বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌরভ চক্রবর্তী

ভীমভবানী চট্টোপাধ্যায়ের নামটা যিনি রেখেছিলেন, তাঁর দূরদর্শিতার প্রশংসা করা যায় না। ভদ্রলোক নিপাট ভালমানুষ। বন্ধুরা তো বটেই, অফিসের জুনিয়র ছেলেরা অবধি তাঁর পিছনে লাগে অবাধে। কারও কথায় তিনি কিছু মনে করেন না। প্রশ্রয়ের অমলিন হাসিটি তাঁর শুভ্র মুখাবয়বের সুষমা বাড়িয়ে তোলে। নয় নয় করে আটচল্লিশ হল। তবে কাঁচাপাকা কোঁকড়ানো চুলে বয়সটা একটু বেশি মনে হয়।

শুক্রবার লিফটে উঠতে গিয়ে পলাশ লক্ষ্য করে তাঁর দৃষ্টি কিছু চিন্তাকুল। হয়তো গরমে কাহিল হয়ে পড়েছেন, এই ভেবে সে হালকা হাসির ছলে বলে, ‘বিবিসি নিউজে কি বলছে?’ ভীমভবানীর মুখে স্বাভাবিক চিরাচরিত হাসির আভা খেলে যায়। আশ্বস্ত হয়ে পলাশ মোবাইলে চোখ রাখে। পলাশদের গ্রুপটা ওঁকে ওই নামেই ডাকে।

তাঁর হাসিতে ইদানীং গ্রহণ লেগেছে। অদ্ভুত সমস্যায় পড়েছেন মাঝবয়সী মানুষটি। কিন্তু সমস্যাটা এমন, যে কাউকে মন খুলে বলা যাচ্ছে না। অবিশ্যি লাজুক মুখচোরা ভীমভবানীবাবু কতটা বলে উঠতে পারবেন, সেটাও সংশয়ের বিষয়। সমস্যা না বলে উটকো ঝামেলাও বলা চলে এটাকে। মাঝারি মাপের মানুষের জীবনে খুব বড় সমস্যা দেখা দেয় না এমন নয়। কিন্তু এ এক উদ্ভট সমস্যা, দাঁত ব্যথা বা হাঁটু ব্যথার মতো, যার যখন হয়, সে তখন বোঝে।

চিরকালই ঘরে বাইরে ভীমভবানীর অত্যন্ত সংযত জীবন। না হয়ে উপায়ও ছিল না। তাঁর বিধবা মা অতিশয় বেয়াড়া ধরণের মহিলা। সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাতেন। রাতবিরেতে তাঁর ঘুম আসত না, এঘর ওঘর ঘুরে বেড়াতেন। অনিদ্রাজনিত নানা ধরণের শারীরিক ও মানসিক উৎপাত দেখা দিত। গা হাত পা চুলকানো, পা ব্যথা, খুশখুশে কাশির উপদ্রব। আর এই সবের জন্য থেকে থেকে উঠে এসে ওষুধ চাইতে হতো ছেলের কাছে, যদিও তাঁর ওষুধ সব তাঁর ঘরেই যত্ন করে রাখা থাকত। সেখান থেকেই খুঁজে দিতে হত ভীমভবানীকে। একারণে দোর বন্ধ করে বউয়ের সঙ্গে নিরিবিলি প্রেম করার অবকাশ তাঁর কোনদিনই ছিল না। তারপর মেয়েরা বড় হতে বউয়ের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারেই ঘুচে গেল। নেহাত চন্দ্রাণী ঘুমকাতুরে, রাতবিরেতে জেগে থেকে সোহাগ করায় তার প্রবল অনীহা, তাই বাঁচোয়া।

আজকাল মেয়েরা আলাদা ঘরে শোয়, রাত জেগে পড়ে, ফোন দেখে। মায়েরও বয়স হয়েছে। আগের মতো হাঁটাচলা খুব একটা করতে পারেন না। দীর্ঘ ব্যবধানের পর রাতে বউকে কাছে পেতে মন্দ লাগে না ভীমভবানীবাবুর। কিন্তু কি কপাল! যখনই চন্দ্রাণীকে জড়িয়ে ধরেন, ওর গল্প করার প্রবল ইচ্ছে হয়। সারাদিনের যাবতীয় কথা ওর তখনই বলা চাই। আর কথাই বা কি, কুমড়োর চচ্চড়ি, লাউঘন্ট, পাবদা মাছের ঝোল, আমের আচার এইরকম দু’চার কথার পর গিন্নি পাশের গলির দ্বিজেনবাবুর কথায় চলে যান।

