প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর সম্পাদনায় প্রকাশিত 'পুণ্য' পত্রিকা।
বাঙালির ভোজন-রসিকতা সর্বজনবিদিত। খেয়ে ফতুর হতে মোটেই পিছপা নয়। মাছে ভাতের বাঙালি এখন সর্বভুক। ভিনদেশি খাবারে অবশ্য পক্ষপাতিত্ব, নিজস্ব দেশি খাবার খুঁজতে, মোচা বা থোড়ের ঘন্ট খেতে এখন যেতে হয় বিশেষ বিশেষ রেস্তোরাঁয়। ব্যস্ততার যুগে ভোজন-রসিকতার প্রমাণ প্রতিদিন হয়তো দেওয়া যায় না, রসিয়ে প্রতিদিন খাওয়া হয় কই, কিন্তু সুযোগ পেলেই চলে সদ্ব্যবহার। রসনা-পরিতৃপ্তির জন্য নিঃস্ব হতেও বাঙালি বোধহয় রাজি আছে।
আজকের ব্যস্ত-জীবনে রসনা-পরিতৃপ্তির বৈচিত্র্যে হয়তো বা খানিক ভাটা পড়েছে। একসময় বাঙালির জীবনের সঙ্গে ব্যঞ্জন-বৈচিত্র্য জড়িয়ে ছিল। পঞ্চব্যঞ্জন ছাড়া মাটিতে আসন পেতে কাঁসার থালা- গ্লাসে ক’জনই বা ভোজনে বসতেন? সন্তানাদি সামলেও হাতে বাড়তি সময় থাকত, সেই সময়টুকু বাড়ির মেয়ে-বউরা মন দিতেন রকমারি রান্নায়। ঘরকন্যা ও রান্নাবান্না চলত সমানতালে।
আজকের ব্যস্ত-জীবনে রসনা-পরিতৃপ্তির বৈচিত্র্যে হয়তো বা খানিক ভাটা পড়েছে। একসময় বাঙালির জীবনের সঙ্গে ব্যঞ্জন-বৈচিত্র্য জড়িয়ে ছিল। পঞ্চব্যঞ্জন ছাড়া মাটিতে আসন পেতে কাঁসার থালা- গ্লাসে ক’জনই বা ভোজনে বসতেন? সন্তানাদি সামলেও হাতে বাড়তি সময় থাকত, সেই সময়টুকু বাড়ির মেয়ে-বউরা মন দিতেন রকমারি রান্নায়। ঘরকন্যা ও রান্নাবান্না চলত সমানতালে।
সুনৃতা দেবী।
ঠাকুরবাড়িতেও রন্ধন-প্রণালী নিয়ে কত না পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে! রসনা-পরিতৃপ্তির সে-আয়োজন ছিল কৌতূহলোদ্দীপক। রবীন্দ্রনাথের সেজদা হেমেন্দ্রনাথ কাথ্রাঁ নামে এক পাচক নিযুক্ত করেছিলেন। ফরাসিভাষি এই মানুষটি পাচক হিসেবে যথেষ্ট সম্ভ্রান্ত ছিলেন। তার জন্য ত্রিশ টাকা মাসমাইনে বেতন বরাদ্দ ছিল। তখনকার দিনে টাকার এই পরিমাণটা খুব কম নয়। সেই পাচকমহাশয় হেমেন্দ্রনাথকে বিবিধ-বিচিত্র রান্না করে খাওয়াতেন। হ্যাঁ, ফরাসি রান্না, সেই সঙ্গে সঙ্গে হেমেন্দ্রনাথকে ফরাসি ভাষাও শেখাতেন। হেমেন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়ে একবার সপরিবারে শান্তিনিকেতনেও গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কাথ্রাঁ সম্পর্কে কী বলেছিলেন, তা অবশ্য জানা যায়নি। সে- যাত্রায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথও সঙ্গে গিয়েছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’তে আছে এ তথ্য। তিনি জানিয়েছেন, ‘আমাদের বিলাতি খানা খাইবার ইচ্ছা হইলে সেই রাঁধিত। সে অল্প খরচে নানাবিধ সুখাদ্য ডিশ প্রস্তুত করিতে পারিত।… কাথ্রাঁ বাস্তবিক রন্ধনে সিদ্ধহস্ত ছিল।’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথই জানিয়েছেন, শুধু ফরাসি সুস্বাদু খাদ্য নয়, ‘শাক-সবজির নিরামিষ ডিশ’ও অতি সুন্দর করে কাঁথ্রা রাঁধত।
