রবিবার ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫


ভোর হচ্ছে অযোধ্যায়। এ ভোর প্রতিদিনের নিয়মের বাইরে যেন অন্য এক অলৌকিক ভোর। রামের কানে ভেসে আসছে সুত, মাগধ, বন্দনাকারীদের মধুর স্তুতিগাথা। সে গানের রেশ থাকতে থাকতেই শেষ হল তাঁর প্রাতঃসন্ধ্যার উপাসনা। মন সংযত, একাগ্র করে পট্টবস্ত্র পরে বসলেন মধুসূদনের উপাসনায়। উপস্থিত ব্রাহ্মণদের স্নিগ্ধ গম্ভীর স্বস্তিবচনে অযোধ্যার আকাশ যেন পূর্ণ হয়ে উঠল।

অযোধ্যাবাসীর জয়ধ্বনিতে মুখরিত দশদিশি। ভোরের আলো গায়ে মেখে সেজে উঠছে নগরী, আসন্ন উৎসবের আনন্দে সাজছে মানুষজন। মেঘশুভ্র দেবালয়ের উচ্চ শিখরে, চতুষ্পথে, বড় বড় রাজপথে, চৈত্যসমূহে, প্রাচীরের উঁচু সীমানায়, মহীরুহগুলিতে নানা বর্ণের ধ্বজা উড়ছে। নানা পণ্যদ্রব্যে সাজানো বিপণি, সমৃদ্ধ গৃহস্থের অট্টালিকাও সেজে উঠেছে পতাকার শোভায়। পথের ধারে কতই না বিনোদনের আয়োজন। অভিনেতার অভিনয়ে, নর্তকের নৃত্যে, গায়কদের গানে আনন্দের উচ্ছ্বাস গোপন থাকছে না। নগরবাসীরা প্রাণ খুলে রামের প্রশংসা করছে পথেঘাটে। বালকের দল খেলতে খেলতে সে প্রশংসা বাক্য কখন আত্মস্থ করে ফেলেছে। তারা নিজেরাও ক্রমে মেতে উঠেছে রামের স্তুতিতে।

অভিষেকের সময় এগিয়ে এল কাছে। পুরবাসীরা নিজেরাই রাজপথ সাজিয়ে দিল ফুলে ফুলে। জ্বেলে দিল সুগন্ধী ধূপ। পথের পাশে সাজিয়ে রাখল বড় বড় দীপস্তম্ভ। অভিষেকক্রিয়া শেষ হওয়ার পর রাতের অন্ধকার নেমে এলেও তাদের প্রিয় রাজকুমার রাম নিশ্চয়ই নগর পরিক্রমায় বের হবেন। প্রজারা ক্রমে ভিড় জমালো সভাগৃহে আর প্রাঙ্গণে। সে জনপ্লাবনে শত সমুদ্রের কলরোল। এমন পরিপূর্ণ আনন্দের আয়োজন, এত মানুষের প্রতীক্ষিত এই অভিষেক—
মহিষী কৈকেয়ীর প্রাসাদে শুধু এই আনন্দ-আয়োজনের সংবাদটি পৌঁছয়নি। সকাল হতেই এত মানুষের কলকোলাহল — চারপাশ গমগম করছে, লোকে লোকারণ্য রাজপথ। রাজপথে এত ফুলের সজ্জা? দিকে দিকে এত পতাকা উড়ছে? রামের মাতা কৌশল্যা খুশিমনে লোকদের ধনরত্ন দান করছেন! — কৈকেয়ী পিতৃগৃহ থেকে এসেছিল মন্থরা নামে এক পরিচারিকা।দেহে সে কুব্জা, মনে সে কুটিলা। প্রাসাদের শিখরে উঠে সেসব দৃশ্য চোখে পড়ল তার। সামনে দেখতে পেল এক ধাত্রীকে। তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল সব বৃত্তান্ত। মন্থরা শুনল সব ঘটনা। দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্র রামের রাজ্যাভিষেক! মন্থরার মনে মুহূর্তে যেন ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল। দ্রুত, অসহিষ্ণু পায়ে সে নেমে এল প্রাসাদের শিখর থেকে। কৈকেয়ীর ঘরে এসে যেন তপ্ত লাভাউগরে দিলসে।

রাজার আদরিণী রানীকৈকেয়ী তখনও নরম শয্যায়, ঘুমের রেশ কাটেনি।নিজের রূপে, নিজের সুখে আত্মবিভোর রানীর কানে পৌঁছয়নি অভিষেকের জয়বাদ্যের ধ্বনি। মন্থরার রাগ তার উপরেই আছড়ে পড়ল— “তোমার সৌভাগ্য তো দেখছি পাহাড়ী নদীর মতো অস্থির। তুমি এখনও শুয়ে সময় কাটাচ্ছ। তোমার যে চরম সর্বনাশ ঘনিয়ে আসছে, সে কি খেয়াল রাখো?”

তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন কৈকেয়ী।“কী হয়েছে মন্থরা? এত রাগ কিসের জন্য? শোকে দুঃখে পাগলপ্রায় অবস্থা কেন তোর?”— প্রশ্ন করলেন তিনি। মন্থরা সময় নষ্ট করল না।কাছে এসে বলতে শুরু করল— “দেবি, তোমার যে দারুণ বিপদ! রামকে রাজা দশরথ যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে চলেছেন। এ সংবাদ শোনার পর থেকে এত জ্বালা ধরছে মনে, যে ,মনে হচ্ছে আগুনে পুড়ে যাচ্ছি। তোমার মঙ্গলে আমার মঙ্গল রানি, তোমার দুঃখে দুঃখ। কথায় বলে, শত্রু আর সাপ — এদের উপেক্ষা করলে তারাই উল্টে অনিষ্ট ঘটায়। রাজা দশরথ তোমার ও ভরতের সঙ্গে তাই করছেন। রাজকুলে তোমার জন্ম, রাজমহিষী তুমি। তুমি রাজধর্মের এই কুটিল আবর্ত বুঝতে পারছনা কেন? তুমি সরলমতি। কিন্তু তোমার স্বামী শঠ, মিষ্টভাষী অথচ নিষ্ঠুর। তিনি প্রতারণা করছেন তোমার সঙ্গে। তিনি ভরতকে ভেবেচিন্তেই দূরে রেখেছেন। তুমি পুত্রসহ নিজেকে রক্ষা করো। এমন উপায় বের করো, যাতে রাম অভিষিক্ত হতে না পারেন।”

“ওমা! রামের অভিষেক হবে? এ তোভারি খুশির খবর!আমারকাছে এর থেকে আনন্দেরআর কিছুহয় না। — ন মে প্রিয়ং কিঞ্চিদতঃপরং ভবেৎ। আমারভরত আররামে তো কিছু পার্থক্য নেই। রাজা যা স্থির করেছেন ভালোই করেছেন” কৈকেয়ী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন। সোনার হারখানি গলা থেকে খুলে মন্থরাকে দিলেন ‘প্রীতিদান’।

ক্রোধে ফেটে পড়ল মন্থরা। ছুঁড়ে ফেলে দিল কৈকেয়ীর দেওয়া উপহার। কথার স্রোতে বেরিয়ে এল বিদ্বেষের বিষ।— “তোমারকি বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে? এমন বিপদকালে তোমার আনন্দ হচ্ছে? এরপর রাম রাজা হবে। কৌশল্যা হবে রাজমাতা। বিপুল ঐশ্বর্যৈর শিখরে বসে থাকবে সে। আর তুমি দাসীর মতো সেবা করবে তাকে। রামের স্ত্রীর তো সমৃদ্ধিতে পা পড়বে না মাটিতে।আর তোমার পুত্রবধূকে দেখবে শ্রীহীন অবস্থায় পড়ে থাকবে এককোণে।”
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৯: রাজ্যাভিষেকের অপেক্ষায় অধীর অযোধ্যাবাসী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৭: রান্নাবান্নার ঠাকুরবাড়ি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫: সে এক হতভাগ্যের ‘নষ্ট নীড়’ [২৪/০৮/১৯৫১]

সোনার মেয়ে কার্তিকা

এমন বিষজর্জরিত বাক্যরাশি! কৈকেয়ীর মন সেসব বাক্য শুনেও ভোরের আকাশের মতো নির্মল। রামের অভিষেকের সংবাদ কলুষিত করেনি তাঁর মনকে। মন্থরার অসন্তুষ্ট ভাব দেখেও রামের প্রশংসা করে চলেন তিনি — “রামইযৌবরাজ্যের উপযুক্ত এ রাজ্যে। সবাইকে সমান চোখে দেখে সে। তার মায়েদের, ভাইদের সে দেখাশোনা করবে সঠিকভাবেই। দেখ, মন্থরা, সে তার মায়ের থেকেও আমাকে সম্মান করে বেশি। আর ভরত ও রামের পরে রাজত্ব পাবে নিশ্চয়। মন্থরা, তুই এত অমঙ্গল ভাবনা করিস না।”

মন্থরা কিন্তু কোনও মঙ্গলচিন্তা করতেই পারল না। সে বলে চলল, “তুমিতো দেখছি অগাধ দুঃখের পাতালে নামতে নামতেও নিজের অবস্থা বুঝতে পারছ না। রাম রাজা হবে, তারপর তার পুত্র, তারপর তার বংশধরেরা। এভাবেই তো রাজবংশে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী স্থির হয়। রাম রাজা হলে তোমার ভরত অনাথ হয়ে সমস্ত রাজসুখ থেকে বঞ্চিত হবে। রাম হয় ভরতকে দেশান্তরে পাঠাবে না হলে প্রাণে মারবে। তুমি কি এসব চিন্তা করছ না?

