অলঙ্করণ : সৌরভ চক্রবর্তী
বিকেলের আলো ক্রমশ মরে আসছিল। রুহি এ সময়টা রোজ জানলার কাছে বসে থাকে। সূর্যের চলে যাওয়া দেখে। এ তো আর একবারে চলে যাওয়া নয়! গনগনে তেজ কখন যেন ধীরে মিইয়ে আসে। আর তারপরে শেষবারের মতো জ্বলে উঠে নিভে যাওয়া। আবার একটা রাত ভোরের অপেক্ষা। বাবার কথা বড় মনে পড়ে। বিশেষ করে দিনের এই সময়টায়। সে আর তার বাবা একসঙ্গে সন্ধে হওয়া দেখতেন। বাবা বলতেন, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে, ‘জানিস রু, এই চলে যাওয়াটা মানে কিন্তু চলে যাওয়া নয়। কোথাও একটা থেকে যাওয়া।’ ছোট্ট রুহি কিই বা বুঝত তখন? বাবার হাতটা আরও শক্ত করে ধরত। বাবা বলে চলতেন, ‘এই যেমন দ্যাখ না, সূর্যের দেখা আবার পাওয়া যাবে কাল। আবার নতুন রঙে রূপে কালকের জন্য অপেক্ষা করব সব্বাই। কিছুই ফুরায় না বুঝলি?’ রুহি সেসব শুনে কোনও মন্তব্য করত না। বাবা যে কত কী বলে? হাতটা আরও জোরে আঁকড়ে ধরত শুধু।
চারপাশটা আরও অন্ধকার হয়ে এসেছে। বৈশাখী হাওয়া ঝাপটা মারে চোখেমুখে। কোথা থেকে একটা সোঁদা গন্ধ আসছে নাকে। আশেপাশে নিশ্চয়ই কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। ওদের এই শহরতলীতে বেশ কিছুদিন বৃষ্টির বালাই নেই। তবে চারপাশটা বেশ ফাঁকা আর পুকুর গাছপালা থাকায় প্রবল গরমেও হুস-হাস করতে হয় না। মা তো সেই কোন ছোটবেলায় চলে গিয়েছে সংসারের মায়া কাটিয়ে। মা সংসারটা বড় ভালোবাসত। আগলে রাখত সকলকে। কত পুষ্যি ছিল মায়ের। পাখপাখালি থেকে গাছগাছালি, কুকুরটা বেড়ালটা পর্যন্ত। একএক সময় রুহির মনে হতো ওর আদর বুঝি কমে যাচ্ছে। সেসব মনে করে অজান্তেই মুখে হাসি আসে ওর। এখন এই টুকরো স্মৃতিগুলোই সম্বল। এখন অবশ্য এসব নিয়ে ওর আর মন খারাপ হয় না। একলা থাকাটা সয়ে গিয়েছে। একমাত্র এই সূর্য ডোবার মুহূর্তটাতেই একটু যা অন্যরকম মন হয়। উঠোনের লতানে জুঁইগাছটায় ঝেঁপে ফুল এসেছে। একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে উঠোন ছাড়িয়ে ঘরময়। ঘরের আলোগুলো জ্বেলে দেয় রুহি। এবার তার বন্ধুসঙ্গ করার পালা। পড়ার টেবিলে ডায়েরিখানা পড়ে আছে। পাশে কলমদান। সস্তাদামের নানান রঙের পেন সাজানো তাতে। দামী কলম সে কেনে না। শখ বলতে ওই রঙবেরঙের কলম।
আরও পড়ুন:
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৯: ইল্বলদৈত্য আর অগস্ত্যমুনির কথা
সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৩: বাংলাদেশ শিশু একাডেমি— শিশুদের আনন্দ ভুবন
ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-৪: তারপর সেই আঁকাবাঁকা পথে হারিয়ে গেলাম গ্রিন-বে অভিমুখে, সন্ধে পর্যন্ত কোত্থাও যাইনি
আজ যে কী হয়েছে ওর! অনেক কথা ভিড় করে আসছে মনে। সেসব হারিয়ে যাওয়ার আগেই লিখে ফেলতে হবে ডায়েরিখানায়। ডায়েরিটা বাবাই এনে দিয়েছিল তাকে। বাবা প্রতিবছর জন্মদিনে একটা করে ডায়েরি কিনে দিতেন আর সঙ্গে একটা করে পেন। রোজ দিনলিপি লিখতে বলতেন বাবা। ডায়েরিগুলোই রুহির বন্ধু, কথা বলবার জায়গা। এমন করে আর কেই বা তার মন বুঝবে! চেয়ারটা টেনে বসে রুহি। সস্তা কলমের আঁচড়ে ভরে ওঠে মুহূর্তকথার সঞ্চয়। বাবার দেওয়া অনেকগুলো ডায়েরিই জমে আছে। বাবার খুব আদরের ছিল সে। কখনও অবাধ্য হয়নি বাবার। তবে দিনলিপি লেখাতেও তেমন উত্সাহ ছিল না। স্কুল-কলেজের পড়াশোনার পর ঘরে ফিরে এসে অফিসফেরত বাবার সঙ্গে দু’দণ্ড গল্প করার পর পুতুলের সংসার সাজিয়ে বসত। বেশ বড় হওয়া অবধিও সে অভ্যাস যায়নি। নিজের হাতে পুতুলদের সাজানো, মিথ্যে মিথ্যে রান্না করা, খেতে দেওয়া, আর সকলের খাওয়ার শেষে নিজে অবশিষ্ট যত্সাফমান্য খাওয়া। কোনও কোনও দিন সেই সংসারের দায়দায়িত্ব সারতে সারতে রাত ১০টা বেজে যেত। বাবার ডাকে সম্বিৎ ফিরত।
