বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


কী অদ্ভুত ব্যাপার! ১৯৯২ সালে আবারও সাম্প্রদায়িকতার কালো মেঘে ঢাকা পড়ে বাংলাদেশের সুনীল আকাশ৷ হামলা, লুটপাট, আগুন লাগানোর ঘটনা৷ সারা দেশে কয়েক হাজার মন্দির ধ্বংস হয়৷ ধর্ষণ ও অপহরণের শিউরে ওঠা সব কাহিনি৷ তবে সেবার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে কোনো হামলা হয়নি৷ ১৯৯০ ও ১৯৯২ সালে সাম্প্রদায়িক হামলায় হিন্দু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে৷

সংখ্যালঘুদের একাংশ ভিটেমাটি ছেড়ে কপর্দকহীন অবস্থায় সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে আসে৷ ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আবার সাম্প্রদায়িক হামলার মুখে পড়ে৷ এমনকী ২০১৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরেও সাধারণ নির্বাচন ও আরও কিছু ইস্যুকে কেন্দ্র করে আওয়ামি লিগের সঙ্গে বিএনপি আর জামাত-ই-ইসলাম জোটের বিরোধ যখন তুঙ্গে, সেইসময় হিন্দু অধ্যুষিত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া সাতক্ষীরা থেকে অনেক হিন্দু পরিবার বাধ্য হয়ে এপারে চলে এসেছে৷

১৯৯৩ সালে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রায় হামলা চালানো হলে কয়েকজন গুরুতর আহত হয়৷ কিন্তু তৎকালীন সরকার ওই দুর্বত্তদের না ধরে হাত গুটিয়ে বসে থাকে৷ প্রদীপবাবু বললেন, ‘এই ঘটনার প্রতিবাদে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ওই বছর মূর্তির পরিবর্তে ঘটে শারদীয়া দুর্গাপুজো করার অনুরোধ জানায় সমস্ত পুজো কমিটিকে৷ আর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণেই আয়োজিত এক জরুরি সভায়৷

বাংলাদেশে ওই বছর মূর্তি গড়ে দুর্গাপুজো হয়নি৷ একটা ব্যাপার ভাবতে বেশ অবাক লাগে, আবার কষ্টও হয় যে, আমাদের মায়ের মন্দিরে চুরি মাঝে মাঝেই হয়৷ ২০১০ সালের কথা৷ শীতের সময় আবার চুরি৷ ঢাকেশ্বরীর সমস্ত অলংকার৷ মায়ের শ্রীবিগ্রহের সামনে কান্নাকাটি করলাম৷ তুমি তোমার সমস্ত অলংকার ফিরিয়ে আনো মা৷

আশ্চর্য ব্যাপার, এক মাসের মধ্যে চোর ধরা পড়ল! কিন্তু দুঃখের কথা চুরি যাওয়া প্রায় দুশো ভরি সোনার গহনা, দানবাক্সের প্রায় সাড়ে চার লক্ষ টাকা ও আরও কিছু মূল্যবান সামগ্রী উদ্ধার হয়নি৷ অবাক হওয়ার মতো ঘটনা, মন্দিরে পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষীদের চোখ এড়িয়ে এতবড় চুরি হল কী করে?’

প্রতি বছর পুজোর সময় পুরো ঢাকেশ্বরী মন্দির রং করা হয়৷ ষষ্ঠী থেকে দশমী পাঁচদিন লক্ষাধিক লোক এখানে আসে৷ লাখ দুয়েক টাকা পুজোর বাজেট৷ ভক্তদের দানেই পুজো হয়৷ তবে কুমারীপুজো হয় না৷ আর মহানগর পুজো কমিটির সঙ্গে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দুর্গাপুজোর কোনো সম্পর্ক নেই৷ এই মন্দিরে পয়লা বৈশাখও বেশ বড় করে হয়৷ সেদিন পঁচিশ-ত্রিশ হাজার মানুষ আসেন৷ মন্দিরের সামনে দু’দিন মেলা বসে৷ সরস্বতীপুজো, বাসন্তীপুজো, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, কালীপুজো বারো মাসে তেরো পার্বণ এই মন্দিরে৷ প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি—জন্মাষ্টমী, বিজয়া দশমী, বুদ্ধপূর্ণিমা ও বড়দিন বাংলাদেশে এই চারটি দিনও জাতীয় ছুটি৷

