শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অমলকান্তি বন্ধু খুঁজে বেড়ায়। (চিত্রকলা: সংগৃহীত)

 

ভাগ- ৮

(আলো জ্বলে সুধীন্দ্রের দামী চেয়ার রাখা অফিস অংশে)


সুধীন্দ্র (মোবাইলে): হ্যাঁ শুনছো! ছেলে স্টেটস থেকে মেল করেছে – ভালো আছে – আমি লিখেছি রাতে স্কাইপে আসতে। (অমলকান্তি ঢোকে) এ কী! আপনি কে? (মোবাইলে) আমি পরে কথা বলছি! আপনি কে?

অমলকান্তি: তোমার স্কুলের বন্ধু। আমি অমলকান্তি।

সুধীন্দ্র: অমলকান্তি?! নাঃ আমার ওই নামে উঁহু কোন বন্ধু ছিল না! কস্মিন কালেও না!

অমলকান্তি: একটু বসতে পারি?

সুধীন্দ্র: (অনিচ্ছা চেপে উদ্ধত ইশারায় বসতে বলে) তা এখানে কি মনে করে?

অমলকান্তি: আজকের দুনিয়ায় তোমরা কেউ কারও কাছে দরকার ছাড়া যাও না! ঠিক কিনা? এমনিই তোমার কথা খুব মনে হচ্ছিল তাই চলে এলাম বললে তোমরা নিশ্চিত ভাববে – এর ধান্দাটা কী? তাই না! সুধীন্দ্র বোস!! তোমার ছেলে তো বিদেশে আছে?

সুধীন্দ্র: সেটা তো ফোনে আমার কথা শুনে যে কেউ বলে দেবে। ওটা কোন এভিডেন্স নাকি?

অমলকান্তি: এভিডেন্সই কি সব কিছু? বন্ধুত্ব সম্পর্ক ভালোবাসা খুশি মন খারাপের এভিডেন্স হয় নাকি? মানুষের জীবনটাকে দলিলের ছাপে প্রমাণ করাটা শক্ত। (আডভোকেট পৃথ্বীশ সেনগুপ্ত – ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি হঠাৎ ঢোকে- তাকে দেখে অমল কান্তি বলে) তবে অ্যাডভোকেট পৃথ্বীশ সেনগুপ্ত হয়তো পারেন!

পৃথ্বীশ (উদ্ধত): হু ইস হি!

সুধীন্দ্র: অমলকান্তি! বলছে আমাদের সঙ্গে পড়তো। কিন্তু আমি তো।

পৃথ্বীশ (উদ্ধত): পয়সাকড়ি দিসনি তো?

সুধীন্দ্র (লজ্জিত): আরে নানা – সে সব কিছু।

পৃথ্বীশ (উদ্ধত): কলকাতা শহর ফ্রডে ভরে গিয়েছে- (টুস্কী দিয়ে) হেই ইউ! আপনাকে বলছি –জাস্ট গেট আউট!!

সুধীন্দ্র (লজ্জিত): পৃথ্বীশ প্লিজ! আমার কথা শোন!

পৃথ্বীশ (উদ্ধত): তোর ভালোমানুষী দিয়ে হবে না- এদের আমি চিনি! আমি জাস্ট না এ সে পড়লে তোর অনেক টাকা চোট হতো। বাইরে বাইরে!

নাট্যকথা: রোদ্দুর ও অমলকান্তি— মুখবন্ধ ও চরিত্র বিন্যাস

অমলকান্তি: ধাক্কাধাক্কি করো না- আমি চলে যাচ্ছি- আসলে আমার মতো সাধারণ মানুষের সঙ্গে তোমাদের মতো কৃতীরা পড়তে তো খুব গর্ব হয়। দেখো এক ধাক্কায় আজ দুজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো।

পৃথ্বীশ (উদ্ধত): ওসব সেন্টিমেন্টে পৃথ্বীশ সেনগুপ্ত টলে না বুঝেছেন ! বাইরে!
আলো নেভে। মঞ্চ অন্ধকার
 

