সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


‘কামনা’-র আশাতীত ফ্লপ, নায়ক হওয়ার সমস্ত আশাকে দুমড়ে মুচড়ে তছনছ করে দিল। মাত্র কয়েক মাস আগে মুক্তি পাওয়া ‘কবি’ সিনেমার কদর তখন বাংলার ঘরে ঘরে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী ও গীতরচনায় দেবকী বসুর পরিচালনা, যেন সোনার ফসল উপহার দিয়েছিল। সে পরিস্থিতিতে উত্তম চট্টোপাধ্যায়ের নায়ক হিসাবে ডেবিউ, না মনে রাখলেও কিছু যায় আসে না। কে কবে আগামী দিনে বাংলা সিনেমার সম্রাট হবেন সে ভাবনা অত আগেভাগে কে ভাববে?

একবার আশা আবার নিরাশা। একবার উত্থান, পুনরায় পতন যেন উত্তমরূপী অরুণকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। আবার কেরানির জীবন শুরু হল। নইলে সদ্য বিবাহিতের সংসার চলবে কি করে! ভীষণভাবে মুষড়ে পড়া অরুণকে সজীব রাখত গৌরীর সর্বংসহা মুখটা। প্রতিটা দিন যেন হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে অসম লড়াই। পরবর্তীকালে সুপ্রতিষ্ঠিত মহানায়ককে জড়িয়ে যখন কোনও সোহাগিনী খবরের কাগজের প্রথম পাতায় আসতেন ‘উত্তমদা আমার মধ্যে শান্তি খুঁজে বেড়াতেন, আশ্রয় চাইতেন’ কিংবা ‘তোমাদের দাদা আমাকে চোখে হারাতেন’ তাঁদের উদ্দেশ্য বলতে ইচ্ছা করে, অভিনয় জীবনের প্রথম দশটা বছর দারিদ্র্যের সঙ্গে, ভিন্ন মেরুর সঙ্গে সর্বোপরি দুর্ভাগ্যের সঙ্গে মানুষটা রক্তাক্ত হয়ে যে লড়াইটা চালিয়েছিলেন গৌরী পাশে না থাকলে কোথায় হারিয়ে যেতেন উত্তম কুমার!
যাইহোক ‘কামনা’-র ব্যর্থতার ঘা শুকোনোর আগে স্টুডিয়ো পাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে খবর পাওয়া গেল প্রযোজক সরোজ মুখোপাধ্যায় ‘মর্যাদা’ নামে একটা ছবি তৈরির পরিকল্পনা প্রায় কার্যকরী করে ফেলেছেন। সরোজবাবু ছিলেন রায়বাহাদুর সত্যেন মুখোপাধ্যায়ের ছেলে। অনেক ধনকুবেরদের মতো এনারাও সদ্য জনপ্রিয় ফ্লিম ব্যবসার পরিবেশক সংস্থারও মালিক ছিলেন।

‘মর্যাদা’ ছবির পরিচালক হিসাবে সুযোগ পাচ্ছেন ‘পথের দাবী’ (১৯৪৭) খ্যাত দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়। নায়ক হিসাবে মনোনীত হয়ে গেছেন সুদর্শন প্রদীপ কুমার। প্রদীপ কুমার ফাইনাল হয়ে গিয়েছেন শুনেও আশা ছাড়লেন না। ‘মর্যাদা’-র প্লেয়ার কাস্টিং মনে পড়লেই ঈশ্বরের নামে কপালে হাত ঠেকান কেরানি অরুণ। গোয়েন্দার মতো দূর থেকে সব খবর নেওয়া চলছে। হঠাৎ শোনা গেল, প্রদীপ কুমার অন্য ছবির কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে ‘মর্যাদা’ ছবিতে অংশ নিতে পারবেন না জানিয়ে দিয়েছেন।

