সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

যশোরেশ্বরী মন্দির

মঙ্গলবার সকাল পৌনে আটটা৷ জয় মহারাজকে সঙ্গে নিয়ে ইজিট্যাক্সিতে বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হলাম৷ অবশ্য তার আগে ভাত, ডাল আর একটা সবজি দিয়ে ব্রেকফাস্ট৷ সুদেব মহারাজের সবদিকে নজর৷ সারাদিনের জন্য বেরনো৷ পেটে একটু ডাল-ভাত থাকলে নিশ্চিন্ত৷

রামকৃষ্ণ মিশনের কাছেই যশোর রেলস্টেশন৷ লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে আশ্রম রোডে মিশনে আসতে হয়৷ যশোর থেকে বেনাপোল পর্যন্ত ট্রেন যায়৷ যশোর থেকে ট্রেনে দর্শনা হয়ে চুয়াডাঙা, কুষ্ঠিয়া প্রভৃতি জায়গায়ও যাওয়া যায়৷ যশোর থেকে সরাসরি ট্রেনে খুলনায় আসা যায়৷ বাংলাদেশের ট্রেন মূলত মিটারগেজ৷ তবে ইদানীং চট্টগ্রামসহ কয়েক জায়গায় ট্রেনের সুবিধা বাড়ানোর জন্য ব্রডগেজ লাইন পাতা হচ্ছে৷

যশোর থেকে প্রথমে সাতক্ষীরায় যাব৷ সেখান থেকে কালীগঞ্জের বাস৷ কালীগঞ্জ থেকে প্রায় ২৩ কিমি বংশীপুর৷ অবশ্য বংশীপুর থেকে যশোরেশ্বরী মন্দির তেমন দূরে নয়৷ শ্যামনগর থানার ঈশ্বরীপুর গ্রামে এই মন্দির৷ যশোর শহর থেকে যশোরেশ্বরী মন্দির ২২৫ কিমি৷ যাতায়াতে কম করেও নয়-দশ ঘণ্টা৷ মোটামুটি এক্সপ্রেস গোছের একটা বাসে উঠলাম৷ কালীগঞ্জ পর্যন্ত মাথাপিছু ভাড়া ১৩০ টাকা৷ বাসে ওঠার আগেই টিকিট কাটতে হল৷

ইতিমধ্যে এক পশলা বৃষ্টি৷ ছুটন্ত বাসের জানালা দিয়ে সকালের ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগতেই বেশ লাগছিল৷ রোডম্যাপ আমার সঙ্গেই রয়েছে৷ জয় মহারাজকে আমাদের যাত্রাপথের একটু বর্ণনা দিতেই হাসিমুখে বললেন, ‘বাঃ আপনি তো দেখছি ভালোমতো তৈরি হয়ে বেরিয়েছেন!’

বাসে জানালার ধারেই জায়গা পেয়েছিলাম৷ কিছুদূর যেতেই রাস্তার পাশে চাঁচড়া সর্বজনীন কালীমন্দির৷ জয় মহারাজ মন্দিরের দিকে তাকিয়ে করজোড়ে প্রণাম করে বললেন, ‘খুব জাগ্রত কালীঠাকুর৷ অনেকেই এখানে পুজো দিতে আসেন৷ মানতও করেন লোকজন৷’ দেখলাম, বাসচালকও কালীমন্দির দেখে বাসের গতি একটু হালকা করে ডান হাতখানা একবার কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন৷

বাসচালক হিন্দু ব্রাহ্মণ, পরে সাতক্ষীরায় বাস থেকে নামার সময়ই জানতে পারলাম৷ নাম, লক্ষ্মীপদ ঘোষাল৷ উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটেও তাঁর বাড়ি আছে৷ ’৮৮ সাল থেকে ড্রাইভারি করছেন৷ আমি বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছি শুনে খুশি হয়ে বললেন, ‘ভালো করে ঘুরে নিন বাবু৷ দেশটা আপনার ভালোই লাগবে৷’

