শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


দীপাবলি নামটির মধ্যে রয়েছে ঈশ্বরীয় আবেশ, ইতিহাস ও পুরাণের অভিবন্দনা। দীপাবলি— এই সংস্কৃত শব্দ থেকেই দিওয়ালি কথাটি এসেছে। ‘দীপ’ অর্থ প্রদীপ, ‘আবালি’ অর্থ সারি। সুতরাং সারিবদ্ধ প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ বা প্রদীপের সমষ্টিই দীপাবলি। পাঁচ দিনব্যাপী এই হিন্দু ধর্মীয় উৎসবের সূচনা হয় আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরাস অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে ভাই ফোঁটার মাধ্যমে এই উৎসবের সমাপ্তি। কালীপুজোর সঙ্গে দীপাবলির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। শ্যামাপুজোর দিনই এই উৎসব পালন করা হয়। দীপাবলি বা দিওয়ালি দীপান্বিতা, দীপালিকা, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা এবং যক্ষরাত্রি নামেও অভিহিত।

প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে দীপাবলি পালিত হয়ে আসছে। আলোকসজ্জার এই দিবসে অন্ধকারের বিরুদ্ধে আমরা দীপ প্রজ্জ্বলন করি। এই আঁধার শুধু প্রকৃতিসৃষ্ট অমানিশা নয়, এ অন্ধকার আমাদের অজ্ঞতার, ভ্রান্তির, অপসংস্কারের। নিজের অন্তরের ও বাহিরের সকল অজ্ঞানতারূপ ‘তম’-কে দীপশিখায় বিদূরিত করার প্রয়াসই দীপাবলি।
স্কন্ধ পুরাণে দীপান্বিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে— এই প্রদীপ সূর্যকে স্মরণ করে জ্বালানো হয়। কারণ, ধরিত্রীকে প্রতিনিয়ত আলো এবং শক্তি প্রদান করে চলেছে একমাত্র সূর্য। কথিত আছে, শ্রীরামচন্দ্র চৌদ্দ বছরের বনবাসের পর অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন দীপাবলীর দিনেই। সেদিন আনন্দে সকল অযোধ্যাবাসী প্রদীপ জ্বেলে সজ্জিত করেছিলেন তাঁদের রাজধানী। আনুমানিক ৪৪৫০ বছর আগে মহাভারতের যুগে পাণ্ডবরা তাঁদের বারো বছরের বনবাস ও এক বছরের অজ্ঞাতবাস শেষ করে দীপাবলির দিনেই হস্তিনাপুর ফিরে এসেছিলেন। পুরাণ অনুসারে এই দিনটি মহালক্ষ্মীর জন্মদিন। ভগবান শ্রীবিষ্ণু বামন অবতারের রূপ ধারণ করেছিলেন দীপাবলিতেই। রাজা বিক্রমাদিত্য (দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত) শক দস্যুরাজকে পরাজিত করে শকারি নামে পরিচিত হন। এই জয়লাভ তাঁর রাজত্বকালে মহাসমারোহে পালিত হতো আলো উৎসব তথা দীপমালা উৎসব হিসাবে।
আরও পড়ুন:

মহালয়া কি শুধুই পিতৃপক্ষের অবসান

ছোটদের যত্নে: বাজির আগুন থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখুন খুদেদের, কী কী নিয়ম মানতেই হবে জেনে নিন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-৫: এমন সুন্দরের মাঝে নির্ভয়ে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ জীবনে রোজ রোজ আসে না…

উৎসব দিনে চট জলদি বানিয়ে ফেলুন স্বাদে ও গন্ধে ভরপুর চাইনিজ স্টাইলে গার্লিক চিকেন

দেশ ও অঞ্চল ভেদে এই দিনটির মাহাত্ম্য ভিন্ন ভিন্ন হলেও ভাবনার মূল সুর একই। বাংলা, অসম, ওড়িশা ও মিথিলাতে এই দিনটি কালীপুজো হিসেবে উদযাপিত হয়। পূর্ব ভারত বাদে সমগ্র ভারতে লক্ষ্মী পুজোর নিয়ম আছে দীপাবলীর দিনে। জৈন মতে, মহাবীর নির্বাণ লাভ করেছিলেন এই পুণ্য দিনেই। ১৬১৯ খ্রিস্টাব্দে শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ এবং ৫২ জন রাজপুত্র দীপাবলির দিন বন্দীদশা থেকে মুক্তি লাভ করেছিলেন বলে শিখরাও আলোকশিখা প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে এই উৎসব পালন করেন। আর্য সমাজ এই দিনটিতে পালন করে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মৃত্যু দিবস।

