পাণ্ডবভাইরা বনবাসে। আজ তো দুর্যোধনের আনন্দের দিন হওয়ার কথা। সেটা হওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু নিয়তি তা হতে দিলে তো! পাণ্ডবেরা রাজ্যছাড়া হয়েও যেন সদাসর্বদা রয়েছেন চারপাশে। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রী হতে পারেন। কিন্তু তাঁর সম্পূর্ণ সহানুভূতি পাণ্ডবদের প্রতি। আর সেখানেই যত ভয় দুর্যোধনের। যাও বা পিতা ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে দূর করে দিলেন রাজ্য থেকে। আর সেই দেখে আপাত নিশ্চিন্ত ছিলেন দুর্যোধন। আর অন্তত কেউ পাণ্ডবদের হয়ে উপদেশ দিতে আসবেন না। কিন্তু না। ধৃতরাষ্ট্রের দয়ার শরীর। রাগ ভাঙতেই আবার ডেকে পাঠিয়েছেন বিদুরকে। নিজের ভাইয়ের ওপর বড় ভরসা তাঁর। প্রমাদ গোনেন দুর্যোধন! মনে মনে কিছুটা অভিমানও হয় পিতার প্রতি। হঠাৎ ভয়টা চাগাড় দিয়ে ওঠে, আবার তাঁরা ফিরে আসবেন না তো! বনবাস শেষ না করেই? কয়েক দিনের জন্য রাজ্য ছাড়া হয়ে বিদুর তাঁদের সেই সাহস জুগিয়ে এসেছেন কি না কেই বা জানে! তাঁর একান্ত ভরসার জায়গা দুঃশাসন, কর্ণ আর শকুনির সঙ্গে দুর্যোধন আলোচনায় বসেন। কর্ণ পরামর্শ দেন, বনবাসকালেই যদি সহায়সম্বলহীন পাণ্ডবদের বধ করতে পারা যায়, তবেই নিষ্কণ্টক রাজ্যভোগ করতে পারবেন দুর্যোধন। কর্ণের পরামর্শ সকলের বেশ মনে ধরে। সেইমতো তাঁরা তৎক্ষণাৎ রওনা দেন বনের পথে। ওদিকে ধ্যানমগ্ন বেদব্যাস এই সম্পূর্ণ বিষয় জানতে পেরে সেই স্থানে এসে উপস্থিত হন আর তাঁদের নিবৃত্ত করেন। এরপর রাজা ধৃতরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন পাণ্ডবদের প্রতি বৈরীভাব আদতে কৌরবদের পক্ষে ক্ষতিকর। বেদব্যাসের কাছে ধৃতরাষ্ট্র অকপটভাবে স্বীকার করেন, পুত্রের এমন বারংবার অন্যায় আচরণ সত্ত্বেও কেবলমাত্র পুত্রস্নেহই তাঁকে ন্যায়পথে প্রবর্তিত হতে বাধা দিচ্ছে। ব্যাসদেব সমর্থন করেন সে কথা। বলেন, পুত্রস্নেহ এমনই হয় বটে। উচিত অনুচিত বিচার করে না।
ব্যাসদেবের মুখনিঃসৃত এ মহাভারতকথা সুতের কথায় গল্পে গাঁথা। আজ সেই বেদব্যাস স্বয়ং গল্পকথক। এক পিতার কাছে পুত্রস্নেহাতুর আর এক পিতার কথা বলে চলেন তিনি। প্রাচীনকালে স্বর্গের গাভী সুরভিকে দুঃখিত হয়ে রোদন করতে দেখে দেবরাজ ইন্দ্র অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে কোমল সুরে রোদনের কারণ জানতে চান। সুরভি তাঁকে বলেন, প্রজাদের কষ্টে নয়, আমার ছোট দুর্বল ছেলেটাকে কৃষক আঘাত করছে, বেশি ভার বহন করাচ্ছে। তার এই কষ্ট আমায় পীড়া দিচ্ছে।’ ইন্দ্র আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার তো এমন হাজার হাজার ছেলেকে রোজ কোন না কোনওভাবে কৃষকের কাছে পীড়িত হচ্ছে। তবে এই ছেলেটির প্রতি তোমার এমন দুর্বলতা কেন? সুরভি তার উত্তরে বলেন, ‘এই ছেলেটি ছোট আর দুর্বল। তাই একথা সত্য যে আমার সকল ছেলেরাই পীড়িত। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুর্বল ছেলেটার প্রতি আমার দয়া বেশি হওয়ায় তার কষ্ট আমাকেও পীড়া দিচ্ছে।’ এরপর ইন্দ্র সুরভির পুত্রদের কথা ভেবে প্রবল বর্ষণ করালেন যাতে কৃষকের কাজে বিঘ্ন ঘটে।
ব্যাসদেবের মুখনিঃসৃত এ মহাভারতকথা সুতের কথায় গল্পে গাঁথা। আজ সেই বেদব্যাস স্বয়ং গল্পকথক। এক পিতার কাছে পুত্রস্নেহাতুর আর এক পিতার কথা বলে চলেন তিনি। প্রাচীনকালে স্বর্গের গাভী সুরভিকে দুঃখিত হয়ে রোদন করতে দেখে দেবরাজ ইন্দ্র অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে কোমল সুরে রোদনের কারণ জানতে চান। সুরভি তাঁকে বলেন, প্রজাদের কষ্টে নয়, আমার ছোট দুর্বল ছেলেটাকে কৃষক আঘাত করছে, বেশি ভার বহন করাচ্ছে। তার এই কষ্ট আমায় পীড়া দিচ্ছে।’ ইন্দ্র আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার তো এমন হাজার হাজার ছেলেকে রোজ কোন না কোনওভাবে কৃষকের কাছে পীড়িত হচ্ছে। তবে এই ছেলেটির প্রতি তোমার এমন দুর্বলতা কেন? সুরভি তার উত্তরে বলেন, ‘এই ছেলেটি ছোট আর দুর্বল। তাই একথা সত্য যে আমার সকল ছেলেরাই পীড়িত। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুর্বল ছেলেটার প্রতি আমার দয়া বেশি হওয়ায় তার কষ্ট আমাকেও পীড়া দিচ্ছে।’ এরপর ইন্দ্র সুরভির পুত্রদের কথা ভেবে প্রবল বর্ষণ করালেন যাতে কৃষকের কাজে বিঘ্ন ঘটে।
গল্প বলা শেষ হলে ধৃতরাষ্ট্রের মুখের দিকে চান বেদব্যাস। রাজার মনের ভাব বুঝি বা পড়ার চেষ্টা করেন। তারপর বলে ওঠেন, ‘রাজা, পিতার পুত্রের প্রতি স্নেহ থাকবে এ তো স্বাভাবিক। পাণ্ডবেরাও তোমার ছেলে আর কৌরবেরাও তাই। কিন্তু এই মুহূর্তে পাণ্ডবেরা দুর্বল। দুর্বল ছেলেদের কথা ভেবো রাজা। তাদের প্রতি দয়াশীল হয়ো।’ ধৃতরাষ্ট্র কাতর হয়ে বেদব্যাসের প্রতি বলে ওঠেন, ‘আমার ছেলেটাকে দয়া করে একটু সদুপদেশ দিয়ে যান।’ বেদব্যাস বলেন, খুব শীঘ্রই মৈত্রেয়মুনি পাণ্ডবদের সাথে সাক্ষাৎ করে তোমার কাছে আসছেন। তিনিই দুর্যোধনকে সদুপদেশ দেবেন।