যশোর থেকে সাতক্ষীরা যাওয়ার পথে প্রায় ৩০ কিমি দূরে যশোর-সাতক্ষীরা হাইওয়ের ওপর কপোতাক্ষ নদীর তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রাম৷ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান৷ জায়গাটি এখন ট্যুরিস্ট স্পট৷

সাতক্ষীরা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম বেলা ১১টা নাগাদ৷ খানিকক্ষণ আগেই রাস্তার বাঁ-দিকে দেখলাম, দুলালের মিষ্টির দোকান৷ বেশ ভিড়৷ কাচের লম্বা শো-কেসে নানারকমের মিষ্টি থরে থরে সাজানো— চমচম, রসমালাই, ক্ষীরকদম্ব, গোলাপজাম, কালোজাম এরকম কত কী! রসগোল্লা, পান্তুয়া আর শাঁখ সন্দেশ তো আছেই৷
মনোতোষ রায়ের চাঁদসির ক্ষত চিকিৎসালয়ের পাশেই এক মুসলমান ব্যবসায়ীর দোকান৷ ‘ঘোষ ডেয়ারি’ মিষ্টির দোকানটিও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন৷ রাস্তার দু’ধারে ফলের দোকান৷ উচ্ছে-বেগুন-পটল-আলুর দোকানগুলো যানজট বাড়িয়ে দিয়েছে৷

কালীগঞ্জ যাওয়ার এক্সপ্রেস বাসে উঠলাম বটে, বাস আর এগোয় না৷ বাস চলেছে ড্রাইভারের মর্জিমতো৷ আমার নজর রাস্তার দিকে৷ আলিপুর হাটখোলা বাজারে মহানাম যজ্ঞানুষ্ঠানের গেরুয়া ব্যানার হাওয়ায় দোল খাচ্ছে৷ শ্রীচৈতন্যদেবের অষ্টপ্রহর নামযজ্ঞ৷ কোথাও ভাগবত পাঠের আয়োজন৷ মসজিদের পাশে পিচের রাস্তা৷ রাস্তার ওপর আড়াআড়ি টাঙানো ব্যানারে ভাগবত পাঠের নির্ঘণ্ট৷ আবার কোথাও বাসরাস্তার ওপর মুসলমান সম্প্রদায়ের উৎসব উপলক্ষে সুদৃশ্য উঁচু তোরণ৷ পথচলতি হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির এ জাতীয় উদাহরণ অমিল নয়৷

একসময় সাতক্ষীরায় হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যা ছিল আধাআধি৷ ক্রমশ জামাত-ই-ইসলামের রাজনৈতিক ক্ষমতা বাড়ে৷ কট্টর সাম্প্রদায়িক জামাত নেতা ও কর্মীরা হিন্দুদের যেনতেন প্রকারেণ ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ করে দেশ থেকে তাড়ানোর নোংরা খেলায় নামে৷ প্রথমদিকে হিন্দুরা সর্বশক্তি দিয়ে জামাতদের প্রতিহত করেছিল৷ পরে প্রশাসনের সরাসরি মদত পায় জামাতরা৷ অসহায় বহু হিন্দু পরিবার সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়৷ এখন সাতক্ষীরায় হিন্দুর সংখ্যা ৫০ শতাংশ থেকে নেমে প্রায় ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে!

