বরাবরই বৈচিত্র আমায় আকর্ষণ করে! তবে সংসারের বাঁধন সম্পূর্ণ ছিন্ন করার সাধ্য আমাদের মতো সাধারণ মানুষের থাকে না৷ আবার এক এক সময় আমরা তা করি মনের তাগিদে৷
ছোট থেকেই আমি একটু অন্যমনস্ক৷ জীবন খাতার অঙ্ক কষার থেকে কঠিন কাজ বোধহয় আমার কাছে আর কিছুই নেই৷ আমাদের অবস্থা ছিল বেশ সচ্ছল৷ পড়াশোনার পাঠ শেষ করার কয়েক বছর পরই ছোটভাইয়ের কাঁধে পৈতৃক ব্যবসার সমস্ত ভার চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ি দেশ ঘুরতে৷ বিধাতার সৃষ্টি মহিমা বিচিত্র৷ পথ চলতে নানা অভিজ্ঞতায় জীবনের স্মৃতির খাতাটি প্রায় ভরে উঠেছে৷
কেদার বদ্রীর নৈসর্গিক সৌন্দর্যর কথা অনেকদিন ধরেই লোক মুখে শুনে আসছি৷ তাই প্রত্যক্ষ দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিলাম৷ শেষে প্রায় পঞ্চান্ন বছর বয়সে সময় ও সুযোগ মেলাতে রওনা দিলাম ঋষিকেশের পথে৷ পার্বত্য গঙ্গার ওপর লছমনঝোলার পুল পেরিয়ে ওপারে আছে অনেক মঠ ও দেবদেবীর মন্দির৷
গৌরীকুণ্ডে পৌঁছাতে দু’দিন লাগল৷ পথে মন্দাকিনী ও অলকানন্দা নদীর সংগমস্থল রুদ্রপ্রয়াগের অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য বিস্ময় ও আনন্দ জাগাল৷ সোনাঝরা বিকেলের আকাশে তখন অজস্র খুশির রং! রুদ্রপ্রয়াগ থেকে গৌরীকুণ্ডের পথে পাশ দিয়ে মন্দাকিনী নদী পাহাড়ের বিভিন্ন বাঁকে এঁকেবেঁকে বড় বড় পাথরে আছড়ে পড়ছে! বুক ভরা তার উন্মাদনা!
গৌরীকুণ্ডে যখন পৌঁছালাম সন্ধ্যা নেমে এসেছে৷ শীতের প্রকোপ প্রবলভাবে অনুভূত হল৷ ওখানকার রেস্ট হাউসে সে রাত্রে থাকার ব্যবস্থা হল৷ আমার সঙ্গে বিভিন্ন ভাষাভাষী অনেক সহযাত্রী আছেন৷ কাল ভোরে আমাদের কেদার যাত্রা৷ বেশি রাত না বাড়িয়ে ডাইনিং হলে খেতে গেলাম৷ খাওয়া প্রায় শেষ করে এনেছি, হঠাৎ পিঠের ওপর একটা হাত রেখে কে যেন বলল, ‘নিখিল না?’
চমকে উঠলাম আমার নাম ধরে ডাকতে৷ তাকিয়ে দেখি আপাদমস্তক কম্বলমুড়ি দেওয়া বিশালদেহী এক ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে৷ ভদ্রলোকের মুখ ভর্তি বড় বড় দাড়ি, চোখ দুটো বড় সরল! কিন্তু আমি কিছুতেই তাঁকে মনে করতে পারলাম না৷
‘চিনতে পারলি না তো?’