সুযোগের অপব্যবহার বুদ্ধিমানের কাজ নয়, অভাগার তো নয়ই। লজ্জা ঘেন্নার মাথা খেয়ে সরাসরি সাক্ষাৎ সরোজবাবুর সঙ্গে। বিনা মেঘে বজ্রাহত সরোজবাবু, পথশ্রমে ক্লান্ত ও একরাশ আশায় বুকবাঁধা অরুণের মুখটা দেখে মনে মনে খুব খুশি হলেন। অরুণের মনে তখন নতুন আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ, পরক্ষণেই ‘কামনা’-র ব্যর্থতার গ্লানি। যে অরুণ পাড়ার ক্লাবে নাটক, থিয়েটার করে মানুষের কাছে অনেকটা গ্রহণযোগ্য তারই ফিল্ম লাইনে মর্মান্তিক দশা, বড্ড পীড়াদায়ক।
সরোজ মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। এমন কিছু বলতে চান যেটাতে অরুণ হয়তো অখুশি হতে পারে। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন পথিকের নিজের মতামত গুরুত্ব পায় না। প্রযোজকের মুখে ভাষা ফোটার আগে অরুণ সবিনয়ে বললেন, ”আপনার যা বলার আছে আপনি বলতে পারেন।”

সরোজবাবু বললেন, “তোমাআআ..র নামটা পাল্টাতে হবে, যদিইই.. রাজী থাকো…।” নাম পরিবর্তনে মন যে ভারাক্রান্ত হয়নি তা নয়, তবুও হতভাগ্য-র আবার ইচ্ছা অনিচ্ছা! পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রের যেমন হয় আর কি। যথাসময়ে প্রদীপ কুমারের পরিত্যক্ত হিরোর রোলে মনোনয়ন পেলেন ফ্লপ হওয়া অরুণ। নতুন নাম হল— অরূপকুমার। এও এক প্রকার নবজন্ম। সময় খারাপ গেলে মানুষকে কত কি মেনে নিতে হয়! এ তো সামান্য নাম। আশা নিরাশার মধ্যে যখন মুখ টিপে হাসাহাসি চলছে তখন পরাজিতের আর যাই হোক নিজের পছন্দ বলে কিছু থাকে না। থাকা উচিতও নয়।

পোর্ট কমিশনার্শের চাকরিটা তখনও দু’বেলা দুমুঠো জোগায়। ছুটির পর ছুটি। অফিসের অনেকেই কামাইয়ের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট। কিন্তু ফিল্মের হিরো হবার জন্য যে মানুষ পিতৃদত্ত নাম বদলাতে দু’বার ভাবেননি তাঁর কাছে যে কোনও পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়া কষ্টকর নয়। আজকের দিনে বসে আমরা অনুভব করতে পারব কিনা জানি না, মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে চাকরিতে বরখাস্ত হওয়া কতটা চাপের। অন্যদিকে ফিল্ম লাইনেও সুবিধাজনক পরিস্থিতি নয়। কতজন কথা দিয়ে কথা রাখেননি। যাঁরা রেখেছেন পারিশ্রমিকের একটা অংশ তাঁরা হাতে রেখে তবে পেমেন্ট করিয়েছেন।
আগে পিছে যিনি, যা শর্ত দিয়েছেন অরুণ হাসিমুখে তা মেনে নিয়েছেন। সেলুলয়েড যে তাকে বড্ড টানে। সেখানে একটু জায়গা পাওয়ার জন্য কার না হাতে পায়ে ধরতে বাকী রেখেছেন। তাই সরোজবাবুর নাম পাল্টাতে চাওয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন বটে, কিন্তু ভেতরের ভেতরটা বড্ড ডুকরে কাঁদছে। সবাই দেখবে উত্তম বা অরুণ অভিনয় করছে আর নাম হবে অরূপকুমার-র। এর ভবিষ্যত কি! কেউ জানে না।

অনেক আশা ভরসার পাখায় ভর দিয়ে নতুন নামধারী অরুণ হাজির হলেন উত্তর কলকাতার সিঁথির মোড়ে এমপি স্টুডিয়োতে। প্রাথমিক নিয়মকানুন পালনের পর ‘মর্যাদা’ ছবির কাজ শুরু হল। এই এমপি স্টুডিয়ো তথা এমপি প্রোডাকশনসের থেকেই আগামী দিনে তার ভাগ্য অন্য পথে বাঁক নেবে…কে জানত! সে কথায় পরে আসছি। শ্যু টিং, বাড়ি আর মাঝে মাঝে অফিস।

সহকারী শিল্পীদের তৎপরতায়, দিগম্বর বাবুর ম্যানেজমেন্টে খুব কম দিনে ‘মর্যাদা’ ছবির কাজ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ছবির রিলিজ আর হয় না। এও একপ্রকার বিড়ম্বনা। যার জন্য সরাসরি অরূপ তথা অরুণের কোনও দায় নেই। ‘কামনা’-র ব্যর্থতার কাঁটাটা তখনও রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। যদি কোনওভাবে এক দান লেগে যায় অন্তত ভদ্রসমাজে মাথা তুলে দাঁড়ানো যায়।

