বাচ্চা মহারাজ
বাচ্চা মহারাজ এসে মা-র দিকে তাকিয়ে বললেন,
—আপনার মনের অবস্থা পুরোপুরি না পারলেও কিছুটা আমি আন্দাজ করতে পারছি মা। শ্যামসুন্দরবাবু এই ১৯টা বছরের অনেকটা সময় উত্তর ভারতের নানা তীর্থস্থানে কাটিয়েছেন। এই মঠের গেটে উনি জ্বরে বেহুঁশ অবস্থায় পড়েছিলেন। বেশ কিছুদিন কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তারপর সামান্য সুস্থ হতে—প্রতিদিন একটু একটু করে আমি ওঁর কথা শুনতাম। তাতে যা বুঝেছি—ভাইয়ের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর উনি খানিকটা উদ্ভ্রান্ত হয়ে আপনাদের ছেড়ে চলে আসেন। ওঁর মনে হয়েছিল জ্যোতিষীর অকাট্য ভবিষ্যদ্বাণীকে অগ্রাহ্য করে উনিই ভাইয়ের মৃত্যুর কারণ। তাই…তাই ওঁর সংসারভোগ করার কোনও অধিকার নেই। প্রথমে ভেবেছিলেন সাধু হয়ে যাবেন—হৃষীকেশ হরিদ্বারে কিছুদিন কাটিয়েছেন। তবে সংসার ছেড়ে এলেও সংসারের মায়ার বাঁধন উনি কাটাতে পারেননি। এখানে-সেখানে পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছেন—খাওয়াদাওয়া বিশ্রামের কোনও ঠিক ছিল না। এই ১৯ বছরে নানা রোগে বারবার অসুস্থ হয়েছেন—আবার অল্প সুস্থ হয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। মাঝে একসময় ভেবেছিলেন আপনাদের কাছে ফিরে যাবেন। কিন্তু লজ্জায় সংকোচে দায়িত্ব অস্বীকার করার দায়ে তিনি ফিরতে পারেননি। শেষে বেনারসে এসে কঠিন ব্রঙ্কালনিউমোনিয়ায় কাবু হয়ে পড়েন।
মাকে নিঃশব্দে কাঁদতে দেখে বাচ্চা মহারাজ মায়ের মাথায় হাতে রেখে কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজে থাকলেন। তারপর মাকে বললেন,
—মা, এসব সকালেই আমি আপনাকে বলতে পারতাম—কিন্তু আমি আপনাকে একটু সময় দিতে চেয়েছিলাম—একটু প্রস্তুতি। এতদিন পর আপনারা ওঁকে দেখে যেভাবে উদগ্রীব হবেন উনি তার চেয়েও বেশি উদগ্রীব হবেন এবং ওঁর মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করবে। তাই এটা খেয়াল রাখবেন যে উনি যেন খুব উত্তেজিত না হয়ে পড়েন। উনি কিন্তু এখনও খুবই অসুস্থ। আর হার্টের অবস্থা একেবারেই ভালো নয়।
দোতলায় বড় ঘরটার দরজা দিয়ে ঢুকে ডান দিকের বিছানায় বাবা শুয়ে আছেন— আমরা তাঁর চাদরে ঢাকা পা দুখানা দেখতে পাচ্ছি।
হাসপাতালের দোতলার ঘরের দরজাটা টপকে ডানদিকে ঘুরলেই ১৯ বছর আগে পৌঁছানো যাবে—সেই দরজার সামনে বিনয়কান্তি ও বসুন্ধরা একমুহূর্ত থমকে দাঁড়ায়। বিনয় মা-র দিকে তাকিয়ে মাকে ঘরে যেতে বলে।
—তুমি যাও মা!