ভদ্রলোকের প্রাণখোলা হাসিতে সচকিত হলাম৷ কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি অঘোর বিশ্বাস৷ আশুতোষ কলেজে আমরা একসঙ্গে পড়েছি৷’
এইবার আমি চিনতে পারলাম অঘোরকে৷ চেহারায় পরিবর্তন হলেও হাসিটা কিন্তু একই রকম আছে৷ রাতের খাওয়া শেষ করে দুজনে আমরা গল্পে মাতলাম৷ আমার চেহারার বিশেষ কোনও পরিবর্তন না হওয়ায় অঘোর সহজেই আমায় চিনতে পেরেছে৷
আশুতোষ কলেজে তখন বিএসসি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি৷ হঠাৎই অঘোরের সঙ্গে আমার খুবই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে৷ অঘোর খুব ভালো ক্রিকেট খেলত৷ ও ছিল কলেজের ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন৷ অঘোর ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করত না৷ প্রচণ্ড সাহসী ছিল আর ছিল ঘোরতর নাস্তিক৷ ফর্সা ছিপছিপে এই তরুণের সরল হাসি শুধু আমার নয়, কলেজের অন্যান্য ছেলেদেরও মন জয় করেছিল৷ কোনও পুজোর প্রসাদ বা চরণামৃত অঘোর খেত না৷ দেবদেবীতে কোনও বিশ্বাস ছিল না৷ তারপর আর কোনও খবর পাইনি অঘোরের৷ অথচ অঘোরের বাড়িতে মা ভবানীর মন্দিরে নিত্য দুবেলা সেবা হত৷ অঘোরের বাবা-মা সকলেরই ছিল দেবীর প্রতি অগাধ ভক্তি ও বিশ্বাস৷ বিএসসি পাশ করে অঘোর চাকরি নিয়ে চলে যায় কানপুর৷ চিঠিপত্রে কিছুদিন যোগাযোগ ছিল৷ তারপর আর কোনও খবর পাইনি৷ বহু দিন পর দেখা হওয়ায় দুজনেই দুজনের খবরাখবর জানতে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম৷ অঘোরের কাছে জানলাম ওর স্ত্রী আট বছর আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে৷ অঘোর একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছে ডাক্তার পাত্রের সঙ্গে৷ তারা এখন কলকাতার বাইরে৷ অঘোরের বড় দাড়ি দেখে ঠাট্টা করে বললাম, ‘তোকে তো গুরুদেব গুরুদেব দেখাচ্ছে৷’
অঘোর হেসে জবাব দেয়, ‘গুরুদেব না হলেও এখন আমি শিষ্য হয়েছি, দীক্ষা নিয়েছি৷’
অঘোর এখন দুই বেলা পুজো ও মন্ত্র জপে সারা দিনের অনেকটা সময় কাটায় শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না৷ এ যে ভূতের মুখে রামনাম! এরপর অঘোরের মুখ থেকে ওর জীবনপথ পরিবর্তনের কাহিনিটি শুনলাম৷
প্রায় চার বছর আগে অঘোর প্রথম কেদার যাবে বলে গৌরীকুণ্ডে আসে৷ বরাবরই অঘোর সাহসী৷ হেঁটেই কেদারে উঠবে ঠিক করে৷ তীর্থদর্শন নয়, অ্যাডভেঞ্চার আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানেই ও এসেছিল৷ অঘোর বলে পার্বত্য পথে সে আগেও উঠেছে৷ গৌরীকুণ্ড থেকে সংকীর্ণ চড়াইপথ বাঁক ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠে গেছে৷ এবড়োখেবড়ো নুড়ি-পাথর সাজানো সেই পথের একপাশে সুগভীর খাদ, যার শেষ দেখা যায় না৷ সেই অন্তহীন শূন্য খাদের পাশ দিয়ে প্রবহমানা চঞ্চলা মন্দাকিনী পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে৷ এই পথের