দিন যায়, মাস যায় চাকরি জীবনের একঘেয়েমিতে ক্লেদাক্ত অরুণ, পাড়ার নাটকেও খুব বেশি যাতায়াত করেন না। সেখানে সবাই তার কেরিয়ারের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তা-ও আবার এককথায় জানতে চায়। মানুষের মন, খারাপকে গ্রহণ করতেই বেশি অভ্যস্ত। হাতে অন্য কোনও ছবির কাজও নেই যে মনের বৈচিত্র্য থাকবে।শ্যুেটিং চলাকালীন পারিবারিক জীবনে আলো জ্বলেছে।
আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: সন্তান জ্বরে ভুগছে? কী ভাবে সামলাবেন? রইল ঘরোয়া চিকিৎসার খুঁটিনাটি

ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-২৮: পরান বাড়ুজ্যে মানেই এনার্জি টনিক

দেখব এবার জগৎটাকে, পর্ব-১২: বেশিক্ষণ থাকলে আরও কী কী হতো কে জানে, মুহূর্তে নৌকা ঘোরাল বনি

গৌরী-র কোল আলো করে গৌতম এসেছে চাটুজ্জ্যে বাড়ির উত্তরাধিকারী হয়ে। গৌরী-র ‘গৌ’ আর উত্তম-র ‘তম’ নিয়ে নবজাতকের নাম হয়েছে ‘গৌতম’। অফিসের বাঁধাধরা চাকরির পর গৌরী আর গৌতমের সান্নিধ্য। ভাঙাচোরা মনের ওপর দিয়ে একটা ফুরফুরে বাতাসের চালনা। প্রথম সন্তান ছেলে হওয়ায় মনের অলিন্দে কোথায় যেন একটা ম্যাচ জেতার আনন্দ।

অনেক ঠাকুরের মানত করে অবশেষে ছবি রিলিজের দিন এগিয়ে এল। বড়দিনের ঠিক আগে ডিসেম্বর মাসের ২২ তারিখে হাতিবাগানের ‘রূপবাণী’, শিয়ালদহের ‘অরুণা’ এবং ভবানীপুরের ‘ইন্দিরা’ সিনেমার চেনে ‘মর্যাদা’ রিলিজ হল। ছবি মুক্তির পর অরুণের মানসিক উৎকণ্ঠা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, অবসর সময়ে একজন হিরো হয়ে রিলিজিং হাউসের পাশাপাশি ঘুরে বেড়িয়েছেন। নিজের অভিনয় সম্পর্কে দর্শকদের মন্তব্য শোনার আগ্রহে নয়, দর্শক সমাগমের মাত্রা দেখাই ছিল সেদিনের পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রের আকাঙ্ক্ষা। ছবিটা প্রথম দিকে ভালোই চলছিল। হঠাৎ যেন কোথা থেকে কি হয়ে গেল। ‘মর্যাদা’-র প্রতি দর্শকদের আগ্রহ কমে গেল। মর্যাদা ফ্লপ করল।
আরও পড়ুন:

অচেনা টলিউড, পর্ব-২: প্রোডিউসাররা টাকা নিয়ে তৈরি, আর ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পরিচালক!

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৫: বাহুকরূপী নলের রথ ঋতুপর্ণরাজাকে নিয়ে তীব্র বেগে বিদর্ভের পথে চলল

শিশু হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ-এ ভুগছে? কষ্টকর হলেও ভয়ের কিছু নেই, হোমিওপ্যাথিতে রয়েছে সমাধান

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৬: রাম-পরশুরাম দ্বৈরথ অযোধ্যার পথে

অরূপকুমারের অভিনয়ের ত্রুটিতে ছবি ফ্লপ করেছে —এরকম কেউ বললেন না। তবে হেরে যাওয়া ম্যাচে সেঞ্চুরির কোনো দাম নেই। মর্যাদার ব্যর্থতা অরুণকে পতনের কিনারায় এনে দাঁড় করালো। পরিচিত অপরিচিত সর্বস্তরের মানুষ সমালোচকের ভূমিকা পালন করতে লাগলেন।