আমার সামনের দুটো সিট আগে বসেছেন জয় মহারাজ৷ পাশাপাশি জায়গা পাইনি৷ আমার পাশের সিট খালি হতেই এক যুবক বসল৷ যুবকটি মোবাইলে তার এক নিকট আত্মীয়ের মারা যাওয়ার খবর কাউকে দিচ্ছিল, সে দু-তিনদিন কাজে যেতে পারবে না সেকথাও জানিয়ে দিল৷ মিনিট দশেক একভাবে জোরে জোরে কথা বলার পর যুবকটি থামল৷

একটু পরেই আমাকে জিজ্ঞাসা করল— আপনি কি ইন্ডিয়া থেকে আসছেন? বললাম, ‘হ্যাঁ’৷ বলল, ‘আমার দু’ভাই নোশেল ও নাসির দমদমে থাকে৷ আমার বিবির চিকিৎসা চলতাছে কলকাতায়৷ ওখানে ভালোই ট্রিটমেন্ট হইতাছে৷’

একটি মেয়েও আছে নাজিবুল হকের৷ লং-ডিস্ট্যান্স বাসের ড্রাইভার নাজিবুল৷ কখনো ঢাকা, কখনো চট্টগ্রাম৷ শুনলাম, ওর ভাইরা আর দেশে ফিরবে না৷

নাজিবুলের উচ্চারণে পুরোপুরি বাংলাদেশি টান নেই৷ ওকে জিজ্ঞাসা করলাম— তোমরা ভাইরা তো বাংলাদেশের নাগরিক৷ ওরা এতদিন ধরে ভারতে রয়েছে কী করে? অবশ্য এই প্রশ্ণের সদুত্তর পাইনি৷ তবে হিন্দু-মুসলমান দু’সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা ওর মুখে শুনলাম৷ একটু কুণ্ঠিতভাবে বলল, ‘আমি সামান্য বাস-ড্রাইভার৷ বেশিদূর পড়াশুনাও করি নাই৷ তবে ধর্ম বলতে ঘৃণা, হানাহানি বুঝি না৷ আমরা হিন্দু-মুসলমান যেন পাশাপাশি থাইক্যা ভালোভাবে বাঁচতে পারি৷ কিন্তু রাজনৈতিক নেতারাই তা হইতে দেয় না৷ ওদের শুধু স্বার্থ৷’

আমরা যশোরেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছি শুনে নাজিবুল বেশ উৎসাহিত হয়েই বলল, ‘আপনারা তো কালীগঞ্জ হইয়া যাইতাছেন৷ সম্ভব হইলে বাঁশদহে শিবু বিশ্বাসের সঙ্গে অবশ্যই একবার দেখা করবেন৷ এমন মানুষ হয় না৷ তাঁর কালীমন্দির আছে৷ বড় কইরা কালীপূজা করেন৷ হিন্দু-মুসলমান সব্বাই শিবুদাকে ভীষণ মান্যি করে৷ কালীপূজায় শিবুদা দাওয়াত দিলে যেখানেই থাকি না কেন, ওই দিন শিবুদার বাড়িতে যামুই৷ আপনাগো ইন্ডিয়া হইতেও শিবুদার পূজায় মেলা লোক আসে৷’

কালীভক্ত, দয়াবান, এলাকায় জনপ্রিয় এক হিন্দু ভদ্রলোকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ এক মুসলমান যুবক৷ নাজিবুল বলল, ‘আমি হয়তো খাইতে বসছি৷ মুসলমান বইলা কোনো ব্যাপার নাই৷ শিবুদা ও ভাবী আমার পাশটাতেই খাইতে বইসা গেলেন৷ এমনই উঁচা মন তাঁদের৷’

নাজিবুলকে কথা দিইনি৷ বলেছিলাম, সময় পেলে বাঁশদহে নেমে শিবুবাবুর সঙ্গে দেখা করব৷ কিন্তু সময় পাইনি৷ আমাদের আশাশুনি হয়ে কালীগঞ্জে যেতে হবে৷ এই আশাশুনিতে ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীমৎ স্বামী প্রণবানন্দজির নামাঙ্কিত ‘প্রণব মঠ’ রয়েছে৷ এই আশ্রমকে ঘিরে স্থানীয় অঞ্চলের হিন্দুরা ধর্মাচরণের সুযোগ পাচ্ছে৷ ‘প্রণব মঠ’ রয়েছে বলে হিন্দুদের মনে বল-ভরসাও কম নয়৷

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content