যথাসময়ে মৈত্রেয়মুনি আসেন। যথোচিত আপ্যায়ন করা হয় তাঁর। কুশল বিনিময়ের পর কৌরবদের হিতকামনায়, রাজ্যের হিতকামনায়, দুর্যোধনের হিতকামনায় প্রথমত, ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে আর তারপর দুর্যোধনকে উদ্দেশ্য করে, পাণ্ডবদের সঙ্গে মৈত্রীস্থাপনের প্রস্তাব দেন। তিনি বলে চলেন, পাণ্ডবেরা অত্যন্ত বলশালী। কৃষ্ণ যাঁদের বন্ধু, দ্রুপদপুত্র যাঁদের আত্মীয় তাঁদের সঙ্গে বিরোধ অর্থহীন আর ভয়াবহও বটে। পাণ্ডবদের ভয় দুর্যোধনকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বনবাসে পাঠিয়েও একমুহূর্তের জন্য স্বস্তি পান না দুর্যোধন। তদুপরি এই সমস্ত উপদেশ! অসহনীয় হয়ে ওঠে দুর্যোধনের কাছে। কিন্তু মনের ভাব তো প্রকাশ করা চলবে না। তাতে দুর্বলতা প্রকট হবে। তাই সর্বসমক্ষে মৈত্রেয়মুনিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেন। দুর্যোধনের হাবেভাবে অসম্মান প্রকট হওয়ায় ক্রুদ্ধ মৈত্রেয়মুনি বলে ওঠেন, ‘যাঁরা সহায়সম্বলহীন হয়েও, কপর্দকশূন্য দশায় বনে থেকেও কির্ম্মীরনামের ভয়ঙ্কররাক্ষসকে বধ করতে পারেন, তাঁদের থেকে তোমার বিনাশ অনিবার্য।’
মুনির মুখে এমন অভিশাপ ধৃতরাষ্ট্রকে বিচলিত করে। দুর্যোধন মুখে অবিচল থাকলেও কির্ম্মীরবধের চিন্তা তাঁকে গ্রাস করে। ধৃতরাষ্ট্রের শত অনুরোধেও মুনি কির্ম্মীরবধের সে কাহিনী না বলেই স্থানত্যাগ করেন। ধৃতরাষ্ট্র আকুল হয়ে বিদুরকে ডেকে পাঠান। ‘বিদুর বলো, কির্ম্মীর কে? কীভাবেই বা সে বধ হল? আমি বিস্তারিত শুনতে চাই তোমার কাছে।’ স্নেহ যেখানে, সেখানেই ভয় প্রবল। এখানে তাঁর পুত্রকে হারানোর ভয় ঘিরে ধরে। ছেলেটা বড় অবাধ্য। তার ওপর দুর্বুদ্ধিদাতারও অভাব নেই। তাই বুঝি বিদুরের কাছ থেকে পাণ্ডবদের ক্ষমতার আন্দাজ করতে চান।
বিদুরের পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, তাদের কথা ভেবে বারবার উপদেশে বিরক্ত হয়ে ধৃতরাষ্ট্র যখন বিদুরকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেন, তখন বিদুর কাম্যকবনে পাণ্ডবদের কাছে যান। সেখানেই কির্ম্মীরবধের কথা শোনেন। আজ ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে ভীমের সে আশ্চর্য পরাক্রমের গল্প বলে চলেন, ‘মহারাজ! কির্ম্মীরবধের কৃতিত্ব একা ভীমের। বনবাসী হলেও আজও প্রবল তেজ ধারণ করেন তিনি। সে তেজ হেলাফেলার নয়। বকরাক্ষসের ভাই, হিড়িম্বরাক্ষসের বন্ধু ভয়ঙ্কর কির্ম্মীররাক্ষসকে যে তিনি বধ করেছেন, এটাই তার প্রমাণ।’ ধৃতরাষ্ট্রের মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। কোনওমতে বলে ওঠেন তিনি, ‘কি ঘটেছিল সেদিন, বলো বিদুর?’ বিদুর বলে চলেন…
