সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪


দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

দ্বিজেন্দ্রনাথ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও সারদাসুন্দরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র, রবীন্দ্রনাথের অগ্ৰজ, এটাই তাঁর শুধু পরিচয় নয়, তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। ‌কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন নানা ক্ষেত্রে। তাঁর প্রতিভার বিস্তার ও‌ ব্যাপ্তি আমাদের ‌মনে বিস্ময়ের সঞ্চার করে।‌ দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন বড় দার্শনিক। অনুরাগ ছিল সংগীতে। অঙ্কে তুখোড়। জ্যামিতিতে অফুরান আগ্ৰহ। ‘অঙ্কবিদ’ বলা যায় তাঁকে। সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রনাথের পাণ্ডিত্য ও ব্যুৎপত্তির কোনও তুলনা হয় না। তথ্য ও তত্ত্বের আলোকে আলোকিত।

কত রকমের বিষয়েই না দ্বিজেন্দ্রনাথের অনুরাগ-অনুসন্ধিৎসা ছিল! কীরকমভাবে বাংলায় শর্টহ্যান্ড লেখা যেতে পারে, সে-বিষয়েও প্রথম ভেবেছেন তিনি। বাংলা গানের স্বরলিপির গোড়াপত্তনও তাঁর হাতে। দ্বিজেন্দ্রনাথই বাংলা শর্টহ্যান্ড ও স্বরলিপির পরিকল্পক।

প্রতিভাবান মানুষরা একটু আপনভোলা, খানিক খামখেয়ালি হয়ে থাকেন— প্রচলিত এই ধারণাটির সত্যতা দ্বিজেন্দ্রনাথের জীবন নিয়ে পর্যালোচনা করলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বোতাম লাগানোর ঝুটঝামেলায় যেতে চান না বলে একটি কোট পরার পর বোতাম না-লাগিয়ে আরেকটি কোট উলটো করে পরে নিতেন। কোটের যে দিকটা পেছনের দিকে থাকার কথা, সে-অংশটি তখন আশ্চর্য কৌশলে সামনের দিকে চলে আসত, ফলে দু’টি কোটের কোনওটিতেই আর বোতাম লাগানোর দরকার হত না।‌ জোড়া কোট পরে দ্বিজেন্দ্রনাথ সাইকেলে ঘুরে বেড়াতেন শান্তিনিকেতনের পথে পথে।

নানা দিকে কৃতিত্ব, গুণের মানুষ দ্বিজেন্দ্রনাথ। অহমিকার ছিটেফোঁটাও ছিল না। সারল্যে ভরপুর। থাকতেনও অতীব সাদামাটাভাবে। ছিল জীবকুলের প্রতি ভেতর থেকে উঠে আসা গভীর ভালোবাসা। সে-ভালোবাসার কোনও তুলনা হয় না।

শান্তিনিকেতনে ক্যাম্পাসে প্রবেশের এক নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে ক’পা গেলেই টালি-চালের একটি বাড়ি। বাড়িটির লাগোয়া জমিতে, আশপাশে রকমারি গাছপালা। এখন সংরক্ষিত, ‘হেরিটেজ’ হিসেবে চিহ্নিত। তাই বাড়িতে বা বাড়ির সামনের বাগানে প্রবেশাধিকার নেই। লোকমুখে বাড়িটির নাম ‘নিচুবাংলো’। এই নিচুবাংলোতেই এক সময় থাকতেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। সেই কারণেই বাড়িটির নতুন নামকরণ হয়েছে ‘দ্বিজবিরাম’। আসতেন, এসে বাড়ির দাওয়াতে মাঝে মধ্যেই বসতেন রবীন্দ্রনাথ। অগ্ৰজের সঙ্গে কত গম্ভীর তত্ত্বালোচনায় কোথা দিয়ে সময় কেটে যেত! নিচুবাংলোতে এক সময় আশ্রম-বিদ্যালয়ের শিশুবিভাগের শিক্ষার্থীদের রান্না হত।‌ সাধারণ পাকশালায় ছোটদের জন্য রান্না না করাই ভালো, বাড়তি যত্নে দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্রবধূ হেমলতা রান্না করে দিক, ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবির কথা মেনে নিয়ে শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য নিচুবাংলোতেই রান্না হত। হেমলতা দেবীই রান্না করতেন। তিনি ছিলেন সকলের ‘বড়োমা’। এই সম্বোধনেই আশ্রমিকরা ডাকত তাঁকে।

রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রনাথ।

দক্ষিণের বারান্দায় রোজ সকালে একটি চেয়ার নিয়ে নিয়ম করে বসতেন দ্বিজেন্দ্রনাথ‌। সামনে রাখা টেবিলে থাকত দু-একটি প্লেট। ‌প্লেটে ছাতু-মাখা কয়েকটি পাখি এসে ঠুকরে ঠুকরে খেত। সামনেই আমলকী গাছ। সেই গাছে প্রতিদিনই লাফালাফি করত বেশ ক’টি কাঠবেড়ালি। দ্বিজেন্দ্রনাথ দক্ষিণের বারান্দায় বসলেই তড়বড়িয়ে নেমে আসত তারা। সোজা গিয়ে উঠত টেবিলে। শুরু করত লাফঝাঁপ, নাচানাচি। দ্বিজেন্দ্রনাথ বিস্কুট টুকরো-টুকরো করে আগেভাগে রেখে দিতেন। কাঠবেড়ালিরা পেছনের দু’পায়ে বসে সামনের দু’হাতে বিস্কুটের টুকরো ধরে কুটকুট করে খেত। ক’টা কাক এসে রোজই বসত অদূরে। দ্বিজেন্দ্রনাথের হাতে থাকত একটি পাতলা ছড়ি। সেই ছড়িটি ব্যবহার করতেন তিনি ভয় দেখানোর কাজে। শুধুই ভয় দেখাতেন, আঘাত করেননি কখনও।

কাকগুলো বড় ধুরন্ধর, পারলে পাখির খাবার, কাঠবেড়ালির খাবার সব খেয়ে ফেলে! ক’টা কাক ডানা ঝাপটে উড়ে আসত টেবিলে। শুধু মুখের খাবার কেড়ে খেত না, কাঠবেড়ালিদের ঠোকরাতও । টেবিলের কাছাকাছি উড়ে এলেই পাখিরা, কাঠবেড়ালিরা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজত! সুধাকান্ত রায়চৌধুরী দ্বিজেন্দ্রনাথের স্নেহধন্য। ‘বড়বাবু’ বলতেন তাঁকে। পেয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথের গভীর স্নেহ। ‘বড়বাবু’কে নিয়ে চমৎকার একটি বই লিখেছিলেন। সে-বইতে আছে, ‘আমি দাঁড়িয়ে দেখছি মজলিশের অদ্ভুত ব্যাপার। কাক যখনই এসে টেবিলের উপর বসবার চেষ্টা করছে অমনি ও-সব পাখিগুলো আর কাঠবিড়ালগুলো টেবিল ছেড়ে বড়বাবুর গায়ে উঠে পড়ছে, কেউ বসছে কাঁধে, কি আবার মাথাতেও বসছে।’

একটি কুকুরও মজলিশে থাকত রোজ। কূকুরটি দ্বিজেন্দ্রনাথের চেয়ার ঘেঁষে বসে থাকত। সে যে খাবার থেকে বঞ্চিত হত, তা নয়। দ্বিজেন্দ্রনাথ তাকেও দিতেন, আনন্দে লেজ‌ নাড়িয়ে আয়েশ করেই খেত। কুকুরটি‌ অবশ্য সারাক্ষণ বাড়িতেই থাকত। অন্যরা প্রতিদিন নিয়ম করে উড়ে আসত প্রাতরাশের প্রত্যাহিক মজলিশে।

নিচুবাংলো : এই বাড়িতে দ্বিজেন্দ্রনাথ থাকতেন।

পশুপাখিদের প্রতি এই ভালোবাসা কখনও কখনও বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। খেসারত দিতে হয়েছে। সুধাকান্তের বইতেই এমন বিপদ-বিপত্তির কথাও আছে। তাঁর সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রনাথের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। ফলে দৈনন্দিন ঘটনাবলি তাঁর কিছুই অজানা ছিল না। সুধাকান্তবাবু একদিন নিচুবাংলোয় গিয়ে দেখেছিলেন, দ্বিজেন্দ্রনাথের চশমা কপালের উপর তোলা। একটি চোখে তুলোর পটি বাঁধা।

ব্যাপার কী, কিছু হয়েছে কি! সুধাকান্তের প্রশ্নের উত্তরে দ্বিজেন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন,’আর বল কেন, এই ছোট ছোট পাখিগুলোর দৌরাত্ম্য বড়ই বেড়ে গেছে। একটা‌ পাখি মাথার উপর বসেছিল,হঠাৎ তার কী খেয়াল হল, আমার চোখে ঠোঁট দিয়ে খোঁচা দিয়ে দেখলে ওখানে কিছু খাদ্য পাওয়া যায় কিনা।…ভাগ্যিস বেশি জোরে ঠোকর দেয়নি, তাই রক্ষে! জোরে ঠোকরালে চোখটা গিয়েছিল আর কি!’

