সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


বইমেলার ডাঃ আবীরলাল মুখোপাধ্যায়।

এক জীবনের মধ্যে অনেকগুলো জীবন দেখে ফেলেছেন যাঁরা, আমি সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে পড়ি। আমার ডাক্তারি জীবন হল পেশাগত জীবন। নেশাগত জীবন অনেক কিছুই। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, আমার নাটক জীবন এবং লেখালেখির জীবন। এক কথায় বলতে গেলে ডাক্তারি, নাটক এবং লেখালেখি– এই তিনটিই আমার জীবনকে ঘিরে রয়েছে। আর এই সূত্রে আমি এই তিন জগতেরই বহু খ্যাত-অখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে এসেছি। এমন কিছু মহান মানুষের কথা, যাঁরা আমার পেশাগত জীবনেরই অর্থাৎ ডাক্তারবাবু, তাঁদের কথাই এবার বলি। ইতিমধ্যেই আমার মাস্টার মশাই ডাঃ সরোজ গুপ্ত, ডাঃ শান্তনু বন্দোপাধ্যায়, ডাঃ এসপি ঘোষ, ডাঃ ব্যোমকেশ ভট্টাচার্য– এঁদের কথা বলেছি। এবার বলি একটু অন্যদের কথা। সবিনয়ে একটি কথা জানিয়ে রাখি, এইসব মহান ডাক্তারবাবুদের কেউই কিন্তু সরাসরি আমার শিক্ষক নন, তবু এঁদের স্নেহডোরে আমি বাধা পড়েছিলাম।

আবিরলাল মুখোপাধ্যায়। এক সময় এই রাজ্যের রীতিমতো স্টার ডাক্তার ছিলেন অর্থাৎ তারকা ডাক্তার। ছিলেন কান নাক গলা বিশেষজ্ঞ। অর্থাৎ আমার বিভাগের ডাক্তার। আর জি কর-এ পড়ার সময় ওঁর নাম এত শুনেছি যে, মনে হতো মানুষটিকে একবার চাক্ষুষ দেখা দরকার। ইএনটি-তে হাউস স্টাফশিপ করার সময় একবার সেই সুযোগ মিলে গেল। ইএনটি অ্যাসোসিয়েশনের একটি কনফারেন্সে প্রথম তাঁকে দেখলাম। বেশ দীর্ঘদেহী, সৌম্য দর্শন, বিরল কেশ মানুষ। জুনিয়রদের সঙ্গে খুবই সহজ সরল ভাবে কথা বলছিলেন, হাসিঠাট্টাও করছিলেন। অনেকে স্যারের সঙ্গে গিয়ে ফটো তুলছিল। প্রথম দর্শনে আমার সেই সাহস হয়নি।

বইমেলায় ডাঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র।

স্যারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা লেখালেখির সূত্রেই। ডাক্তারদের কিছু সমস্যা নিয়ে আনন্দবাজার সম্পাদকীয় পাতায় আমার একটি দীর্ঘ চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল ৯০-এর দশকের গোড়ায়। স্যার সেটা মন দিয়ে পড়েছিলেন। দেখা হতেই প্রশংসা করলেন। তখন আমি খুব বিনীতভাবে জানালাম যে, স্যার আমি নানা বিষয়ে একটু লেখালেখি করছি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। শুনে স্যার বললেন, ‘ভেরি ভেরি গুড। জানো, পেশার বাইরেও একটু অন্য বিষয় নিয়ে লেখাপড়া আমারও খুব ভালো লাগে। আসলে আমি তো সেই পথের পাঁচালীর স্রষ্টা বিভূতিভূষণের ছাত্র ছিলাম। আমি তাঁকে নিয়ে একটি ছোট বইও লিখেছি। তুমি পড়ে দেখতে পারো’। ‘মিত্র ও ঘোষ’ প্রকাশনার এই বইটি আমি পরে কিনে পড়েছিলাম। ভালো লেগেছিল। বইটি এখন আর আমার কাছে নেই। কাকে পড়তে দিয়েছিলাম, মনেও নেই। সম্ভবত বইটির নাম ছিল ‘আমার শিক্ষক বিভূতিভূষণ’।