আরও পড়ুন:
নাট্যকথা: রোদ্দুর ও অমলকান্তি/৪
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬: সে এক হতভাগ্যের ‘নষ্ট নীড়’ [২৪/০৮/১৯৫১]
শারদীয়ার গল্প-১: প্ল্যানচেট রহস্য
গত শীতে বাবাও হারিয়ে গেলো। হ্যাঁ, হারিয়েই তো গেলো। আর কিই বা বলতে পারে? দু’দিন আগেও বিকেলের মরে আসা আলোয় দাওয়ায় চেয়ার দু’খানা টেনে নিয়ে বসে গল্প করতে করতে চা খাচ্ছিলো দু’জনাতে। দু’জনের সংসার হলে কী হবে? পুষ্যি কি কম? কালু কুকুরটা, চড়াইছানাটা কিংবা ওই সাদা-কালো কাবলে বিড়ালটা যার নাম দিয়েছিল রুহি, ‘বুলি’। ওদের নিয়ে আলোচনা হতো। সেদিন রাত থেকেই বাবার ধূম জ্বর। ডাক্তারকাকাকে ডেকে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করল রুহি। কিন্তু জ্বর আর কমল না। তারপর…?
পুতুলের সংসার সাজানোর কথা আজকাল আর মনে হয় না। বাবার রেখে যাওয়া সংসারে রুহি আজ মালকিন। আজও মনে হয়, বাবা গিয়েছে, না বলেই গিয়েছে বাইরে কোথাও। ফিরে এসে বাইরের গেট থেকে উদাত্ত গলায় ডাকবে, ‘রু…রুহি মা? কোথায় গেলি?’ যেন বাবা ফিরে এসে অগোছালো সংসারখানা দেখে ভারি বকবে। রুহি তাই বাবার সংসারখানা গুছিয়ে রেখে চলে সাধ্যমতো। ডায়েরির পাতাখানার ওপরে পেনটা রেখে জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকায়। হঠাৎ ভীষণ কান্না পায় তার। কোনওক্রমে উচ্ছ্বাসটা দমন করতে করতেই মনে হয়, পাশে কারো নীরব উপস্থিতি। চমকে পিছনে ঘুরে, ‘কে কে? কে ওখানে? বলে চিত্কারর করে ওঠে রুহি। কোনও সাড়া মেলে না। তবে কি বাবা এসেছিল? রুহি ভাবে? আবার পরক্ষণেই মনে হয়, তা কী করে সম্ভব? সে রাতে শ্মশানে সেই তো নিজে হাতে করে…চোখটা আবার জলে ভিজে আসে। বাইরের অন্ধকার আকাশে একফালি চাঁদ তার মৃদু আলো ছড়িয়ে দিয়েছে চারপাশে। বাবার কথা মনে পড়ে রুহির, এই তো সব রয়েছে, শুধু সেই দেহে নয়। বাবার স্পর্শ ছড়িয়ে রয়েছে এই ঘরে, বাবার যত্নের সংসারে, রুহির স্মৃতিতে।
পুতুলের সংসার সাজানোর কথা আজকাল আর মনে হয় না। বাবার রেখে যাওয়া সংসারে রুহি আজ মালকিন। আজও মনে হয়, বাবা গিয়েছে, না বলেই গিয়েছে বাইরে কোথাও। ফিরে এসে বাইরের গেট থেকে উদাত্ত গলায় ডাকবে, ‘রু…রুহি মা? কোথায় গেলি?’ যেন বাবা ফিরে এসে অগোছালো সংসারখানা দেখে ভারি বকবে। রুহি তাই বাবার সংসারখানা গুছিয়ে রেখে চলে সাধ্যমতো। ডায়েরির পাতাখানার ওপরে পেনটা রেখে জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকায়। হঠাৎ ভীষণ কান্না পায় তার। কোনওক্রমে উচ্ছ্বাসটা দমন করতে করতেই মনে হয়, পাশে কারো নীরব উপস্থিতি। চমকে পিছনে ঘুরে, ‘কে কে? কে ওখানে? বলে চিত্কারর করে ওঠে রুহি। কোনও সাড়া মেলে না। তবে কি বাবা এসেছিল? রুহি ভাবে? আবার পরক্ষণেই মনে হয়, তা কী করে সম্ভব? সে রাতে শ্মশানে সেই তো নিজে হাতে করে…চোখটা আবার জলে ভিজে আসে। বাইরের অন্ধকার আকাশে একফালি চাঁদ তার মৃদু আলো ছড়িয়ে দিয়েছে চারপাশে। বাবার কথা মনে পড়ে রুহির, এই তো সব রয়েছে, শুধু সেই দেহে নয়। বাবার স্পর্শ ছড়িয়ে রয়েছে এই ঘরে, বাবার যত্নের সংসারে, রুহির স্মৃতিতে।
* গল্প (Short Story) – পরশ (Porosh) : অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ
গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম
‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com