সৌন্দর্যের সুধারস পান করার জন্য প্রকৃতি প্রেমিকের মন আকুল হয়ে ওঠে৷ আবার বিশাল গিরি কান্তারের দুর্গমতাও মনকে কম আতঙ্কিত করে না৷ কেদারনাথের মন্দির যত কাছে আসতে থাকে, অঘোরের চলার গতি ও উৎসাহ বেড়ে ওঠে৷ কেদারে পৌঁছানোর দুটি চটি আগে অঘোর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে বসে৷ কিছু দূরে একজন সাধুবাবা প্রায় অর্ধ নগ্ন, গায়ে ছাইভস্ম মেখে বসে আছেন৷ অনেকেই তাঁকে ভক্তি ভরে প্রণাম করছে৷ এই পথে এরকম দৃশ্য বিরল নয়৷ অঘোর তাড়াতাড়ি চা শেষ করে উঠতে যাবে এমন সময় সাধুবাবা নিজেই অঘোরের কাছে এসে শুদ্ধ বাংলায় বলেন, ‘এই প্রসাদটা খাও৷ তোমার কল্যাণ হবে৷’
তিনি শালপাতার ঠোঙায় অঘোরকে প্রসাদ দিলেন৷ অঘোর কিছুটা অবাক হয়৷ অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাধুবাবার প্রসাদ হাতে নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে চলে৷ কিছুটা যেতেই গা গুলিয়ে ওঠায় পথের পাশে বমি করে অঘোর৷ ভাবে পার্বত্য ঝরনার জল খাওয়াতেই এই অবস্থা৷ মাথাটা ঘুরতে থাকে৷ শরীরে চাপা কষ্ট অনুভূত হয়৷ হঠাৎ পাশে সেই বাঙালি সাধুকে দেখতে পায় অঘোর৷ সাধুবাবা অঘোরকে ধরে চটিতে নিয়ে আসেন৷ সেখানে বেঞ্চে অঘোরকে শুইয়ে দিয়ে সাধুবাবা বলেন, ‘আজ তোমার না যাওয়াই ভালো৷’
তখন অঘোরের ঘড়িতে বেলা বারোটা৷ ওর মাথার ভারটা কাটেনি৷ শরীরে যথেষ্ট অস্বস্তি৷ তবু অঘোর আপত্তি করে বলে, ‘না না, ও কিছু নয়৷ আমার কিছু হয়নি৷ আর তো একটুখানি পথ৷ ঠিকই যেতে পারব৷’
সাধুবাবা স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে অঘোরের দিকে তাকিয়ে হাসলেন৷ তাঁর চোখদুটো বড় উজ্জ্বল৷ মুখখানা সৌম্য শান্ত৷ তিনি অঘোরের হাতে ধরা প্রসাদের ঠোঙা থেকে কিছুটা প্রসাদ তুলে দেন অঘোরের মুখে৷ অঘোর আপত্তি করতে পারে না৷ মুহূর্তের মধ্যে অঘোরের চোখের সামনে গভীর অন্ধকার নেমে আসে৷ দীর্ঘ ক্লান্তির পর যেন আবেশ মাখানো তন্দ্রা৷ ধীরে ধীরে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয় অঘোর৷ আর কিছুই খেয়াল থাকে না ওর৷
অঘোরের যখন ঘুম ভাঙে তখন প্রায় সন্ধে৷ ক্লান্তি আর শারীরিক অস্বস্তি কেটে গেছে৷ শরীরে বেশ তরতাজা ভাব৷ চটি থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখে চারদিকের পার্বত্য অঞ্চলে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে৷ উত্তরের ঠান্ডা হাওয়ার অবাধ গতি সহ্য করা বেশ কষ্টদায়ক৷ একটু একটু হিম পড়ছে৷ চারপাশে ঘন অরণ্য৷ কল্লোলিনী মন্দাকিনীও এখন শ্রান্ত! বড়ই নিস্তব্ধ পরিবেশ৷ সেদিন আর কেদারে পৌঁছানোর কোনও উপায় না দেখে অগত্যা রাত কাটানোর জন্য চটিতেই ফিরে আসে অঘোর৷ সে রাত্রে চটির লোকেরা অঘোরের আদর যত্নের কোনও ত্রুটি রাখে না৷ এই সকল পাহাড়ি লোকেরা খুবই আন্তরিক ও সরল৷ অঘোর ওদের দেওয়া রুটি ভাজি খেয়ে শুয়ে পড়ে৷ রাতে ঠান্ডা দ্বিগুণ বেড়ে যায়৷ দুটো কম্বলেও শীত কমতে চায় না৷