বৃ্দ্ধ দ্বিজেনবাবু দুপুর হলেই এসে হাজির হন তাদের বাড়ি। রোগ বেরোগের কথা হয়। ছেলে মেয়েদের পড়াশুনো ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হয়। বিকেলে একেবারে চা বিস্কুট খেয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। এই অবধি ভীমভবানীর আপত্তির কিছু ছিল না। কিন্তু ব্যাপারটা যা দাঁড়াল, কোন পুরুষমানুষ তাতে চুপ করে থাকতে পারে!
এ হপ্তার কথাই ধরা যাক। সোমবার গিন্নির হাতটি ধরে ঠোঁটের কাছে আনতেই চন্দ্রাণী বললেন, ‘জানো আজ দ্বিজেনবাবু বলছিলেন, আমার হাতের আঙুলগুলো নাকি খুব সুন্দর। সারাদিন এত যে রাঁধি, নখ দেখে নাকি বোঝাই যায় না! সেলাই করছিলুম তো, তাইতে চোখে পড়েছে।’
চন্দ্রাণীর হাতটি ছেড়ে দিয়ে ভীমভবানী বলেন, ‘হঠাৎ একথা?’
‘আহা, ওর বউয়ের জানোই তো শুচিবাই। ধুয়ে ধুয়ে নখে ছাতা পড়ে যা তা অবস্থা। খুব দুশ্চিন্তা করেন উনি বৌদিকে নিয়ে’ গভীর সমবেদনার সঙ্গে জানায় চন্দ্রাণী।
ভীমভবানী ভুরু কুঁচকে উঠে বসেন। বলেন, ‘কত বয়স হবে বলত ওনার?’
‘কে জানে! এই তো ক’দিন আগে রিটায়ার করলেন। বাষট্টি চৌষট্টি হতে পারে, সাতষট্টি আটষট্টিও হতে পারে’।
‘হুম। তুমি ওঁকে এখন থেকে কাকাবাবু বলে ডেকো। অত বয়স্ক মানুষকে নাম ধরে ডাকা ঠিক নয়’, বিরক্তি চেপে রেখে ভীমভবানী সুভদ্রস্বরে বলেন।
রাত গড়ায়। চন্দ্রাণী হাই তোলে। ঘুমিয়ে পড়ে। ভীমভবানীর ভুরু কুঁচকেই থাকে।

ফের বুধবার। যেমনি গিন্নিকে জড়িয়ে ধরে কাছে টানতে যাবেন, চন্দ্রাণী বলে উঠল, ‘আচ্ছা, তুমি তো প্রায়ই ব্যাঙ্কে যাও, দেখো তো আমার নামে একটা টাকা ফিক্সড করা যায় কি না’।
বিবিসি বলেন, ‘কেন, তোমার আবার টাকাকড়ির কি দরকার পড়ল?’
চন্দ্রাণী বলে, ‘আহা না না, দ্বিজেনবাবু বলছিলেন কবে আছি কবে নেই, বউয়ের নামে কিছু রেখে যাই, যাতে চোখ বুজলে খাবার চিন্তা করতে না হয়’।

কিঞ্চিৎ অভিমানমেশা কণ্ঠে ভীমভবানী বলেন, ‘তুমি কি এত তাড়াতাড়ি আমায় উপরে পাঠাতে চাও নাকি!’ ‘ছিঃ কি যে বল’, বলতে বলতে চন্দ্রাণী ওর দুহাতের মধ্যে ধরা দিলেন বটে, ভীমভবানীর মনটা তেতো হয়েই রইল।

বৃহস্পতিবার রাতে আবারও দ্বিজেনবাবুর কথা। ভদ্রলোক সিনেমা দেখেননি কয়েক দশক। চন্দ্রাণী আবদার করে ওঁকে দুটো টিকিট কেটে দিতে, বউকে নিয়ে যাবেন। কার বউকে নিয়ে যাবেন সেব্যাপারে ভীমভবানীর ঘোর সন্দেহ হতে থাকে।

