সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

বাংলাদেশের বহু হিন্দু পরিবারে প্রভু শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দরের নাম অত্যন্ত ভক্তিভরে স্মরণ করা হয়৷ ফরিদপুরের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন জায়গায় শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দরের বেশ কয়েকটি আশ্রম আছে৷ এরকমই একটি সুন্দর আশ্রম মুর্শিদাবাদ জেলার ডাহাপাড়ায়৷ গ্রাম হলেও এর ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছে পিচের রাস্তা৷ যদিও এই রাস্তা কোথাও কোথাও বেশ ভাঙাচোরা৷ সেই রাস্তা গিয়ে মিশেছে আর একটা মসৃণ বড় রাস্তার সঙ্গে৷ যাতায়াতে অসুবিধা নেই৷ ডাহাপাড়ায় বেশ কয়েকটি বর্ধিষ্ণু পরিবারের বসবাস৷ হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষই পারস্পরিক ভাব-ভালোবাসার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করে এখানে৷ শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দরের কুন্দশুভ্র নানা কারুকার্যময় সু-উচ্চ মন্দিরচূড়া অনেক দূর থেকে দেখা যায়৷

শ্রীপ্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দরের অমোঘ আকর্ষণ আমার মতো নগণ্য এক লেখক- সাংবাদিককেও ডাহাপাড়া আশ্রমে নিয়ে এসেছিল৷ ৫১ পীঠের এক পীঠ কিরীটেশ্বরী মন্দির দর্শনের পর আশ্রমে যখন পৌঁছলাম সূর্য তখন অস্তাচলে৷ ভারত সেবাশ্রম সংঘের দুজন সন্ন্যাসী আমার সঙ্গী৷ সংঘের বেলডাঙা শাখায় জগদ্ধাত্রী পূজা উপলক্ষে তাঁরা জামশেদপুরের আশ্রম থেকে এসেছেন৷ মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা শাখার প্রধান স্বামী প্রদীপ্তানন্দের আমন্ত্রণে নবমীর দিন সেখানে গিয়েছিলাম৷ তিনি যখন শুনলেন ডাহাপাড়ায় শ্রীশ্রীজগদ্বন্ধু ধামে যেতে আমি আগ্রহী, তিনি সানন্দে সম্মতি দিলেন৷ এমনকী দশমীর দিন সকালে ডাহাপাড়ায় যাওয়ার জন্য একটা মোটরগাড়ির ব্যবস্থাও করে দেন৷

স্বামী প্রদীপ্তানন্দ আমাকে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আমাদের আশ্রমের দুজন সন্ন্যাসীও যাবেন৷ ওঁরা মুর্শিদাবাদে হাজারদুয়ারিসহ কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থান একটু ঘুরেফিরে দেখতে চান৷ ফেরার পথে আপনারা ভালোভাবেই ডাহাপাড়া দেখে আসতে পারবেন৷’ ডাহাপাড়া আশ্রম যে এতবড় সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই ছিল না! যাইহোক, এই আশ্রম সম্বন্ধে কিছু কিছু তথ্য জানানোর আগে শ্রীপ্রভু জগদ্বন্ধুসুন্দরের জন্মবৃত্তান্তের কথা জেনে নিই৷ সংক্ষেপে তাঁর দিব্যজীবনের কিছু কথাও শুনি৷

বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ কুলতিলক পণ্ডিতপ্রবর শ্রীযুক্ত দীননাথ চক্রবর্তী ন্যায়রত্ন মহাশয় ভাগীরথীর তীরে একদা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদের ডাহাপাড়ায় বসবাস করতেন৷ তাঁর পৈতৃক বাড়ি ফরিদপুর জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে৷ দীননাথ চক্রবর্তীর পাণ্ডিত্য ও আদর্শ চরিত্র বহু মানুষকে অনুপ্রাণিত করে৷ তাঁর পত্নী বামাসুন্দরীদেবী রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী৷

তাঁদের প্রথম পুত্র গুরুচরণ শৈশবেই মারা যায়৷ দ্বিতীয় কন্যাসন্তান৷ এক রাতে বামাসুন্দরী দেবী স্বপ্ন দেখলেন এক জ্যোতির্ময় পুরুষ তাঁকে বলছেন, ‘সংসারটা অধর্মে পরিপূর্ণ হল৷ আমি শীঘ্রই হরিনাম প্রচার করিবার জন্য তোর কাছে আসিব৷’