রবীন্দ্রনাথের ভোজনবিলাসের কথা অল্পবিস্তার আমাদের জানা। কবির মাথায় নিত্যনতুন রেসিপির ‘আইডিয়া’ আসত। রান্না নিয়ে কবি-কল্পিত নতুনতর রেসিপি বাস্তবায়িত করতেন পত্নী মৃণালিনী। এ ব্যাপারে তাঁর নিষ্ঠার অভাব ছিল না। মৃণালিনী তৈরি করতেন চিঁড়ের পুলি, দইয়ের মালপো, পাকা আমের রকমারি মিঠাই। পত্নীর এই রন্ধন-কুশলতাই কবিকে নতুনতর ব্যঞ্জন-পরিকল্পনায় প্রাণিত করেছিল। তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন, মৃণালিনীর হাতের গুণে যে কোনও পদই মুখরোচক হয়ে উঠবে। ভোজন-রসিক স্বামীকে খুশি করার জন্য মৃণালিনী দেবীর চেষ্টার অন্ত ছিল না। নানাভাবে চেষ্টা করতেন। শিলাইদহে থাকাকালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের পত্নী অমলা দাসের কাছে ‘ঢাকাই রান্না’ শিখে কবিকে খাওয়াতেন তিনি।
ঠাকুরবাড়ির বধূ ও কন্যারা অনেকেই রান্না নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। নতুনতর ব্যঞ্জন উদ্ভাবন করেছেন। এই প্রসঙ্গে যিনি ফরাসি পাচক রেখে বিলেতি খানা খেতেন, সেই হেমেন্দ্রনাথের এক গুণবতী কন্যার কথা বলতেই হয়। তিনি প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। ঠাকুরবাড়ি থেকে একসময় ‘পুণ্য’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এ পত্রিকাটি ঘিরে হেমেন্দ্রনাথের পুত্র-কন্যারা সাহিত্যমুখী হয়ে উঠেছিলেন। পত্রিকাটি দীর্ঘজীবী হয়নি। বছর পাঁচেকের জীবনকালে এমন সব রচনা বক্ষে ধারণ করেছিল, বিষয় বৈচিত্র্যে নিজেকে সাজিয়ে তুলেছিল, সত্যিই তা ভোলার নয়।
ঠাকুরবাড়ির বধূ ও কন্যারা অনেকেই রান্না নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। নতুনতর ব্যঞ্জন উদ্ভাবন করেছেন। এই প্রসঙ্গে যিনি ফরাসি পাচক রেখে বিলেতি খানা খেতেন, সেই হেমেন্দ্রনাথের এক গুণবতী কন্যার কথা বলতেই হয়। তিনি প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। ঠাকুরবাড়ি থেকে একসময় ‘পুণ্য’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এ পত্রিকাটি ঘিরে হেমেন্দ্রনাথের পুত্র-কন্যারা সাহিত্যমুখী হয়ে উঠেছিলেন। পত্রিকাটি দীর্ঘজীবী হয়নি। বছর পাঁচেকের জীবনকালে এমন সব রচনা বক্ষে ধারণ করেছিল, বিষয় বৈচিত্র্যে নিজেকে সাজিয়ে তুলেছিল, সত্যিই তা ভোলার নয়।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৬: শারদীয় সংখ্যায় লিখে পাওয়া অর্থ বন্যাপীড়িত মানুষের কল্যাণে
শারদীয়ার গল্প-৬: পর্সতার
ছোটদের যত্নে: কোন সময় গর্ভধারণ করলে সুসন্তান লাভ সম্ভব? নব দম্পতির মা হওয়ার আগের প্রস্তুতির পরামর্শে ডাক্তারবাবু
ইংলিশ টিংলিশ: One word expressions কী? জেনে নিন একঝলকে