তারপর থেকে এই চলেছে। আজ দ্বিজেনবাবুর ছেলের জন্য জমি খুঁজে দাও, কাল দ্বিজেনবাবুর অর্শ্বের ওষুধ এনে দাও, পরশু ওর মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজে দাও, হরেক রকম ফিকির ভদ্রলোকের। ভীমভবানী চন্দ্রাণীকে কিছু বলতে পারেন না। চন্দ্রাণী খুব সরল। কিন্তু দ্বিজেনবাবুর সহৃদয়তা বা সদিচ্ছা ঘিরে সংশয় দুর্বার হয়ে উঠল ওঁর।

এ যে কি সমস্যা বলে বোঝাবার নয়। নিজের বউ, নিজের বাড়ি, নিজের খাট, নিজের বিছানা, অথচ তিনি নন, দ্বিজেনবাবুই হিরো। তিনি যেন পার্শ্বচরিত্রে টিঁকে আছেন কোনওরকমে। নিত্যদিন এ আর সহ্য হয় না। কাউকে বলতে পারেন না, অকারণে রেগে ওঠেন। বন্ধুরা ওঁর বিষণ্ন মুখ দেখে চেপে ধরল। কিন্তু এ কথা কি বলা যায়! ‘গিন্নির একা একা সময় কাটেনা’, এইসব বলে ছাড়া পেলেন কোনওরকমে।

তাপস বলল, ‘বৌদির এত ভাল গানের গলা। কাছাকাছি কোন গানের ক্লাসে ভরতি করে দিন না। ওই নিয়েই সময় কেটে যাবে’। কথাটা মনে ধরল বিবিসির। সত্যি এতদিন কেন ভাবেননি, আপশোষ হল তাঁর। বাড়ির পাশেই গৃহকল্যাণ সমিতির ক্লাবঘর। দু’পা হাঁটলেই। ফি হপ্তা দু’একদিন উনি নিজেই যান ক্লাবে তাস খেলতে, আড্ডা দিতে। মণিদীপাদি আছেন, বছরে চারবার অনুষ্ঠান করেন, রবীন্দ্র জয়ন্তী, বিবেকানন্দ জন্মদিন, বর্ষাবরণ আর বিজয়া সম্মেলনী। সারা বছর ওঁর নেতৃত্বে নাচ গান নাটকের রিহার্সাল চলতে থাকে। একদিন ভীমভবানী চন্দ্রাণীকে না জানিয়ে মণিদির বাড়িতে হাজির হলেন ওকে সঙ্গে নিয়ে। কথায় কথায় গানের কথা এল। চন্দ্রাণী গেয়েও দিল ‘অঞ্জলি লহ মোর, সঙ্গীতে’। ব্যাস। মণিদি খুশি হয়ে ডেকে নিলেন ওকে। এবার বিজয়ায় থিম ‘ছয় ঋতু ছয় কবি’। গানের লোক চাই। ওদিকে গীতগোবিন্দ নাটক হবে। রঞ্জন সেন খুব খেটে নাটক নামাচ্ছেন। তাঁর নিজের লেখা চিত্রনাট্য, তাঁরই কথা, তাঁরই সুর। সেখানেও লোক চাই গানে। চন্দ্রাণী মন দিয়ে সারাদিন অনুষ্ঠানের প্রাক্টিস করছে। প্রতিদিন বিকেল থেকেই মণিদির বাড়ি রিহার্সাল চলছে পুরোদমে। রান্না করা, খাওয়ার অবধি সময় পায় না। দ্বিজেনবাবু এসে ফিরে যাচ্ছেন। ভীমভবানী খুশি হন গিন্নির নিষ্ঠা দেখে।

কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই নাকি সন্ধে হয়। আর বলে নাকি কপালে না থাকলে ঘি ঠকঠকালে হবে কি! আজকাল রাতে শুতে এসে রঞ্জনবাবু ছাড়া চন্দ্রাণীর মুখে আর কথা নেই। তিনি কি চড়ে এলেন, কিভাবে সংলাপ উচ্চারণ করা শেখালেন, কিভাবে দুলে দুলে হাঁটলেন, কীভাবে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লেন, কোনওদিন কি পাঞ্জাবি পরলেন, মায় কোনদিন কি ঝোলাব্যাগ নিলেন অবধি।

