বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

আমরা সকলেই জানি আমাদের শরীরের অন্যতম প্রধান অঙ্গ কিডনি। কিডনি বা বৃক্কই আমাদের শরীরকে সুস্থ ও শুদ্ধ রাখতে সহায়তা করে। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন আমাদের শরীরে কিডনি বা বৃক্ক কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। আমাদের শরীরকে শুদ্ধ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় কিডনি এবং কিডনির মাধ্যমেই আমাদের শরীর থেকে বিপাকজাত সমস্ত দূষিত পদার্থ নিষ্কাশিত হয়। অর্থাৎ আমাদের শরীরে কিডনি যদি সঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে শরীর থেকে দূষিত পদার্থ নিষ্কাশিত হতে পারবে না ফলে শরীরের প্রতিটি কোষ তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে এবং তার প্রভাবে আমাদের শরীরের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বা তন্ত্রের কার্যকারিতাও নষ্ট হবে। আমাদের শরীরে দুটি কিডনি রয়েছে একটি ডান দিকে এবং একটি বাম দিকে এবং দুটি কিডনি থেকে দুটি নালি বেরিয়েছে যাদেরকে বলা হয় গবিনী বা ইংরেজিতে বলে ইউরেটার এবং ইউরেটার দুটি একটি থলির সঙ্গে সংযুক্ত যেটাকে বলা হয় মূত্রথলি বা ইউরিনারি ব্লাডার। এই মূত্রথলিতেই মূত্র সঞ্চিত হয় এবং সময় বিশেষে মূত্রনালির মাধ্যমে শরীর থেকে নির্গত হয়। এই ভাবেই কিডনির মাধ্যমে শরীরে মূত্র উৎপাদন হয় এবং তারপরে এই বিভিন্ন অঙ্গগুলির সহায়তায় শরীর থেকে নির্গত হয় এবং প্রত্যেকটি বয়সে কিডনি সুস্থতা একান্তভাবেই জরুরি আর প্রবীণদের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। আর তাই বয়স কালে আপনার কিডনি সুস্থ আছে কি না সেটা জেনে রাখা আমাদের খুব জরুরি।
 

কিডনি ঠিকমতো কাজ করছে বোঝার উপায় কী?

আপনার দৈনিক মুত্রের পরিমাণ সঠিক হচ্ছে কি না অর্থাৎ মূত্র সঠিক পরিমাণে নির্গত হচ্ছে কি না? মূত্রের স্বাভাবিক পরিমাণ সচরাচর আমরা বলে থাকি দৈনিক অন্তত দুই থেকে আড়াই লিটার কিন্তু এর থেকে যদি আপনার কম উৎপাদন হয় অর্থাৎ সচরাচর এক লিটারের থেকে কম মূত্র হলে আপনাকে কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিজের গৃহ চিকিৎসককে জানালেই তিনি আপনাকে সঠিক পরামর্শ দেবেন।

মুত্র নির্গমনের সময় কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না অর্থাৎ কোনও বেগ পেতে হচ্ছে কি না অথবা ড্রপ-এর আকারে বের হচ্ছে কি না অথবা আপনার মনে হচ্ছে কি না যে আপনার মূত্র জমে রয়েছে। এ ধরনের কোনও সমস্যার সম্মুখীন হলে আপনি সত্বর আপনার গৃহ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন কারণ পুরুষদের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যা বেশি দেখা যায় কারণ তাদের প্রোস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি বা ইউরেথ্রাল স্ট্রিকচার ইত্যাদির কারণে এই সমস্যা হতে পারে।

প্রোস্টেট গ্রন্থির বৃদ্ধি যাকে আমরা বিনাইন প্রসটেটিক হাইপারপ্লাসিয়া বলি সেটা একটা বয়সের পরে মূলত ৬০ বছরের পরে পুরুষদের সাধারণ একটি সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রে কিন্তু একটু বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন, কারণ অনেক ক্ষেত্রে প্রস্টেট ক্যানসার কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে হয়, ফলে সে বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি। প্রোস্টেট ক্যানসারের প্রাথমিক নির্ণয়ের একটি পদ্ধতি হল রক্তের পিএসএ পরীক্ষা। পিএসএ অর্থাৎ প্রোস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন যেটা সচরাচর চারের মধ্যেই থাকে কিন্তু চারের বেশি হলে আমাদের কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে সব সময় চারের বেশি হওয়া মানেই যে ক্যানসার সেটাও নয়, অনেক সময় অন্যান্য বিভিন্ন কারণেও এটা হতে পারে তাই একজন ইউরোলজিস্ট আপনাকে এ বিষয়ে সঠিক পরামর্শ দেবেন।