এই স্বপ্ণের কথা বামাদেবী ক্ষমাময়ীদেবী ও আরও কয়েকজনকে বললেন৷ স্বপ্নের কথা শুনে সকলেই আনন্দিত হলেন৷ বামাদেবীর মন খুশিতে পরিপূর্ণ হল৷ তাঁর কোল আলো করে আসতে চলেছেন এমন এক মহাপুরুষ যিনি এই জগৎ-সংসারকে উদ্ধার করবেন৷ বামাদেবীর সন্তান হওয়ার লক্ষণ ক্রমশ প্রকাশ পেল৷

শ্রীপাদ কুঞ্জদাসজি তাঁর ‘শ্রীশ্রীপ্রভু জগদ্বন্ধু ও শ্রীশ্রীজগদ্বন্ধু ধাম’ গ্রন্থে শ্রীশ্রীপ্রভু জগদ্বন্ধুর প্রকট হওয়ার কাহিনি এভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন—‘১২৭৮ সাল, শুভ বৈশাখ মাস আসিল৷ সমগ্র রাঢ়দেশময় বৈশাখী শ্রীহরিনামের স্রোত৷ প্রাকৃত অপ্রাকৃত উভয়বিধ আনন্দ আজ ডাহাপাড়া গ্রামে উপস্থিত৷ বঙ্গাধিকারী রাজবাড়িতে অন্নপ্রাশন উৎসব; রাজা ব্রজেন্দ্রনারায়ণ রায় মহাশয় অতি সমাদরে ন্যায়রত্ন মহাশয় ও বামাদেবীকে আপনার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করিয়া লইয়াছেন৷ কার্য্য সমাধান্তে বঙ্গাধিকারী বাড়ি হইতে প্রত্যুষে তাঁরা নিজ বাড়িতে আসিয়াছেন৷ বামাদেবী গৃহের দ্বার খুলিয়াই দেখেন, গৃহ আলোকিত করিয়া সদ্যোজাত দিব্য শিশু বিরাজমান, শিশুর জ্যোতির্ম্ময়রূপ দর্শনে তিনি বাহ্যজ্ঞান হারা হইলেন৷ ন্যায়রত্ন মহাশয়ও গৃহাভ্যন্তরে আসিয়া নবজাত শিশুকে দেখিতে পাইলেন৷ ন্যায়রত্ন মহাশয়ের পুত্রসন্তান হইয়াছে এই সংবাদ গ্রামে ছড়াইয়া পড়িল৷ বঙ্গাধিকারী রাজবাড়ি হইতে বাদ্যভাণ্ডাদির ব্যবস্থা হইয়াছে৷

বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যা যখন একটি রাজ্য ছিল, তখন এই সংযুক্ত রাজ্যের রাজস্ব বিভাগের প্রধান কর্মকর্ত্তা ছিলেন ব্রজেন্দ্রনারায়ণের পূর্র্ব্বপুরুষ, তাঁহার উপাধি ছিল বঙ্গাধিকারী৷ ইহাদের বাড়ী বঙ্গাধিকারী রাজবাটী নামে খ্যাত৷

ন্যায়রত্ন গুণগ্রাহী বহুব্যক্তি এবং পুরনারীরা ন্যায়রত্নভবনে উপস্থিত হইয়াছেন৷ আনন্দ কোলাহলে ন্যায়রত্নভবন মুখরিত৷ সীতানবমী তিথি দণ্ড ৫৭৷৩৩ গতে ৫৮৷৩ মধ্যে শুভ মাহেন্দ্রক্ষণে শ্রীশ্রীহরিপুরুষ বন্ধুচন্দ্র এ ধরাধামে প্রকাশ হইলেন৷ শুক্রবার শেষ হইয়া শনিবার আসিতেছে এমন সময়৷ মনে হইতেছে শনিবারের প্রাতঃকাল জ্যোতির্ব্বিদ্গণের মতে সূর্যোদয় পর্য্যন্ত শুক্রবার৷ এইজন্য জন্মবার শনিবার না হইয়া শুক্রবার হইল৷ শ্রীবামাদেবী শিশুকে আপনার পুত্রজ্ঞানে কোলে লইলেন৷ তাঁহার গর্ভলক্ষণ অন্তর্হিত হইল৷

