ওপর থেকে খুব সুদৃশ্য লাগে দেখতে। ঘাটগুলোতে অজস্র তীর্থযাত্রীদের সমাগম উল্লেখযোগ্য। অযোধ্যায় একদিকে সরযূ নদীতে পর্যটকদের নৌবিহারের জন্য রঙবেরঙের নৌকা, পূজাপাঠ ও ভক্তদের স্নানকার্য চোখে পড়ে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু তীর্থযাত্রী পুণ্য লাভের জন্য এখানে আসেন। বেশ কিছু পান্ডা তাদের জীবিকার জন্য ঘাটগুলোয় থাকে। এই নদীর অন্য দিকে বহমান স্রোতের অপর পাড়সমূহে প্রচুর দেবদেবীর মন্দির লক্ষিত হয়। সরযূ নদীর জল মাথায় নিয়ে নিজেকে ধন্য মনে করেছি। এখানের ঘাটে প্রতি বছর দীপাবলি উৎসবে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়। ২০২১ সালে কয়েক লক্ষ প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের দ্বারা বিশ্বের বৃহত্তম তৈলবাতি প্রদর্শনে গিনেস রেকর্ড সৃষ্টি করে। আমরা শরৎকালে গিয়ে অযোধ্যায় অল্প বৃষ্টি ও রোদ ঝকঝকে দিন পেয়েছি। নদীর ঘাটে সন্ধে সাড়ে ছটায় প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও আরতির মুহূর্ত উপভোগ করে ক্যামেরাবন্দী করেছি। এক অপার্থিব আনন্দের সাক্ষী হয়েছি।
আরও পড়ুন:
ফিল্ম রিভিউ: ‘হাওয়া’য় ভেসে গেল বাঙালি
Appropriate Prepositions কাকে বলে জানো কি?
খাই খাইঃ উৎসব দিনে চট জলদি বানিয়ে ফেলুন স্বাদে ও গন্ধে ভরপুর চাইনিজ স্টাইলে গার্লিক চিকেন
দু’শো বছর আগে হলে তিনি ইঞ্জিনিয়ারের বদলে সতী হতেন
জৈন পুঁথি অনুযায়ী প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের জন্মস্থান মথুরা এবং তাঁর পুত্র ভরত। ভগবত পুরাণে (৫.৭.৩) আছে ভরতের নাম অনুসারে ভারতবর্ষ নাম হয়েছে। অযোধ্যায় ঋষভনাথের মন্দিরটিও উল্লেখনীয়। এখানে ঋষভনাথের মূর্তিটি বেশ বড়। এছাড়া কয়েকজন জৈন দেবীমাতাদের মূর্তিগুলোও দর্শন করলাম।
সময়ের অভাবে অযোধ্যায় তুলসী স্মারক ভবনে যাওয়া হয়নি। শুনেছি ভবনটি তুলসী দাসজীর প্রতি উৎসর্গীকৃত। প্রতিদিন সন্ধে ছটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত তুলসী স্মারক ভবনে রামলীলা পরিবেশিত হয়। এটি এখানকার আকর্ষণ।
সময়ের অভাবে অযোধ্যায় তুলসী স্মারক ভবনে যাওয়া হয়নি। শুনেছি ভবনটি তুলসী দাসজীর প্রতি উৎসর্গীকৃত। প্রতিদিন সন্ধে ছটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত তুলসী স্মারক ভবনে রামলীলা পরিবেশিত হয়। এটি এখানকার আকর্ষণ।
অযোধ্যায় 'রাম কি পায়দি'।
অযোধ্যার পৌরাণিক তৎপর্যের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহাসিক পটভূমিকাও উল্লেখনীয়। খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য অযোধ্যাকে চারিপাশের জঙ্গল থেকে মুক্ত করে নতুন ভাবে সজ্জিত করেন। তিনি শ্রীরামচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত তিনশো ষাটটি স্থান চিহ্নিত করে রামগড় দুর্গ স্থাপন করেন। এরপর চতুর্থ শতকে চৈনিক পরিব্রাজক ফা হিয়েন তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ততে অযোধ্যাকে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের ক্ষেত্র বলে বর্ণনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-য়েন-সাং-এর (সপ্তম শতাব্দী) ভারতবৃত্তান্ত অনুযায়ী অযোধ্যা সাকেত নামে পরিচিত ছিল। তাঁর তথ্যতে এ কথাও আছে যে, বুদ্ধদেব তাঁর জীবনের ষোল বছর বিশাখা নামে এক বিদুষী রমণীর আতিথেয়তা গ্রহণ করে অযোধ্যায় অতিবাহিত করেন।
সরযূর তীরে সন্ধ্যারতি।
একাদশ শতকে অযোধ্যা সুলতানী শাসনের অধীনস্থ হয়। ইতিহাস, পুরাণ, বেদ, মহাকাব্যের মিশ্রিত ধারায় অযোধ্যা ভারতের প্রাণকেন্দ্র রূপে আজও বর্তমান — এই অনুভূতিটুকু নিয়ে অযোধ্যা থেকে ফিরে এলাম। হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ সব রকম প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির নির্যাস পেলাম অযোধ্যায়, যা ভারতীয় জীবনদর্শন ও জীবনবোধকে উজ্জীবিত করে।—শেষ