এরপর ১৯৯১ সালের বইমেলায় দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত আমার বইয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্যারকে আমন্ত্রণ করেছিলাম। আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বও ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন। সেদিন বুঝেছিলাম যে স্যারের জনপ্রিয়তা কোন লেভেলে। বাংলায় খুব সুবক্তা ছিলেন স্যার, এমন হয়তো নয়, কিন্তু ওঁর উপস্থিতিই পুরো মঞ্চ ভরিয়ে রাখত। এরপর একাধিকবার উনি বইমেলায় আমার আমন্ত্রণে গিয়েছেন। ধীরে ধীরে একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরিও হয়েছিল। ল্যান্ডলাইনে সরাসরি ফোন করে কতবার যে স্যারের চেম্বারে পেশেন্ট পাঠিয়েছি! স্যার শুধু বলতেন, ‘সময় হাতে করে আসতে বলবে। সব রোগী দেখা শেষ হলে আমি ডেকে নেব। এসে শুধু রিসেপশনে তোমার নাম বলতে বলবে, পারলে তোমার একটা কার্ডও পাঠিয়ে দিও। ওটা রিসেপশনে দেখাতে বলো’। তখন স্যারের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া মানে লটারির টিকিট পাওয়া। আমার একটি বইয়ের নামকরণও স্যার করেছিলেন। বইয়ে কী কী ধরনের লেখা থাকবে, ভালো করে আমার কাছ থেকে জেনে নিয়ে চটজলদি বললেন, তোমার এবারের বইয়ের নাম রাখো ‘সুখে থাকবেন না অসুখে’। আমার জীবনের প্রথম বই, বলা যায় আমার প্রথম সন্তান ‘শরীর স্বাস্থ্য জিজ্ঞাসা’ বইয়ে একটি দীর্ঘ ভূমিকাও লিখেছিলেন। এই ভূমিকাটি আনতে এক বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় আমি স্যারের বাড়ি গিয়েছিলাম। মনে আছে স্যার নিজে ফ্রিজ থেকে চিকেনের ঠ্যাং বার করে একজনকে ডেকে বলেছিলেন, ‘এই দুটো ভালো করে ভেজে দাও। অমিতাভ খাবে’।
স্যারের মহানুভবতার সাক্ষী একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। বছর তিরিশেক আগের ঘটনা তো হবেই। তখন আমি ব্যারাকপুরে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশনে আউটডোর করি। মহারাজ স্বামী নিত্যানন্দ একদিন মিশনের একজন স্টাফকে আমার আউটডোরে পাঠালেন। দীর্ঘদিন তাঁর গলা ভেঙে রয়েছে, ভালো করে কথাও বলতে পারছেন না। সম্ভবত ভোকাল কর্ডে কোনও নডিউল অর্থাৎ গুটলি আছে সন্দেহ করে এক নার্সিংহোমে তাঁকে ভর্তি করাই। তারপর অজ্ঞান করে এন্ডস্কোপি করে সেই গুটলি বার করি এবং যথারীতি বায়োপসিতে পাঠাই। তারপর দিন সাতেক বাদে যখন রোগী আমাকে আবার দেখাতে আসেন, তখন অভিযোগ করেন, অপারেশন তো হলো, কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর তো ফিরলো না। আমি বলি, ধৈর্য ধরুন একটু সময় লাগবে। কিন্তু উনি ধৈর্য ধরতে রাজি হলেন না। আমাকে না জানিয়ে অন্য একজন সিনিয়র ইএনটি সার্জেনকে দেখিয়ে এলেন। এবং দেখানোর পর আমার আউটডোরে এসে হম্বিতম্বি শুরু করলেন। সেই সার্জেন নাকি তাঁকে বলেছেন, কোনও অপারেশনই নাকি আমি করিনি। গুটলি যেমন ছিল তেমনই আছে– ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক সময় রোগীরা এক ডাক্তারের সম্বন্ধে আরেক ডাক্তারকে এ ভাবে অনেক কিছু অভিযোগ করে থাকেন। এজন্য আমি রোগীর কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করে একটু খোঁজখবর নিয়ে জানলাম যে রোগীর কথাই ঠিক। ওই ইএনটি সার্জেন জুনিয়রদের সম্বন্ধে এই ধরনের কথাবার্তা নিয়মিতই বলে থাকেন।
