রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

বিশ্বব্যাপী গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলে বয়স্ক লোকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে আলঝেইমার-সহ ডিমনেশিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও। বিশ্বে এ জাতীয় রোগীর সংখ্যা ২০৩০ সালে দাঁড়াবে ৭ কোটি ৬০ লক্ষ। বর্তমানে ভারতে এই ধরণের রোগীর সংখ্যা ৪০ লক্ষেরও বেশি। আমাদের রাজ্যেও এই সংখ্যাটা লক্ষ ছুঁইছুঁই।
 

ডিমেনশিয়া আসলে কি?

ডিমেনশিয়া হল মূলত কিছু উপসর্গের সমষ্টি, যাতে স্মৃতিভ্রংশের সঙ্গে সঙ্গে আচরণ গত অস্বাভাবিকত্ব প্রাত্যহিক জীবনে ব্যাঘাত ঘটায়। বিভিন্ন কারণে ডিমেনশিয়া হতে পারে।
 

সব ভুলে যাওয়াই কি ডিমেনশিয়া?

একেবারেই না। বরং বেশিরভাগ ভুলে যাওয়াই বয়সজনিত কারণে। বয়সকালে মস্তিষ্কের কোষগুলি শুকিয়ে যাওয়া (cerebral atrophy) এবং তাৎক্ষণিক স্মৃতির ধারণ ক্ষমতা কমে যেতে থাকায় স্মৃতিশক্তি কমতে থাকে।
 

ডিমেনশিয়ার কি কোনও প্রকার আছে?

হ্যাঁ, ডিমেনশিয়াকে আমরা মূলত চার ভাগে ভাগ করি—
আলঝেইমার রোগভাস্কুলার ডিমেনশিয়া (রক্ত সরবরাহে স্বল্পতা বা বিঘ্নতা জনিত ডিমেনশিয়া) লিউবডি ডিমেনশিয়াফ্রন্টো-টেম্পোরাল ডিমেনশিয়া। এর মধ্যে আলঝেইমার রোগীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।
জার্মান চিকিৎসক ডাঃ এলইস আলঝেইমার ১৯০৬ সালে সর্বপ্রথম রোগটির বর্ণনা দেন।

 

অ্যালঝাইমার্স রোগের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলি কী কী?

বয়স: সাধারণত ৬৫ বছরের উর্ধ্ব।
পরিবারে আলঝেইমার রোগের ইতিহাস।
জেনেটিক কারণ: জিন ‘APOE -e4’ যেমন রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত।
যাঁদের সামান্য পরিমাণে চিন্তন শক্তির হ্রাস (Mild Cognitive Impairment) আছে।
কার্ডিওভাসকুলার রোগীদের যেমন ইস্কিমিক হার্টের রোগী।
উচ্চ রক্তচাপের রোগী।
ডায়াবেটিস রোগী।
ধূমপানাসক্তদের।
স্থুলাকায় ব্যক্তিদের।
মস্তিষ্কে আঘাত: বার বার মস্তিষ্কে আঘাত।
 

আলঝেইমার রোগের কোনও নির্দিষ্ট পরীক্ষা আছে কি?

না, কোনও নির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই। এটিকে প্রমাণ করতে গেলে মৃত্যুর পর মস্তিষ্কের অটোপসি করলে তবেই বোঝা সম্ভব। কিন্তু কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে, যেগুলো কিছুটা নির্ণয়ে সাহায্য করে (অন্য রোগের কারণগুলোকে বাদ দিতে)। যেমন: পারিবারিক ইতিহাস কমপ্লিট মেডিকেল পরীক্ষা রক্তের কিছু পরীক্ষা যেমন ভিটামিন বি১২, থাইরয়েড, সুগার ইত্যাদি কগনিটিভ (cognitive ability) পরীক্ষা, মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:

ডিমেনশিয়া ও অ্যালঝাইমার্সের ঝুঁকির মধ্যে আপনি নেই তো? সতর্ক হতে হবে গোড়াতেই/ পর্ব: ১

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫: সে এক হতভাগ্যের ‘নষ্ট নীড়’ [২৪/০৮/১৯৫১]

প্যারিস, ইউট্রেকট, আমস্টারডাম হয়ে ব্রাসেলস—স্বপ্নের ভ্রমণ ডেসটিনেশন/১

ইংলিশ টিংলিশ: One word expressions কী? জেনে নিন একঝলকে

 

রোগের লক্ষণ?