যথাসময়ে মৈত্রেয়মুনি আসেন। যথোচিত আপ্যায়ন করা হয় তাঁর। কুশল বিনিময়ের পর কৌরবদের হিতকামনায়, রাজ্যের হিতকামনায়, দুর্যোধনের হিতকামনায় প্রথমত, ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে আর তারপর দুর্যোধনকে উদ্দেশ্য করে, পাণ্ডবদের সঙ্গে মৈত্রীস্থাপনের প্রস্তাব দেন। তিনি বলে চলেন, পাণ্ডবেরা অত্যন্ত বলশালী। কৃষ্ণ যাঁদের বন্ধু, দ্রুপদপুত্র যাঁদের আত্মীয় তাঁদের সঙ্গে বিরোধ অর্থহীন আর ভয়াবহও বটে। পাণ্ডবদের ভয় দুর্যোধনকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বনবাসে পাঠিয়েও একমুহূর্তের জন্য স্বস্তি পান না দুর্যোধন। তদুপরি এই সমস্ত উপদেশ! অসহনীয় হয়ে ওঠে দুর্যোধনের কাছে। কিন্তু মনের ভাব তো প্রকাশ করা চলবে না। তাতে দুর্বলতা প্রকট হবে। তাই সর্বসমক্ষে মৈত্রেয়মুনিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেন। দুর্যোধনের হাবেভাবে অসম্মান প্রকট হওয়ায় ক্রুদ্ধ মৈত্রেয়মুনি বলে ওঠেন, ‘যাঁরা সহায়সম্বলহীন হয়েও, কপর্দকশূন্য দশায় বনে থেকেও কির্ম্মীরনামের ভয়ঙ্কররাক্ষসকে বধ করতে পারেন, তাঁদের থেকে তোমার বিনাশ অনিবার্য।’
মুনির মুখে এমন অভিশাপ ধৃতরাষ্ট্রকে বিচলিত করে। দুর্যোধন মুখে অবিচল থাকলেও কির্ম্মীরবধের চিন্তা তাঁকে গ্রাস করে। ধৃতরাষ্ট্রের শত অনুরোধেও মুনি কির্ম্মীরবধের সে কাহিনী না বলেই স্থানত্যাগ করেন। ধৃতরাষ্ট্র আকুল হয়ে বিদুরকে ডেকে পাঠান। ‘বিদুর বলো, কির্ম্মীর কে? কীভাবেই বা সে বধ হল? আমি বিস্তারিত শুনতে চাই তোমার কাছে।’ স্নেহ যেখানে, সেখানেই ভয় প্রবল। এখানে তাঁর পুত্রকে হারানোর ভয় ঘিরে ধরে। ছেলেটা বড় অবাধ্য। তার ওপর দুর্বুদ্ধিদাতারও অভাব নেই। তাই বুঝি বিদুরের কাছ থেকে পাণ্ডবদের ক্ষমতার আন্দাজ করতে চান।
বিদুরের পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, তাদের কথা ভেবে বারবার উপদেশে বিরক্ত হয়ে ধৃতরাষ্ট্র যখন বিদুরকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেন, তখন বিদুর কাম্যকবনে পাণ্ডবদের কাছে যান। সেখানেই কির্ম্মীরবধের কথা শোনেন। আজ ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে ভীমের সে আশ্চর্য পরাক্রমের গল্প বলে চলেন, ‘মহারাজ! কির্ম্মীরবধের কৃতিত্ব একা ভীমের। বনবাসী হলেও আজও প্রবল তেজ ধারণ করেন তিনি। সে তেজ হেলাফেলার নয়। বকরাক্ষসের ভাই, হিড়িম্বরাক্ষসের বন্ধু ভয়ঙ্কর কির্ম্মীররাক্ষসকে যে তিনি বধ করেছেন, এটাই তার প্রমাণ।’ ধৃতরাষ্ট্রের মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। কোনওমতে বলে ওঠেন তিনি, ‘কি ঘটেছিল সেদিন, বলো বিদুর?’ বিদুর বলে চলেন…