জন্মরহস্য সম্বন্ধে শ্রীশ্রীপ্রভুর শ্রীমুখের বাণী এইরূপ—ইং সন ১৮৯১ সাল ডাহাপাড়া (মুর্শিদাবাদ) ভট্টাচার্য্যদের বাগান বেলতলায় বেলা ১১টা প্রভু হাততালি দিয়া চম্পটী মহাশয়কে ডাকিয়া বলেন :—‘‘অতুল, আয় আজ তোকে আমার জন্মরহস্য বলি আমি অযোনিসম্ভব, যেমন শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীগৌরাঙ্গ৷ রাজধানী ভিন্ন অবতারের জন্ম হয় না৷ বঙ্গাধিকারী বাঙ্গালার শ্রেষ্ঠ ভূম্যধিকারী৷ রীতিমত গড় প্রাসাদপরিখাপরিবে৷ দীননাথ ন্যায়রত্ন বঙ্গাধিকারীর দ্বারপণ্ডিত৷ ন্যায়রত্ন এবং তাঁহার ব্রাহ্মণী অন্নপ্রাশন উপলক্ষ্যে বঙ্গাধিকারীর বাটী যান, ফিরিয়া আসিয়া দেখেন ঘরের ভিতর অপূর্ব সদ্যোজাত শিশু বর্ত্তমান, জ্যোতির্ম্ময় গৃহ আলোকে উদ্ভাসিত৷ ন্যায়রত্ন ও ব্রাহ্মণী স্তম্ভিত৷ অবশ্য ব্রাহ্মণীর গর্ভাভাসের লক্ষণ ছিল৷

লোকে জানিল যে, ন্যায়রত্নের ব্রাহ্মণী পুত্রসন্তান প্রসব করিয়াছে৷ কিন্তু উভয়ে এ গুহ্যকথা কাহাকেও প্রকাশ করে নাই৷ দেড় বৎসর পরে ব্রাহ্মণী নিত্যধামে গমন করেন৷ ভট্টাচার্য্য বাড়ীর ন’মা প্রতিপালন করেন৷ ন্যায়রত্ন জন্মলগ্ণ ঠিকুজি করিয়া রাখেন৷ ঐ সময়ে মহারাণী স্বর্ণময়ীর ওখানে একজন সন্ন্যাসী জ্যোতিষী আসেন৷ গঙ্গাধর কবিরাজের সহিত ন্যায়রত্নের বিশেষ সম্প্রীতি ছিল৷ কবিরাজ মহাশয় বলিলেন—ন্যায়রত্ন! তোমার ছেলের ঠিকুজিখানা এই সন্ন্যাসী ঠাকুরকে দিয়া গণনা করে দেখ না? গঙ্গাধরের অনুরোধে ন্যায়রত্ন ঠিকুজিখানি সন্ন্যাসী ঠাকুরকে দেখাইলেন৷
সন্ন্যাসী ঠিকুজি পাইয়া বলিলেন—আমি দেখে রাখব, তুমি অমুক দিন এসো৷ সেই দিন ন্যায়রত্ন গেলে, সন্ন্যাসী বলিলেন, ন্যায়রত্ন আমি ভালো করে দেখি নাই, তুমি আর একদিন এসো৷ দ্বিতীয় দিন উপস্থিত হইলে সন্ন্যাসী বলিলেন—হ্যাঁ, আমি বেশ করে দেখেছি, কিন্তু আমার কৌতূহল বৃদ্ধি হইয়াছে৷ আমি আর একবার ভালো করে দেখিব; তুমি অমুক দিন এসো৷ তৃতীয় দিন ন্যায়রত্নকে দেখিবামাত্র সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করিলেন :—ন্যায়রত্ন, তোমার ছেলে কি বেঁচে আছে? ন্যায়রত্ন বলিলেন, আপনি এমন কথা কেন বলিলেন? ছেলের কি কোনো গ্রহ ফাঁড়া আছে?