ভীমভবানী ভাজা ভাজা হয়ে গেলেন। এখন বিজয়ার অনুষ্ঠান শেষ হবার আগেই তিনি ডিপ্রেশনে না চলে যান।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৪: অবশেষে দময়ন্তী ফিরে গেলেন পিতৃগৃহে…

মনের আয়না: পরীক্ষার আগে হারাচ্ছে মনঃসংযোগ? কী করলে ফিরবে মনঃসংযোগ? জেনে নাও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের মতামত

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৫: শেকল-বাঁধা ঠাকুরবাড়ির খাতা

সেদিন অফিসে কি একটা মিটিং। খুব জরুরি দরকার। হঠাৎ ডেকেছেন বিশ্বপতি ঘোষ, ভীমভবানীর বস। ঠান্ডা ঘরে ওরা জনা দশেক ডিম্বাকার বৃহৎ টেবিল ঘিরে অপেক্ষা করছে। ঘোষবাবুর দেখা নেই। নিজেরাই আড্ডায় মেতে উঠেছে ওরা। তাপসের দুহাতে খান বারো আংটি। শীতল দেখে দেখে বলে ওঠে, ‘কি হয় এসবে? কাজ হয় কিছু?’ তাপস সভক্তি জানায়, ‘কি হয় তা জানিনা, তবে শ্রীখনা বোস মা যখন দিয়েছেন, নিশ্চয় কিছু হয়’। ভীমভবানী আনমনে রাতের হয়রানির কথা ভাবছিলেন, তাপসের কথা শুনে সজাগ হয়ে নড়ে বসলেন। তাঁর মাথায় গোটা মিটিং আর কিছু ঢুকল না। শেষ হলেই তাপসকে ধরে পড়লেন, ‘কোথায় বসেন ভাই তোমার বোস মা। আমাকে নিয়ে চল’। তাপস মাথা চুলকে বলে, ‘আমি একটু ছুটিতে যাব দাদা, আপনাকে বরং ওর বেলঘরিয়ার অ্যাড্রেসটা দিয়ে যাচ্ছি’।

অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েই ছুটলেন জ্যোতিষীর কাছে, ভগ্নীপতি রাজেশকে নিয়ে। রাজেশকে ঢুকতে দিল না সিকিউরিটি। যে ক্লায়েণ্ট তাকেই যেতে হবে। শ্রীখনা বোস আধুনিকা জ্যোতিষী। জন্মদিন, ক্ষণ, সাল আর জন্মস্থান জেনে নিয়ে একজন চলে গেল। কিছু পরে ছেলেটি কম্পুটারাইজড জন্মপত্রী দিয়ে গেল মায়ের হাতে। তিনি দেখেই বুঝে নিলেন কোথায় কি সমস্যা। কতটা গভীর। দ্রুত প্রেস্ক্রিপশন করে দিলেন অমুক দোকান থেকে নীলার আংটি আর মুনস্টোন গড়িয়ে নিতে হবে। এতটুকু সময় নষ্ট করা যাবে না। সামনে সমূহ বিপদ। একমাস বাদে আবার আসতে হবে। দুরু দুরু বক্ষে বিবিসি বেরিয়ে আসছেন চেম্বার থেকে, দেখেন রাজেশের সঙ্গে সিকিউরিটি ছেলেটি বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে। মনে হল বিবিসির কেস নিয়েই আলোচনা চলছিল।

ওঁর প্রেস্ক্রিপশনে চোখ বুলিয়ে ছেলেটি বলল, ‘বউ পরপুরুষে মজেছে, এর জন্য আপনাকে নীলা দিলেন! আশ্চর্য ব্যাপার!’ কিঞ্চিৎ চিন্তা করে আবার বলল, ‘যাকগে, যা ভাল বুঝেছে, তাই করেছে। তবে আপনাকেও বলি মসাই, ছেড়ে দিন। এসব নিয়ে আর নেবু কচলাবেন না। যাবে কোতায়! পুরুষ মানুষ, দিয়ে দেবেন সুযোগমতো আড়ং ধোলাই’। তারপর বিবিসির কানের পাশে মুখ নামিয়ে বলল, ‘এ বয়সে ওসব অ্যাফেয়ার ট্যাফেয়ার কিচ্চু হয় না দাদা। দেকচি কত’! মূল্যবান পরামর্শের জন্য তাকেও পঞ্চাশটি টাকা দিতে হল।

