রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


বনেজঙ্গলে ভণিতা নেই, মিথ্যাচার নেই- তাই বন্যেরা বনে সুন্দর।

 

প্রতিশ্রুতি

বিনয় যেন তার মনের সব দ্বিধা উজাড় করে দিতে চাইছে আর অবাক হয়ে তাকে দেখছে স্বর্ণময়ী। এতদিন দারিদ্রকে মিথ্যে আর ভণিতার আড়ালে-আবডালে ঢেকে রাখতেই দেখেছে সে। মেরুদণ্ড সোজা রেখে এভাবে কাউকে নিজের অজানা আত্মকথা বেআব্রু করতে দেখেনি স্বর্ণ। তবে তার জানার, প্রকৃত বিনয়কে চেনার আরও বাকি ছিল।

—‘দেখুন আপনারা সম্ভ্রান্ত মানুষ, আপনার বাবা আপনাদের যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বড় করেছেন। আপনার দিদি বা জামাইবাবুরা সমাজের যে স্তরে রয়েছেন আপনি তাতেই অভ্যস্ত। আপনি বা আপনারা কেউই আমাদের পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারবেন না। আমার সঙ্গে আপনার বিয়েটা শেষমেশ একটা দূর্ঘটনা হবে। এই কথাগুলো আপনার মা-বাবাকে আমার বাড়িতে বসে বলাটা খুব অনুচিত হতো। তাই আমি আপনাকে সরাসরি এ কথাগুলো জানাতে চেয়েছিলাম আর ঠিক সেই কারণেই আজ আমি মাকে নিয়ে এসেছি।

—মনের সব গ্লানি সব দোটানা দূর হয়েছে? এবার আমার কথা শুনুন। আপনি ঠিকই বলেছেন হাওড়া স্টেশন থেকে মধুপুর ঘণ্টা সাতেকের এই যাত্রায় আপনিও আমাকে ঠিক করে চিনতে পারেননি। আপনি যেরকম মানুষের কথা ভাবছেন —আমি, বা আমার মা-বাবা সেরকম নন। আমার বুড়িমা মানে আমার ঠাকুমা বেঁচে থাকলে আপনাকে দেখে খুশি হতেন। আপনার এই লম্বা স্বীকারোক্তিতে এমন একটা কথাও ছিল না যেটা শুনলে কোনও মানুষ আপনাকে অশ্রদ্ধা করতে পারে। আপনার সঙ্গে বিয়ে হবে কি না সেটা ঈশ্বর জানেন আর সে বিয়ে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা হবে না দূর্ঘটনা সেটা বলবে ভবিষ্যৎ।
স্বর্ণময়ীর কথাগুলো শুনতে শুনতে অবাক হয়ে যাচ্ছে বিনয়। এলোমেলো হাওয়ার ঝাপটায় স্বর্ণর আঁচল উড়ছে। অবাধ্য আঁচলকে শাসনে এনে বলে চলে স্বর্ণময়ী।

—কিন্তু দু’জন মানুষ স্বামী-স্ত্রী হন সংসারের দ্বায়িত্ব ভাগ করে নেবার জন্যে – চাহিদা মেটাতে নয়। একজন ঘর সামলান অন্যজন সামলান বাইরেটা। আমার দাদু ক্ষিতিমোহন বসু ডাক্তার ছিলেন। বুড়িমা মানে আমার ঠাকুমা নিভাননী রাজচন্দ্রপুরের মেয়ে। আমাদের এই বরানগর চৈতন্য ঘাটের ওপারে — বেলুড় বালি। বালির পরে রাজচন্দ্রপুর গ্রাম। বুড়িমা মজা করে বলতো এই ছাদ থেকে এসে জোরে চেঁচালে তাদের বাড়িতে সবাই শুনতে পাবে। বুড়িমা আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিল — গল্প উপন্যাস পড়ার অভ্যেস বুড়িমার থেকেই পাওয়া। আমি ছোটবেলা থেকে খুব বেশি কথা বলি। খুব প্রশ্ন করি। এটা কেন হয় ওটা কেন হয়? আমার দুই দিদি আমার থেকে বেশ বড়। বড়দিদি মেজদিদি পিঠোপিঠি। ওদের যখন বিয়ে হল দেখলাম সাতপাকে কনেকে বরের চারদিকে ঘোরানো হল।

কথা বলতে বলতে ছাতের উঁচু আলসেতে হাত রাখে স্বর্ণ।

—মেজদিদির বিয়ের সময় আমি বুড়িমাকে বললাম মেয়েকে এ ভাবে বরের চারপাশে ঘোরানো কেন হয়
—সাতপাকে ঘোরানোর মানেটা কি? বুড়িমা বলল পাঁচজনের সামনে মানে সমাজের সামনে পান পাতা দিয়ে মুখ ঢেকে কনে এল। এবার সাতপাকে তাদের দু’জনকেই নিঃশব্দে সাতটি প্রতিজ্ঞা করতে হয়। সেই প্রতিজ্ঞা সম্পন্ন হলে তবেই শুভদৃষ্টি হয় একে অপরকে প্রথমবার দেখে। মালা বদল হল হিন্দু মতে একজন পুরুষ ও নারীর বিবাহিত জীবনযাপন করার প্রাথমিক সম্মতি। এরপর বাকি নিয়ম পালন করে পাণিগ্রহণ ও অগ্নিকে আহুতি দিয়ে সিঁদূরদান। আপনি জানেন সাত পাকের সাতটি প্রতিজ্ঞা কী কী?’