আমরাও পিছিয়ে থাকবো না। আজকের দিনের প্রেক্ষিতে যেখানে উত্তম কুমার নামক একজন অভিনেতা নিজেকে কালজয়ী রূপে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন সে চিন্তাভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে প্রশ্রয় না দিয়ে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা করব, কেন সেদিন ‘মর্যাদা’ ছবি দর্শক মাথায় তুলে নেননি।

প্রথমত ছায়াছবির কাহিনী নির্বাচন। অরূপকুমার নামক একজন হিরোকে মার্কেটে ইনট্রোডিউস করানোর জন্য, দর্শককে সিটের সঙ্গে বেঁধে রাখার জন্য সে ধরনের কোনও চিত্তজয়ী কাহিনীর ভিত্তিভূমি, ছবিটির ছিল না। ফিল্ম ‘মর্যাদা’ হল নাগরিক জীবনের একটা ছেঁদো গল্প নিয়ে ছবি আর শব্দের কারিগরি সহাবস্থান।
গল্পের মনোগ্রাহী সেতু, কুশীলবদের সাথে দর্শক-শ্রোতাদের অদৃশ্য বন্ধন তৈরি করে। সত্যজিৎ রায়, ঋতুপর্ণ ঘোষ বা হালের অনীক দত্ত সকলেই সাফল্যের প্রথম শর্ত হিসাবে ভালো কাহিনীকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তারপর ওয়ে অফ স্টোরি টেলিং, একজন পরিচালককে আরেকজনের থেকে আলাদা করেছে।
উত্তমবাবুর জীবিত অবস্থায় ‘বাঞ্ছা রামের বাগান’ ছবির নির্মাণপর্বে শুধু উত্তমকুমার নন, মহানায়ক উত্তমকুমার বাদ পড়েছিলেন। পরিবর্তে তৎকালীন নবাগত দীপঙ্কর দে অভিনয় করেছিলেন এবং ছবি সুপার ডুপার হিট। কারণ পরিচালক নিশ্চন্তে ছিলেন গল্পের অভিনবত্বে এবং ওয়ে অফ ষ্টোরি টেলিং-এ। সেখানে কে লিড রোল প্লে করছেন -সে ব্যাপার ভাবার সময়ই দর্শক পাননি।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়ে এ ব্যাপারে মনে করাতে চাই, উত্তম কুমারের আকস্মিক তিরোধানের পর যে টলিউড পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল, তার সুদিন আবার ফেরে অঞ্জন চৌধুরি নামক একজন অনামী পরিচালকের ‘শত্রু’ ছবির হাত ধরে। যার অক্সিজেন সিলিণ্ডার ছিল, দর্শক উপযোগী চোখা চোখা সংলাপে ভরা, গড়পড়তা মননে ছাপ রেখে যাওয়া একটা কাহিনী। ফলে উত্তম-আলোয় ম্লান হয়ে থাকা রঞ্জিত মল্লিককে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

পরবর্তীকালে অঞ্জন চৌধুরির পরিচালনার মান লঘু হয়েছে কিন্তু ‘শত্রু’-র ব্র্যা ন্ডভ্যালুর বোনাস নিয়ে রঞ্জিত মল্লিকের জমি ইন্ডাস্ট্রিতে পাকাপোক্ত হয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য হিন্দি সিনেমায় আমজাদ খানের বেলায়। উনি পরবর্তীকালে অনেক ভালো চরিত্রে অভিনয় করলেও মানুষ মনে রেখেছেন ‘শোলে’-র গব্বর সিং হিসাবে।
উত্তমকুমারের দুর্ভাগ্য যে উনি কেরিয়ারের শুরুতে সে ধরণের কোনও পরিবেশ পাননি যেখানে ডেডিকেটেড ফিল্ম অ্যাক্টরের যথাযথ মূল্যায়ণ হয়েছে।
মনে রাখতে হবে, ছবির নায়কের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রদীপ কুমার-কে মনোনীত করা হয়েছিল। উত্তমবাবু (তৎকালীন অরূপকুমার) শুধু ব্যবহৃত হয়েছিলেন নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে বিপত্তারণ হিসাবে। সেটা উত্তম কুমারের পক্ষে সবুজ সংকেত হলেও পরিচালক প্রযোজকমণ্ডলী শুধুমাত্র দায়মুক্ত হয়েছিলেন। উত্তমবাবু সুযোগ না পেয়ে যদি প্রদীপ কুমার অভিনয় করতেন তাহলেও কিন্তু পরিচালক একই ট্রিটমেন্ট করতেন। দ্বিতীয়ত প্লেয়ার কাষ্টিং।