ভাগ- ৯

আবহে নার্সের কণ্ঠ: আসুন –ডাক্তার বাবু ডাকছেন- সাবধানে। চোখে অ্যাট্রোপিন দেওয়া আছে!! আমার হাতটা ধরুন।

আলো জ্বলে – একটা সবুজ পর্দার সামনে একা অমল কান্তি বসে – ডাক্তারের কথা শুরু হলে কালোচশমাটা পরে নেয়।

ডাক্তার (আবহ): দেখলাম।খুব একটা ইম্প্রুভমেণ্ট না হলেও ডেটোরিয়েট করেনি! আসলে আপনি একটানা অনেক বছর ম্যানুয়াল প্রিন্টিং প্রেসে কম্পোসিটার এর কাজ করেছেন তো। মনে হয়…

অমলকান্তি: হতে পারে চোখে খুব লাগতো – আর ওই প্রেসের কালিটার ঝাঁজটায় চোখ জ্বালা করতো।

ডাক্তার: হ্যাঁ, হতে পারে eye irritant কিছু থাকে ওই কালিতে।একেবারে ইনিসিয়াল স্টেজে যখন মাথা যন্ত্রণা করতো চোখে আবছা দেখতেন –তখন যদি।

অমলকান্তি: দেখিয়েছিলাম তো। চশমার পাওয়ার বদলে দিল।

ডাক্তার (আবহ): নানা মানে তখন স্পেশালিস্ট দেখালে।

অমলকান্তি: আমাদের মতো লোকের পক্ষে কি ঘন ঘন স্পেশালিস্ট দেখানো সম্ভব? বরাত জোরে আপনি আই ক্যাম্পে এসেছিলেন তারপর এখানে নিখরচায় চিকিৎসার বন্দোব্যস্ত করে দিলেন!! আচ্ছা আবার দেখতে পাবো? খোলাখুলি বলুন! আমার সাতকুলে কেউ নেই! কষ্ট যা হওয়ার তা আমারই হবে। বলুন না ডাক্তারবাবু আমার চোখ সারবে কোনওদিনও।

ডাক্তার (আবহ): আপনি একথা বললে তো আমি কনফিডেন্স পাব না! আচ্ছা আপনি কি ফিল করছেন আমায়?!

মঞ্চের আলো বাড়তে বাড়তে যেন ঝলসে উঠে অন্ধকার হয়ে যায়। তারপর অল্প আলোর রেখায় ডাক্তারকে সাদা আপ্রণ পরে বসে থাকতে দেখা যায় – অমল কান্তি এখন দর্শকের দিকে পিছন ফিরে বসে– তাকে সিল্যুয়েটের মতো দেখায়। হালকা আলোয় দর্শকের মুখোমুখি বসে থাকা ডাক্তার অস্পষ্ট।

অমলকান্তি: হ্যাঁ, মানে আমি তো জন্মান্ধ নই! তাই আওয়াজটা শুনে আপনি কতটা দুরে বা গলাটা শুনে আপনার চেহারাটা আন্দাজ করছি!
আরও পড়ুন:

নাট্যকথা: রোদ্দুর ও অমলকান্তি/৫

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪: কবে আসবে তুমি মননের সে ‘সহযাত্রী’? [০৯/০৩/১৯৫১]

পুজোর ছুটিতে সপরিবারে ঘুরতে যাচ্ছেন? কোন কোন বিষয় মাথায় রাখবেন? রইল ডাক্তারবাবুর জরুরি পরামর্শ

শারদীয়ার গল্প-৫: ধান চোর ইঁদুর

ডাক্তার: গলা শুনে চেহারা আন্দাজ করা যায়?!

