শুক্রবার ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


রবীন্দ্র সদনের অনুষ্ঠানে কমল মিত্র, নীলাদ্রিশেখর বসু এবং ডাঃ সরোজ গুপ্তর সঙ্গে আমি (১৯৮৬)।

বাংলা সিনেমায় প্রায় সিংহ দাপটে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত রাজত্ব করেছেন দুই প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা বিকাশ রায় এবং কমল মিত্র। সৌভাগ্যক্রমে এঁদের দুজনেরই স্নেহ সান্নিধ্য পেয়েছিলাম আমি। প্রথমে বিকাশ রায়ের কথাই বলি। তিনি যে শুধু বড় অভিনেতা ছিলেন তা তো নয়, ছিলেন বড় পরিচালকও। মরুতীর্থ হিংলাজ-এর মতো ছবি উনিই বানিয়েছিলেন। আবার আমার ছোটবেলায় দেখা ৪২ সিনেমায় নৃশংস এক ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় দেখে শিউরে উঠেছিলাম। তারাশঙ্করের অমর সৃষ্টি আরোগ্য নিকেতন সিনেমায় আয়ুর্বেদাচার্য জীবন মশায়ের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় ভোলার নয়। বরাবরই বিকাশ রায়ের সম্বন্ধে আমার একটা কৌতূহল ছিল।

আশির দশকের মাঝামাঝি। আমি তখন ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে কাজ করছি। প্রায়ই দেখতাম বিভিন্ন সংস্থা এই হাসপাতালের সাহায্যার্থে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে ডিরেক্টর, মানে আমাদের স্যার ডাঃ সরোজ গুপ্তর হাতে কিছু অর্থ সাহায্য তুলে দিচ্ছেন। এমন কিছু করার ইচ্ছে আমারও ছিল। আমার নাট্যদলের বার্ষিক অনুষ্ঠান সেবার একটু জাঁকজমক করে করব, ঠিক করলাম। যদি দু-একজন স্টারকে আনা যায়, তাহলে কিছু টিকিটও বিক্রি করা যাবে। কিন্তু সবার আগে দরকার স্যারের পারমিশন। স্যারের সঙ্গে একদিন কথা বলতে ওঁর ঘরে গেলাম। উনি সব শুনে বললেন, তুমি কারও কথা ভেবেছ? আমি বিকাশ রায়ের কথা বললাম। স্যার বললেন, বিকাশদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালো, ওঁকে পাওয়া যেতে পারে, দাঁড়াও একবার ফোনে কথা বলি। তখন শুধুই ল্যান্ডলাইন ফোন। স্যারের এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল, বহু মানুষের ফোন নম্বর মনে রাখার। সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে উনি সঠিক নম্বরে বিকাশ রায়কে ফোন করলেন। দু-একটি সৌজন্যমূলক বাক্যালাপের পর আমার পরিচয় জানিয়ে বললেন যে আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব। দিন এবং সময়ও জেনে নিলেন। কিন্তু কী কারণে যাব, সেটা বললেন না।

আমি যথারীতি সেই দিন সেই সময় বিকাশবাবুর বাড়িতে গিয়ে বেল বাজালাম। যোধপুর পার্কের পেট্রোল পাম্পের ঠিক উলটোদিকে ছিল বাটার শোরুম। তার পাশের দোতলা বাড়িতে থাকতেন উনি। নিজেই দরজা খুললেন। ভেতরে আসতে বললেন, বসতে বললেন সোফায়। পরিষ্কার মনে আছে, ওঁর পরনে ছিল লুঙ্গি আর ফতুয়া। দু-তিন বছর ধরে উনি আর সিনেমা করেন না। শরীরেও বয়সের ছাপ। তবে পর্দায় যেমন দেখতে লাগে মানুষটিকে, কাছ থেকে তেমনই দেখলাম।