বেশ ভোর ভোর ঘুম ভাঙে অঘোরের৷ নির্ঝরিণীর কলমুখরতা শুনতে শুনতে বাইরে বেরিয়ে বুঝতে পারে রাতে বেশ জোরে ঝড়বৃষ্টি হয়েছে৷ ওখানকার মানুষজনের মুখে অঘোর শোনে কেদারনাথের মন্দিরের কিছুটা আগে বিরাট ধস নেমেছে৷ গতকাল কেদারের অধিকাংশ তীর্থযাত্রী ধসে মারা গেছে৷ সরকারি ব্যবস্থায় উদ্ধারের কাজ চলছে৷ এত বড় দুর্ঘটনা আজ পর্যন্ত সচরাচর ঘটেনি৷ অতএব কেদারনাথ যাবার রাস্তা এখন বন্ধ৷ অঘোরের ভীষণ মন খারাপ হয়৷ পথে বেরিয়ে এরকম বাধার সম্মুখীন সে আগে কোনওদিনও হয়নি৷ বরাবরই অঘোরের ডায়েরি লেখার অভ্যাস৷ যেখানেই হোক না কেন ডায়েরিটি অঘোরের নিত্যসঙ্গী৷ সব সময় হাতেই থাকে৷ ঘুমোলেও মাথার পাশে রাখা থাকে৷ বিষণ্ণ মনে সে ডায়েরি লিখতে বসে৷ কিন্তু ডায়েরিটি খুলে একেবারে চমকে ওঠে অঘোর৷ গতকালের তারিখের পাতাটিতে পরিষ্কার বাংলা হরফে লেখা আছে—’তোমার মঙ্গলের জন্যই আজ আর তোমায় যেতে দিলাম না৷ …শুভাকাঙ্ক্ষী৷’
অঘোরের মনে পড়ে ওই বাঙালি সাধু গতকাল তাকে কেদার যেতে বারণ করেন৷ সাধুবাবার প্রসাদে এমন কিছু ছিল যা খেয়ে অঘোরের আর দীর্ঘ সময় জ্ঞান থাকে না৷ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ওই সাধুই দৈবশক্তিতে অঘোরকে সাংঘাতিক বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন৷ নইলে হয়তো কালই অঘোরের মৃত্যুযোগ ছিল৷ সাধুবাবা দুটি লাইনে এই কথাই পরোক্ষভাবে বলেছেন৷
অঘোরের জ্ঞান ফেরার আগেই সাধুবাবা চটি ছেড়ে চলে গেছেন৷ চটির লোকজন এবং আশপাশের কেউই বলতে পারল না সাধুবাবার নাম বা তিনি কোথায় গেছেন৷ অঘোর প্রসাদ খেয়ে জ্ঞান হারালে অঘোরের হাতের ডায়েরির পাতায় তিনি দুটো লাইন লিখে রেখে গেছেন৷ হিমালয়ের ভাব সমাহিত পবিত্র দুর্গম পথে বাঙালি সাধুর প্রতি অঘোর শ্রদ্ধায় আবিষ্ট হয়৷ গৌরীকুণ্ডে, ঋষিকেশে, হরিদ্বারে এসেও অঘোর তাঁর অনেক খোঁজ করে৷ কেউই বাঙালি সাধুর সঠিক সন্ধান দিতে পারে না৷
মিথ্যে মায়া মোহের জগৎ সংসারে কোনও কোনও সময় পরম সত্যের সন্ধান মেলে৷ কেদারের পথে সেই সত্যপ্রজ্ঞের সাক্ষাৎই পেয়েছিল অঘোর৷ প্রশান্ত ধীর বাঙালি সাধুর প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাভক্তিই নাস্তিক অঘোরের মধ্যে বিশাল পরিবর্তন আনে৷ সেবার আর অঘোরের কেদারনাথ দর্শন করা হয়নি৷ সর্বশক্তিমান বিশ্বনিয়ন্তার মহিমা অপার৷ অঘোর কলকাতা ফিরে এসে দীক্ষা নেয়৷ শান্তির অন্বেষণে ডুবে যায় আধ্যাত্মিক যোগ সাধনায়৷
বছর দুই বাদে অঘোর আবার কেদারে আসে৷ প্রাণভরে হিমালয় দর্শন করে৷ সেবার অনেক সাধুর সঙ্গে দেখা হয় অঘোরের৷ কিন্তু ওই বাঙালি সাধুর দেখা আর মেলে না৷ তাই সাধুবাবার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রত্যাশায় অঘোর এবারেও চলেছে কেদারের পথে৷ আমি বিস্ময় বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি অঘোরের দিকে!