বসুন্ধরা ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর বিনয়কান্তির হাতটা ধরে দরজা টপকে ঘরের ভেতরে গেলেন।
ওদের পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকলেন স্বয়ং বাচ্চা মহারাজ।
বাবার চেহারা বিনয়ের মনে নেই। সে দেখল একজন শীর্ণকায় মানুষ বেডে শুয়ে আছেন। বালিশের পাশে অক্সিজেনের নল রাখা। হাতে স্যালাইন চলছে। কিন্তু বসুন্ধরা যে মানুষটিকে চিনত সে তো ইনি নন। সুঠাম পেশিবহুল চেহারা শ্যামসুন্দরের। উজ্জল শ্যামবর্ণ। মাথায় কোঁকড়ানো চুল। বড় বড় চোখ। হাসপাতালের বিছানায় যিনি শুয়ে আছেন—সে তো কালচে হয়ে যাওয়া একটা কঙ্কালসার দেহ। কোটরাগত দু চোখের চারপাশে কালো ছাপ। চোপসানো ভাঙা গাল। চামড়া কুঁচকে গেছে—কপালের চামড়ায় কালো কালো দাগ—চাদরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে থাকা শিরা-বেরোনো হাতটায় স্যালাইনের ছুঁচ ফোটানো—নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সময় চাদরের মধ্যে থাকা বুকটা যেন হাপরের মতো উঠছে নামছে।
বসুন্ধরা বিনয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে লাগলেন—বিনয়ের মনে হল মা বলতে চাইছেন উনি নন। বিনয় বাচ্চা মহারাজের দিকে তাকিয়ে ইশারায় তাঁকে একটিবার দরজার বাইরে আসতে বলেন।
বাইরে এসে মহারাজের সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলে বিনয়৷
—মহারাজ আমার ছ’মাস বয়সে বাবা গৃহত্যাগী হন—তাই আমার স্মৃতিতে বাবার কোনও চেহারা নেই। তবে মা-র মুখ দেখে বুঝলাম তিনি বলতে চাইছেন উনি আমার বাবা নন।
বাচ্চা মহারাজ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন,
—দেখো বিনয়, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ কেন মিথ্যে বলবেন। তিনি আমায় সব বলেছেন। ওঁরা দুই ভাই শ্যামসুন্দর আর কৃষ্ণসুন্দর। ছোটবেলায় নৌকাডুবি হয়ে ওঁদের বাবা-মা একইসঙ্গে মারা যান। ওঁদের বিধবা পিসির বরিশালের নলচিতিতে বিরাট বাড়ি, ব্যবসা। পিতৃমাতৃহীন দুই ভাইপোকে পিসিমা তারাসুন্দরী ফরিদপুরের বাখুণ্ডা থেকে বরিশালের নলচিতিতে নিয়ে গিয়ে মানুষ করেন। পিসিমা চাইলেন ভাইপোরা সাবালক হলে তিনি তাঁর সম্পত্তি ভাইপোদের লিখে দিয়ে যাবেন। কিন্তু অস্বাভাবিকভাবে তাঁর মৃত্যু হল। পিসিমার শ্বশুরবাড়ির জ্ঞাতি-কুটুম্বেরা দুই ভাইপোকে বরিশাল ছাড়া করলেন— তাঁরা বাখুণ্ডায় এসে বাস করতে শুরু করলেন। এক জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীর ফলে শ্যামসুন্দর বিবাহ করতে চাননি।
বিনয় হাত তুলে বাচ্চা মহারাজকে বাধা দিয়ে বলে,
—থাক মহারাজ। আপনি যা যা বলছেন এগুলো সবটুকু সত্যি—আমি এসবই আমার মা-র কাছ থেকে শুনেছি। আসলে ১৯টা বছর অনেকটা সময়। আর আপনার কাছে শুনলাম ওঁর ওপর নানা রোগের ধকল গেছে। তাই হয়তো মা ওঁকে ওঁর পুরনো চেহারার সঙ্গে মেলাতে পারছেন না।
দরজার বাইরে বাচ্চা মহারাজ ও বিনয় যখন চাপাস্বরে এসব আলোচনা করছে— তখন চোখ মেলে তাকালেন শয্যাশায়ী শ্যামসুন্দর—চোখ খুলেই বসুন্ধরাকে দেখতে পেয়ে অসুস্থ শ্যামসুন্দর অস্ফুটে বললেন,
—তুমি এসেছ বসুন্ধরা? আমার বিনু আসেনি?
বসুন্ধরা তাঁর দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে আছেন দেখে—এই অসুস্থ অবস্থাতেও বুদ্ধিমান শ্যামসুন্দরের বুঝতে অসুবিধে হল না যে বসুন্ধরা তাঁকে হয়তো চিনতে পারেনি। খুব কষ্ট করে শ্বাস নিতে নিতে শ্যামসুন্দর মৃদু স্বরে বলেন,
—তুমি আমায় চিনতে পারোনি বসুন্ধরা? না চেনাটা দোষের কিছু নয়। এ শরীরের উপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে—আমার বড় বড় দাড়ি হয়ে গিয়েছিল, মাথার চুলে জট পড়ে গিয়েছিল। রোগ জীবাণু থেকে আমার সুস্থতার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হবার পর আমার মত নিয়ে ওরা চুল দাড়ি সব কেটে দিয়েছেন—হ্যাঁ, একটা জিনিস দেখলে তোমার মনের সব ধন্দ হয়তো কেটে যাবে—একবার মহারাজকে ডাকবে।