দার্শনিকগণের মতে, জীবকুলে একমাত্র মানুষই আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই তো সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে গুহামানবের আগুন আবিষ্কার থেকে শুরু করে যজ্ঞশালার আগুন, সন্ন্যাসীদের ধুনি ও পরবর্তীকালে ঠাকুর পুজোর সময় দীপ প্রজ্জ্বলন —এ সবই আগুন তথা প্রদীপের দীর্ঘ যাত্রাপথের হাত ধরে সমাজের সংস্কৃতি ও ভাবনার বদলের চিত্রটিকেই তুলে ধরে।

শুধু সংস্কৃতির পরিবর্তনই নয়, মানুষের সমৃদ্ধি থেকে প্রাচুর্যে উত্তরনেরও সাক্ষ্যপ্রমাণ এই প্রদীপ।
“শুভং করোতি কল্যাণম্ আরোগ্যং ধনসম্পদা
শত্রুবুদ্ধিবিনাশায় দীপজ্যোতির্নমোঽস্তুতে।।
দীপজ্যোতিঃ পরং ব্রহ্ম দীপজ্যোতির্জনার্দনঃ
দীপো হরতু মে পাপং সন্ধ্যাদীপং নমোঽস্তুতে “।।
আরও পড়ুন:

রুমা দেবী—তিরিশ হাজার মহিলার ভাগ্য পরিবর্তনের কান্ডারি তিনি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৭: হারিয়ে যাওয়ার আগে এ এক বিফল মৃত—‘সঞ্জিবনী’ [০৮/০২/১৯৫২]

পেট ফাঁপা ও বদহজমের সমস্যায় ভুগছেন? এই ঘরোয়া উপায়গুলি ম্যাজিকের মতো কাজ করবে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-২৮: কাদম্বরী বিহারীলালকে দিয়েছিলেন ‘সাধের আসন’

প্রদীপের উজ্জ্বল আলোকজ্যোতি শুভ ও মঙ্গলদায়ক, আরোগ্য ও ধন-সম্পদ প্রদানকারী এই দীপজ্যোতিই পরমব্রহ্ম, শ্রীবিষ্ণু। প্রদীপশিখা আমাদের সকল পাপ হরণ করে, তাকে আমরা প্রণাম করি —এই বিশ্বাস নিয়েই প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করি প্রতিনিয়ত এবং দীপান্বিতাতেও। আলোকমালার স্পর্শে প্রকৃতির অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে দূর হয় আমাদের মনের অন্ধকার— এ আকাঙ্ক্ষা আমাদের চিরন্তন।” তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ”— মানুষ চিরদিনই অন্ধকার থেকে আলোয় আসতে চেয়েছে। তাই তো সে তার সকল অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত করতে চেয়েছে আলো, লাভ করতে চেয়েছে পরম প্রশান্তি। দীপালিকার প্রতিটি দীপশিখার মধ্যে এই অনুভূতি আর ঐকান্তিক ইচ্ছারই অনুরণন—
“আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও
আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধুলায় ঢাকা, ধুইয়ে দাও”।।


পবিত্র আলোকমালার স্পর্শে উন্মোচিত হোক সত্যিকারের ‘আমি’-র স্বরূপটি। শুধু আচার-অনুষ্ঠান রীতিনীতির উদযাপনে নয়, আমাদের অনুভূতির আর বিশ্বাসের অনুরণনে মিশে থাক দীপাবলি। অগ্নি যেমন সব কিছুকে গ্রাস করে, তেমনই উদ্ভাসিতও করে। দীপ প্রকাশের দ্যোতক আর প্রকাশ জ্ঞানের। পরমাত্মার থেকেই আমরা সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করি। সেই জন্যই দীপ প্রজ্জ্বলনের প্রথা। শুধু পুজো নয়, কোনও কিছুর শুভারাম্ভও দীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। যেরকম ভাবে দীপশিখা উপরের দিকে ওঠে, সেরকম ভাবেই মানুষের প্রবৃত্তির, বোধের, চেতনার উর্ধ্বগমন হোক — এটাই দীপ প্রজ্জ্বলনের অর্থ।

প্রদীপের দীপ্তি শুধু আঁধারই ঘুচায় না, উদ্দীপিত করে মনকে। তার প্রদীপ্ত উজ্জ্বলতা প্রদান করে পরম প্রশান্তি। সকলকে নিয়ে ভেদাভেদ ভুলে খুশি থাকার, আনন্দে মেতে ওঠার অনির্বাণ আলোকশিখাই দীপাবলির প্রকৃত উদযাপন।

Skip to content