রমনা কালীমন্দির থেকে মিনিট কুড়ি-পঁচিশের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ঢাকেশ্বরী মন্দিরে৷ ‘ঢাকেশ্বরী মাতৃভাণ্ডার’-এর স্বত্বাধিকারী রামরতন চক্রবর্তী আমাকে দেখে দোকানের ভেতর থেকে হাসিমুখে হাত নেড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আবার মন্দিরে আসা হল বুঝি?’ বললাম, ‘আপনাদের ঢাকেশ্বরী মন্দির এমনই এক তীর্থস্থান যেখানে বারবার আসতে ইচ্ছা করে৷’
রামরতনবাবু বললেন, ‘একদম খাঁটি কথা বলেছেন৷ মাত্র কয়েক মাস দোকান দিয়েছি৷ সারাদিন দোকানেই থাকি৷ এমনও দেখেছি, সপ্তাহে তিন-চারদিনও মন্দিরে আসেন কেউ কেউ৷ আমার দোকান থেকে পুজোর সামগ্রী কিনে নিয়ে যান৷’
পুজো, বিয়ে, পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের নানা জিনিসপত্র পাওয়া যায় এখানে৷ পুজোর সামগ্রীর আরও দুটো ছোট দোকান রয়েছে ঢাকেশ্বরী মাতৃভাণ্ডারের পাশে৷ ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বিয়ে, মুখেভাত, উপনয়ন, পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মও অনুষ্ঠিত হয়৷
মন্দিরে পৌঁছে প্রদীপবাবুর খোঁজ করতেই তাঁর দেখা পেয়ে গেলাম৷ একতলায় অনেকটা জায়গা৷ মন্দিরের বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে এখানে পঙ্ক্তিভোজন হয়৷ অন্য সময় এখানে বসে চুটিয়ে গল্পগুজব করা যায়৷ প্রদীপবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘মায়ের প্রসাদ পেতে আর একটু অপেক্ষা করতে হবে৷ ইতিমধ্যে আমরা বসে একটু গল্পসল্প করতেই পারি৷ আপনার অসুবিধা হবে না তো?’
বললাম, ‘ভালোই তো৷ আপনার কাছে আমারও কিছু কথা জানার আছে৷’
১৯৭১-এ ঢাকেশ্বরী মন্দির কীভাবে পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পেল?
প্রদীপবাবুর বয়স পঁয়ষট্টির ওপর৷ সারাদিন মন্দির দেখাশোনার কাজে ব্যস্ত থাকলেও ক্লান্তি বলে কিছু নেই৷ বরং গল্প করতে ভালোবাসেন৷ বললেন, ‘এই মন্দিরের প্রায় অর্ধেক অংশে ব্যাপক ভাঙচুর হলেও ঢাকেশ্বরী মায়ের ইচ্ছাতেই এই জায়গা শেষপর্যন্ত রক্ষা পায়৷ এও এক অলৌকিক ব্যাপার! তবে ভক্তরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে বা বসে মায়ের পুজো ও আরতি দেখেন সেই জায়গায় পাক সেনাদের স্তূপীকৃত গোলা-বারুদ থাকত৷
আমার বাবা তখন জীবিত৷ মন্দিরেই ছিলেন৷ আমাদের বাড়ির সবাই তখন ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম৷ একদিন সকালে খান সেনারা মন্দিরে এসে বাবাকে স্টেনগান উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল—এখানে কোনও মুক্তিযোদ্ধা নেই তো? বাবা বললেন, ‘আমি বুড়ো মানুষ৷ মন্দির দেখাশোনা করি৷’ ওই সেনারা তখন বাবাকে সাবধান করে বলেছিল—এখানে যেন কোনও মুক্তিযোদ্ধা না থাকে৷
বাবা ভালো হিন্দি বলতেন৷ তাঁর কথা পাকিস্তানি সেনাদের হয়তো বিশ্বাস হয়েছিল৷ ১৯৬৫ সালে নেপালের রাজা মহেন্দ্র ঢাকেশ্বরী মন্দিরে এসেছিলেন পুজো দিতে৷ তিনি একটি যজ্ঞমন্দির নির্মাণ করে দিয়ে যান৷ এরশাদ সরকারের মদতপুষ্ট ’৯০-এর সাম্প্রদায়িক হামলায় সেই যজ্ঞমন্দির ধ্বংস হয়৷ মূল মন্দিরেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়৷ তবে ’৭১-এ মন্দিরটি যে একরকম রক্ষা পেল তার জন্য নেপালের রাজার কৃতিত্বই সবথেকে বেশি৷ রাজার নির্দেশে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নেপালের রাষ্ট্রদূত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সর্বময়কর্তা জেনারেল টিক্কা খানকে অনুরোধ করেন যাতে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের বড় কোনও ক্ষতি না হয়৷ তবে বিভিন্ন সময়ে বারবার সাম্প্রদায়িক জনরোষেরও শিকার হয়েছে এই মন্দির৷’