প্রজ্ঞাসুন্দরী ভালো লিখতেন, নাটক করতেন। ‘মায়ার খেলা’তে অভিনয় করে তিনি নজর কেড়ে ছিলেন। তাঁর বিবাহ হয় অসমীয়া সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়ার সঙ্গে। ঠাকুরবাড়ির সেই প্রথম আন্তঃপ্রাদেশিক বিবাহ। তাঁর বিবাহোত্তর জীবনে স্বামীর প্রেরণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। প্রজ্ঞাসুন্দরী সুন্দর রান্না করতেন। সেই রন্ধন-পটুত্ব নিজের রন্ধনশালায় সীমাবদ্ধ রাখেননি, ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ভোজনরসিকজনের ঘরে ঘরে। নিতান্তই রেসিপি লেখেননি, তাঁর হাতে রন্ধনপ্রণালী প্রায়- সাহিত্য হয়ে উঠেছে। এভাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলা ভাষায় কেউ রন্ধনসাহিত্য রচনা করেননি।
‘পুণ্য’ পত্রিকার পৃষ্ঠায় নিয়মিত ছাপা হত রন্ধন-রচনা। অধিকাংশই প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর লেখা। এমন সব ব্যঞ্জনের কথা লিখতেন তিনি, যা পড়ে প্রথমে অবাকই হতে হতো। বিস্ময়ের ঘোরে হয়তো-বা শোনা যেত স্বগতোক্তি, এও সম্ভব! সেই ঘোর কেটে যাওয়ার পর ব্যঞ্জন প্রস্তুতে মনোনিবেশ করলে অচিরেই ভালো লাগায় মন ভরে উঠত। পরিতৃপ্ত হতো রসনা।
‘পুণ্য’ পত্রিকার পৃষ্ঠায় নিয়মিত ছাপা হত রন্ধন-রচনা। অধিকাংশই প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর লেখা। এমন সব ব্যঞ্জনের কথা লিখতেন তিনি, যা পড়ে প্রথমে অবাকই হতে হতো। বিস্ময়ের ঘোরে হয়তো-বা শোনা যেত স্বগতোক্তি, এও সম্ভব! সেই ঘোর কেটে যাওয়ার পর ব্যঞ্জন প্রস্তুতে মনোনিবেশ করলে অচিরেই ভালো লাগায় মন ভরে উঠত। পরিতৃপ্ত হতো রসনা।
সুদক্ষিণা দেবী ।
প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী ‘পুণ্য’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় লিখেছিলেন ‘বাগদা চিংড়ির কাটলেট’ ও ‘মেটের দোপেয়াজা’ নিয়ে। পরের সংখ্যাতে ছিল ‘রামমোহন পোলাও’ নামে এক নিরামিষ পদ। ব্যঞ্জন-নামের সঙ্গে কেন রামমোহনের নাম যুক্ত হয়েছে, সে কৈফিয়ৎ পাদটিকায় আছে। প্রজ্ঞাসুন্দরী লিখেছেন, ‘এই উৎকৃষ্ট পোলাওটি আমাদের দ্বারা উদ্ভাবিত। ইহা আমরা মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের নামে উৎসর্গ করিয়া ইহার নাম ‘রামমোহন পোলাও’ রাখিলাম।’ শুধু রামমোহনের নামে নয়, বিদ্যাসাগরের নামেও ব্যঞ্জন তৈরি করেছিলেন প্রজ্ঞাসুন্দরী। দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম ও দ্বিতীয় যুগ্ম সংখ্যায় বর্ণিত হয়েছিল ‘বিদ্যাসাগর বরফি’ নামে এক মিঠাইয়ের কথা। এমন নামকরণ কেন, সে প্রসঙ্গে প্রজ্ঞাসুন্দরী জানিয়েছেন, ‘প্রাতঃস্মরণীয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নামে উৎসর্গ করিয়া ইহার নাম বিদ্যাসাগর বরফি রাখিয়াছি।’ এমনতর নামকরণ মধ্য দিয়ে উচ্চতার শিখরস্পর্শী মানুষটিকে নতুন করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা যায় কিনা, সে প্রশ্ন তো রয়েই যায়! আপাতত সে প্রশ্ন মুলতবি রেখে আমরা ওই পোলাও ও বরফি কতখানি উপাদেয় হয়ে উঠত, সে কল্পনায় বুঁদ হতে পারি।
ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
‘পুণ্য’-র পাতায় প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী কত বিচিত্র সব ব্যঞ্জন নিয়ে লিখেছেন। রুইমাছের ঘন্ট, হিন্দুস্থানি কোপ্তা, তালের সন্দেশ, কাসুন্দি মাছ, দুধের হালুয়া, দুধ-কমলা, মাংসের বিরিঞ্চি, চিঁড়ের পিঠে, কাঁচা আম দিয়ে মাটনকারি, ইলিশ মাছের উল্লাস, জয়পুরি কোরমা, বাগদা চিংড়ি ও তোপসে মাছের দোমাছা কারি — এমন সব ব্যঞ্জন, নামই কখনও শোনা হয়নি অধিকাংশজনের। প্রথমবার শুনে, ‘পুণ্য’-র পাতায় রন্ধন-কৌশল পড়ে আমরা আমোদিত হই। অত্যুৎসাহী কেউ যদি রন্ধন-ব্যবস্থা করেন, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই! প্রজ্ঞাসুন্দরী শুধুমাত্র চোখা দারুণ-দারুণ খাবারের কথা লিখেছেন, রন্ধন-কৌশল শিখিয়েছেন তা নয়, অনেক সাদামাঠা পদের কথাও লিখেছেন। ডিমের আমলেট, আদার চাটনি, এমনকি কচুপোড়া শিরোনামেও ‘পুণ্য’-র পাতায় তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে। প্রজ্ঞাসুন্দরী আমিষ পদের পাশাপাশি নিরামিষ পদের কথাও লিখেছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিচক্ষণতা কতদূর বিস্তৃত ছিল, তা তাঁর স্বীকারোক্তি থেকেই জানা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘পোলাও মাংসেরই উপকরণে প্রধানত প্রস্তুত হইয়া থাকে, কিন্তু যত্ন ও চেষ্টার ফলে আমরা উপরোক্ত পলান্নটিকে সম্পূর্ণ আমিষ বিবর্জিত এবং আমিষ পলান্ন অপেক্ষা অনেকাংশে উৎকৃষ্ট করিতে কৃতকার্য হইয়াছি।’
প্রজ্ঞাসুন্দরী একটি খাদ্যের নাম দিয়েছিলেন ‘সুরভি’। সুরভি আর কেউ নয়, তার অকাল প্রয়াত কন্যা। এই খাদ্যদ্রব্যটি কীভাবে তৈরি করতে হবে, তা বিশদে জানিয় পাদটিকায় তিনি যা লিখেছেন, তা আমাদেরও মন খারাপের কারণ হয়ে ওঠে। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী জানিয়েছেন, ‘সুরভি বরাবর বলিত, ‘মা ছানার মেঠাই হয় না? সে যখন এই কথা বলিত আমার বরাবর মনে হইত একদিন করিয়া দেখলে হয়। এতদিন পরে করিয়া দেখিলাম ছানা দিয়ে করিলে মেঠাই বেশ হয়। কিন্তু এখন তো আর সে ইহজগতে নাই। তাকে তো আর খাওয়াইতে পারিলাম না। এই মেঠাইয়ের নাম আমার কন্যার নামে সুরভি রাখিলাম।’
প্রজ্ঞাসুন্দরী একটি খাদ্যের নাম দিয়েছিলেন ‘সুরভি’। সুরভি আর কেউ নয়, তার অকাল প্রয়াত কন্যা। এই খাদ্যদ্রব্যটি কীভাবে তৈরি করতে হবে, তা বিশদে জানিয় পাদটিকায় তিনি যা লিখেছেন, তা আমাদেরও মন খারাপের কারণ হয়ে ওঠে। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী জানিয়েছেন, ‘সুরভি বরাবর বলিত, ‘মা ছানার মেঠাই হয় না? সে যখন এই কথা বলিত আমার বরাবর মনে হইত একদিন করিয়া দেখলে হয়। এতদিন পরে করিয়া দেখিলাম ছানা দিয়ে করিলে মেঠাই বেশ হয়। কিন্তু এখন তো আর সে ইহজগতে নাই। তাকে তো আর খাওয়াইতে পারিলাম না। এই মেঠাইয়ের নাম আমার কন্যার নামে সুরভি রাখিলাম।’