আপনার কিডনির প্রাথমিক কার্যকারিতা সঠিক হচ্ছে কি না সেটা জানার একটি সহজ পদ্ধতি হল রক্তের ইউরিয়া এবং ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা। ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন যদি তার স্বাভাবিক মাত্রা থেকে বেশি থাকে অর্থাৎ ইউরিয়া যদি 45 mg এর বেশি বা ক্রিয়েটিনিন যদি ১.৪ এমজি-এর বেশি থাকে তবে কিন্তু আপনাকে কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ জরুরি। ইউরিয়া এবং ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বৃদ্ধি অনেক সময় তাৎক্ষণিক কিছু কারণের জন্য হয় যেমন ইউরিনারি ইনফেকশন আবার অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী কারণের জন্য হতে পারে যেমন ক্রনিক রেনাল ফেলিওর এই বিষয়ে সঠিক পরামর্শ দেবেন আপনার চিকিৎসক। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা ভীষণভাবে জরুরি। সচরাচর বলা হয়ে থাকে যে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা চারের বেশি হলে ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয় কিন্তু ভয় পাবেন না সব ক্ষেত্রেই চারের বেশি হলেই ডায়ালিসিস করতে হবে এরকম কোনও কথা নেই এ বিষয়ে সঠিক পরামর্শ নেবেন নেফ্রোলজিস্ট।

৬০ বছরের পর আমরা সাধারণত বলে থাকি যে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ইউএসজি কে ইউ বি অর্থাৎ আলট্রাসনোগ্রাফি করে দেখে নেওয়া যে আপনার কিডনি এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট গ্রন্থি ঠিক আছে কি না।

যাদের ইউরিনারি ফ্লো বা প্রস্রাবের বেগের সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ইউরোফ্লোমেট্রি বলে একটি টেস্ট করে দেখা প্রয়োজন হয়।

প্রস্রাবের কোনও জ্বালা যন্ত্রণা বা প্রস্রাবের রঙের পরিবর্তন বা প্রস্রাব দিয়ে রক্ত গেলে সে ক্ষেত্রে কিন্তু আপনাকে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ অতি সত্বর নেওয়া প্রয়োজন। প্রস্রাবে ইনফেকশন বা সংক্রমণ বা অন্যান্য নানান কারণে এই সমস্যাগুলি দেখা দিতে পারে এমনকী কিডনি ছাড়াও অন্যান্য অঙ্গের কার্যকারিতার অস্বাভাবিকতার কারণে এই সমস্যা বিশেষ করে রঙের পরিবর্তন হয় যেমন লিভারের অসুখের ক্ষেত্রে বিশেষ করে জন্ডিস হলে মূত্রের রং গাঢ় হলুদ রং হয়। তাই এই সব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ ভীষণ রকম জরুরি। মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রস্রাবের সংক্রমণ বেশি হতে দেখা যায়।

বিশেষ কিছু রোগীদের ক্ষেত্রে যেমন ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে মুহূর্তেই সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে বলে তাঁদের সর্তকতা গ্রহণ বিশেষভাবে জরুরি।

ইউরোজেনিটাল এরিয়া অর্থাৎ মূত্রদ্বার এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে যোনিদ্বার সংলগ্ন অঞ্চলগুলি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা ভীষণভাবে জরুরি নতুবা এসব অঞ্চলে ছত্রাকজাতীয় সংক্রমণের কারণে এখানে চুলকুনি বা ইরিটেশন এগুলো সচরাচর লক্ষ করা যায় এবং শুধু তাই নয়, এই ছত্রাকের সংক্রমণ উপরের দিকেও ছড়িয়ে যেতে পারে।