‘মর্যাদা’-তে নায়িকা হিসাবে মনোনয়ন পেলেন স্মৃতিরেখা বিশ্বাস। বয়সে অরুণ বা অরূপকুমারের থেকে কিছুটা বড়। মনীষা দেবী পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। বলিষ্ঠ অভিনেতা অভিনেত্রীদের মধ্যে পাহাড়ী সান্যাল, কমল মিত্র, সন্তোষ সিংহ, জীবেন বোস, হরিধন মুখোপাধ্যায়, নবদ্বীপ হালদার প্রমুখরা। আসলে দর্শক-শ্রোতারা, রূপোলি পর্দাতে মানুষ হাঁটাচলা করছে কথা বলছে-এ বিস্ময়ের ঘোর কাটাতেই কয়েক দশক কাটিয়েছেন। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে সবাক ছবির আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নেপথ্য শিল্পী বাছাই করে যোগ্য কুশীলবের সঙ্গে তার সমতা ঘটাতে পরিচালকদের অনেক সময় ব্যয় হয়েছ। সেখানে ফিল্মের শিল্পগুণ নিয়ে মাথা ঘামাতে সময়-সুযোগ বা ইচ্ছা সবকিছুরই ঘাটতি হয়েছে।

গায়ক নায়ক কনসেপ্ট বাতিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বহু মঞ্চাভিনেতা কাম ফিল্ম অ্যাক্টরের সমস্যা শুরু হয়। প্রকৃতপক্ষে কলকাতায় ফিল্মের নির্মাণ বিষয়ক ব্যবস্থাটা, শুরুর লগ্ন থেকে আজও অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রির মতো বিনিয়োগ – উৎপাদন-মুনাফার বাইরে ভাবা হয়নি। দেশের বিত্তবান ক্ষমতাবান লোকেরা একটা নতুন ব্যবসার সন্ধান পেয়েছিলেন। যা
প্রগতিবাদীরা দমবন্ধ অবস্থায় পরিচালনায় হাত পাকিয়ে গড্ডলিকায় গা ভাসাতে বাধ্য হয়েছেন। সত্যজিৎ রায়-র মতো কজন পরিচালক আর ইন্ডাস্ট্রিকে আর্টে পৌঁছতে আপোষহীন লড়াই লড়তে পেরেছিলেন। আমি হলফ করে বলতে পারি, উত্তম কুমার কেরিয়ারের শুরু থেকে নির্ভেজাল ফিল্ম এ্যাক্টিং করেছিলেন, যা খুব কম নির্মাতা সেসময় অনুভব করতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ উনিই প্রথম, ‘মঞ্চাভিনয়’ আর ‘ক্যামেরার সামনে অভিনয়’ পার্থক্য করতে পেরেছিলেন। সত্যজিৎ রায় বিনা কারণে ‘নায়ক’-এ ওঁকে মনোনয়ন করেননি!

‘অগ্নিপরীক্ষা’তে উনি খুব উচ্চমানের অভিনয় করেননি যা, ‘মর্যাদা’-য় ছিল না। ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র নির্মাণ কৌশল, উত্তমকুমারকে পায়ের তলায় শক্ত মাটি এনে দিয়েছিল। তৃতীয়ত পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্তদের লেখা গানে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরমূর্চ্ছনা, স্বাভাবিক সাঙ্গীতিক ব্যাকরণে পাশ করেছিল কিন্তু শিল্পের প্রয়োজনীয় রসসৃষ্টিতে বোধহয় খামতি রেখেছিল।

সবকিছুর মিলিত ফলে ছবিটি দর্শককে যথার্থ চিত্র-আমোদ দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, যা আগামী দিনের মহানায়ককে একটা ডাকনাম উপহার দিয়েছিল; এফএমজি (ফ্লপ মাস্টার জেনারেল)। এ নামও ফ্লিম জগতে প্রথম এবং শেষ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার মালিক উত্তমকুমার নামক ক্ষণজন্মা একজন চিত্রাভিনেতা। —চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content