একেকজন লোকের মধ্যে একেক ধরনের লক্ষণ বেশি পরিপুষ্ট হয়ে দেখা দেয়। সবারই একই রকমের লক্ষণ দেখা যাবে এরকম কোনও কথা নেই। এই রোগের বিভিন্ন পর্যায় থাকে। যেমন প্রাথমিক পর্যায়, মধ্যবর্তী পর্যায় এবং চূড়ান্ত পর্যায়। সবাই সব পর্যায় অতিক্রম করতে নাও পারে।
প্রথম পর্যায় হল রোগের সূত্রপাত। পরিবর্তন হয় খুবই ধীরগতিতে। প্রায়ই রোগী নিজে বা বাড়ির লোকজন প্রথম দিকে বুঝতেই পারেন না যে এ রোগ শুরু হয়েছে।
 

কী কী দেখলে সতর্ক থাকবেন

একটু বেশি উদাসীন।
কোনও কিছুতেই আগ্রহবোধ না করা।
মেজাজটা প্রায় বিগড়ে যায়, খুব বেশি খিটখিটে।
একটুতে হতাশ হয়ে পড়া।
নিজেকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়া।
একই কথা বারবার বলা।
চিন্তা-ভাবনা দ্রুত করতে না পারা।
প্রতিদিনের কাজকর্ম শেষ করতে বিলম্ব।
বর্তমান ঘটনা মনে রাখতে না পারা; যেমন খাওয়ার পরেই আবার খেতে চাওয়া। কিন্তু পুরনো ঘটনা স্পষ্ট মনে করতে পারা।
টাকা-পয়সা, জিনিসপত্র হারিয়ে অন্যদের দোষ দেওয়া।
ওষুধপত্র নিয়মমতো খেতে ভুলে যাওয়া।
পরিবারের সদস্যদের এবং বন্ধুদের নাম মনে করতে বা চিনতে না পারা।
নিজের বাড়ি চিনতে না পারা।
বিনা কারণে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া।
স্নান বা পরিষ্কার থাকতে, পোশাক পরিচ্ছদে অনীহা।
পর্যায় ক্রমে আক্রমাণাত্মক ও অসংযত হয়ে পড়েন প্রায় সময়ই। শেষ পর্যায়ে এক কথায় বাস্তব পৃথিবীর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৯: রাজ্যাভিষেকের অপেক্ষায় অধীর অযোধ্যাবাসী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৭: রান্নাবান্নার ঠাকুরবাড়ি

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৭: পুষ্কররাজাকে পরাস্ত করে রাজ্য ফিরে পেলেন নলরাজা

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩২: দেশে প্রথম গবেষণা সংস্থার কারিগরি সহায়তায় বেড়ে ওঠা সেরা প্রাপ্তি ‘জয়ন্তী রুই’ মাছ

 

কী করলে স্মৃতিভ্রংশকে এড়ানো যেতে পারে?

মস্তিষ্ককে সচল রাখা যায় এমন ক্রিয়া কর্মে নিজেকে যুক্ত রাখতে পারলে যেমন লেখালেখি, আঁকা, ক্রস ওয়ার্ড করা, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্ক, সামাজিক কাজকর্মে নিজেকে যুক্ত করা ইত্যাদি বয়স জনিত স্মৃতিভ্রংশকে রোধ করতে সহায়ক হতে পারে।
 

এ রোগের চিকিৎসা কী?

সঠিক অর্থে এই রোগের কোনও চিকিৎসা বা ওষুধ নেই। যে দু’ প্রকার ওষুধ (কোলিনএস্টারেজ ইনহিবিটর আর মেমানটিন) চিকিৎসকেরা দিয়ে থাকেন তা কোনও ভাবেই রোগকে সারাতে পারে না বা ক্রমাবনতিকে আটকাতে পারে না। শুধু এই রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত উপসর্গগুলোর তীব্রতাকে কিছুটা কমিয়ে রোগীকে উপশম দিতে পারে।

 

অ্যালঝাইমার্স রোগী যত্ন কীভাবে নেবেন?

পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এই রোগীর সেবা করবেন। অ্যালঝাইমার্স রোগীর সেবা প্রদান একটি চ্যালেঞ্জ। অনেক ক্ষেত্রেই খুবই কঠিন, ক্লান্তিকর এবং বিরক্তিকরও হতে পারে। তাই সেবাদানকারী ব্যক্তিকে ধৈর্যশীল-সহনশীল-সংবেদনশীল এবং কৌশলী হতে হবে। অ্যালঝাইমার্স আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য দরকার সযত্ন সেবা, অকৃত্রিম ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং সহমর্মীবোধ। সেবাযত্নের জন্য দরকার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রশিক্ষিত সেবাকর্মীর সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাকর্মী গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ ভীষণ আবশ্যিক।

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

লেখক: কর্ণধার ‘বাঁচবো’, সহ সম্পাদক জেরিয়াট্রিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া, পশ্চিমবঙ্গ শাখা৷ উপদেষ্টা, প্রোটেক্ট দ্যা ওয়ারিয়ার্স। যোগাযোগ : ‘বাঁচবো’, ফোন : ৯৯০৩৩৮৮৫৫৬


Skip to content