সন্ন্যাসী বলিলেন, না, সেকথা নয়৷ তুমি যখন এলে তখন ছেলে কী করছিল? ন্যায়রত্ন বলিলেন, খোকা উঠানে হামাগুড়ি দিয়া বেড়াচ্ছিল৷ সন্ন্যাসী বলিলেন—তুমি এক কাজ কর, তোমার ছেলেকে নিয়ে এসো৷ আমি তাকে দেখব৷ ন্যায়রত্ন চলিয়া গেলেন, গঙ্গা পার হইয়া খোকাকে কোলে করিয়া সন্ন্যাসীর নিকট আসিলেন৷ সন্ন্যাসী দুই হাত বাড়াইয়া খোকাকে নিলেন এবং পা-দুখানি বক্ষ সংলগ্ণ করিয়া জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে লাগিলেন৷ ন্যায়রত্ন ভীত হইলেন৷ বলিলেন, আপনি সন্ন্যাসী, খোকার অকল্যাণ কেন করিতেছেন?

সন্ন্যাসী সে কথার উত্তর না দিয়া মাথার উপর খোকার পা-দুখানি রাখিলেন ও বলিলেন, ন্যায়রত্ন! আমি এতদিনে বুঝিতে পারিলাম যে সুদূর নেপাল হইতে সহসা বাঙ্গালায় কেন আসিলাম? এইরূপ ভাগ্য প্রতি অবতারে একজনের ঘটিয়া থাকে৷ আজ আমার সেই ভাগ্য উপস্থিত৷ তোমাকে আর আমি কি বলিব? যে পাঁচটি গ্রহের সঞ্চার ও সংযোগে অবতারের আবির্ভাব হয় যেমন, শ্রীরামচন্দ্র, লক্ষ্মণ—সেই পাঁচটি গ্রহই তোমার পুত্রের জন্মলগ্ণে তুঙ্গস্থ৷ ইনি জগৎ উদ্ধার করিবেন, ইহা হইতে জীব কৃতার্থ হইবে৷ ইহার পর সেই জ্যোতিষী সন্ন্যাসীকে আর কেহ মুর্শিদাবাদ শহরে দেখে নাই৷
‘দেশকাল সুপাত্রজ্ঞঃ শাস্ত্রচক্ষুঃ শুচির্ব্বশী’

ভবিষ্যৎকালে মহা আবির্ভাবের কথা জানিতে কোনোরূপ অসুবিধা না ঘটে তাই দয়া করিয়া শ্রীমুখে জন্মকথা বলিয়াছেন৷ স্বয়ং ভগবানের শ্রীমুখের বাণী পরম সত্য৷ ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই৷ এবার স্বয়ং জন্মস্থান নির্দ্ধারণ করিয়া এবং ভক্তদের দর্শন করাইয়া জন্মস্থানের প্রকাশ করিলেন৷’

প্রভু শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দরের আবির্ভাব—শ্রীশ্রী ডাহাপাড়া ধাম৷ মাত্র দেড় বছর বয়সে মাতৃবিয়োগ হয় শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দরে৷ মাতৃবিয়োগের পর সাধের ডাহাপাড়া ধাম ছেড়ে যান৷ এখন ষোলো বছরের এক কিশোর শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দর৷ ন্যায়রত্ন মহাশয়ের বসতবাড়ি জঙ্গলে পরিপূর্ণ৷ শ্রীরাধাগোবিন্দের সেবা-কুঞ্জটি সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত৷ তবে শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দরের এই জন্মভিটায় বেলগাছ ও ডালিম গাছদুটো বেশ বড়সড় তরতাজা চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷

নবকিশোর প্রভু জগদ্বন্ধু বেলগাছের নীচে এসে দাঁড়িয়েছেন৷ শুভ্রবস্ত্রে আচ্ছাদিত শ্রীঙ্গ তাঁর৷ একজন দু’জন করে ক্রমশ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ এসে ওই জায়গায় ভিড় করল৷ সকলের মনেই প্রশ্ণ—কে ইনি?
জন্মভিটা থেকে প্রভু ধীর পদক্ষেপে এসে পৌঁছলেন ক্ষৌরকার চন্দ্রর খড়ের চালের ভাঙাচোরা বাড়িতে৷ প্রভু সুমধুর কণ্ঠে বললেন, ‘চন্দ্র আমার মুণ্ডন করিয়া দাও৷’ এই স্নেহমাখা আবদার শোনামাত্রই চন্দ্র ক্ষৌরকাজের যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে পড়ল৷
ক্ষৌরকাজ শেষ হল৷ চন্দ্র হঠাৎ লক্ষ করল তার পাশে একটি চকচকে রৌপ্যখণ্ড৷ সেটা তুলতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হল৷ তারপর চোখ ফেরাতেই অবাক কাণ্ড! যে কিশোরটি তার কাছে মস্তক মুণ্ডন করাতে এসেছিল,আশপাশে কোথাও নেই৷