ছবি: লেখক
* গল্প (Short Story) – খুঁজে ফিরি তাঁকে (khuje-firi-tanke) : ড. জনা বন্দ্যোপাধ্যায় (Jana Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, হুগলি মহিলা মহাবিদ্যালয়
ছোট থেকেই আমি একটু অন্যমনস্ক৷ জীবন খাতার অঙ্ক কষার থেকে কঠিন কাজ বোধহয় আমার কাছে আর কিছুই নেই৷ আমাদের অবস্থা ছিল বেশ সচ্ছল৷ পড়াশোনার পাঠ শেষ করার কয়েক বছর পরই ছোটভাইয়ের কাঁধে পৈতৃক ব্যবসার সমস্ত ভার চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ি দেশ ঘুরতে৷ বিধাতার সৃষ্টি মহিমা বিচিত্র৷ পথ চলতে নানা অভিজ্ঞতায় জীবনের স্মৃতির খাতাটি প্রায় ভরে উঠেছে৷
কেদার বদ্রীর নৈসর্গিক সৌন্দর্যর কথা অনেকদিন ধরেই লোক মুখে শুনে আসছি৷ তাই প্রত্যক্ষ দর্শনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিলাম৷ শেষে প্রায় পঞ্চান্ন বছর বয়সে সময় ও সুযোগ মেলাতে রওনা দিলাম ঋষিকেশের পথে৷ পার্বত্য গঙ্গার ওপর লছমনঝোলার পুল পেরিয়ে ওপারে আছে অনেক মঠ ও দেবদেবীর মন্দির৷
গৌরীকুণ্ডে পৌঁছাতে দু’দিন লাগল৷ পথে মন্দাকিনী ও অলকানন্দা নদীর সংগমস্থল রুদ্রপ্রয়াগের অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য বিস্ময় ও আনন্দ জাগাল৷ সোনাঝরা বিকেলের আকাশে তখন অজস্র খুশির রং! রুদ্রপ্রয়াগ থেকে গৌরীকুণ্ডের পথে পাশ দিয়ে মন্দাকিনী নদী পাহাড়ের বিভিন্ন বাঁকে এঁকেবেঁকে বড় বড় পাথরে আছড়ে পড়ছে! বুক ভরা তার উন্মাদনা!
গৌরীকুণ্ডে যখন পৌঁছালাম সন্ধ্যা নেমে এসেছে৷ শীতের প্রকোপ প্রবলভাবে অনুভূত হল৷ ওখানকার রেস্ট হাউসে সে রাত্রে থাকার ব্যবস্থা হল৷ আমার সঙ্গে বিভিন্ন ভাষাভাষী অনেক সহযাত্রী আছেন৷ কাল ভোরে আমাদের কেদার যাত্রা৷ বেশি রাত না বাড়িয়ে ডাইনিং হলে খেতে গেলাম৷ খাওয়া প্রায় শেষ করে এনেছি, হঠাৎ পিঠের ওপর একটা হাত রেখে কে যেন বলল, ‘নিখিল না?’
চমকে উঠলাম আমার নাম ধরে ডাকতে৷ তাকিয়ে দেখি আপাদমস্তক কম্বলমুড়ি দেওয়া বিশালদেহী এক ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে৷ ভদ্রলোকের মুখ ভর্তি বড় বড় দাড়ি, চোখ দুটো বড় সরল! কিন্তু আমি কিছুতেই তাঁকে মনে করতে পারলাম না৷
‘চিনতে পারলি না তো?’