এ-রকম কত ঘটনাই না ঘটেছে! দ্বিজেন্দ্রনাথকে দেখভাল্ করতেন মুনীশ্বর। সুধাকান্ত দেখেছিলেন, মুনীশ্বর দ্বিজেন্দ্রনাথের জোব্বার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কিছু বের করার চেষ্টা করছে।‌ সুধাকান্তের কানে আসে মুনীশ্বরকে দ্বিজেন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘দেখো আস্তে আস্তে বের করো, জোরে হাত দিয়ে চেপে বের করতে গিয়ে ওটাকে আবার মেরে ফেলো না।’

কী ঘটেছিল, কী ঢুকে পড়েছিল দ্বিজেন্দ্রনাথের জোব্বায়!জানা যায়, এক শিশু-কাঠবেড়ালি খেয়েদেয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথের হাতে পিঠে ঘোরাঘুরি করছিল। কখন হঠাৎ জোব্বার হাতার ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঢুকে পড়ে আর বের হওয়ার পথ পাচ্ছিল না। মুনীশ্বর অতীব সতর্কতায় কাঠবেড়ালিটিকে বের করে ফেলে। বের করা মাত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ তার হাত থেকে নিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে খুব আদর করেছিলেন।

এক সময় শান্তিনিকেতন-আশ্রমে দু’টি হরিণ ছিল। দু’টি ময়ূর ছিল। ময়ূর দু’টি আমগাছের তলায় জাল দিয়ে ঘেরা জায়গায় থাকত। হরিণ দু’টি অবশ্য বাঁধা থাকত না। আশ্রমে ঘু্রে বেড়াত। কুকুর প্রায়ই তাদের পিছু নিত, তাড়া করত। কুকুরের তাড়া খেয়েই একদিন একটি হরিণ আশ্রম-ছাড়া হয়। অনেক খোঁজাখুঁজি, ‌শেষে জানা গেল, সাঁওতালরা তীর ছুঁড়ে মেরে ফেলেছে তাকে।
অন্য হরিণটি আশ্রমেই রইল। হঠাৎ কী যে হল তার, একে-তাকে, যাকে পায় গুঁতোয়। সবাই সারাক্ষণই আতঙ্কে, ভয়ে ভয়ে থাকে। বেশ ক’জনকেই গুঁতিয়েছে। হরিণটিকে শেষে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা হল। সকলে ভয়ে তটস্থ, দ্বিজেন্দ্রনাথ সেই হরিণের কাছে এক‌ সকালে পৌঁছে গেলেন। না, হরিণটি তাঁকে কিচ্ছুটি করল না। দ্বিজেন্দ্রনাথ একেবারে কাছে গিয়ে তাকে আদর করলেন। গায়ে হাতে হাত বুলিয়ে দিলেন। সকলেই অবাক, হিংস্র হরিণটি তাঁকে কিছুই করছে না যে ! দ্বিজেন্দ্রনাথের পশুপাখি-প্রীতির কথা বুঝতে পেরেছে কি, অবাক বিস্ময় তাদের এমনই মনে হল।

দ্বিজেন্দ্রনাথ : মুকুল দে-র আঁকা।

হরিণটিকে বেঁধে রাখা হয়েছে দেখে দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আশ্রমের ছেলেদের বলেছিলেন, ‘হরিণটির এমন স্বভাবের জন্য তোমরাই দায়ী। তাকে আদর-যত্ন করলে কখনওই তার স্বভাব এরকম হত না।’

খুব বকাঝকা করে শেষে একটু শান্ত হয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথ তাদের ভয় দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘রবি কি এই কাণ্ড দেখেছেন! তিনি যদি দেখেন, হরিণকে তোমরা বেঁধে কষ্ট দিচ্ছ শখ মেটাবার জন্য, তাহলে মজা টের পাবে ! রবি এসব মোটেই পছন্দ করেন না। এ হচ্ছে নিষ্ঠুর শখ!’

সত্যিই তো, রবীন্দ্রনাথও পশুপাখিদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথের মতো পশুপাখিদের এমনভাবে আমরা ক’জন ভালোবাসতে পারি! পশুপাখিদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা বাড়ুক, ছড়িয়ে পড়ুক।

ছবি সৌজন্যে: লেখক

* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content