প্রদীপবাবুই কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘২০১৩ সালের মার্চে আমার বাবার নামে ১৬টি স্কলারশিপ চালু করেছি৷ প্রতিটি স্কলারশিপের মূল্য নগদ ৩ হাজার টাকা৷ বাংলাদেশের মেধাবী হরিজন ছেলে-মেয়ে যারা পয়সার অভাবে পড়াশুনো করতে পারছে না, তাদের এককালীন এই বৃত্তির টাকা দেওয়া হয়৷’ তাঁর কাছেই শুনলাম, মন্দিরের জলের সমস্ত কাজকর্ম ট্যাপ ওয়াটারের সঙ্গে হরিদ্বার থেকে আনা গঙ্গাজল মিশিয়ে হয়৷

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কোনও কমিটি নেই৷ প্রদীপবাবুর ছেলে পলাশ চক্রবর্তী উত্তর ২৪ পরগণার সোদপুরে থাকেন৷ দু’মেয়ের বিয়ে হয়েছে ভারতেই৷ প্রদীপবাবুর অন্য ভাই-বোনেরাও ভারতে থাকেন৷ প্রদীপবাবুর পর ঢাকেশ্বরী মন্দিরের সেবাইত কে হবেন? কেই বা এই মন্দিরের দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনা করবেন?

‘আমারও তো এসব নিয়ে ইদানীং দুশ্চিন্তা হচ্ছে৷ ছেলে এদেশে আর ফিরবে বলে তো মনে হয় না৷ আমিও কবে আছি, কবে নেই৷ কাজল দেবনাথ ও ঢাকার আরও দু’চারজন গণ্যমান্য মানুষকে অনুরোধ করেছি, ঢাকেশ্বরী মন্দিরের একটা পরিচালন কমিটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তৈরি করা দরকার৷ ওঁরাই সব কাজকর্ম দেখাশোনা করবেন৷ দেখা যাক কী হয়৷’ বললেন প্রদীপবাবু৷

প্রদীপবাবুর সঙ্গে গল্প করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল৷ গীতা বিশ্বাস বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তার কথা উঠলে তবুও কমু যে, ঢাকা শহরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাইয়াদের অবস্থা কিছুটা হইলেও ভালো৷ গাঁয়ের মাইয়াদের অবস্থা আজ সত্যই করুণ৷ এত নির্যাতিতা হইতাছে গাঁয়ের মাইয়ারা৷ শহরে বইস্যা কিচ্ছু বোঝন যায় না৷ আর অপেক্ষা না৷ সরকারের পক্ষ হইতে এই ব্যাপারে কিছু একটা এখনই করন লাগে৷ গেল ডিসেম্বরেও গাঁ-গঞ্জের অনেক হিন্দু মাইয়া ধর্ষিতা হইছে৷’

জিজ্ঞাসা করলাম—আপনি যে স্কুলে পড়াচ্ছেন সেখানকার ছাত্রীদের অবস্থা কেমন? গীতা বললেন, ‘হিন্দু মাইয়ারা পড়ালিখায় বেশ ভালো৷ হিন্দু-মুসলমান বইল্যা আমাগো ইসুকলে কিছু নাই৷ মাইয়াদের মধ্যে মিলমিশ খুব৷ ইসুকলগুলাতে রিলিজিয়ান সাবজেক্ট গোছের কিছু যে পড়ানো হয় না সেইটাই রক্ষা৷ তাছাড়া প্রতিটা ইসুকলের প্রেয়ার হইল গিয়া, আমাগো দ্যাশের জাতীয় সংগীত—‘আমার সোনার বাংলা,/আমি তোমায় ভালোবাসি…৷’

সেদিন গীতা এ কথাও বললেন, ‘ইন্ডিয়া যদি বাংলাদ্যাশের সংখ্যালঘুদের আর একটু সাপোর্ট দিত তা হইলে আমাগো সাহস আরও বাড়ে৷ আমরা তো শুধু মারই খাইতাছি৷’ গীতাদেবীকে সমবেদনা জানাবার ভাষা সেদিন সত্যিই আমার ছিল না৷ তাছাড়া ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বারবার হামলা ও চুরির ঘটনায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে মন৷

সন্ধ্যা ৬টা৷ শনিপুজো উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বেশ ভিড়৷ ঢাকেশ্বরীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছেন মহিলারা৷ প্রত্যেকের হাতেই একটা করে মিষ্টির প্যাকেট৷ নাটমন্দিরে পরিচয় হল পূজা শিকদারের সঙ্গে৷ ঢাকার গুলশানে বাড়ি তাঁর৷ ঢাকেশ্বরী দেবীন্তপ্রাণ পূজা৷ হবেন নাই-বা কেন৷ পূজা বিশ্বাস করেন ঢাকেশ্বরীর আশীর্বাদেই কোল আলো করে সন্তান এসেছে তাঁর৷

