বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর, ২০২৪


ছিন্নপত্রাবলীতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—
‘ইচ্ছে করে জীবনের প্রত্যেক সূর্যোদয়কে সজ্ঞানভাবে অভিবাদন করি এবং প্রত্যেক সূর্যাস্তকে পরিচিত বন্ধুর মতো বিদায় দিই।’

তাঁর জন্মদিন কাছাকাছি এলেই কবিকথিত এই আপাতসরল আকাঙ্ক্ষার কথাটি মনে পড়ে যায়। তাঁর বহুতর জীবনকথায় এতদিনে আমরা সকলেই জানি, আশি বৎসরের সেই অতুল্যপ্রভ রবিকিরণের দিনগুলির প্রতিটিই শুরু হত সূর্য জাগানিয়া হয়ে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন সূর্য উঠে গিয়েছে অথচ তিনি ওঠেননি এমনটা কখনও হয়নি। শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণে বিচিত্র নান্দনিকতায় নির্মিত তাঁর বাসভবনগুলির প্রতিটিই সূর্যকরোজ্জ্বল, বিশেষত উদয়ন বাড়িটির তো তুলনাই নেই। প্রতি প্রত্যূষে পূর্বাস্য কবি মগ্ন হতেন সৃষ্টিতে, রঙেরসে রঙিন হত সাহিত্য তথা চিত্রাঙ্কনের জগৎ, বাড়িগুলি আজও যেন সেই স্থির অচঞ্চল ছবিটি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

রবীন্দ্রনাথের এই সূর্যপরিক্রমণ তাঁর দৈনন্দিন যাপনসীমায় কেমন করে ওতপ্রোত হয়ে ছিল তার সবচেয়ে বড় উদাহরণটি বোধ হয় ধরা আছে নিশীথ সূর্যের দেশ নরওয়েতে! সেখানে নাকি মধ্যরাতে সূর্যোদয়ের ‘অভিঘাত’ থেকে রবিকবিকে আড়াল করতে মোটা পর্দা লাগানো হয়েছিল তাঁর শয়নকক্ষের জানালায়!

পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোর বাইরে গেলে ছোট্ট রবি তাঁর তেতলার ঘরটিতে কলের জলের ‘আনন্দ’ যেমন নিতেন, তেমনিই ছাদের ওপর ঘুরে বেড়াতেন সারাদেহে সূর্যস্নানের আপ্লুতি নিয়ে।স্রষ্টার এই বিশেষ অনুভবটি ধরা পড়েছে তাঁর সৃষ্টির মাঝে, ‘বলাই’ গল্পে। ওই গল্পের নামচরিত্র বলাই সম্পর্কে গল্পকার রবীন্দ্রনাথের কলম যেন ফিরে দেখেছেন আপন উদ্ভিন্ন কৈশোর—
‘ছাদের উপর বিকেল-বেলাকার রোদ্দুর পড়ে আসে, গা খুলে বেড়ায়; সমস্ত আকাশ থেকে যেন কী একটা সংগ্রহ করে নেয়।’

বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির ‘রাতের তারা দিনের রবি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন করেই তাঁর জীবনে মিশিয়েছিলেন সূর্যের সৌরভ, যতসব মরা গাছের ডালে ডালে যুগযুগান্ত ধরে ছড়িয়ে গেছে সে রবিরশ্মির ছটা। আমরা সে সব কখনও ভুলি কখনও শুনি বটে, তবে বৈশাখ নামের রবিমাসটি এলেই মনে পড়ে জীবনের যাবতীয় দুঃখের পথে তূর্য হয়ে ওঠার মতো চিরপ্রভাতসূর্যের জন্মদিনটি সমাগতপ্রায়;
চিরনূতনেরে দিল ডাক—সেই সূর্যোদয়ের তিথি!

Skip to content