জ্যোতিষীর কৃপা হোক বা ভীমভবানীর বরাত, অদ্ভুত উপায়ে রঞ্জনবাবুর কেসটা মিটে গেল। ওঁর বড় মেয়ে অ্যানা চাকরি পেয়েছে। নতুন ফোন কিনে নিজের পুরোনো ফোনটা সে মাকে দিয়ে দিয়েছে, প্লাস ফেসবুকে অ্যাকাউন্টও খুলে দিয়েছে। বিজয়ার অনুষ্ঠান জমজমাট ভাবেই শেষ হল। সেসব ভিডিও, ছবি টবি আপলোড তো করা হলই, এই হিড়িকে পুরোনো বন্ধুদেরও খুঁজে পেয়ে গেল চন্দ্রাণী।

এ এক নতুন জগৎ। চন্দ্রাণী সারাদিন বাক্যালাপে, গান শোনায় ব্যস্ত থাকে। ইউটিউব থেকে নতুন নতুন রেসিপি ট্রাই করে। বিবিসি দেখে দেখে খুশি না হয়ে পারেন না।

তাঁর মুখের এই স্বস্তির হাসি অবশ্য বেশিদিন রইল না। শিগগিরই চন্দ্রাণীর চার পাঁচজন স্কুল কলেজের বন্ধু একদিন বাড়িতে এসে হাজির হল তাদের বরেদের সঙ্গে নিয়ে। খুব হইচই। ওর মধ্যে একজন সুবরণা। কলেজে ফিলসফি পড়ায়। ওর বর আবার ঘটনাচক্রে চন্দ্রাণীর সঙ্গে কলেজে পড়ত। নন বেঙ্গলি, নাম ব্রিজেন আগরওয়াল। প্রায় ছফুট লম্বা ঘোর ফর্সা ব্রিজেনের পাশে সুবরণার শ্যামলা দোহারা চেহারা কেমন বেমানান দেখায়। শান্ত নম্র প্রায়নীরব মেয়েটির মুখে একটা বিষণ্ণ হাসি মাখা। বিবিসির মায়া লাগে।
আরও পড়ুন:

শারদীয়ার গল্প-১: প্ল্যানচেট রহস্য

নাট্যকথা: রোদ্দুর ও অমলকান্তি/২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩: এক ফ্লপ মাস্টার জেনারেল-র ‘মর্যাদা’ [২২/১২/১৯৫০]

সেই শুরু। গার্ল গ্যাং এর লিডার হতে দেরি হল না চন্দ্রাণীর। আজ এখানে সিনেমা দেখা, কাল কাবাব পার্টি, পরশু কেক পার্টি, তরশু ডিনার, নরশু শপিং, এই করে রোজ মলে আর রেস্তোরায় ঘুরে বেড়ায় ওরা। মেয়েদের ছেড়ে তাদের মাকে সামলানোই দুষ্কর হয়ে উঠেছে ইদানীং ভীমভবানীর কাছে। গোদের উপর বিষফোঁড়া ওই ব্রিজেন আগরওয়ালা। অন্যদের বরেরা রণে ভঙ্গ দিলেও সে সর্বত্র চন্দ্রাণীদের সঙ্গী। সুবরণা অবশ্য আর আসে না কাজের চাপে। ব্রিজেনের কিসের ব্যবসা কে জানে, অঢেল সময় আর অফুরন্ত এনার্জি। ইদানীং তার গপ্পেই মশগুল চন্দ্রাণী। এখন শীতে কি একটা পিকনিকের পরিকল্পনা চলছে। ভীমভবানী নির্বিকার মুখে শোনেন, তারপর ঘুমানোর চেষ্টা করেন। চন্দ্রাণী অনেক রাত অবধি হোয়াটস অ্যাপে খুটখাট চালিয়ে যায়।

