শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


সাধু ও চলিত ভাষার সমন্বয়ে মানুষের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম বাংলা ভাষা। আবার সেই সব ভাষাকে নির্ভর করে গড়ে ওঠে বিভিন্ন উপভাষা। বহুকাল যাবৎ প্রচলিত কোনও উদ্দেশ্যমূলক উক্তি বা বাস্তবে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনার শিক্ষামূলক বিবরণ সূচক জনশ্রুতি যা প্রবাদ নামে পরিচিত। এই প্রবাদ, প্রবচন বা জনশ্রুতি পুরুষ থেকে পুরুষানুক্রমে রয়ে যায় মানুষের মধ্যে।

বাঙালির এই প্রবাদগুলির দিকে যদি আমরা চোখ রাখি তাহলে দেখবো বিভিন্ন বিষয়ের উপর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রবচন। বাঙালির দ্বিপ্রহরের ভোজনে মাছের উপস্থিতি প্রায় সকলের কাছেই কাঙ্ক্ষিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই প্রিয় খাবার নিয়ে মানুষের মধ্যে যে প্রবচন থাকবে তা বলাই বাহুল্য। যেমন—
“মাছ কাটলে মুড়ো দেব, ধান ভাঙলে কুঁড়ো দেব।
কালো গরুর দুধ দেব, দুধ খাবার বাটি দেব”।।

মাছের মুড়োটিই যে পুষ্টিকগুণে উৎকৃষ্ট তা জানান দেয় এই প্রবাদটিতে। আর একটি প্রবাদে বলা হয়েছে—
“শাকের মধ্যে পুঁই আর মাছের মধ্যে রুই”।

এখানে যেন পুঁইশাক ও রুই মাছের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করা হচ্ছে। প্রবাদ তো শুধু কয়েকটি সংলাপ নয় সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, রাগ, অভিমান, দ্বেষ সব কিছুকে আশ্রয় করেই সে পূর্ণতা পায়। “শাক দিয়ে কি মাছ ঢাকা যায়?”—মাছের উৎকর্ষতা যেমন কোনওভাবেই শাক দিয়ে ঢাকা যায় না তেমনি মানুষের গুন তার দোষ ঢাকতে পারে না। একই কাজের বাসনা নিয়ে যখন দুই কাজে সিদ্ধিলাভ হয় তখন আবার বলতে শোনা যায়—“মাছের তেলে মাছ ভাজা”। সমাজের বুকে দুর্বল যাঁরা তাঁরা পীড়িত হন বলবানের কাছে। সবলরা বিচারের পরও মুক্তি পায়। তাইতো বলতে শোনা যায়—
“রাঘব বোয়ালরা মুক্তি পায়,চুনো পুঁটিদের প্রাণ যায়”।

ছোটদের ছড়াতেও আমরা পাই মাছের উল্লেখ, যা শুনলে এখনও আমাদের মনে আনন্দ খেলা করে।
“খোকা গেল মাছ ধরতে
ক্ষীর নদীর কূলে।
মাছ নিয়ে গেল কোলা ব্যাঙে
ছিপ নিয়ে গেল চিলে”।।

শুধু প্রবাদের মধ্যেই যে মাছের অস্তিত্ব বিদ্যমান আছে তা কিন্তু নয়। বাংলা সাহিত্যে দৃষ্ট হয় মাছ বিষয়ক কবিতা বা পংক্তি। ছন্দের জাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বিখ্যাত কবিতা “ইলিশে গুঁড়ি”কবিতা। যেখানে কবি বর্ষাকালে ইলিশ মাছের নাচন যে কিরূপ হতে পারে তা তিনি সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করেছেন।
“ইলিশে গুঁড়ি ইলিশে গুঁড়ি
ইলিশ মাছের ডিম।
ইলিশে গুঁড়ি ইলিশে গুড়ি
দিনের বেলায় হিম”।।

রবীন্দ্র কাব্যেও মেলে মাছ ধরার বিবরণ—
“বাবু ছিপ হাতে,পারিষদ সাথে,ধরিতে ছিলেন মাছ”।।

প্রকৃতি প্রেমিক কবি জীবনানন্দ দাশ সহ বহু কবির কবিতায় আমরা মাছের কথা পাই। বাঙালির সংগীত প্রীতিও বাঙালি জাতির পরিচয় বহন করে। ভালোবাসার বা পছন্দের বিষয় দিয়ে তাঁরা বাঁধের গান। ভাটিয়ালি-বাউলের সুরে যেগুলি পূর্ণতা পায়। মাছ নিয়েও রয়েছে এমন অনেক গান যা জীবন্ত ইতিহাস হয়ে রয়ে যাবে চিরকাল।
“ট্যাংরা তবু কাটন যায়,মাগুর মাছে ক্যাটকেটায়।
আবার শিঙ্গি মাছটা মারছে কাঁটা,পরাণ যায় জ্বলিয়া রে।
কি মাছ ধরিছ বড়শি দিয়া”।।

আরও একটি জনপ্রিয় গান—
“বাংলা আমার সর্ষে ইলিশ,চিংড়ি কচি লাউ।
বাংলা পারশে মাছকে ধুয়ে,জিরের বাটায় দাও।
বাংলা ভুলবো কি করে বাংলা বুকের ভিতর”।।

বাঙালির প্রবাদ বাক্য থেকে শুরু করে,বাঙালির সংগীত ও সাহিত্য জীবনেও যে মাছ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে রয়ে আছে এ সমস্ত কিছু যে তারই জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। বাঙালির মৎস্যপ্রীতি সহ বাঙালির প্রবাদ,সংগীত ও সাহিত্য আপন ধারায় প্রবাহিত হোক; এই হোক আমাদের কামনা, এই হোক আমাদের প্রার্থনা।

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।
 

অনুলিখন: সুমন্ত দাস


Skip to content