মায়ের নিরামিষ ভোগ খুব তৃপ্তি করে খেলাম৷ সাদা সরু চালের ভাত, বেগুনি, আলুভাজা, ছোলার ডাল, পনিরের তরকারি, পায়েস ও মিষ্টি৷ ততক্ষণে প্রদীপবাবুরও খাওয়া হয়ে গিয়েছে৷ কী ধরনের আক্রমণ নেমে এসেছিল ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ওপর, সেসব ঘটনার কথা শুনেছিলাম তাঁর মুখে৷
সেই সময় আরেকজন শ্রোতাও জুটে গেলেন আমার সঙ্গে৷ শ্রীমতী গীতা বিশ্বাস৷ সেদিন দুপুরে ঢাকেশ্বরীকে ভোগ দিয়েছেন গীতাদেবী৷ প্রদীপবাবুর চেনাশোনা৷ ঢাকার অক্সব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষিকা৷ ঢাকা শহরের অন্যতম পশ এলাকা ধানমণ্ডির ৭নং রোডে থাকেন গীতাদেবী৷ ঢাকেশ্বরী দেবীর ভক্ত গীতাদেবীর জীবনও নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা৷ অল্প বয়সে বিধবা হয়েছেন৷ অনেক চিকিৎসা করেও স্বামীকে বাঁচাতে পারেননি৷ দুই ছেলে প্রসূন ও পলক৷ প্রসূন ইকনোমিক্স নিয়ে মার্কিন মুলুকে পড়াশুনো করছে৷
প্রদীপবাবু বলে চললেন— ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবর রহমান সপরিবারে ঘাতকদের হাতে নিহত হন৷ ২৫ তারিখ রাত বারোটা নাগাদ বাংলাদেশ সেনার পোশাক পরা কিছু লোক মন্দিরে আসে৷ আমাকে ওরা ঘুম থেকে ডেকে তোলে৷ বলে, অভিনেত্রী কবরীর কাছ থেকে একটা ওয়ারলেস সেট পাওয়া গিয়েছে৷ এই ওয়ারলেসে ভারতে খবর পাঠানো হয়৷ এই মন্দিরেও ওয়ারলেস আছে বলে আমরা জানতে পেরেছি৷
আমি বললাম, আপনারা ভুল খবর পেয়েছেন৷ এরপর ওরা আমাকে বন্দুকের মুখে বাসায় নিয়ে গিয়ে আমার বাবা ও বড় ভাই নারায়ণচন্দ্রকে ঘুম থেকে তোলে৷ মন্দিরে ঢুকে পূজারিদেরও ডেকে তোলে৷ তারপর আমাদের মন্দিরের প্রধান গেটের সামনে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে মাথার ওপর হাত উঁচু করে দাঁড়াতে বলে৷ সেইসময় এক বন্দুকধারী আমাদের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে৷ বাকি সবাই হইচই করতে করতে মন্দিরের ভেতরে ঢুকে গেল৷
কিছুক্ষণ পর একটা ভারী বস্তা কাঁধে নিয়ে সবাই মন্দির থেকে বের হয়ে মোটরগাড়িতে চলে যায়৷ ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকে দেখি, শূন্য বেদি৷ ঢাকেশ্বরী মায়ের অষ্টধাতুর মূর্তিটি নেই৷ প্রায় ৫০ ভরি সোনার অলংকার ছিল৷ তারও কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ নেই মন্দিরের মূল্যবান জিনিসপত্রও৷ মায়ের বড় রুপোর সিংহাসন ভেঙে নিয়ে যায়৷ এমনকী বাসুদেবের পিতলের বিগ্রহ উধাও৷ কষ্টিপাথরের শিবমূর্তি চূর্ণবিচূর্ণ৷ এসব দেখে চোখে জল এসে গিয়েছিল৷’
পরদিন স্থানীয় থানায় প্রদীপবাবুরা লিখিত অভিযোগ জানাবার পর মন্দির পাহারার জন্য কয়েকজন পুলিশ নিয়োজিত হয়৷ কিন্তু লুট হয়ে যাওয়া ঢাকেশ্বরী মূর্তি, গহনা ও মূল্যবান সামগ্রীর হদিশ পাওয়া যায়নি৷ এই ঘটনার পর প্রায় ছ’বছর ধরে পটে ঢাকেশ্বরীর পুজো হয়েছে৷ ১৯৮৩ সালে হরিপদ ঘোষ নামে এক ভক্ত ভারত থেকে নতুন বিগ্রহ তৈরি করিয়ে এনে মন্দিরে দান করেন৷ শাস্ত্রীয় মতে ঢাকেশ্বরী বিগ্রহ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হল গর্ভগৃহে৷
পনেরো বছর পরের ঘটনা৷ ঘটনাস্থল সেই ঢাকেশ্বরী মন্দির৷ ১৯৯০ সাল৷ অক্টোবর মাসের ৩১ তারিখ৷ সারা দেশে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু হল৷ ‘বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’ তখন এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছিল, এই সংঘবদ্ধ হামলার শিকার হয়েছে ছোটবড় প্রায় আড়াই হাজার মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কয়েক হাজার বাড়িঘর ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান৷ দেশের নানা জায়গায় বহু হিন্দু মহিলা অপহৃতা ও ধর্ষিতা হয়েছেন৷
ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বিকেলের দিকে প্রায় সাত-আটশো লোক বোমা, বল্লম ও লাঠিসোঁটা নিয়ে ঢুকে পড়ে৷ মন্দিরের মূর্তি, অলংকার, আসবাবপত্র আবারও লুট হয়৷ এরপর ওই হামলাকারীরা মন্দিরের সেবাইত প্রদীপবাবুর বাড়িতে ও মন্দির কর্মীদের বাসভবনে লুটপাট চালায়৷ প্রদীপবাবু তাঁর পরিবারসহ পালিয়ে বাঁচেন৷ অন্য কর্মীরাও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মন্দির থেকে চলে যান৷ পুলিশ থাকলেও তারা নির্বাক দর্শকের ভূমিকা নেয়৷
এর পরেও বর্বর হামলাকারীরা চুপ থাকেনি৷ গোটা চত্বরে আগুন লাগিয়ে দেয়৷ অল্প সময়ের মধ্যে আগুনের লেলিহান শিখা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ছড়িয়ে পড়ে৷ পুড়ে যায় মন্দির ও আশপাশের এলাকা৷ প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শনসমূহ ধ্বংস হয়৷ মন্দির জ্বলতে দেখা যায় অনেক রাত পর্যন্ত৷ মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির দুর্গামন্দিরও হামলাকারীদের হাতে ভেঙেচুরে যায়৷ দুর্গা ও কালী প্রতিমা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করা হয়৷
সবকিছু ঘটে যাওয়ার পর পরদিন আওয়ামি লিগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে এসে সেই ধ্বংসলীলা স্বচক্ষে দেখেন৷ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মহম্মদ এরশাদ ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যগণও মন্দির পরিদর্শনে আসেন৷ হায়রে দুনিয়া!
ঢাকেশ্বরী মন্দির নতুন করে নির্মাণ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন মাননীয় রাষ্ট্রপতি৷ কিন্তু মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি ও বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতারা রাষ্ট্রপতিকে বলেন, সারা দেশে সাম্প্রদায়িক হামলায় যে অগুনতি মন্দির ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে, সেগুলো পুনর্নির্মাণের পরই ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাজ শুরু হতে পারে৷ প্রবল জনমতকে উপেক্ষা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি৷
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশাপাশি মাধব গৌড়ীয় মঠ ও চট্টগ্রামের শ্রীশ্রীরামঠাকুরের আশ্রম মেরামতের কাজে হাত দেয় সরকার৷ কিন্তু ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাজ মহানগর পূজা কমিটির দাবি মেনে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় সরকার৷ কমিটির বক্তব্য যে পরিষ্কার ও সবদিক থেকে যুক্তিযুক্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷
প্রদীপবাবু বলেন, ‘ঢাকেশ্বরী দেবীর পুজো-অর্চনা ছবিতেই চলতে থাকে৷ ইতিমধ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়৷ গণ-অভ্যুত্থানে সরকারের পতন ঘটে৷ সাধারণ নির্বাচনে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে৷ কিন্তু সরকারের তরফে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পুনর্নির্মাণের ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ায় মন্দির কর্তৃপক্ষকেই ভক্তদের সহায়তায় কাজ শুরু করতে হয়েছিল৷’
সেবাইতের মুখে শুনলাম, ২৪ বছর আগে ঢাকেশ্বরীর অষ্টধাতুর মূর্তিটি তৈরি করে দেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট মানুষ ইন্দো-সুইস ব্যাংকের ম্যানেজার দিলীপ দাশগুপ্ত৷ রুপোর সিংহাসন গড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করেন প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ অরূপরতন চৌধুরি৷ ঢাকেশ্বরী দেবীর মূর্তিটি নির্মাণ করেন নামী ভাস্কর শংকর ধর৷—চলবে
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
সৌজন্যে দীপ প্রকাশন