শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


নীল গুল্ম এক ধরনের উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদ এখন আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশের ট্রপিক্যাল ও টেম্পারেট অঞ্চলে পাওয়া যায়। এই গুল্মের বৈজ্ঞানিক নাম: ইন্ডিগোফেরা টিনক্টরিয়া (Indigofera tinctoria)। এরা সিম বা বিন জাতীয় উদ্ভিদ পরিবারের সদস্য, যার নাম উদ্ভিদ বিজ্ঞানের পরিভাষায়, ফ্যাবেসি (Fabaceae) পরিবার। নীল গুল্ম বা নীল উদ্ভিদ নামেও পরিচিত। ভারতে প্রায় ১২-১৫টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায়। নীল উদ্ভিদের আদিনিবাস সম্পর্কে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। এই উদ্ভিদের সঠিক জন্মস্থান সম্পর্কে প্রামাণিক তথ্যের বিশেষ অভাবও রয়েছে।
এই উদ্ভিদটি প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রে অর্থাৎ আয়ুর্বেদে ব্যবহৃত হয়। প্রধানত এর পাতা এবং নরম কাণ্ড শিলে বেটে তার নির্যাস দিয়ে আগেকার দিনে চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত করা হতো। কথিত আছে প্রাচীনকালে মৃগী রোগীদের চিকিৎসাতেও এর ব্যবহার ছিল। গবেষণা করলে নীল উদ্ভিদের ভেষজ গুণের আরও অনেক তথ্য পাওয়া যাবে।

তবে নীল উদ্ভিদের অন্যতম গুরুত্ব অবশ্যই ভারতের ইতিহাসের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আজকাল আমরা এটিকে সাধারণ গুল্ম বা বনে-জঙ্গল, আলের পাশে গজিয়ে ওঠা গুরুত্বহীন আগাছা মনে করলেও ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষত পূর্ব ভারতে এর ব্যাপক চাষ করা হতো, যা ইতিহাসে কুখ্যাত নীল চাষ নামেই অবিহিত। ভারতের দরিদ্র প্রান্তিক চাষি ও তাঁদের পরিবারের রক্তমাখা ভয়ানক ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। যে উদ্ভিদটি আজ পথের ধারে শুধু আগাছা, একদিন সে চিন ও ভারতের ইতিহাসে বিশেষ ভাবে জায়গা করে নিয়েছে।
আরও পড়ুন:

বিশ্বের সবচেয়ে বড় সরকারি সংস্থা ভারতীয় রেলই দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড

সেদিনের কোম্পানি বাগানই আজকের বোটানিক্যাল গার্ডেন

নীল উদ্ভিদ এক সময়ে অত্যন্ত সমাদৃত ছিল প্রধানত নীল রঞ্জক পদার্থের জন্য। আধুনিক পৃথিবীতে প্রাকৃতিক রঞ্জনের ব্যবহার উঠেই গিয়েছে। কৃত্রিম রাসায়নিক রঞ্জক পদার্থ আবিষ্কারের পর এখন সারা পৃথিবীতেই কেবল কৃত্রিম ভাবে তৈরি রঞ্জকই ব্যবহৃত হয়। মূলত কাপড়-চোপড় রঙিন করার প্রয়োজনে লাগে। রঞ্জক পদার্থ আবিষ্কারের আগে নীল উদ্ভিতের নীল রঞ্জকও ব্যবহার হতো কাপড় রাঙানোর জন্যই। এই ধরনের বস্ত্রের প্রচুর চাহিদা ছিল। এর দামও ছিল বেশ চড়া। ফলে ধনী বা অভিজাত পরিবারের সদস্য ছাড়া এই ধরনের বস্ত্রের ব্যবহার দারিদ্র সাধারণ বা মধ্যবিত্ত স্তরের লোকজন ভাবতেই পারতেন না। তাই স্বাভাবিক বেই বেশি মুনাফার লোভে নীল চাষের ব্যাপক প্রচলন ঘটে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, নীল উদ্ভিত খাদ্যশস্য না হওয়ায় বেশিরভাগ প্রান্তিক চাষি এই চাষে বিশেষ উদ্যোগী ছিলেন না। তাছাড়া অত্যন্ত অল্প বা বিনা লাভে বিপুল পরিমাণ দাদনের চাপে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়া চাষিরা ভয়ঙ্কর শোষণের মুখেই পড়েন। ইংরেজ ব্যবসায়ীরা অমানবিক ভাবে দরিদ্রদের নীল চাষ করতে বাধ্য করতেন। নির্দেশ না মানলে জুটত নির্মম অত্যাচার।
এছাড়াও নীল চাষের ফলে জমির উর্বরা শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি এই চাষের পদ্ধতিকেও জটিল করে তোলে। ব্রিটিশ নীলকর ব্যবসায়ীরা তাঁদের তাঁবেদার জমিদার, জোতদার এবং মহাজনদের সাহায্যে অসহায় কৃষকদে উপরে অমানবিক অত্যাচার করতে থাকে। পূর্ব ভারতের নীলকর সাহেবদের কারখানা ও অফিসগুলি নীলকুঠি নামে প্রচলিত ছিল গ্রামেগঞ্জে। এই নীলকুঠিগুলি ছিল অসহায় ও অবাধ্য কৃষক ও তাঁদের পরিবারের উপর অকথ্য অত্যাচারের কেন্দ্রস্থল। আজও পূর্ব ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ভগ্নপ্রায় নীলকুঠিগুলি সে যুগের মানুষের হাহাকারের সাক্ষী হয় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: বাজির আগুন থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখুন খুদেদের, কী কী নিয়ম মানতেই হবে জেনে নিন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৭: হারিয়ে যাওয়ার আগে এ এক বিফল মৃত—‘সঞ্জিবনী’ [০৮/০২/১৯৫২]

নীল উদ্ভিত থেকে নীল রং উৎপাদনের বিষয়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জমি থেকে নীল উদ্ভিত কেটে এনে বড় বড় জলাধারে প্রায় অর্ধেক দিন চুবিয়ে রাখলে এর থেকে সবুজ নির্যাস নির্গত হয়। এই নির্যাসকে বড় পাত্রে ঢেলে কাঠির সাহায্যে অনেক্ষণ ধরে নাড়লে সবুজ নির্যাস বাতাসের সংস্পর্শে আসে এবং বাতাস থাকা অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে নীল রং ধারণ করে। আর ভারী অংশ থিতিয়ে পড়ে। গুঁড়ো নীল রঙের তলানি ধীরে ধীরে পাত্রের নিচে জমা হয়। শুকিয়ে গিয়ে এই তলানিও চাঙড়র আকার ধারণ করে। একে ছোট ছোট টুকরোয় কাটা হয়, যা রঞ্জক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই নীল রঙের মধ্যে যে রঞ্জক পদার্থগুলি প্রধানত পাওয়া যায় সেগুলি হল, ইন্ডিগোটিন ইন্ডিগো গ্রিন ও ইন্ডিগো ব্রাউন। ব্রিটিশ নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ১৮৫৯-৬০ সাল নাগাদ নীল চাষিরা বিদ্রোহ করবেন। লাগাতার বিদ্রোহ এবং পরবর্তী সময়ে কৃত্রিম রঞ্জকের ব্যবহার শুরু হওয়ায় নীলচাষ ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়।

ছবি: সৈকতকুমার বসু

জয়ন্ত বসু, অধ্যাপক, নেতাজি নগর গার্লস কলেজ

Skip to content