বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


প্রকৃতির অপার রহস্য ভেদ করা মানুষের সাধ্যাতীত। রহস্যের আকর এই প্রকৃতির বিভিন্ন প্রকৃতিজাত উপাদান মানুষের জীবন ও জীবিকার কারণ হয়। সুন্দরবনের বনানী ও তার সম্পদই আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়।

১৯৪৭ সালে আমাদের দেশ ভারত যখন স্বাধীন হয় তখন দেশ ভাগ হয়ে যায়। সুন্দরবনের বেশিরভাগই অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ চলে যায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) দিকে। আমাদের দেশে থাকে এক-তৃতীয়াংশ। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার উনিশটি ব্লক জুড়ে এর ব্যাপ্তি। এই উনিশটি ব্লকের মধ্যে ষোলটি ব্লক দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় এবং অবশিষ্ট তিনটি ব্লক উত্তর চব্বিশ পরগনায়।

এই সুন্দরবনে রয়েছে ১০২টি ব-দ্বীপ। এর মধ্যে দুটি ব-দ্বীপ অধুনা লুপ্তপ্রায়। এই ১০০টি ব-দ্বীপের মধ্যে ৫৪টি দ্বীপে মানুষ বসবাস করে। অবশিষ্ট ৪৬টি দ্বীপে মানুষ সেভাবে বাস করে না। মনুষ্যহীন এই দ্বীপগুলিতে রয়েছে সুন্দরী, গরান, পাইন প্রভৃতি গাছের বনভূমি। এছাড়া যেটুকু বনাঞ্চল আছে তাতে যেমন রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মেছো বিড়াল, বন বিড়াল, বুনো শুয়োর, হরিণ, শেয়াল তেমনি জলে রয়েছে অসংখ্য প্রজাতির মাছ, কাঁকড়া ও কুমির।
এখানকার জলে যে সব মাছ দেখা তার মধ্যে কিছু প্রজাতির মাছ চাষ করা শুরু করেছে ভারত সরকারের অধীনস্থ বেশ কয়েকটি সংস্থা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য— আইসিএআর/সিআইবিএ। সেই মাছগুলির মধ্যে পারসে, রাম পারসে, ভাঙন, আধ ভাঙন, তেল চাপটি, পায়রাচাঁদা, ভেটকি, গুরজাওলির নাম করতেই হয়। চিংড়ির মধ্যে রয়েছে পিনিয়াস মোনোডন এবং পিনিয়াস ইনডিকাস। কিন্তু এমন অসংখ্য প্রজাতির মাছ আছে যেগুলি চাষ করা এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
এখানকার বনজসম্পদ, জলজসম্পদ এবং পলিসমৃদ্ধ যে ব-দ্বীপ অঞ্চল তা খুবই উন্নত কৃষিযোগ্য ভূমি। এত কিছু সম্পদ থাকার সত্বেও যেভাবে প্রগতি আসা প্রয়োজন ছিল সেভাবে আসেনি। বরং দেখা দিয়েছে বেশ কিছু সমস্যা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় একটি চিংড়ি যার নাম ‘ভেনামি চিংড়ি’ তার চাষ করা হচ্ছে। নোনা জলের সঙ্গে মিষ্টি জলের সমতা বজায় রাখার জন্য বা জলের লবণাক্ততা কমানোর ভূগর্ভস্থ জল প্রচুর পরিমাণে তোলা হচ্ছে। ফলে সুন্দরবনে স্বাদু মিষ্টি জলের অভাব দেখা দিচ্ছে। তৃষ্ণা মেটাতে সাধারণ মানুষকে পান করতে হচ্ছে নোনাজল। এর কারণ মূলত এই ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার অর্থাৎ প্রশান্ত মহাসাগরীয় ভেনামি চিংড়ির চাষ।

বনজসম্পদ ও কৃষিজ সম্পদে যেটুকু উন্নতি করা গিয়েছে মৎস্য শিল্পেও সেই উন্নতি করা সম্ভব হতো। কিন্তু তা হয়নি! যেটুকু করা সম্ভব হয়েছে তা হল, মাছগুলিকে ধরে সেগুলিকে শুকিয়ে শুঁটকি মাছ হিসাবে বিক্রি করা। যদিও আরও প্রগতি আসা উচিত ছিল বলে মনে করি।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই ‘ভেনামি চিংড়ি’র চাষের ফলে সামাজিক বহু ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তুতন্ত্রের উপরেও একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা কখনই শুভ ফলদায়ক হতে পারে না। তাই প্রশান্ত মহাসাগরীয় চিংড়ির দিকে নজর না দিয়ে যদি দেশীয় মাছগুলিকে চাষযোগ্য করা যেত, যে সমস্ত মাছগুলিকে চাষের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি তাদেরকে চাষের আওতায় আনার প্রয়াস করা যেত তাহলেই জলজসম্পদে সমৃদ্ধ সুন্দরবনের প্রকৃত উন্নতি হতো বলেই বিশ্বাস করি।

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।
 

অনুলিখন: সুমন্ত দাস


Skip to content