অমলকান্তি: আপনার বয়স অল্প। তাই আপনি জানেন না যে বছর ৩০-৪০ আগে যুবক-কিশোরবেলায় আমরা রেডিও নাটকে গলা শুনেই তো চেহারার আন্দাজ করতাম! তবে হ্যাঁ, আজ আপনি সেদিনের সেই পারফিউমটা।

ডাক্তার: এক্সেলেন্ট! আপনার সেন্সারি নার্ভ পুরোপুরি কাজ করছে। আপনি অন্ধ হননি। আমি আগে বলেছি আপনার রোগটা অপ্টিক নিউরিটিস –আপনার ডায়াবিটিস আছে ভিটামিন বি-টুয়েলভ ডেফিসিয়েন্সি আছে। আপনার চোখের রেটিনা থেকে যে অপ্টিক নার্ভ ব্রেনের অসিপিটাল কর্টেক্স-এ ভিসুয়াল ইনফর্মেশন নিয়ে যায় সেটা ড্যামেজ় হয়েছে – সেন্স যাচ্ছে না। ড্যামেজটা আঘাতজনিত হতে পারে –ব্লাড ক্লট হতে পারে – কারও কারও এমন ব্ল্যাক আউট হয় আবার দৃষ্টি ফিরে আসে। চিকিৎসা চলছে। আপনার দৃষ্টিও ফিরবে! হতাশ হবেন না!

অমলকান্তি: নানা আমি হতাশ নই! আমি একা একা এই অন্ধকারটা উপভোগ করি। যুবক বয়সে খুব সিনেমা দেখতাম – সত্যজিৎ আমার প্রিয় পরিচালক- তপন সিনহার ছবিও দেখতাম। আর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা পড়তাম। তাদের নিয়েই এখন সম্ভব অসম্ভবকে মিলিয়ে দিয়ে একা একা আমার ভাবনায় সময় কাটাই। আর দৃষ্টি ফিরে পাবার অপেক্ষা করি। আসলে আপনাকে দেখার খুব ইচ্ছে করে! এইযুগে আপনার মতো এক যুবক ডাক্তার – আমার মতো এক অকিঞ্চিৎকর সাধারণ রোগীকে সারিয়ে তুলতে লড়াই চালাচ্ছেন আর আমার খুব রোদ্দুর দেখতে ইচ্ছে করে – জানলা গলে ঘুপচি বস্তিতে ঢুকে পড়া ভোরের নরম রোদ্দুর! খোলা মাঠ আলো করা বিকেলের কমলা রোদ। (আলো নেভে)

অমলকান্তি আমাদের অন্তর্দৃষ্টি। (চিত্রকলা:সংগৃহীত)

 

ভাগ- ১০

আবছা মায়াবী আলোয় দেখা যায় আগে দেখা সব কটি পুরুষ নারী চরিত্রেরা নিজের নিজের আসনে –সোমনাথ-বাণী চা-দোকানের
বেঞ্চে –নীতা পিঁড়ে বসে। সকলেই চটি কবিতার বই হাতে –নিজের মতো করে সকলেই অমলকান্তি কবিতাটি পড়ছে – কোরাস নয়। একের থেকে অন্যের গলায় চলে যায় কবিতার অংশ শোনায়

লেখক (ব্যালকনিতে): অমলকান্তি আমার বন্ধু
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম। রোজ দেরি করে ক্লাসে আসত, পড়া পারত না।

শ্যামলেন্দু (পার্কে): শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে,
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকত যে, দেখে ভারি কষ্ট হত আমাদের।

প্রশান্ত (নার্সিং হোমে): আমরা কেউ মাস্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।

নীতা (পিঁড়িতে): অমলকান্তি সে সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!

