নিজেকে দেখা
মুখোমুখি
সেই প্রথম থেকে এই আজকে ফেরার দিন পর্যন্ত কাশীর ঘটনাগুলো পরপর ছবির মতো মনের আয়নায় ভেসে উঠতে লাগল। বাচ্চা মহারাজ — স্বামী নিখিলানন্দ। ডাক্তার মানুষ। সুদর্শন সুপুরুষ। সন্ন্যাসী হলেন কেন? সন্ন্যাসীকে পূর্বাশ্রমের কথা জিজ্ঞেস করতে নেই। তিনি বলবেন না। কিন্তু এরকম একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ সংসার ছাড়লেন কেন? মানুষ কি কেবল দুঃখের কারণেই অপ্রাপ্তির কারণেই সংসার ছেড়ে যায়। নাকি অন্য কোনও কারণ আছে… বাচ্চা মহারাজ তো ইচ্ছে করলেই পায়ের উপর পা তুলে জীবন কাটাতে পারতেন। তাহলে? কল্পেশ শুক্লার ব্রহ্মানল চকে নিজের একজোড়া দোতলা বাড়ি — স্ত্রীর মালিকানায় কচৌরি গলিতে ভাড়াটে-সমেত তিনটে বাড়ি। তবু কেন তিনি প্রতিদিন মহন্তের ঠেকে গিয়ে বসেন— ভক্ত নিয়ে বিশ্বনাথ ধাম অন্নপূর্ণা মন্দির মণিকর্ণিকা দশাশ্বমেধ ঘাট ঘুরিয়ে দেখান। হাত পেতে দক্ষিণা নেন। আবার বিনয় আর বিনয়ের মাকে নিখরচায় ১৫ দিন বাড়িতে অতিথি করে রাখেন। কেন? জীবনে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয় যার উত্তর হয়তো বহুদিন বাদে পাওয়া যায় বা পাওয়াই যায় না।
এখন আর সময় দেখতে ইচ্ছে করছে না তাই হাত ঘড়িটা খুলে বুকপকেটে রেখে দিয়েছে বিনয়। তবে এখন অনেকটা রাত। কামরার সব যাত্রীরা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। বসে থাকতে-থাকতে একটা সময়ের পর শরীর যখন ক্লান্ত হয়ে যায় — তখন ঘুম আসে। সেটা ভোররাতে। তবে আজ আর ঘুম আসবে না। আসার সময় প্রথম মাকে নিয়ে বেরোনোর একটা উৎকণ্ঠা ছিল। একটানা তিনদিন তিনরাত গোডাউনে কাজ করার একটা ধকল ছিল। আর বাবার দেখা পাওয়া তার গুরুতর অসুস্থতা নিয়ে একটা দোটানা, একটা অনিশ্চিয়তা ছিল মনে। এখন সেসব নেই। বাবার মৃত্যুর প্রাথমিক ধাক্কাটা মাকে কাটিয়ে উঠতে দেখে অনেক নিশ্চিন্ত লাগছে বিনয়ের। এখন মাকে বাড়িতে একা রেখে অফিস করতে যাওয়ার আর কোনও সমস্যা রইল না।
অন্ধকার চিরে রেল চলেছে কলকাতার দিকে। কলকাতা। বিনয়কান্তির কর্মভূমি। অতীতের সংশয় অতীতের যন্ত্রণা পিছনে ফেলে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বিনয় কান্তি পৌঁছবে তার ভবিষ্যতে।
সব উদ্যোগী মানুষের নতুন কিছু করে ফেলার কিছু গড়ে ফেলার একটা অতিরিক্ত তাগিদ থাকে। ভেবে রাখা কাজ ফেলে রাখা তাদের ধাতে সয়না। তাই পরিকল্পনা মতো কাজটা শেষ করার জন্যে তারা ছটফট করে। সে তাগিদটাকে ঠিক হড়বড়ে বলা যায় না! যারা ঈশ্বরবিশ্বাসী, আস্তিক তারা এটা মানে যে ঈশ্বর না চাইলে কোনও কাজ সম্পন্ন করা যায় না— তাই যতই উদ্যোগ থাক যতই চেষ্টা থাক ঈশ্বর নির্ধারিত নির্দিষ্ট সময়েই সব ঘটে। যত দিন যাচ্ছে বিনয় ততই জগতের নিয়ন্তা সেই সর্বশক্তিমানের অস্তিত্ব তাঁর অদৃশ্য নির্দেশ যেন স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে। কাশী আসার আগে- মায়ের মধ্যে সর্বক্ষণ একটা উদ্বেগ কাজ করতো — মনের ভেতরের একটা যন্ত্রণার সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধ করতে করতে মা ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। একটা অবসাদ যেন মাকে… কাশীতে এসে তার পরিসমাপ্তি হল। কিন্তু মা তাঁর জীবনের অনেকটা সময় কেবল কষ্টই পেলেন! কেন? মায়ের সঙ্গে এত অবিচার কেন করলেন জগদীশ্বর? এবার মা’র মুখের হাসি মনের আনন্দ সব ফিরিয়ে দেবে বিনয়। তার জন্যে যা অসাধ্যসাধন করতে হয় বিনয় করবে— মা’র সুখের জন্যে সব অসম্ভবকে সম্ভব করবে সে।
