সোমবার ১১ নভেম্বর, ২০২৪


ধ্রুবাক্ষ রায়, সোহান কুণ্ডু, প্রীতম মাইতি
লেখকত্রয় দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র, রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রম উচ্চ বিদ্যালয় (উচ্চ মাধ্যমিক), রহড়া, কলকাতা

পচাঁত্তর বছরের স্বাধীনতা—বহু বিপ্লবীর অদম্য জেদের ফলশ্রুতি। দেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকেরই তার মাতৃভূমির প্রতি যেমন কর্তব্য আছে, তেমনই স্বাধীন দেশের কাছ থেকেও সাধারণ মানুষ বেশ কিছু দাবি রাখে। আসমুদ্রহিমাচল প্রায় সকল নাগরিকই দিনটির তাৎপর্য বিষয়ে অবগত। স্বাধীনোত্তর পচাঁত্তর বছর—এই সুদীর্ঘ সময়কালে দেশের বুকে নানা ঘাত প্রতিঘাত এসেছে। এসেছে বহু প্রতিবন্ধকতা। বিবিধ প্রতিকূলতা সর্বদাই নতুন কিছুর উন্মেষের জন্য অক্সিজেন যোগান দেয়, তাই স্বভাবতই সেই সকল ত্রুটি বা প্রতিঘাত, সে সব কিছু থেকে শিক্ষা নিয়েই দেশ পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যাঁদের উপর ভর করে এই প্রত্যাবর্তন, তাঁরা দেশের সাধারণ মানুষ। দেশের নাগরিকই হল দেশের মূল জীবনী শক্তি। নাগরিকের স্বার্থরক্ষা দেশের শাসকের প্রাথমিক কর্তব্য।

স্বাধীনোত্তর পর্বে প্রাথমিক ভাবে দেশকে উদ্বাস্তু সমস্যা, দেশভাগজনিত নানা সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে। পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। আস্তে আস্তে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, সবুজ বিপ্লবের মতো যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়েছে। দেশের মহাকাশ গবেষণায় ইসরোর অবদান অনস্বীকার্য। আজ অবধি ইসরোর তত্ত্বাবধানে প্রায় একশো সতেরোটি মহাকাশ অভিযান হয়েছে। সর্বদাই যে তা সাফল্য পেয়েছে, তা নয়। অতি সাম্প্রতিক চন্দ্রযান-২ আর চন্দ্রাভিযান উল্লেখযোগ্য। প্রাক্তন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম-এর হাত ধরে দেশের পরমাণু শক্তির বিকাশ ঘটে। আজ ভারত বিশ্বের অন্যতম পরমাণু শক্তিধর দেশ।
মোট কথা, এই সাড়ে সাত দশকে দেশের পরিকাঠামো-সহ আর্থসামাজিক কিছু উন্নয়ন হলেও এখনও অনেকটা পথ আমাদের চলতে হবে। দেশের পরিকাঠামো ধরে রাখে অর্থনীতি। স্বাধীনতা উত্তর ভারতের অর্থনৈতিক পরিক্রমাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পরিসংখ্যানের একটি তালিকা দেওয়া যেতে পারে। স্বাধীনতার কাছাকাছি সময় প্রতি ১০০ জন শিশুর মধ্যে ৪০ জন দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকলেও, এখন সেটা ২২। যদিও দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে সংখ্যাটা নেহাতই কম নয়, প্রায় ২৪ কোটির কাছাকাছি। আজও ভারতের শিক্ষিত দক্ষ লোকেরা চাকরি করছে বিদেশি সংস্থায়। ভারতীয়দের মেধার ফল তুলছে একাধিক দেশ। এর জবাব দেওয়ার জন্য দরকার আরও দেশীয় সংস্থা ও আন্তর্জাতিক মানের ব্র্যান্ড গড়ে তোলা এবং সব স্তরের মানষুকে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির সুযোগ দিয়ে স্বনির্ভরের ব্যবস্থা করা। সর্বস্তরের মানুষের কাছে সুযোগ সুবিধা তুলে ধরার মধ্যে দিয়েই বিকশিত হবে অর্থনীতি। কিন্তু এখনও সমাজের উচ্চ স্তরের ধনীদের হাতে ক্ষমতার জাদুকাঠি কুক্ষিগত আছে।