—না। আমার কোনও বুড়িমা ছিল না।

—প্রথম পাকে ভবিষ্যতের স্বামী-স্ত্রী দু’জনে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যত্ন নেওয়ার অঙ্গীকার নেন। দ্বিতীয় পাকে স্বামী, স্ত্রী-কে সমস্ত রকম বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেন। তৃতীয় পাকে পরিবারের উন্নতির জন্য অর্থ উপার্জনের প্রতিশ্রুতি দেন। চতুর্থ পাকে স্বামী পরিবারের কল্যাণের ভার স্ত্রীর হাতে অর্পন করেন। পঞ্চম পাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসের প্রতিশ্রুতি নেন। ষষ্ট পাকে পরস্পরের প্রতি অনুগত থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। সপ্তম পাকে স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরের বন্ধু থাকার প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হন। এর মধ্যে কোথাও কিন্তু সম্পদ স্বাচ্ছন্দ্য সামাজিক স্তর এসবের উল্লেখ নেই। বিয়ের এই পদ্ধতি বেদেও আছে হিন্দুশাস্ত্রেও আছে। এতে যদি আপনার বিশ্বাস থাকে আর সংসারের লড়াইয়ে একজন সহযোগীর হাত ধরার ইচ্ছে থাকে তাহলে বিয়েতে আপত্তি করবেন না সে আপনি যাকেই বিয়ে করুন।’

এরপর আর কথা হয়নি। স্বর্ণময়ী বিনয়কে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে এসেছিল। বসুন্ধরার সামনে এসে সকলকে অবাক করে স্বর্ণময়ী বলেছিল,

— উনি তাঁর আপত্তির কথা জানিয়েছেন আমিও আমার মতামত তাঁকে জানিয়েছি। এরপর নিশ্চয়ই উনি আপনার সঙ্গে কথা বলবেন — আর আমার মা-বাবাও আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করে নেবেন। রেলে সেদিন দেখা হবার পর আজ আপনি আমাদের বাড়িতে এসেছেন। আমি নিশ্চয়ই আপনাকে প্রণাম করবো। কিন্তু সে প্রণামটা আপনি যাবার সময় করব। এতটা সময়ের মধ্যে একজন মানুষের জীবনের যত কথা জানানো যায় উনি সব জানিয়েছেন। সবটা শোনার পর আমার মনে হয়েছে যে এখনি নেমে এসে আপনার দু’ পায়ে আমার দু-হাত ছুঁইয়ে একটা প্রণাম করা উচিত। কারও ছেলে বা মেয়ের প্রশংসা শুনলে বুড়িমা মানে আমার ঠাকুমা বলতেন – ফল ভালো দেখলেই হবে না গাছটাকে গিয়ে চিনে আসতে হবে। তাই ওঁর কথা শোনার পর জানার পর আমি আপনাকে প্রণাম করতে এসেছি।

স্বর্ণময়ী পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার আগেই বসুন্ধরা দাঁড়িয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বসুন্ধরা ছেলেকে একঝলক দেখেই যেন তার মন পর্যন্ত দেখতে পেলেন। তাই ছেলের সঙ্গে কোনও কথা না বলেই — স্বর্ণময়ীর মুখটা দু’হাতে ধরে বললেন,

— আমি আর কারও কথা শুনবো না। আমি তোকেই আমার ঘরে বউ করে নিয়ে যাব। কিন্তু শুভ কাজের জন্যে আমাদের একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের কালাশৌচ থাকবে। আর বিনুও নিজেকে গড়ে নেওয়ার জন্য একটা বছর হাতে পাবে। এই বলে বসুন্ধরা তার নিজের গলার হারটা খুলে স্বর্ণময়ীর গলায় পরিয়ে দিলেন।

— আজ আমি তৈরি হয়ে আসেনি মা। তবে এ আমার মায়ের গলার হার। এটা দিয়ে আমি তোকে আশীর্বাদ করলাম।’