ঘরদোর পরিষ্কার করতে বেশ খানিকটা সময় গেল। মাকে বিধবার বেশে দেখে তেলিপাড়া লেনের ভাড়াবাড়ির উৎসাহী বউ মেয়েরা এগিয়ে এল। তাদের নানা রকম ব্যক্তিগত জিজ্ঞাস্য কিন্তু এতটুকু উত্তেজিত না হয়ে হাসিমুখে মা সবাইকে সামলে নিল — একটা কথায় থামিয়ে দিল পরচর্চা পরনিন্দার সমস্ত উৎসাহ। মা বলল, ‘নিয়তিকে মেনে নেওয়া ছাড়া তো উপায় নেই দিদি’ — এত বছর আমার স্বামীর কোনও খোঁজ পাইনি — হঠাৎ খোঁজ এল কাশী থেকে। ছেলেকে নিয়ে ছুটলাম। গিয়ে দেখলাম তিনি হাসপাতালে ভর্তি খুব অসুস্থ। কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমরা তো জানি না দিদি আমাদের কার ভবিতব্যে কি আছে? আমরা এই এখন কথা বলছি — পাঁচ মিনিট বাদে কার ভাগ্যে কী ঘটবে আমরা কি জানি? কার কপালে বৈধব্য — কার কপালে প্রিয়জন বিয়োগ — কেউ বলতে পারেনা বোন।
বিনয় অবাক হয়ে দেখল — একটু আগেই প্রবল কৌতুহল নিয়ে দঙ্গল করা ভাড়া বাড়ির মেয়ে বৌরা যেন ভয়ে আতঙ্কে পালিয়ে বাঁচলো। বিনয় তাকিয়ে আছে দেখে মা বলল, আমি কিন্তু একটাও মিছে কথা বলিনি বিনু। সত্যিই তো কার ভবিতব্য কী আছে আমরা জানি না। পাঁচটা মিনিট পরে কার ভাগ্যে কী ঘটে যাবে কেউ কি বলতে পারে? হ্যাঁ তবে কথাগুলো আমি জেনে বুঝে বলেছি না হলে এখানে অন্তত মাসখানেক এরা আমায় জ্বালিয়ে মারতো। যা যা যা তুই আর দেরি করিস নি। এরপর বাজার গেলে আর কিছু পাবি না।
গুহবাবুদের বাড়িতে গিয়েও মা সব সামলালেন। কর্তাবাবু কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলেন। মা সে টাকা দু-হাতে নিয়ে বলল, ‘কত্তাবাবু কত্তামা আপনারা না থাকলে সত্যিই আমরা ভেসে যেতাম। উনি দেশান্তরি হবার পরে কত্তামা বলেছিলেন যেন আমি ছেলেকে নিয়ে বাখুণ্ডায় আপনাদের বাড়িতে গিয়ে উঠি। আমি কত্তামাকে বলেছিলাম আজ বাবা এসেছেন কোটালীপাড়ায় নিয়ে যেতে তাই ছেলেকে নিয়ে বাবার কাছে যাচ্ছি — কিন্তু বাবা তো চিরকাল থাকবেন না কত্তামা, যেদিন প্রয়োজন হবে সেদিন আপনার আশ্রয়ে এসে উঠবো। তাই ঘটেছিল। আজকে যে বিনু নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে — সেতো আপনাদেরই আশীর্বাদ। বিনুর আপিসের সাহেব জানতো — বিনুর বাবার আজ ১৯ বচ্ছর কোন খোঁজ নেই — তাই কাশীর সে চিঠিটা নিয়ে সে যখন অফিসের সাহেবের কাছে গেল — সাহেব শুধু মাইনেসমেত একমাসের ছুটি দিলেন না — আমাদের যাতায়াতের গাড়ি ভাড়া দেবার কথা জানালেন— কাশীতে মঠের মহারাজ চিকিৎসার বিশেষ কিছু খরচ নেননি — বাবা বিশ্বনাথের কৃপায় আমরা কাশীতে যাঁর বাড়ীতে ছিলাম তিনিও আমাদের এতদিনের থাকার কোন খরচ নেননি। তাই আজ এক্ষুণি এই টাকাটার প্রয়োজন হচ্ছে না, কিন্তু কত্তামা এ টাকা আমি আপনাদের পায়ের কাছে জমা রাখলাম। জানি না ভবিষ্যতে কি আছে? হয়তো একদিন এ টাকা নিতে আপনাদের কাছেই আসতে হবে।
ফড়েপুকুর থেকে তেলিপাড়া লেনে ফেরার সময় বিনয় বলেছিল, ‘অন্ধকার হয়ে এসেছে, চলো মা! হাতে টানা রিকশা করে চলে যাই।’ মা রাজি নয়, ‘না না ওই এক মানুষ উঁচুতে বসে টাল খেতে খেতে যাওয়া, এই তো একটুখানি রাস্তা আমি হেঁটে যাবো।’ মার পাশে চলতে চলতে বিনয়কান্তি প্রশ্ন করলো — ‘আচ্ছা একটা কথা বলব মা!’ — মা তাকায়। ‘আমি মানছি গুহবাবুরা আমাদের অনেক সাহায্য করেছেন—তাঁদের কাছে আমরা ঋণী। কিন্তু তুমি সব সময় এত কুণ্ঠা নিয়ে থাকবে কেন মা? ওঁরা সাহায্য করতে চেয়েছেন – আমাদের এখন সাহায্য লাগবে না- কিন্তু তুমি এত অনুনয় বিনয় কেন করো মা!’