কলকল করে কথা বলেন পূজা৷ আর কথার মাঝে হাসি৷ ঢাকেশ্বরীর কাছে মানতের ফলেই ‘মা’ ডাক শুনেছেন ভদ্রমহিলা৷ স্বামী ব্যবসায়ী৷ প্রথম প্রথম স্বামীর সঙ্গে মন্দিরে আসতেন৷ পরে একাই এখানে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতেন৷

সরল বিশ্বাসে বলে যাচ্ছিলেন পূজা—ঢাকেশ্বরী মায়ের নিকট খুব কান্নাকাটি করতাম৷ একদিন সেবাইত প্রদীপ চক্রবর্তী আমাকে কানতে দেইখ্যা কইলেন, শুধু না কাইন্দ্যা মায়ের নিকট জোর কইরা কিছু চাইতে পারস না? ঢাকেশ্বরীর কাছে মানত কর৷ সন্তানের কথা একবার মুখ ফুইট্যা তো কইয়া দেখ৷ মন দিয়া কিছু চাইলে ঢাকেশ্বরী দেবী কক্ষনো বিমুখ করেন না৷’

বললাম, ‘ঠাকুরের কাছে মানত করলেই কি সবকিছু মেলে?’ পূজা বললেন, ‘ঢাকেশ্বরী মাতা ভীষণ জাগ্রতা৷ আমি তো কই তাঁর আশীর্বাদেই মা হইছি৷’ পূজার অটুট বিশ্বাসে আঘাত করার অধিকার আমার তো নেই৷

শনিপুজোর প্রসাদ নাটমন্দিরের বাইরে বিতরণ করা হয়৷ প্রতি রবিবার বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হরিসেবা৷ এদিকে প্রদীপবাবু তো আমাকে মন্দিরে আসার ঢালাও আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন৷ পাঠকদের জানিয়ে রাখা দরকার, ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাজনের সময় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক গোলযোগ শুরু হয়৷ সেইসময় ঢাকেশ্বরী মন্দিরের অন্য দুই সেবাইত যথাক্রমে হরিহর চক্রবর্তী ও প্রহ্লাদমোহন তেওয়ারি ঢাকেশ্বরী বিগ্রহ নিয়ে গোপনে ভারতে চলে যান৷ তাঁরা কলকাতার কুমোরটুলিতে নতুন মন্দির নির্মাণ করে এই বিগ্রহ যথোচিত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করেন৷ আজও সেই বিগ্রহ পূজিত হচ্ছে৷

১৯৪৮ সালে হেমচন্দ্র চক্রবর্তী ঢাকায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে অষ্টধাতুর নতুন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন৷ সেইসময় সাম্প্রদায়িক হামলা ও দেশত্যাগের জোয়ারে ঢাকাসহ সারাদেশে এক গভীর সংকট নেমে আসে৷ ঢাকেশ্বরী মন্দির ও এর দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষা করতে গিয়ে হেমবাবুকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়৷ এমনকী মিথ্যা অভিযোগে জেলেও যান৷ ১৯৫০, ১৯৫৮ ও ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক হামলার রোষে ঢাকেশ্বরী মন্দির নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ দশভুজা বিগ্রহ, রুপোর সিংহাসন, বাসুদেব বিগ্রহ লুট হয়৷ পুজো-অর্চনার পরিবেশ ব্যাহত হয়৷ ভক্তদের সহায়তায় ঢাকেশ্বরীর বিগ্রহ পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়৷

আশ্চর্যের ব্যাপার, এত বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে অগণিত ভক্তকে আপন গৌরব-গাথা শুনিয়ে চলেছে এই মন্দির৷

ঢাকায় থাকাকালীন সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, শাঁখারি বাজারের বিখ্যাত কালীবাড়ি, কমলাপুরের বৌদ্ধ মহাবিহারসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে গিয়েছি৷ এই প্রসঙ্গে ইসকন মন্দিরের কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন৷ কথাবার্তা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’-এর সাধারণ সম্পাদক প্রখ্যাত আইনজীবী রানা দাশগুপ্তের সঙ্গে৷

‘বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন’ -এর সেক্রেটারি – জেনারেল মিঃ নির্মল রোজারিও এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি ভদন্ত সুনন্দপ্রিয় ভিক্ষুর সুচিন্তিত মতামত জেনেছিলাম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে৷ সেসব কথাও যথাসময়ে জানাবার ইচ্ছা আছে৷ তবে যেকথা বলব বলব করেও বলা হয়নি এতক্ষণ তা হল, বাংলাদেশের বিভিন্ন জাগ্রত মন্দির ও শক্তিপীঠের বিস্তারিত আলোচনা স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়৷ — চলবে

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content