সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


অযোধ্যার রাজপথে জনারণ্য। কখন হবে রামের রাজ্যাভিষেক—তার জন্য রাত্রি পার করে উদ্বেল অপেক্ষা অযোধ্যাবাসীর। দ্রুত চলছে অভিষেক ক্রিয়ার প্রয়োজনীয় কাজকর্ম। ব্যস্ততা আজ বড়ই বেশি রাজপুরোহিত, অমাত্য, মন্ত্রীদের। রাজা দশরথের মনে অস্থিরতা— কখন নির্বিঘ্নে জ্যেষ্ঠপুত্রের হাতে তুলে দেবেন সিংহাসনের উত্তরাধিকার।

এদিকে অযোধ্যার এক নিভৃত প্রাসাদকক্ষে লোকচক্ষুর অন্তরালে তখন রচিত হচ্ছে বিপরীত এক চিত্রনাট্য। তার ঘটনাবিন্যাসের সুতোটি ধরে আছে কেকয় দেশের রাজকন্যা, রাজমহিষী কৈকেয়ীর পরিচারিকা মন্থরা। অযোধ্যার রাজসিংহাসনের অধিকার নির্ণয় করে দিচ্ছেন রাজা নন, কোনও রাজনীতিবিদ অমাত্য, মন্ত্রী নন, রাজপুরোহিত নন, রাজমহিষীরা নন, প্রজারাও নন। রাজঅন্তঃপুরের এক কুব্জা, ঈর্ষাকাতর, হীনবুদ্ধি দাসী সবার অলক্ষ্যে লিখে ফেলছে কোশল রাজ্যের ভবিতব্য। অযোগ্যের হাতেও কখনো কখনও এভাবেই উঠে আসে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি, বিশেষজ্ঞ জ্ঞানবৃদ্ধদের প্রজ্ঞাদৃষ্টি সন্ধান পায় না তার।
মন্থরার মন্ত্রণা-বিষ কাজ করতে শুরু করেছে কৈকেয়ীর মনে। যে কথা মনেও আনেননি কোনওদিন, রাম আর ভরতে ভেদাভেদ করেননি, আজ সেই ভাবনাই মনে উথালপাথাল ঢেউ তুলছে। কীভাবে সরাতে হবে দশরথের প্রিয়তম পুত্র রামকে, কীভাবেই বা ভরতকে দেবেন তিনি রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকার — এ ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠেছেন তিনি। মন্থরার যুক্তিকে কোনোভাবেই খণ্ডন করতে পারেননি কৈকেয়ী। এখন সেসব আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছেন তিনি। মন্থরাই আজ সবচেয়ে বুদ্ধিমতী, সর্বাপেক্ষা নিশ্চিন্ত আশ্রয় কৈকেয়ীর কাছে।

মন্থরা কাছে এসে বসে কৈকেয়ীর। কানের মধ্যে দিয়ে তপ্ত তরল বিষ পৌঁছে যায় মাথায়—“যদি তুমি মনে করো, তবে আজই রামকে বনে পাঠিয়ে ভরতকে রাজা করতে পারো!” “ওমা! তাই নাকি! কিন্তু কোন উপায়ে?” — বিস্ময়ের ভার সামলাতে না পেরে তাড়াতাড়ি উঠে বসেন কৈকেয়ী।

“উপায় তো তোমার হাতেই আছে!” আবার বলতে শুরু করল মন্থরা। “মনে করে দেখো, সেই যে দেবাসুরের যুদ্ধ হয়েছিল— রাজা দশরথ দেবরাজ ইন্দ্রকে সাহায্য করার জন্য বৈজয়ন্ত নগরে গিয়েছিলেন। সেখানে ছিল শম্বর নামে বিখ্যাত এক অসুর। সে তার মায়াজাল দিয়ে দেবতাদের একেবারে নাজেহাল করে ফেলেছিল। দশরথের সঙ্গেও তার ভয়ংকর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে জয় হয়েছিল ঠিকই কিন্তু শম্বরের অস্ত্রে দশরথ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিলেন। তুমি তখন সেবাযত্ন করেছিলে রাজার। তোমার সেবায় সুস্থ হয়ে উঠে রাজা তোমাকে দুটি বর দিতে চেয়েছিলেন। তুমি উত্তরে বলেছিলে, — আমার ইচ্ছা হবে যখন, তখন আমি দুটি বর চেয়ে নেব।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২০: আকস্মিক অভিঘাত-আনন্দের পাত্রে বিষাদবিষ

ছোটদের যত্নে: আপনার সন্তান কি প্রায়ই কাঁদে? শিশুর কান্না থামানোর সহজ উপায় বলে দিচ্ছেন ডাক্তারবাবু