ভদ্রলোকের প্রাণখোলা হাসিতে সচকিত হলাম৷ কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি অঘোর বিশ্বাস৷ আশুতোষ কলেজে আমরা একসঙ্গে পড়েছি৷’
এইবার আমি চিনতে পারলাম অঘোরকে৷ চেহারায় পরিবর্তন হলেও হাসিটা কিন্তু একই রকম আছে৷ রাতের খাওয়া শেষ করে দুজনে আমরা গল্পে মাতলাম৷ আমার চেহারার বিশেষ কোনও পরিবর্তন না হওয়ায় অঘোর সহজেই আমায় চিনতে পেরেছে৷
আশুতোষ কলেজে তখন বিএসসি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি৷ হঠাৎই অঘোরের সঙ্গে আমার খুবই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে৷ অঘোর খুব ভালো ক্রিকেট খেলত৷ ও ছিল কলেজের ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন৷ অঘোর ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করত না৷ প্রচণ্ড সাহসী ছিল আর ছিল ঘোরতর নাস্তিক৷ ফর্সা ছিপছিপে এই তরুণের সরল হাসি শুধু আমার নয়, কলেজের অন্যান্য ছেলেদেরও মন জয় করেছিল৷ কোনও পুজোর প্রসাদ বা চরণামৃত অঘোর খেত না৷ দেবদেবীতে কোনও বিশ্বাস ছিল না৷ তারপর আর কোনও খবর পাইনি অঘোরের৷ অথচ অঘোরের বাড়িতে মা ভবানীর মন্দিরে নিত্য দুবেলা সেবা হত৷ অঘোরের বাবা-মা সকলেরই ছিল দেবীর প্রতি অগাধ ভক্তি ও বিশ্বাস৷ বিএসসি পাশ করে অঘোর চাকরি নিয়ে চলে যায় কানপুর৷ চিঠিপত্রে কিছুদিন যোগাযোগ ছিল৷ তারপর আর কোনও খবর পাইনি৷ বহু দিন পর দেখা হওয়ায় দুজনেই দুজনের খবরাখবর জানতে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম৷ অঘোরের কাছে জানলাম ওর স্ত্রী আট বছর আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে৷ অঘোর একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছে ডাক্তার পাত্রের সঙ্গে৷ তারা এখন কলকাতার বাইরে৷ অঘোরের বড় দাড়ি দেখে ঠাট্টা করে বললাম, ‘তোকে তো গুরুদেব গুরুদেব দেখাচ্ছে৷’
অঘোর হেসে জবাব দেয়, ‘গুরুদেব না হলেও এখন আমি শিষ্য হয়েছি, দীক্ষা নিয়েছি৷’
অঘোর এখন দুই বেলা পুজো ও মন্ত্র জপে সারা দিনের অনেকটা সময় কাটায় শুনে অবাক না হয়ে পারলাম না৷ এ যে ভূতের মুখে রামনাম! এরপর অঘোরের মুখ থেকে ওর জীবনপথ পরিবর্তনের কাহিনিটি শুনলাম৷
প্রায় চার বছর আগে অঘোর প্রথম কেদার যাবে বলে গৌরীকুণ্ডে আসে৷ বরাবরই অঘোর সাহসী৷ হেঁটেই কেদারে উঠবে ঠিক করে৷ তীর্থদর্শন নয়, অ্যাডভেঞ্চার আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানেই ও এসেছিল৷ অঘোর বলে পার্বত্য পথে সে আগেও উঠেছে৷ গৌরীকুণ্ড থেকে সংকীর্ণ চড়াইপথ বাঁক ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠে গেছে৷ এবড়োখেবড়ো নুড়ি-পাথর সাজানো সেই পথের একপাশে সুগভীর খাদ, যার শেষ দেখা যায় না৷ সেই অন্তহীন শূন্য খাদের পাশ দিয়ে প্রবহমানা চঞ্চলা মন্দাকিনী পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে৷ এই পথের সৌন্দর্যের সুধারস পান করার জন্য প্রকৃতি প্রেমিকের মন আকুল হয়ে ওঠে৷ আবার বিশাল