নিজের পরিচয় দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে আমার আসার উদ্দেশ্য জানালাম। বললাম, ওঁকে আমার নাট্য সংস্থার তরফ থেকে সংবর্ধনা দিতে চাই। জানতে চাইলেন, আর কে কে আসছেন। বললাম অভিনেত্রী সরযূবালা দেবী রাজি হয়েছেন আসতে। এছাড়া আবৃত্তিকার নীলাদ্রিশেখর বসু তাঁর শিক্ষার্থীদের নিয়ে আবৃত্তি পরিবেশন করবেন। থাকবেন প্রখ্যাত মেকআপ শিল্পী শক্তি বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে আমরা একটি ছোট নাটকও পরিবেশন করব। ধৈর্য ধরে সব শুনলেন। মুখ দেখে বুঝতে পারলাম না, খুশি হলেন কি না! একটু বাদে চা এল। বিস্কুট সহযোগে সেটা খেতে খেতে বারে বারে ওঁর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছিলাম। মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। আমার উলটোদিকে একটি ছোট খাটে বসে ছিলেন উনি। আমার চা খাওয়া শেষ হতেই বললেন, আমি যে খাটে বসে আছি, তার নীচে একবার উঁকি দিয়ে দেখো তো, কী আছে। আমি হাঁটু গেড়ে বসে উঁকি দিয়ে দেখি, ফ্রেমে বাঁধানো প্রচুর মানপত্র পড়ে আছে। একপাশে কিছু খবরের কাগজ।

তোমরা তো আমাকে সংবর্ধনা দিতে চাও। সারাজীবনে তো কম সংবর্ধনা পেলাম না। তোমরা দিলে ওখানে আরেকটি আবর্জনা বাড়বে। এই বয়সে আর সে ইচ্ছে নেই। শুনে হতাশ হলাম আমি। ওঁর মধ্যে এমন একটা কাঠিন্য ছিল, গাম্ভীর্য ছিল, জোরাজুরি বা অনুরোধ করব, সে সাহস আমার আর হল না। ভাবলাম, মানে মানে কেটে পড়ই ভালো। উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বললাম, তাহলে আমি আসি। বলে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছি, উনি বেশ গম্ভীর গলায় বললেন, যাচ্ছ কোথায়, বোসো। তোমাকে সরোজ পাঠিয়েছে। ও আমার ভাইয়ের মতো। ওর কথা তো আমি ফেলতে পারব না। সেইজন্য আমি
তোমার অনুষ্ঠানে যাব। তবে আমার দুটো শর্ত আছে। প্রথম শর্ত, তুমি নিজে আমাকে নিতে আসবে। দ্বিতীয় শর্ত হল, আমার গাড়িতে অন্য কাউকে তুলবে না।

এত বছর পরে অকপটে জানিয়ে রাখি, এই দুটি শর্তের একটিও আমি রাখতে পারিনি। আমি ছিলাম অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা। কাজেই অনুষ্ঠান মঞ্চ ছেড়ে আমি অতিথিকে আনতে গেলে কী করে চলবে! দ্বিতীয় কথা হল, ফেরবার সময় সরযূবালা দেবী বললেন, আমি আর বিকাশ একই সঙ্গে ফিরব গল্প করতে করতে, ফলে দুজনকে এক অ্যাম্বাসেডর গাড়িতেই তুলে দিয়েছিলাম, এটুকু আজও মনে আছে। কিন্তু সেজন্য বিকাশবাবুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোনও সময়ই খারাপ হয়নি। তারপরেও আমি ওঁকে একাধিকবার ফোন করেছি, বাড়িতে গিয়ে গল্প করে এসেছি, আমাদের অনুষ্ঠানের ফটো অ্যালবাম দেখিয়েছি। আমাকে একবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘অবনী বাড়ি আছো’ কবিতাটিও উনি শুনিয়েছিলেন। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির, বিশেষ করে উত্তমকুমারের এবং পুরনো দিনের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অনেক গল্প শুনেছিলাম ওঁর কাছে।
আমাদের প্রোগ্রামে এসে উনি কিন্তু খুব খুশি হয়েছিলেন। কচিকাঁচাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশেছিলেন। অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন, একসঙ্গে ফটো তুলেছিলেন এবং সব থেকে বড় কথা হল উনি আমাদের নাটকটাও বসে দেখেছিলেন। সরযূবালা দেবীও কিন্তু ওঁকে দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। বারে বারে গায়ে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন, শরীর কেমন আছে, এখন কী করে সময় কাটে ইত্যাদি। দুজনেই বড়মাপের অভিনেতা, সমসাময়িকও বটে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসার এক অপূর্ব নিদর্শন সেদিন দেখেছিলাম, যা আমার মনের ফ্রেমে আজও ধরা আছে।