আর তুমি ভরতকে অল্প বয়স থেকেই পাঠিয়ে দিয়েছ মাতুলালয়ে। কছের লোকের প্রতিই মানুষের অনুরাগ বেশি হয়। এক্ষেত্রে রাম লক্ষ্মণের প্রতি স্বভাবতই স্নেহশীল। কাজেই তারকোনো ক্ষতি রাম করবে না। কিন্তু ভরতের উপস্থিতি মেনে নেবে না রাম। তার ক্ষতি হবেই রাম রাজা হলে। ভরত বাঁচতে চাইলে বনে গিয়ে বাস করুক বরং। আর না হলে সে রাজা হোক। তুমিই বলো, তোমার আদরের ছেলে অসহায় হয়ে বনবাসী হবে, ‌এই তাহলে তোমার ইচ্ছা? তোমার তো মা হিসেবে ভরতকে রক্ষা করা উচিত। রাম আজ রাজা হলে পুত্র সহ পড়ে থাকবে অসম্মানের অন্ধকারে। এর চেয়ে নিজের সন্তানের রাজ্য লাভের ব্যবস্থা করো আর অন্যের নির্বাসনের ব্যবস্থা করো।”
কৈকেয়ী শুনছেন আর ভাবছেন। মায়ের যে সবচেয়েদুর্বল স্থান তার সন্তান। তার অমঙ্গল সম্ভাবনায় মন অস্থির হয়ে ওঠে। আর বহু পত্নীক স্বামীর পত্নীদের সবচেয়ে অসহনীয়হল সপত্নীর সমৃদ্ধি। সেখানেই আঘাত করেছে মন্থরার বাক্যবাণ। নির্মল মনে ধীরে ধীরে জমতে থাকে অবিশ্বাসের কাজলকালি। মন্থরার কুটিল যুক্তিগুলো ক্রমে মনের মধ্যে উথাল-পাথাল ঢেউ তোলে। কৈকেয়ীর মন সুন্দর কিন্তু গভীর নয়। পিতার আদরের কন্যা, রাজা দশরথের সুন্দরী, তরুণী, আদরিণী মহিষী তিনি। কোনও বিষয়কে স্থির প্রজ্ঞায় দেখার সামর্থ্য নেই তাঁর। আছে আত্মম্ভরিতা, উগ্র অসংযম। কুব্জা মন্থরার কথা ভেঙে খানখান করে দেয় তার বিশ্বাস। পুত্রসম রামের প্রতি ঘোর অবিশ্বাসের বিষবাষ্পে ঢেকে যায় তাঁর অন্তর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন্থরাকে বলেন তিনি- “তুই ঠিকই বলেছিস। আসলে তোর আমারপ্রতি গভীর ভক্তি, সে আমি জানি। তুই কি আমার অনিষ্ট চিন্তা করবি? কিন্তু কি করে আমি ভরতকে সিংহাসনে বসাবো তার তো কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছি না। রাজা দশরথের প্রাণাধিক প্রিয় জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম। তাকে ত্যাগ করে আমার ভরতকে তিনি কেন অভিষিক্ত করতে যাবেন? আর রামকেই বা কেন নির্বাসনে পাঠাবেন? এর কোনও উপায়, কোনও উত্তর আমার জানা নেই।”

এই তো চেয়েছিল মন্থরা। কুটিলকালো রাজনৈতিক জটিলতার পাঁক উঠবে ঘুলিয়ে। না কি মন্থরার বেশে দৈব অভিঘাত! নিষাদের তীর কোন অলক্ষ্য থেকে আঘাতকরল ক্রৌঞ্চের বুকে, আনন্দের পূর্ণ মুহূর্তকে ছিন্ন ভিন্ন করে— সেই বিরহবেদনায় এ কাহিনীর বীজ বপন — শোক থেকে জন্ম নিল শ্লোক। আনন্দের নিবিড় মুহূর্তে ফিরে ফিরে আসে সে অলক্ষ্য তীরের আকস্মিক অভিঘাত। এগিয়ে নিয়ে যায় ঘটনা প্রবাহকে। কবি জানেন, সংসারে আনন্দের পাত্রটি পূর্ণ হয়েও হয় না।—চলবে
*শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content