মুণ্ডিত মস্তক ওই কিশোর গঙ্গাস্নানের পর পুনরায় ফিরে এলেন ন্যায়রত্ন মহাশয়ের বিল্ববৃক্ষমূলের পাদদেশে৷ সেই মুহূর্তে মানুষের ভিড়৷ ন’মা
ক্ষমাময়ীদেবী এই সংবাদ শোনামাত্রই দৌড়ে এলেন সেখানে৷ সেই মুহূর্তে পিতা-মাতার চরণ স্মরণ করে আবির্ভাব পীঠে প্রণাম করছেন প্রভু শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দর৷ ন’মা ‘বাবা বাবা’ বলে ডাকতেই প্রভুর মনোযোগ ভঙ্গ হল৷ তাঁকে দেখেই শ্রীজগদ্বন্ধু প্রণাম করতে গেলেন৷

ক্ষমাময়ীদেবী কয়েক পা পিছিয়ে এলেন৷ জন্মাবধি প্রায় দেড় বছর যে শিশুপুত্রকে বুকে তুলে লালনপালন করেছেন, তাঁকে এত বছর পর চোখের সামনে দেখে বাৎসল্য রসে ভরে ওঠে মন৷ ন’মা শুধু ‘বাবা বাবা’ বলে কাঁদছেন৷ এবার নিজের গলার রুদ্রাক্ষের মালাটি খুলে শ্রদ্ধাভরে ন’মার হাতে দিয়ে প্রভু বললেন, ‘ন’মা, এই মালার সঙ্গে আমিও তোমার হইয়া রহিলাম৷’ মালাটি ভক্তিভরে মাথায় ঠেকিয়ে ন’মা গলায় পরলেন৷

বাংলা ১২৯৫-এর শেষভাগ থেকে ১২৯৭ সনের প্রথমভাগ পর্যন্ত প্রভু বন্ধুসুন্দর যে কোথায় ছিলেন সঠিকভাবে কেউ জানে না৷ তবে অনুমান এই দীর্ঘ সময় তিনি ভারত ও ভারতের বাইরে বিভিন্ন তীর্থ পরিভ্রমণ করেন৷
ব্রজমণ্ডলে যাবেন শ্রীবন্ধুসুন্দর৷ তার আগে শ্রীশ্রীগোবিন্দজিকে দর্শনের জন্য জয়পুরে এসে উপস্থিত হলেন৷
একদা ব্রজধামেশ্বর শ্রীশ্রীগোবিন্দজি কীভাবে সুদূর ব্রজভূমি থেকে জয়পুরে এলেন?

একদিন স্বপ্ণাদিষ্ট শ্রীশ্রীগোবিন্দজির শ্রীবিগ্রহ উদ্ধার করলেন শ্রীরূপ গোস্বামী৷ কিন্তু চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে তাঁর চোখে-মুখে৷ বিধর্মী অত্যাচারীদের ভয় রয়েছে৷ সেইসময় এই শ্রীবিগ্রহ রক্ষা করার জন্য তৎকালীন জয়পুরের মহারাজা সচেষ্ট হন৷ তিনি শ্রীবিগ্রহকে সোজা তাঁর রাজ্যে নিয়ে এসে মহা ধুমধাম করে প্রতিষ্ঠা করেন৷

শোনা যায়, প্রভু শ্রীজগৎসুন্দর জয়পুররাজের আতিথ্য গ্রহণ করেন৷ রাজাকে শ্রীশ্রীযুগলকিশোরের ভজন বিষয়ক কিছু দুর্লভ উপদেশও দান করেন৷
‘কৃপা পাব, ব্রজে যাব, অমনি পশিব শ্রীবৃন্দাবনে৷
কুঞ্জে মেগে খাব, গুণ গাব, বেড়াইব বনে বনে৷৷’