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪: কবে আসবে তুমি মননের সে ‘সহযাত্রী’? [০৯/০৩/১৯৫১]
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৯: রাজ্যাভিষেকের অপেক্ষায় অধীর অযোধ্যাবাসী
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩২: দেশে প্রথম গবেষণা সংস্থার কারিগরি সহায়তায় বেড়ে ওঠা সেরা প্রাপ্তি ‘জয়ন্তী রুই’ মাছ
৫ ব্যায়ামে থাইরয়েডের সমস্যার সহজ সমাধান
‘পুণ্য’ পত্রিকায় রান্না নিয়ে সুদক্ষিণা দেবী ও সুনৃতা দেবীও লিখেছিলেন। তাঁরা হেমেন্দ্রনাথেরই কন্যা। সুদক্ষিণার বিবাহ হয়েছিল উত্তরপ্রদেশে জ্বালাপ্রসাদ পাণ্ডের সঙ্গে। স্বামীর মৃত্যুর পর ঘোড়া ছুটিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের তিনি ঘুরে জমিদারি দেখাশোনা করতেন। ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘মহারানি’-র খেতাব দিয়েছিলেন। সুদক্ষিণা চমৎকার রান্না করতেন। আমের লখনউ মোরব্বা ও ডিমের লখনউ হালুয়ার মতো কৌতূহল জাগানিয়া খাদ্য-প্রস্তুতের পদ্ধতি জানিয়েছিলেন তিনি। সুনৃতা দেবী পাকা তেঁতুলের আচার বা কাঁচা আমের আচারের মতো লোভনীয় মুখোরোচক খাবার নিয়ে লিখেছিলেন। তাঁর আগ্রহ ব্যঞ্জন প্রস্তুতে নয়, যত আগ্রহ তা ছিল আচার তৈরিতে। হেমেন্দ্রনাথের পুত্র ঋতেন্দ্রনাথও রন্ধন বিষয়ক লেখা ‘পুণ্য’ পত্রিকায় লিখেছিলেন। রন্ধন-প্রক্রিয়ায় নারীর একচ্ছত্র অধিকার থাকবে কেন, পুরুষও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে, এমন ভেবে আমরা পুলকিত হতে পারি। তাঁর একটি রচনার শিরোনাম ছিল ‘লুচি ও তরকারি’ কি প্রজ্ঞাসুন্দরী, কি তাঁর ভগিনী- ভ্রাতারা রন্ধন নিয়ে যে যখন লিখেছেন, তা-ই সরসতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ঋতেন্দ্রনাথ লেখায় রসিকতা তীব্র, পড়তে পড়তে পাঠক হাসবেন। সেই হাসি ব্যঞ্জন প্রস্তুতের পর খাওয়ার সময়ও রয়ে যাবে। ঋতেন্দ্রনাথের লেখায় আছে, ‘লুচি যখন পাত্রমধ্যে বিরাজ করে তখন তরকারি বিহীন হইয়া শোভমান হয় না। লুচি যেন পুরুষ, তরকারি যেন স্ত্রী।’ এমন উক্তি শুনে সত্যি না হেসে পারা যায় না। ঠাকুরবাড়ির অনেক সদস্য-সদস্যার রকমারি খাদ্য তৈরিতে যেমন উৎসাহ ছিল, তেমনই সেই প্রস্তুত খাদ্যের কথা বৃহত্তর মানুষ জানুক, তাদের রসনা পরিতৃপ্ত হোক, চেয়েছিলেন তাঁরা। ‘পুণ্য’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ‘কচুর মালপো’ তৈরির রেসিপিও। সরসতায় সে-মালপো নিশ্চয়ই ভরপুর ছিল। নিজের শুধু রসনা পরিতৃপ্তি নয়, ঠাকুরবাড়ি অন্যের রসনা- পরিতৃপ্তিরও সহায়ক হয়ে উঠেছিল।
ছবি সৌজন্যে: লেখক
ছবি সৌজন্যে: লেখক
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।