অনেক ভেবেছেন ভীমভবানী। অমন যে পাশের বাড়ির ডাকসাইটে ঝিন্টি চাকলাদার, যার হাঁকডাকে কাক চিল বসতে পেত না ছাতে, অমূল্যকে উদয়াস্ত নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাত, সে অবধি কেঁচো হয়ে গেল চোখের সামনে, অমূল্য ডিভোর্সের হুমকি দিতে। কিন্তু ভীমভবানীর মতো নিতান্ত ভদ্রলোকেদের জীবনে কিছু বদলায় না। নিয়তিকে একপ্রকার মেনেই নিয়েছেন তিনি।

দিন যায়। চন্দ্রাণীর জীবনে আনন্দ উপছে পড়ে। ভীমভবানীও খুশি থাকার চেষ্টা করে চলেন। দুঃখের কথা বলারও লোক নেই তাঁর জীবনে। আনন্দ অবশ্য সবার জীবনেই আসে, না বলতেই আসে। শীতের কাছাকাছি অ্যানা চলে গেল পুনা। ওর অফিস ওখানেই পোস্টিং দিয়েছে। ছোট মেয়েও ঘটনাচক্রে পুনা ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করেছিল। অঙ্কে এম.এ করবে। তারও নাম উঠেছে। হোস্টেল না পাওয়া অবধি দিদির কাছেই থাকবে কুর্চি। ভীমভবানী আশ্বস্ত হয়েছেন দুই মেয়ে কাছাকাছি থাকতে পারবে। নিজের জন্য তিনি আর ভাবেন না। তারপর, যাওয়া বললেই তো হল না, কেনাকাটা, ছাঁদা বাঁধা সব তাকেই করতে হল। দিনকতক ভারি ব্যস্ততা। শেষমেশ দিনের দিন মেয়েকে ট্রেনে তুলে দিতে গেলেন হাওড়ায়। সন্ধের দিকে ট্রেন, দুরন্ত। সঙ্গে ছিল বন্ধু শ্যামল। ওর কি একটা কাজ আছে।

ফেরার পথে এস্পল্যানেডের মোড়ে শ্যামলকে নামিয়ে গাড়িটা বাঁক নিতেই ভীমভবানী দেখেন সুবরণা দাঁড়িয়ে। গাড়ির জানলা দিয়ে তিনি হাত নাড়তে সেও দেখতে পেয়েছে। ভীমভবানী সামনে ড্রাইভারকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘দাঁড়াও তো ভাই’।

ড্রাইভার ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। উনি গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘ফিরবেন তো? আসুন না’।

সুবরণা না করল না। স্মিত হেসে পাশে এসে বসল। বলল, ‘আজ শিবপুর গিয়েছিলাম একটু। একজন পরিচিত এই অবধি পৌঁছে দিয়ে গেল। এত দেরি হয়ে গেছে, ভাগ্যিস আপনি এলেন’।

ওর হাসিটা বিবিসিকে কোথাও কি ছুঁয়ে গেল! পিছনে সূর্য ডুবেছে বেশ কিছুক্ষণ। অস্তরাগের আলো এখনও মাখামাখি কালো মেঘে। জানলা দিয়ে ঈষৎ স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে এসে লাগছে ওঁর। ওঁদের। কি জানি কেন, হঠাৎ রঞ্জন, দ্বিজেন, ব্রিজেন জনে জনে সকলের জন্য মমত্ব জেগে উঠল ভীমভবানীর চিত্তে।

রাতে শুয়ে চন্দ্রাণী কিছু বলার আগেই ভীমভবানী বললেন, ‘সুবরণা মেয়েটি বেশ, তাই না’!

চন্দ্রাণী বলল, ‘বড্ড বইমুখো। … আর যা কালো, ব্রিজেনের পাশে…

ওর কথা শেষ না হতেই ভীমভবানী ছাতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘কালো! কি বলছ? কই, তেমন তো কিছু… যাই বল, মুখখানা ভারি সুশ্রী’।

চন্দ্রাণী হাই তুলতে যাচ্ছিল। বিবিসির রসস্থ মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে ওর মুখ আর বন্ধ হল না। হাঁ হয়েই রইল।

* গল্প (Short Story) – আলোকসংশ্লেষ (aaloksongslesh) : অন্তরা বন্দ্যোপাধ্যায় (Antara Banerjee) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ

Skip to content