রোগীর বাড়ির লোক আমাকে টেলিফোনে হুমকি দিতে শুরু করল। এমনকি, মহারাজও আমাকে ডেকে তিরস্কার করলেন। আমি তাঁদের বারবার বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, ওই ডাক্তারবাবু মিথ্যা কথা বলেছেন। যদি আমাকে বিশ্বাস না করেন, তাহলে অন্য আরেকজন সিনিয়র ডাক্তারের মতামত নিন। তাঁরা বললেন, যদি মতামত নিতেই হয়, তাহলে ডাঃ আবীরলাল মুখোপাধ্যায়ের মতামতই নেব। আপনি পারেন তাঁর একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করে দিতে? আমি দেখলাম আমার বাঁচার এই একটিই উপায়। আমি সেদিন রাতেই স্যারকে ফোন করে পুরো ঘটনাটি বললাম। স্যার বললেন, ‘তুমি কালকেই আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। আমি দেখে বুঝিয়ে বলে দেব। এমন তো হতেই পারে। পোস্ট অপারেটিভ ইডিমাও তো হয়। একটু স্টেরয়েড দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে’। বাস্তবে হলও তাই। স্যার দেখলেন। দিন দশেকের মধ্যে রোগীর গলার স্বরও ইমপ্রুভ করতে শুরু করল। পরে তাঁরা আমার কাছে এসে ক্ষমাও চাইলেন। একই প্রফেশনের দু’জন সিনিয়র ডাক্তারের সম্পূর্ণ বিপরীত মানসিকতা দেখার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য হয়েছিল আমার। এই দু’জন ডাক্তারের কেউই এখন আর বেঁচে নেই। কিন্তু সেই নিন্দুক ডাক্তার, যিনি আমার প্রফেশনাল কেরিয়ার শুরুর দিকে ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হতে যাচ্ছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁকে সবাই ভুলে গিয়েছে। কিন্তু আবীরলাল মুখোপাধ্যায়কে আমরা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। ইএনটি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রতিবছর তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে স্মারক বক্তৃতা আয়োজিত হয়। প্রতিটি কনফারেন্সে তিনি আমাদের অন্তরে সসম্মানে বিরাজ করেন। ওঁর কাছে উপকৃত হাজার হাজার রোগী এখনও বেঁচে আছেন এবং তারা স্যারকে এখনও দেবতার স্থানেই রাখেন।
ডাঃ সুনীল ঠাকুর। এক সময়ের প্রখ্যাত অর্থোপেডিক সার্জন এবং স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। আজ থেকে বছর ৪০ আগে কলকাতায় প্রথম স্পোর্টস মেডিসিন নিয়ে কাজকর্ম শুরু হয়। যাঁরা শুরু করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। স্যারের কাছে আমি কোনওদিনই পড়াশোনা করার সুযোগ পাইনি। উনি ছিলেন মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। আমার পড়াশোনা সব আর জি কর কলেজে। স্যার ছিলেন মিডিয়া পার্সোনালিটি। রেডিও, টিভিতে প্রোগ্রাম করতেন, বিভিন্ন সভা সমিতিতে যেতেন, আবার পত্রপত্রিকায় হাড়ের নানা সমস্যা নিয়ে লেখালেখিও করতেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় বহু বছর আগে স্যারের একটি ফটো দেখেছিলাম, যেখানে উনি গাভাস্কারের হাঁটুর চোট পরীক্ষা করছেন। স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি পাবলিক সেমিনার করতে গিয়ে স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। যেহেতু দু’জনেই বিভিন্ন মিডিয়াতে কাজ করতাম এবং লেখালেখিও করতাম, কাজেই আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠতা হতে বেশিদিন সময় লাগলো না।