প্রভু শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দরের শ্রীকণ্ঠ নিঃসৃত কথাগুলো যে কতটা সত্য তার প্রমাণ পেতে দেরি হয় না৷ ব্রজধামে তিনি এলেন৷ ‘হা গৌরাঙ্গ’ বলে দ্বাদশবন পরিক্রমণ করলেন৷ ব্রজবাসীর কাছে ‘মাধুকরী’ করলেন৷ ‘কুঞ্জে কুঞ্জে করপুটে মুঞ্জ মাধুকরী৷’ ৮৪ ক্রোশ ব্রজমণ্ডল পরিক্রমাও সাঙ্গ হল৷ প্রভু শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দরে শ্রীকণ্ঠে উচ্চারিত হল,
‘কুণ্ডে কুণ্ডে স্নান করি সমাধান, আসিব রাসমণ্ডলে৷
নয়নে নেহারি দুবাহু পসারি, লুটাব হা রাধা বলে৷৷’


ললিতাকুণ্ডে, শ্যামকুণ্ডে পুণ্যস্নানের পর রাধাকুণ্ডের তীরে এসে দাঁড়ালেন তিনি৷ তারপর ‘হা রাধে হা রাধে’ বলে কুণ্ডের পাশেই জড়বৎ পড়ে গেলেন৷

কিছুদিন ব্রজধামে অতিবাহিত করে প্রভু বাংলা অভিমুখে রওনা হলেন৷ পথে হঠাৎ কী ভেবে ট্রেন থেকে আড়া স্টেশনে নেমে পড়েন৷ তারপর হাঁটতে হাঁটতে এক বাড়ির দরজায় এসে ‘হরে কৃষ্ণ’ বলে ডাক দিলেন৷ সুমধুর সেই ডাক শুনে এক কুলবধূ ঘোমটা টেনে দরজা খুলতেই হতবাক! এ তো ছোটমামা! ক্ষীরোদার আনন্দের সীমা নেই৷ প্রভু বন্ধুসুন্দর ঘরের ভেতরে গিয়ে মৃগচর্ম পেতে উপবেশন করলেন৷ ক্ষীরোদা প্রণাম করলেন৷

দিগম্বরীদেবীর মেয়ে ক্ষীরোদা স্বামী অতুলচন্দ্রের সঙ্গে আড়ায় থাকেন৷ অতুলচন্দ্র আড়া হাই স্কুলের হেডমাস্টার৷ ছোটমামাকে কাছে পেয়ে তাঁদের আনন্দ ধরে না৷ ক্ষীরদাসুন্দরীর দুই মেয়ে৷ বড় সরযূ কিছুদিন আগে মারা যাওয়ায় ক্ষীরোদা শোকাকুলা৷

বন্ধুসুন্দর তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘ক্ষীরোদা, তুই সরযূর জন্য দুঃখ করিসনে৷ তোর গর্ভে জন্ম নিয়ে সে শাপমুক্ত হয়েছে৷ সে সরযূ নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী৷ আমি যখন এবারে সরযূ নদীতে স্নান করতে গেলাম, তখন তোর সরযূ দুটি ছোট হাত মেলে আমার সামনে দাঁড়াল৷ আমি তাকে আদর করলাম৷ সে জলের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল৷’

ত্রিতাপহারী বন্ধুসুন্দরের স্নিগ্ধগ মধুর প্রবোধ বাক্যে ক্ষীরোদাসুন্দরীর শোকাবেগ অনেকখানি প্রশমিত হল৷ বন্ধুসুন্দর ব্রজভূমির ধূলিকণা ক্ষীরোদার মাথায় দিয়ে বললেন, ‘রজরানির কৃপায় কৃষ্ণভক্তি হয়৷’ ব্রজের রজ ভক্তিভরে গ্রহণ করলেন ক্ষীরোদা৷ ছোট মেয়ে সরসীর মাথায় ছুঁইয়ে দেন৷ অতুলচন্দ্রও ব্রজের রজ গ্রহণ করেন৷

ছোটমামার জন্য মটকার বস্ত্র ও উত্তরীয় কিনে এনেছেন ক্ষীরোদা৷ ভাগ্ণীর অনুরোধে তা পরিধান করলেন প্রভু৷ উত্তরীয়র সঙ্গে তাঁর শ্রীঅঙ্গের রূপ যেন একেবারে মিশে গিয়েছে৷ ক্ষীরোদাদেবী এবং অতুলচন্দ্র নয়নভরে সেই রূপ দেখতে লাগলেন৷ দিন দুয়েকের বেশি ক্ষীরোদার বাড়িতে থাকলেন না প্রভু বন্ধুসুন্দর৷ বঙ্গদেশের উদ্দেশে রওনা হলেন৷ —চলবে

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content