পুরুষদের ক্ষেত্রে গ্লানস পেনিসের অঞ্চলে চামড়া জুড়ে থাকা যেটাকে আমরা ফাইমোসিস বলি সেটা কিন্তু একটা সমস্যা। সচরাচর এই সমস্যা ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকা বা সচেতন থাকা ভীষণভাবে জরুরি এবং এক্ষেত্রে প্রবীণদের বাড়ির লোকদেরও কিন্তু ভূমিকা পালন জরুরি।

ক্যাথিটার পরানো রোগীদের বিশেষ যত্ন

যে সমস্ত রোগীর ক্ষেত্রে ক্যাথিটার পরানো থাকে সে সমস্ত রোগীর ক্যাথিটার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আছে কি না বা ক্যাথিটারের নালিতে কোনওরকম অবরুদ্ধ বা অবস্ট্রাকশন হচ্ছে কি না বা কোনও সেডিমেন্ট জমছে কি না এগুলো লক্ষ রাখা বাড়ির লোকেদের ভীষণ জরুরি। নির্দিষ্ট সময় অন্তর ক্যাথিটার পরিবর্তন করা এবং সময়ে সময়ে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। কখনওই অপ্রশিক্ষিত কোনও ব্যক্তির দ্বারা ক্যাথিটার চেঞ্জ করা বা পরিবর্তন করা বা ক্যাথিটার পরানো একেবারেই কাম্য নয় কারণ এক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হতে পারে এবং আপদকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আমি তাই সবসময় পরামর্শ দেব ক্যাথিটার পরানো এবং ক্যাথিটার চেঞ্জ চিকিৎসকদের দ্বারা সম্ভব হলে তাদের তত্ত্বাবধানেই করানো।

 

ইউরোলজিস্ট না নেফ্রলজিস্ট?

সচরাচর সাধারণ মানুষের মধ্যে ইউরোলজিস্ট এবং নেফ্রলজিস্ট নিয়ে একটি কনফিউশন রয়েছে। কিডনি এবং তৎসংলগ্ন অন্যান্য যে অঙ্গ অর্থাৎ ইউরেটার, ইউরিনারি ব্লাডার, প্রোস্টেট গ্রন্থি, ইউরেথ্রা বা মূত্রনালি প্রভৃতিতে গঠনগত কোনও অস্বাভাবিকত্ব অথবা কোনও বৃদ্ধি যেমন কোনও টিউমার, ক্যানসার অথবা কোনও স্টোন প্রভৃতি বিষয়ক সমস্যা থাকলে যে চিকিৎসককে দেখানোর প্রয়োজন হয় তাকে বলা হয় ইউরোলজিস্ট। আবার কিডনির কার্যকারিতার অস্বাভাবিকত্ব অর্থাৎ রেনাল ফাংশানের অস্বাভাবিকত্বর জন্য যে চিকিৎসককে দেখানোর প্রয়োজন হয় তাকে বলা হয় নেফ্রলজিস্ট। অর্থাৎ ক্রনিক এবং অ্যাকিউট রেনাল ফেলিওরের রোগীদের ক্ষেত্রে নেফ্রলজিস্টের পরামর্শ গ্রহণ জরুরি। কোনও রোগীর ডায়ালিসিসের প্রয়োজন আছে কি নেই সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নেফ্রলজিস্টরা। অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে ইউরোলজিস্ট এবং নেফ্রলজিস্ট উভয়ের পরামর্শ গ্রহণ করা প্রয়োজন হয়। আমি তাই পরামর্শ দেব রোগীদের নিজের সিদ্ধান্ত নিজে না নিয়ে আপনাদের গৃহ চিকিৎসক বা যে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন তার পরামর্শে এগিয়ে চলা। নতুবা চিকিৎসা বিভ্রাটে পড়তে পারেন।

উপরের পরামর্শগুলো মেনে চললে আপনারা আপনাদের কিডনিকে সুস্থ রাখতে সক্ষম হবেন। বিশেষ প্রয়োজনে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ জরুরি।

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

লেখক: কর্ণধার ‘বাঁচবো’, সহ সম্পাদক জেরিয়াট্রিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া, পশ্চিমবঙ্গ শাখা৷ উপদেষ্টা, প্রোটেক্ট দ্যা ওয়ারিয়ার্স। যোগাযোগ : ‘বাঁচবো’, ফোন : ৯৯০৩৩৮৮৫৫৬


Skip to content