ডাঃ সুনীল ঠাকুরকে সম্বর্ধনা দিচ্ছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।

একদিন স্যারকে আমি বললাম আপনার তো কয়েকটি বই বেরিয়েছে অনামী প্রকাশনা থেকে। দুটি বই আমার সংগ্রহ আছে। ছাপা অত্যন্ত নিম্নমানের, অজস্র বানান ভুল, কোনও মার্কেটিং নেই, কাজেই এই বইগুলো সাধারণ মানুষের কাছে কোনওদিনই পৌঁছবে না। আপনি যদি চান আমি দে’জের সঙ্গে কথা বলতে পারি। স্যার সম্মতি দিতেই আমি সুধাংশু শেখর দে-র সঙ্গে কথা বললাম এবং সেই বছর বইমেলাতে (সম্ভবত ১৯৯৫ সালে) স্যারের ‘বাতের রোগ’ বইটি প্রকাশিত হল দে’জ পাবলিশিং থেকে। পরপর পাঁচ বছর বেস্ট সেলার তালিকায় ছিল বইটি, দশটির উপর এডিশনও হয়েছে। স্যারের ইচ্ছানুসারে বইমেলাতে গিল্ড অডিটোরিয়ামে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান করে প্রকাশিত হল স্যারের বই এবং আমার সেই বছরের বইমেলার বই। এরপর থেকে ২০১০ পর্যন্ত প্রতিটি বইমেলায় বই প্রকাশ অনুষ্ঠান ছিল আমাদের জয়েন্ট ভেঞ্চার। বিভিন্ন জগতের বহু বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে স্যারের ঘনিষ্ঠতা ছিল। ডাক্তার সরোজ গুপ্তের পরে এ ব্যাপারে আমি ডাক্তার সুনীল ঠাকুরকেই রাখবো। তাঁরা স্যারকে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন এবং স্যারের ডাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন। সেই ভিআইপি তালিকায় রাজ্যপাল-মন্ত্রী থেকে শুরু করে খেলার জগৎ এবং সিনেমা জগতের বহুজন ছিলেন।

বইমেলার ডাঃ সুনীল ঠাকুর।

ডাঃ সুনীল ঠাকুরের সৌজন্যে আমার প্রথম রাজভবনে প্রবেশ। উপলক্ষ্য ছিল মাদার টেরিজা উপর স্যারের লেখা একটি বইয়ের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ। প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল স্বয়ং। স্যারের উদ্যোগে আমি শৈলেন মান্না, পিকে, চুনি গোস্বামীর মতো দিকপাল খেলোয়াড়দের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলাম। পরবর্তীকালে শৈলেন মান্নাকে আমি আইএমএ-র অনুষ্ঠানে, স্বাস্থ্যমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানেও নিয়ে এসেছি। মানুষটি বড্ড ভালো ছিলেন। অনুচ্চ স্বরে কথা বলতেন। ছিল না কোনও অহংকার। মৃত্যুর কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমার সঙ্গে টেলিফোনে নানা বিষয়ে প্রায়ই কথা হতো। আরেকজন বিখ্যাত মানুষকে স্যারের সৌজন্যে আমি কাছে পেয়েছিলাম। তিনি হলেন ডাঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র। খুব পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। এক সময় ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী। যখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল, তখন বয়স আশির কাছাকাছি। লাঠি নিয়ে হাঁটতেন। তবু আমার আমন্ত্রণে গোটা তিনেক অনুষ্ঠানে তিনিও গিয়েছেন। বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে খুব ভালোবাসতেন। যখন গাড়ি করে তাঁর সঙ্গে অনুষ্ঠানে যেতাম, নানা বিষয়ে কথা বলতেন। একবার ওঁর বাড়িতে গিয়েছি ওঁকে আনতে। উনি আমাকে সাদরে ভিতরে ডেকে নিয়ে বসালেন। তারপর ওঁর লাইব্রেরিটি ঘুরিয়ে দেখালেন। বহু দুষ্প্রাপ্য বই, এমনকি কৌটিল্য শাস্ত্রের পুঁথিও ওঁর সংগ্রহে ছিল।