কৃষিভিত্তিক ভারতবর্ষে স্বাধীনতার সময় থেকে জাতীয় আয়ের শতকরা ৫৪ ভাগ রোজগার হতো। তা এখন কমে প্রায় ১৫ ভাগের মতো। শিল্পের উৎপাদনশীলতা অবশ্যই দরকার আছে। কিন্তু এর পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রের দিকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা আজও প্রায়শই শোনা যায়। এই ঘটনা কমাতে আমাদের দায়িত্ব কৃষকদের যোগ্য সম্মানের সঙ্গে তাদের প্রাপ্য রোজগারের ব্যবস্থা করা। কারণ, ফসল উৎপাদনের পর তার বিক্রি এবং মুনাফা চলে যায় সমাজের উচ্চস্তরের মানুষের কাছে, ফলে স্বাভাবিক ভাবেই কৃষকের আয় অনেক কম। তাই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সমাজের নিচু স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দিকটিও মনে রাখতে হবে।
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। তবে বর্তমানে এই শিক্ষাব্যবস্থার মান অনেকটাই কমেছে। সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে এখনও উপযুক্ত শিক্ষা পৌঁছয় না। নিচু স্তরের মানুষ আজও এই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। তাই এই পচাঁত্তরতম স্বাধীনতা দিবসে আমাদের দায়িত্ব সমাজের সকল স্তরের মানুষকে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া।

স্বাধীনতার প্রাক্কাল থেকে যে বর্ণবৈষম্য এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রথা প্রচলিত রয়েছে, তা আজও সমাজ এবং মানুষের চিন্তা থেকে দূরীভূত হয়নি। আজও নিজের স্তরের মানুষেরা যোগ্য সম্মান ও সামাজিক স্বীকৃতি পায় না–এর বহু উদাহরণ আজও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হয়ে চলেছে। তাই প্রত্যেক মানুষকে মানুষ হিসেবে যোগ্য সম্মান দেওয়া এবং তাকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের নিজেদেরই।

স্বাধীনতা উত্তরপর্বে বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক মজবুত হয়েছে, তেমনই দেশের স্বার্থরক্ষার জন্য বিভিন্ন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বহু জওয়ান প্রাণ হারিয়েছেন। ১৯৬২ এর ভারত-চিন যুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস যেমন ভোলার নয়, তেমনই ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাও বিরাট। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের সুরক্ষা, প্রতিরক্ষা খাতে প্রচুর বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। সেসব খাতে বিনিয়োগের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়-স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ উত্তরোত্তর কমছে, যা দেশের মানুষের স্বার্থকে লঙ্ঘিত করে।
দেশের মানুষের মধ্যে মধ্যযুগীয় বর্বরতা এতই বদ্ধমূল যে, তারা সে সবকে ত্যাগ করতে পারেনি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখনও এরকম প্রচুর ঘটনার খবর মেলে। আমাদের মানব উন্নয়ন সূচক (এইচডিআই) এখনও বহু উন্নয়নশীল দেশের থেকে কম (০.৬৪৫)। সামাজিক সুরক্ষার দিকটিও আরও মজবুত করতে হবে। স্বাধীনতার আজ পচাঁত্তর বছর পরেও দেশের বহু প্রান্ত থেকে ধর্ষণ, খুন-সহ নৃশংস, পাশবিক ঘটনার খবর মেলে। এত কিছুর পরও দেশের বিচার ব্যবস্থায় আস্থা রেখে মানুষ বেঁচে আছে। এখনও এত কিছুর মধ্যেও মানুষ মুষড়ে পড়েনি।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এখনও দেশে উল্লেখযোগ্য ভাবে শিল্পের বিকাশ ঘটেনি। ‘৪৭ এর আগে যেগুলো গড়ে উঠেছে, সেগুলোই কোনক্রমে চলছে। অথচ দেশে বড় শিল্পপতির অভাব নেই। দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পোন্নয়ন অত্যন্ত প্রয়োজন। তার প্রাথমিক পদক্ষেপ হল শিল্পবান্ধব বিনিয়োগ— উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা। তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশের মানবসম্পদের উন্নয়ন।

সর্বোপরি, এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথের মধ্যে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজও দেশবাসী তাদের অদম্য প্রাণশক্তি জোরে বেঁচে আছে। ভারতবাসীই ভারতের আত্মা। নানান সাফল্য, বিফলতাকে সঙ্গী করে, দেশবাসী আগামী দিনে বিশ্বের দরবারে নিজের মর্যাদা বজায় রাখবে। বিজ্ঞান–প্রযুক্তি এবং অধ্যাত্মবাদ দুয়ের সমন্বয়ে সম্প্রীতির আবহে দেশ বেঁচে থাকুক—এটাই আমাদের আশা। তবে এই প্রশ্ন থেকেই যায়—এই স্বাধীনতা কি সত্যিই আমাদের অর্জিত? আমাদের এই পচাঁত্তর বছরের স্বাধীনতা কি পরিণত নাকি শৈশবেই সীমাবদ্ধ?

মতামত ব্যক্তিগত

Skip to content