আজ সেই বর দুটি চাওয়ার সময় এসেছে রানি। তুমি রাজার কাছে আজ এক বরে ভরতের অভিষেক আর অন্য বরে রামের নির্বাসন চেয়ে নাও। রাজা নিশ্চয়ই তোমার কাছে আসবেন একবার অভিষেকের আগে। আর তিনি যে তোমার প্রতি বড় দুর্বল, এ তোমার অজানা নয়। তুমি বরং তোমার এই রাজরানির সাজসজ্জা ছেড়ে মলিন বসন পরো। আর গোঁসাঘরের মেঝেতে শুয়ে থাকো একেবারে অনাথার মতো। রাজা এলে রাজার দিকে একেবারেই তাকিয়ো না। উনার সবচেয়ে প্রিয় পত্নী যে তুমিই এতে তো কোনও সন্দেহ নেই। তোমার জন্য উনি রাজলক্ষ্মীও ত্যাগ করতে পারেন কৈকেয়ি! উনি তোমাকে এভাবে দেখতে পেলে তোমার মনের কথা জানার চেষ্টা করবেনই। আর সেই সময়েই তুমি বর দুটির কথা মনে করিয়ে দেবে রাজাকে। সত্য শপথ করিয়ে চেয়ে নেবে এক বরে রামের চোদ্দো বছরের জন্য নির্বাসন আর অন্য বরে ভরতের রাজ্যলাভ। দেবি, রাম যতদিনে ফিরে আসবেন, ততদিনে ভরত লোকজন, ধনসম্পদ সবই নিজের হাতে নিয়ে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবেন। রাজা তোমার স্বভাব জানেন রাজকন্যা। তুমি রাগ করলে রাজা তা উপেক্ষা করতে পারবেন না এ তুমি বেশ জানো। তুমিই পারবে রাজাকে রামের রাজ্যাভিষেকের সংকল্প থেকে সরিয়ে আনতে।”
আরও পড়ুন:

অযোধ্যা: প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি সমন্বয়ের প্রাণকেন্দ্র/১

ইংলিশ টিংলিশ: জানো কি ‘বাজি ফাটানো’ কিংবা ‘মোমবাতি জ্বালানো’র ইংরেজি কী?

কৈকেয়ী সব শুনলেন, আত্মস্থ করলেন মন্থরার উপদেশ। সংসারের ভাঙন-ধরানো, রাজ্যের ভবিষ্যৎ ভাবনাহীন অনিষ্ট চিন্তার মধ্যেই নিজের ও নিজের পুত্রের কল্যাণ খুঁজে পেলেন তিনি। আহ্লাদে গদ্গদ হয়ে জড়িয়ে ধরলেন মন্থরাকে — “ওলো, তুমি ছাড়া এ সংসারে আমার এমন হিতৈষিণী আর কে আছে বলো? রামের এমন কুটিল বুদ্ধি তুমি না থাকলে আর কেই বা ধরতে পারতো! সত্যি মন্থরা! হতে পারে তুমি কুব্জা, কিন্তু পৃথিবীর সব কুব্জাদের মধ্যে তুমি সবচেয়ে সেরা। তোমার কুঁজে তো দেখি ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমানের যত রাজনীতিবিদ্যা, সব এসে বাসা বেঁধেছে! আচ্ছা, আমার ভরতের অভিষেক হোক, আমি তোমাকে সোনার মালা দেব, সোনায় মুড়ে দেব তোমার গা। তুমি তখন রাজরানীর মত ক্ষমতা ধরবে, দেখো। সব দাসীরা তোমার সেবা করবে।”
কৈকেয়ী নিজে স্বপ্ন দেখছেন, মন্থরাকেও সে স্বপ্নের সঙ্গী করে নিয়ে যেন ভাসছেন স্বপ্নের রাজ্যে। মন্থরা জানেন কৈকেয়ী বড় অগভীর মন। সে মন এভাবেই কখনও হর্ষে উদ্বেল, কখনও ক্রোধে বিহ্বল। তাই মন্থরা নিপুণ হাতে তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে। তাড়াতাড়ি তাঁকে টেনে নামায় স্বপ্নের জগৎ থেকে। সময় নেই যে আর হাতে।

“আর দেরি করো না গো রাজকন্যা। জমিতে জল ঢুকে গেলে আর আল দিয়ে কী করবে? তাই আল আগেই সময় থাকতে বাঁধো। নিজের মঙ্গল চিন্তা করে এবার উঠে পড়ো। যেমন যেমন বলেছি, ঠিক সেইরকম করে মন ভোলাও রাজার। কখন যে এসে পড়বেন তিনি।”

পাখির পালকের মতো নরম বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন কৈকেয়ী। আজ আর কোমল শয্যায় শুয়ে বেলা বইয়ে দেওয়ার সময় নেই। সোনার আভরণ নয়, বহুমূল্য রত্নখচিত বসনভূষণ নয়, আজ তিনি রাজার মন ভোলাতে অন্য সাজে সাজবেন। ছুঁড়ে ফেলে দিলেন গায়ের মহামূল্য সব অলঙ্কার, মুক্তাহার, রাজরানীর বেশভূষা। তুলে নিলেন একটি মলিন, ছিন্নপ্রায় বসন। গোঁসাঘরে ঢুকে এলো চুল বিছিয়ে দিয়ে নিলেন ভূমিশয্যা। নিদারুণ প্রতিজ্ঞাপাশে বাঁধলেন নিজেকে, মন্থরাকে বললেন— “রাম বনবাসে না যাওয়া পর্যন্ত আমি ধন, রত্ন, অলঙ্কার কিছুই ছোঁবো না, কিছুই খাব না।” ক্রোধে, অভিমানে আহত সর্পিণীর মতো ফুঁসছেন কৈকেয়ী। মন্থরার বিষমন্ত্রণা পুরোপুরি বশীভূত করেছে তাঁকে। গোঁসাঘরের অন্ধকারে নিজেও চাঁদ-তারাহীন নিকষ কালো রাত্রির মতো নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে রইলেন কৈকেয়ী অযোধ্যাপতি দশরথের অপেক্ষায়। অযোধ্যার আকাশেও দিনের আলোয় সকলের অগোচরে নেমে এল দুর্যোগের অন্ধকার রাত্রি।—চলবে
*শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content