স্যারের কাছ থেকে ক্রীড়া জগতের মানুষেরা নানাভাবে উপকৃত হয়েছেন। বহু গরিব খেলোয়াড়ের নানা ধরনের অপারেশন উনি খুব কম টাকায় করে দিতেন। আমিও বহু আর্থিক অসচ্ছল মানুষকে স্যারের কাছে পাঠিয়েছি। ওঁর নিজের নার্সিংহোমে অপারেশন করে দিয়েছেন। বহু সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। রক্তদান-সহ স্বাস্থ্য বিষয়ক যে কোনও অনুষ্ঠানে স্যারকে ডাকলেই পাওয়া যেত। এক বছর কলকাতার শেরিফও ছিলেন। স্যারের বয়স যখন ৭০, তখন কলামন্দিরে ‘সত্তর পেরিয়ে’ বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয়েছিল বহু জ্ঞানী গুণী মানুষের উপস্থিতিতে। নিজের জীবনের নানা ঘটনা এই বইতে লিখেছিলেন উনি।
এর কিছুদিন বাদেই বয়স জনিত নানা অসুখে আক্রান্ত হতে থাকেন স্যার। ব্লাড সুগার, হাইপারটেনশন– এগুলো তো ছিলই, তার সঙ্গে শুরু হয় অ্যালঝাইমার্স। চেনা মানুষের স্মৃতি ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে শুরু করে। নিজেকে ভীষণভাবে গুটিয়ে নেন। প্র্যাকটিস বন্ধ করে দেন। বাড়িতেও কারও সঙ্গে সেভাবে কথাবার্তা বলতেন না। একা থাকতে ভালোবাসতেন। সব ঘটনা জেনে আমি একবার দেখা করতে গিয়েছিলাম ওঁর বাড়িতে। অনেক সাধ্য সাধনার পর স্যার দেখা করলেন বটে, কিন্তু ওঁকে দেখে বুঝলাম, আমার সেই প্রিয় স্যার হারিয়ে গিয়েছেন, এ যেন অন্য কোনও মানুষ! আমার সঙ্গে কথা বলতে না পারলেই খুশি হন, একটু বাদে কথার মাঝখানে নিজেই উঠে চলে গেলেন বেডরুমের দিকে। ভীষণ কষ্ট লেগেছিল সেদিন। এমন একজন প্রাণচঞ্চল টগবগে মানুষ হঠাৎ করে এরকম হয়ে যেতে পারেন, এটা আমার ভাবনায় ছিল না। বছর দুয়েক চিকিৎসার পর অনেকটা ভালো হয়েছিলেন। অনেক চেষ্টা করে বেলঘরিয়া স্বাস্থ্যমেলাতে আমি নিয়েও এসেছিলাম। জীবনকৃতি সম্মানও দেওয়া হয়েছিল। স্যারের হাতে সম্মান তুলে দিয়েছিলেন সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু আর আগের জীবনে ফিরতে পারেননি ডাঃ সুনীল ঠাকুর। এখনও তিনি আমাদের মধ্যে আছেন। যতদিন আছেন, ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন, এই প্রার্থনা করি।

Skip to content