গিরি কান্তারের দুর্গমতাও মনকে কম আতঙ্কিত করে না৷ কেদারনাথের মন্দির যত কাছে আসতে থাকে, অঘোরের চলার গতি ও উৎসাহ বেড়ে ওঠে৷ কেদারে পৌঁছানোর দুটি চটি আগে অঘোর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে বসে৷ কিছু দূরে একজন সাধুবাবা প্রায় অর্ধ নগ্ন, গায়ে ছাইভস্ম মেখে বসে আছেন৷ অনেকেই তাঁকে ভক্তি ভরে প্রণাম করছে৷ এই পথে এরকম দৃশ্য বিরল নয়৷ অঘোর তাড়াতাড়ি চা শেষ করে উঠতে যাবে এমন সময় সাধুবাবা নিজেই অঘোরের কাছে এসে শুদ্ধ বাংলায় বলেন, ‘এই প্রসাদটা খাও৷ তোমার কল্যাণ হবে৷’
তিনি শালপাতার ঠোঙায় অঘোরকে প্রসাদ দিলেন৷ অঘোর কিছুটা অবাক হয়৷ অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাধুবাবার প্রসাদ হাতে নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে চলে৷ কিছুটা যেতেই গা গুলিয়ে ওঠায় পথের পাশে বমি করে অঘোর৷ ভাবে পার্বত্য ঝরনার জল খাওয়াতেই এই অবস্থা৷ মাথাটা ঘুরতে থাকে৷ শরীরে চাপা কষ্ট অনুভূত হয়৷ হঠাৎ পাশে সেই বাঙালি সাধুকে দেখতে পায় অঘোর৷ সাধুবাবা অঘোরকে ধরে চটিতে নিয়ে আসেন৷ সেখানে বেঞ্চে অঘোরকে শুইয়ে দিয়ে সাধুবাবা বলেন, ‘আজ তোমার না যাওয়াই ভালো৷’
তখন অঘোরের ঘড়িতে বেলা বারোটা৷ ওর মাথার ভারটা কাটেনি৷ শরীরে যথেষ্ট অস্বস্তি৷ তবু অঘোর আপত্তি করে বলে, ‘না না, ও কিছু নয়৷ আমার কিছু হয়নি৷ আর তো একটুখানি পথ৷ ঠিকই যেতে পারব৷’
সাধুবাবা স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে অঘোরের দিকে তাকিয়ে হাসলেন৷ তাঁর চোখদুটো বড় উজ্জ্বল৷ মুখখানা সৌম্য শান্ত৷ তিনি অঘোরের হাতে ধরা প্রসাদের ঠোঙা থেকে কিছুটা প্রসাদ তুলে দেন অঘোরের মুখে৷ অঘোর আপত্তি করতে পারে না৷ মুহূর্তের মধ্যে অঘোরের চোখের সামনে গভীর অন্ধকার নেমে আসে৷ দীর্ঘ ক্লান্তির পর যেন আবেশ মাখানো তন্দ্রা৷ ধীরে ধীরে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয় অঘোর৷ আর কিছুই খেয়াল থাকে না ওর৷
অঘোরের যখন ঘুম ভাঙে তখন প্রায় সন্ধে৷ ক্লান্তি আর শারীরিক অস্বস্তি কেটে গেছে৷ শরীরে বেশ তরতাজা ভাব৷ চটি থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখে চারদিকের পার্বত্য অঞ্চলে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে৷ উত্তরের ঠান্ডা হাওয়ার অবাধ গতি সহ্য করা বেশ কষ্টদায়ক৷ একটু একটু হিম পড়ছে৷ চারপাশে ঘন অরণ্য৷ কল্লোলিনী মন্দাকিনীও এখন শ্রান্ত! বড়ই নিস্তব্ধ পরিবেশ৷ সেদিন আর কেদারে পৌঁছানোর কোনও উপায় না দেখে অগত্যা রাত কাটানোর জন্য চটিতেই ফিরে আসে অঘোর৷ সে রাত্রে চটির লোকেরা অঘোরের আদর যত্নের কোনও ত্রুটি রাখে না৷ এই সকল পাহাড়ি লোকেরা খুবই আন্তরিক ও সরল৷ অঘোর ওদের দেওয়া রুটি ভাজি খেয়ে শুয়ে পড়ে৷ রাতে ঠান্ডা দ্বিগুণ বেড়ে যায়৷ দুটো কম্বলেও শীত কমতে চায় না৷