বসুন্ধরা এবার যেন বুঝতে পারছেন শ্যামসুন্দরকে—দরজার বাইরে গিয়ে বিনয়কে বললেন,
—বিনু তোমার বাবা মহারাজকে একটিবার আসতে বলছেন।
রুপোর মোটা চেনে বাঁধা একটা বড়সড় তাবিজ সব সংশয় মিটিয়ে দিল। তাবিজটা বাচ্চা মহারাজের কাছে রাখা ছিল।
বাচ্চা মহারাজ লজ্জিত হয়ে বললেন,
—না, আসলে এটা উনি আমায় দিয়েছিলেন কিন্তু সেটা আমার আপনাদের বলা উচিত ছিল। আমার আসলে খেয়াল ছিল না, আপনারা আমায় ক্ষমা করবেন।
শ্যামসুন্দর দম টেনে টেনে বলতে লাগলেন,
—না না, এটার যে দরকার পড়বে সেটা আমিও বুঝতে পারিনি। এটা আমার পিসিমা বরিশালের সুগন্ধা শক্তিপীঠে উগ্রতারার মন্দিরে পুজো দিয়ে করিয়ে দিয়েছিলেন।
বসুন্ধরা কাঁদো কাঁদো ভাবে শ্যামসুন্দরের পা দুখানা জড়িয়ে ধরে বললেন,
—আমায় আপনি ক্ষমা করুন। আমি এই তাবিজ চিনি। বহুবার আপনার কাছে শুনেছি। সুগন্ধা শক্তিপীঠ-এ সতীর নাসিকা পড়েছিল। বরিশালের পোনাবালিয়ার কাছে সুগন্ধা নদীর তীরে শিকারপুর গ্রামে এই মন্দির খুব জাগ্রত। আপনি বলতেন নলচিতি থেকে অনেকটা দূর।
শ্যামসুন্দর নিশ্চিন্ত হয়ে বলেন,
—হ্যাঁ ছোটবেলার কথা—ঘুরে ঘুরে যেতে হত৷ নদীর ওপর সেতু ছিল না—আজ হয়তো হয়েছে, জানি না…প্রায় কুড়ি ক্রোশ রাস্তা মানে ৪০ মাইল—তিনটে নদী পেরোতে হত কীর্তন-খোলা সুগন্ধী—আরেকটা কী, নামটা মনে নেই।
বিনয়কে দেখে অসুস্থ শ্যামসুন্দরের দুচোখ ছাপিয়ে জল এল—একটা হাতে স্যালাইনের ছুঁচ ফোটানো তাই অন্য হাতটা চাদরের মধ্যে থেকে বের করে শক্ত করে চেপে ধরলেন বিনয়ের দুটি হাত—শ্যামসুন্দরের শুকনো ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে। অনেক কিছু বলতে চাইছেন কিন্তু মনের উত্তেজনায় সব কথা যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। বিনয় শ্যামসুন্দরকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
—আপনি এত কথা বলবেন না বাবা। আপনার শরীর অসুস্থ।
—এই আজকের দিনটা এই মুহূর্তটার জন্যেই আমি বেঁচেছিলাম—বাবা। জানি না তোমার মা সবকথা তোমায় বলেছেন কি না। কিন্তু আজ যে বাবা হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার দিন বিনয়। তোমার মা-র সঙ্গে তোমার সঙ্গে আমি ঘোরতর অন্যায় করেছি। আরও বড় পাপ কাজের হাত থেকে তোমার কাকা আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।
বসুন্ধরা স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,
—এবার আপনি চুপ করুন৷ আমি বিনুকে সব কিছু বলেছি৷
বাচ্চা মহারাজ ইশারায় বিনয়কে আবার দরজার বাইরের বারান্দায় ডেকে নিলেন। বিনয় মাকে বলে বাইরে এল।
একজন যুবক-ডাক্তারকে বাচ্চা মহারাজ কিছু বলছিলেন। তাঁরও একইরকম গেরুয়া পোশাক। মাথা কামানো। দাড়ি-গোঁফ কামানো। গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলছে, হাতে লম্বাটে প্রেশার মাপার যন্ত্রের বাক্স। কথা শেষ হতে যুবক-ডাক্তার চলে গেলেন৷ বিনয় গিয়ে বাচ্চা মহারাজের সামনে দাঁড়াল।
—বলুন মহারাজ৷
—বিনয়, মঠের একজন সন্ন্যাসী হিসেবে শ্যামসুন্দরবাবুকে এত বছর বাদে তাঁর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়াটা আমার কর্তব্য ছিল। সেটা মানুষের কর্তব্য। এখন ডাক্তার হিসেবে একজন রোগীকে সুস্থ করে তোলার কর্তব্য আমি করছি।
—মহারাজ আপনি ডাক্তার? আপনি বাবার চিকিৎসা করছেন?——চলবে
পিসিমার নলচিতির বাড়ি
দ্বিতীয়টা তো আরও আশ্চর্যের। ১৭৫৪ সালে অহল্যাবাইয়ের স্বামী খান্দের রাও হোলকার কামানের গোলার আঘাতে মারা যান। কিন্তু অহল্যাবাইয়ের শ্বশুরমশাই মল্লার রাও হোলকার ২৯ বছরের পুত্রবধূকে সতী হতে দেননি। সত্যি আশ্চর্য হতে হয়।