বসুন্ধরা খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে — তারপর বলে, ‘বিনু আজ তুই তোর মাকে নিয়ে আলাদা করে ভাড়া বাড়িতে থাকচিস — কিন্তু এতগুলো বছর তো গুহবাবুদের আশ্রয়েই আমাদের থাকতে হয়েছে। একদিনে সে কথা তো ভুলে যেতে পারি না বাবা। মাথা নুয়ে থাকলে লোকের চোকে পড়ে না বিনু। ওঁদের মুখের উপর এগুলো না বলে টাকাটা ফস করে ফেরত দিলে ওঁদের মনে লাগতো। হয়ত না জেনে ওঁদের অপমান করে বোসতাম। জ্ঞানে অজ্ঞানে কারো মনে কখনও আঘাত দিও না বিনু। একটু আধটু তো নয় বাপ! তোমায় যে অনেক অনেক বড় হতে হবে। তাই সে চলার রাস্তা যেন কারো চোখের জলে ভিজে না যায়। কাউকে ঠকাবে না — কাউকে মনকষ্ট দেবে না। তাকে বুজিয়ে বলবে। আর তুমি তৈরি হবে গোপনে গোপনে — ব্রহ্মচারী বাবা বলতেন ‘যত গুপ্ত তত পোক্ত/ যত ব্যক্ত তত ত্যক্ত’- তোমার সাধনা তোমার নিজেকে গড়ে তোলা সকলের অলক্ষ্যে হতে হবে তবে সে সাধনা মজবুত হবে সার্থক হবে — বড়াই করে লোক জানাজানি করলে তোমার চেষ্টা তোমার কাজ ভেস্তে যাবে।’
বসুন্ধরা বিনয়কে এই ব্রহ্মচারী বাবার কথা আগেও এক দু’ বার বলেছে। ‘তোমার মা মানে আমার দিদিমা ওঁর খুব ভক্ত ছিল তাই না।’
হ্যাঁ বিনু, ছোটবেলায় কোটালীপাড়ার বাড়িতে ঠাকুর ঘরে — যে সাধু বাবার ছবি দেখেছিস — তিনিই ব্রহ্মচারী বাবা। লোকনাথ ব্রহ্মচারী। আমার মায়ের বাড়ি তো ঢাকার নারায়ণগঞ্জ-এ। ওখানেই বারদী গ্রামে বাবা লোকনাথের আশ্রম। আমার জন্মের সালেই বাবা দেহ রাখেন। ১৮৯০ – আর আমার ১০ বছর বয়সে — আমার ছোট ভাই হবার সময় মা চলে গেল।
বসুন্ধরা ভিলা তৈরি হবার পর চারতলায় বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণে বড় ঠাকুর ঘর বানানো হয় — বিনয়কান্তিকে মা বসুন্ধরার জন্য দুটি কাজ করতে হয়। ঠাকুর ঘরে এক মানুষ উঁচু একটা প্রকান্ড ফোটোফ্রেমে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ছবি — আর লিফট বসল বসুন্ধরা ভিলায়। বিনয়কান্তির বিশিষ্ট বন্ধুর নিজের লিফট কোম্পানি ছিল — তারাই দ্বায়িত্ব নিয়ে বসুন্ধরা ভিলায় লিফট বসাল ১৯৬০ সালে — বসুন্ধরার বয়েস তখন সত্তর। —চলবে
ঢাকা বারদীর লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মন্দির
একতলায় একটা বসার ঘর, দুটো শোবার ঘর। ভিতরে লাল মেঝের চিলতে বারান্দা – রান্নাঘর। তারপর খোলা উঠোন – কলতলা ইত্যাদি। এ বাড়িতেই ইলেকট্রিক পাখা আছে। তেলিপাড়া লেনের বাড়ির জন্যে একটা ঘরঘরে টেবিল ফ্যান কিনতে হয়েছিল। বাড়ির মালিক কেদার পাল ও তার স্ত্রী দোতলায় থাকেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তারাও ঝাড়া-হাত-পা একটা ছোট সংসারের ভাড়াটে খুঁজছিলেন।
* বসুন্ধরা এবং (Basundhara Ebong-Novel) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।