বাণী (বেঞ্চে): ক্ষান্তবর্ষণ কাকডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর।

সোমনাথ (বেঞ্চে): জাম আর জামরুলের পাতায়,
যা নাকি অল্প একটু হাসির মতো লেগে থাকে।

পৃথ্বীশ (অফিসে):আমরা কেউ মাস্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।

সুধীন্দ্র (অফিসে): অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।

লেখক (ব্যালকনিতে): সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, চা খায়, এটা ওটা গল্প করে, তারপর বলে ‘উঠি তাহলে’। আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

আরও পড়ুন:

অস্ট্রিয়ার ক্রিস্টাল দুনিয়া— সোয়ার্ভস্কি

শারদীয়ার গল্প-৪: অস্মর্তব্য

শারদীয়ার গল্প-৩: আলোকসংশ্লেষ

অকালে বুড়িয়ে যাচ্ছে ত্বক? তারুণ্য ধরে রাখতে মেনে চলুন এই নিয়মগুলি

চরিত্রদের ওপর আলো কমে আসে অল্প আলো আসে অমলকান্তির ঘরের অংশে- অমলকান্তি গায়ের আলোয়ান দিয়ে হাতল ভাঙ্গা চেয়ারে কালো চশমা পরে বসে- তার ঘরের আবহ – অমলকান্তি ঘরে একা –আবহে রেণুর কন্ঠস্বর

অমলকান্তি: কে? রেণুদি! বেলা হয়ে গিয়েছে!

রেণুদির গলা: হ্যাঁ! – জানলা খুলে দিই!

অমলকান্তি: হ্যাঁ! আজ বেশ ঝকঝকে রোদ উঠেছে না?

রেণুদির গলা: হ্যাঁ! বসুন আমি চা আনছি।

অমলকান্তি: পুরোটা খুলে দিন। ঘরে রোদ আসুক- সেই রোদ ছুঁয়ে যাক আমার শরীর আমার মন।

আলো বাড়তে থাকে আবহের সব গোলমাল মিলিয়ে যেতে থাকে রবীন্দ্র সংগীতের অংশবিশেষের মূর্ছনায়
“আরো আলো আরো আলো এই নয়নে প্রভু ঢালো—
সুরে সুরে বাঁশি পুরে তুমি আরো আরো আরো দাও তান
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ”


গান মিলিয়ে যায় আবহে – চরিত্রেরা মঞ্চে ফিরে এসে অমলকান্তির পাশে এসে দাঁড়ায় সমবেত আবৃত্তি –আলো অমলকান্তির ওপর বাড়তে বাড়তে ঝলসে উঠে – কমে আসতে থাকে – তার কালো চশমাপরা মুখটুকু দেখা যায় অন্ধকার মঞ্চে।

আবহ (সমবেত): আমাদের মধ্যে যে এখন মাস্টারি করে অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত, যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল, উকিল হলেও তার এমন কিছু ক্ষতি হত না। অথচ সকলের ইচ্ছাপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। সেই অমলকান্তি, রোদ্দুরের কথা ভাবতে ভাবতে, যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।

পর্দা পড়তে থাকে আবহে সমবেত আবৃত্তির শেষ পংক্তির অনুরণন চলতে থাকে পর্দা বন্ধের শেষ অবধি।
 

।।সমাপ্ত।।

[এখানে মূল নাটকটি প্রকাশিত হল। তবে বহুরূপী নিবেদিত মঞ্চাভিনয়ে দৃশ্যভাবনা, দৃশ্যান্তরে আবৃত্তি ও গানের ব্যবহার এবং নাট্য-উপস্থাপনায় সামান্য সম্পাদনা ও পরিবর্তন করা হয়েছে।]

[বহুরূপী ব্যতীত আর কোনও নাট্যদলকে এ নাটকের মঞ্চাভিনয়ের অনুমতি দেওয়া হয়নি। নাটকটি ভারত সরকারের রেজিস্ট্রার অফ কপিরাইটস-এ দ্বারা আইনত রেজিস্ট্রিকৃত (L-76713/2018) নাটকের পূর্ণ বা আংশিক মঞ্চ, শ্রুতি বা চিত্রাভিনয় বা কোনপ্রকার অনুবাদ আইনত দণ্ডনীয়]


Skip to content