ফেরিতে চৈতন্যঘাট থেকে শোভাবাজার ঘাটে ফেরার সময় — গঙ্গারভিজে মিঠে বাতাস বিনয়ের মন জুড়িয়ে দিচ্ছিল। মা আজ খুব খুশি। স্বর্ণময়ীর বোধবুদ্ধি বিচার সবকিছুই নিখাদ সোনায় মোড়া। তাকেই আজ ভাবী পুত্রবধূ হিসেবে আশীর্বাদ করে এসেছেন বসুন্ধরা। বিনয়কান্তির জন্যে স্বর্ণ’র চেয়ে ভালো জীবনসঙ্গী আর হতে পারে না। বিনয় নিজেও সেটা জানে কিন্তু স্বর্ণ’র উপযুক্ত হতে হবে তাকে। স্বর্ণ’র মা-বাবার যেন কোনওভাবেই তাঁদের অন্য দু-মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ছোট জামাইকে নিয়ে সম্মানহানি না হয়। স্বর্ণ’র মনে যেন কোনওদিন কোনও হীনমন্যতা সৃষ্টি না হয়। আর সকলের সামনে বসুন্ধরা একবছর সময় দিয়েছেন। মা এতটাই নিশ্চিত? এক বছরে বিনয় নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে? পারবে নিজেকে স্বর্ণ’র যোগ্য করে তুলতে? কিন্তু মা মুখে যখন একবার বলেছেন। তখন মায়ের কথার অমর্যাদা হতে দেওয়া যাবে না।

পরের একটা বছর বিনয়কান্তির জীবনে একটার পর একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। স্বর্ণময়ীকে আশীর্বাদের এক মাসের মধ্যে — পিটারসন সাহেব কলকাতায় চা অকশনের জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকায় — আসামের এক চা বাগানের তদারকিতে বিনয়কান্তিকে পাঠালেন। এক-দু দিন নয়। প্রায় মাস খানেকএর ধাক্কা। একটু বেশি সময়ও লাগতে পারে। পিটারসন বিনয়কে মাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বললেন — গ্রে স্ট্রিটের বাড়িতে তালাচাবি দিয়ে মাকে নিয়ে আর্দালি সমেত বাংলোতে গিয়ে উঠল বিনয়কান্তি দত্ত।

পিটারসন সাহেব একইসঙ্গে বুদ্ধিমান এবং সহৃদয়। ‘Intelligent’ শব্দের অন্তত ১৫টির বেশি ‘synonyms’ আছে ‘Oxford Dictionary’-তে। বাংলার মতোই ইংরেজি ভাষাতেও ভাব বুঝে শব্দের ব্যবহারের রীতি আছে। বুদ্ধিমান হল ‘Intelligent Brilliant Bright Intuitive Sharp’ -আর চালাক হল ধূর্ত – ‘clever canny alert’ – তাই চালাকরা সাধারণত সহৃদয় হয় না। পিটারসন সাহেব বুঝেছিলেন মাকে একলা কলকাতায় রেখে গিয়ে পাণ্ডববর্জিত আছাবাম চা বাগানে বিনয়কান্তি ক’দিনেই হাঁফিয়ে উঠবে। মা কাছে থাকলে সে মন দিয়ে কাজটা করতে পারবে। ছেলের সঙ্গে মা-ও ভালো থাকবেন। তাঁর কোনও দুশ্চিন্তা থাকবে না।

আসামের ডিব্রুগড় থেকে প্রায় ৩৪ মাইল মানে প্রায় ৫৫ কিমি দূরে নাহারকাটিয়ার কাছে মোটামুটি জঙ্গলের মধ্যে আছাবাম চা বাগিচা। আচ্ছা বা ভালো থেকে এসেছে ‘আছা’ আর অসমীয়া ভাষায় ‘বাম’ মানে হল উর্ব্বর। ভূমি উর্বরা হলে কী হয় বাগানের চা ফলন চায়ের যোগান যে মনোমতো হচ্ছে না। কারণ ক্রমাগত চা-শ্রমিকদের নানান অসন্তোষ। কলকাতা থেকে আসাম পৌঁছানোর পথ খুব একটা সুগম নয়। আর এই চা বাগানে পৌঁছনোর পথ তো আরও দুর্গম। পিটারসন সাহেব যৌথ মালিকানায় এই বাগান চালান। ঘনঘন যোগাযোগের অভাবে পিটারসনকে বাগান চালানোর ব্যাপারে তার পার্টনারদের ওপরই নির্ভর করতে হয়। কিছুদিন ধরেই আছাবাম চা বাগান থেকে চায়ের যোগান বেশ কম।অথচ এই বাগানের চায়ের তেজি লিকার ও ফ্লেভার-এর কারণেই চাহিদা খুব ভালো। এই জটিল সমস্যার সমাধান করতেই বিনয়কান্তিকে পাঠিয়েছেন উইলিয়াম পিটারসন। তার দৃঢ় বিশ্বাস তিনি নিজে গেলে যে সমাধান হতো বিনয়কান্তি হয়তো তার চেয়েও ভালো কিছু করে ফিরবেন। —চলবে

দুটিপাতা -একটি কুঁড়ি।

ছবি সৌজন্য: সত্রাগ্নি
পরের পর্ব আগামী রবিবার

স্বর্ণময়ীর আত্মবিশ্বাস দেখে – বসুন্ধরা ভারি খুশি হলেন। ভাবি বৌমা ছেলেকে সামলে নেবে বলছে শুনলে শতকরা ৯৭ভাগ মেয়েরা খুশি হবেন না। কিন্তু -বসুন্ধরা ওই তিন শতাংশের মধ্যে পড়েন। তিনি জানেন, যোগ্য হয়ে উঠতে গেলে স্বামীকে বুঝতে জানতে চিনতে হয়।

* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content