বেশ ভোর ভোর ঘুম ভাঙে অঘোরের৷ নির্ঝরিণীর কলমুখরতা শুনতে শুনতে বাইরে বেরিয়ে বুঝতে পারে রাতে বেশ জোরে ঝড়বৃষ্টি হয়েছে৷ ওখানকার মানুষজনের মুখে অঘোর শোনে কেদারনাথের মন্দিরের কিছুটা আগে বিরাট ধস নেমেছে৷ গতকাল কেদারের অধিকাংশ তীর্থযাত্রী ধসে মারা গেছে৷ সরকারি ব্যবস্থায় উদ্ধারের কাজ চলছে৷ এত বড় দুর্ঘটনা আজ পর্যন্ত সচরাচর ঘটেনি৷ অতএব কেদারনাথ যাবার রাস্তা এখন বন্ধ৷ অঘোরের ভীষণ মন খারাপ হয়৷ পথে বেরিয়ে এরকম বাধার সম্মুখীন সে আগে কোনওদিনও হয়নি৷ বরাবরই অঘোরের ডায়েরি লেখার অভ্যাস৷ যেখানেই হোক না কেন ডায়েরিটি অঘোরের নিত্যসঙ্গী৷ সব সময় হাতেই থাকে৷ ঘুমোলেও মাথার পাশে রাখা থাকে৷ বিষণ্ণ মনে সে ডায়েরি লিখতে বসে৷ কিন্তু ডায়েরিটি খুলে একেবারে চমকে ওঠে অঘোর৷ গতকালের তারিখের পাতাটিতে পরিষ্কার বাংলা হরফে লেখা আছে—’তোমার মঙ্গলের জন্যই আজ আর তোমায় যেতে দিলাম না৷ …শুভাকাঙ্ক্ষী৷’
অঘোরের মনে পড়ে ওই বাঙালি সাধু গতকাল তাকে কেদার যেতে বারণ করেন৷ সাধুবাবার প্রসাদে এমন কিছু ছিল যা খেয়ে অঘোরের আর দীর্ঘ সময় জ্ঞান থাকে না৷ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ওই সাধুই দৈবশক্তিতে অঘোরকে সাংঘাতিক বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন৷ নইলে হয়তো কালই অঘোরের মৃত্যুযোগ ছিল৷ সাধুবাবা দুটি লাইনে এই কথাই পরোক্ষভাবে বলেছেন৷
অঘোরের জ্ঞান ফেরার আগেই সাধুবাবা চটি ছেড়ে চলে গেছেন৷ চটির লোকজন এবং আশপাশের কেউই বলতে পারল না সাধুবাবার নাম বা তিনি কোথায় গেছেন৷ অঘোর প্রসাদ খেয়ে জ্ঞান হারালে অঘোরের হাতের ডায়েরির পাতায় তিনি দুটো লাইন লিখে রেখে গেছেন৷ হিমালয়ের ভাব সমাহিত পবিত্র দুর্গম পথে বাঙালি সাধুর প্রতি অঘোর শ্রদ্ধায় আবিষ্ট হয়৷ গৌরীকুণ্ডে, ঋষিকেশে, হরিদ্বারে এসেও অঘোর তাঁর অনেক খোঁজ করে৷ কেউই বাঙালি সাধুর সঠিক সন্ধান দিতে পারে না৷
মিথ্যে মায়া মোহের জগৎ সংসারে কোনও কোনও সময় পরম সত্যের সন্ধান মেলে৷ কেদারের পথে সেই সত্যপ্রজ্ঞের সাক্ষাৎই পেয়েছিল অঘোর৷ প্রশান্ত ধীর বাঙালি সাধুর প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাভক্তিই নাস্তিক অঘোরের মধ্যে বিশাল পরিবর্তন আনে৷ সেবার আর অঘোরের কেদারনাথ দর্শন করা হয়নি৷ সর্বশক্তিমান বিশ্বনিয়ন্তার মহিমা অপার৷ অঘোর কলকাতা ফিরে এসে দীক্ষা নেয়৷ শান্তির অন্বেষণে ডুবে যায় আধ্যাত্মিক যোগ সাধনায়৷
বছর দুই বাদে অঘোর আবার কেদারে আসে৷ প্রাণভরে হিমালয় দর্শন করে৷ সেবার অনেক সাধুর সঙ্গে দেখা হয় অঘোরের৷ কিন্তু ওই বাঙালি সাধুর দেখা আর মেলে না৷ তাই সাধুবাবার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রত্যাশায় অঘোর এবারেও চলেছে কেদারের পথে৷ আমি বিস্ময় বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি অঘোরের দিকে!
ছবি: লেখক
* গল্প (Short Story) – খুঁজে ফিরি তাঁকে (khuje-firi-tanke) : ড. জনা বন্দ্যোপাধ্যায় (Jana Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, হুগলি মহিলা মহাবিদ্যালয়