এবার বলি আর এক সিংহর কথা। যাঁকে নিয়ে ফেসবুকে আজও মিম হয়। তিনি হলেন কমল মিত্র। বহু সিনেমায় যিনি উত্তমকুমারের ভিলেন বাবা সেজেছেন। কীভাবে আমার সঙ্গে পরিচয় সেটা আগে বলি। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে স্যারের সঙ্গে দেখা করার জন্য বহু ভিআইপি সেই সময় আসতেন। অভিনয় জগতের কেউ এলে আমাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। আসলে আমার অভিনয় নিয়ে পাগলামিকে স্যার বরাবরই প্রশ্রয় দিতেন। এভাবেই আমি সত্যজিৎ রায়, হেমা মালিনী, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, গীতা দে, দেবরাজ রায়, সুখেন দাস, চিরঞ্জিত-সহ বহু গুণীজনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। এভাবেই একদিন ডাক পড়ল স্যারের ঘরে। ঢুকে দেখি বড় পর্দার সিংহ-অভিনেতা কমল মিত্র। আলাপচারিতার পর যথারীতি আমাকে দায়িত্ব দিলেন ওঁকে একটু হাসপাতাল ঘুরিয়ে দেখানোর। এ দায়িত্ব এর আগেও আমি বহুবার পালন করেছি। উৎসাহ নিয়ে কমলবাবুকে নিয়ে হাসপাতাল পরিদর্শনে বেরোলাম। একটু ঘুরেই উনি বললেন, বয়স হয়েছে, বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারি না, চলুন আপনার কোয়ার্টারে গিয়ে বসি। শুনে একটু আশ্চর্য হলাম। ব্যাচেলর কোয়ার্টার, ঘরের অবস্থা কেমন, কে জানে! তবু ওই বাজখাঁই গলার কমান্ডিং টোনকে ইগনোর করতে পারলাম না। ঘরে এনে চেয়ারে বসালাম। ওঁর সঙ্গে কী কথা বলব ভাবছি! যমালয়ে জীবন্ত মানুষ সিনেমায় ওঁর যমরাজ চরিত্র দিয়ে শুরু করলাম। সিনেমার আলোচনায় খুব একটা উৎসাহ দেখালেন না। বরং নিজেই জানতে চাইলেন আমাদের ডাক্তারি-জীবন। কীভাবে ডাক্তারিতে চান্স পেতে হয়, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করতে হয়, কী কী ডিউটি করতে হয় ইত্যাদি। সব শুনে বললেন এখানে তো আপনাদেরকে হেকটিক সিডিউল। সরোজ (ডাঃ সরোজ গুপ্ত) আপনাদের বিনোদনের কী ব্যবস্থা রেখেছে? টেবিলের উপর রাখা একটা ছোট ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভি দেখিয়ে বললাম, এই যে এটা, তবে প্রায় সময় ছবিগুলো খুব কাঁপে।

আপনারা রেডিও শুনতে ভালোবাসেন? উত্তরে বললাম, একটা ট্রানজিস্টার আছে। উনি বললেন, আমার কাছে একটা মারফি সেট আছে। আজকাল পাওয়া যায় না। এরিয়াল লাগিয়ে শুনতে হবে। তবে গমগমে আওয়াজ। আমি সেটা আপনাকে দিতে পারি। আপত্তি করার কোনও তো কারণই ওঠে না। কমল মিত্রর মতো একজন বিখ্যাত অভিনেতা আমাকে একটা কিছু দিতে চাইছেন, এটাই তো যথেষ্ট। হাজির হলাম একদিন সকালে ওঁর বাড়িতে, এসপি মুখার্জি রোডের উপরে ল্যান্সডাউন অঞ্চলে। রাস্তার উপরেই একটানা স্কুল বাড়ির মতো অনেকগুলো ঘর। মাঝামাঝি একটি ঘরের সামনে মার্বেল ফলকে লেখা আছে ‘কে মিত্র’ (K. MITRA)। বেল বাজাতে একজন দরজা খুলে দিলেন, ভিতরে এসে বসতে বললেন। একটু বাদে কমলবাবু প্রবেশ করে আমার মুখোমুখি এক সোফাতে বসলেন। নানা বিষয়ে কথা হল, চা-মিষ্টি খাওয়ালেন, স্ত্রী-র সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অবশেষে রেডিও দর্শন হল। একটা বাজারের ব্যাগে সেটিকে ঢুকিয়ে আমার হাতে তুলে দিলেন।

কমল মিত্রর দেওয়া উপহার নিয়ে ফিরে এলাম আমাদের কোয়ার্টারে। আমার অন্য ডাক্তার বন্ধুদের সাহায্যে অনেক কসরত করে সেটাকে চালানো হল। ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত এরিয়াল টাঙানো হল। কিন্তু এই ঘটনার কিছুদিন বাদেই আমাকে ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতাল ছাড়তে হল। বিদায় লগ্নে ট্যাক্সি ডেকে আমার মালপত্র তোলার সময় কী মনে হল, রেডিওটিকেও সবার অলক্ষ্যে গাড়িতে ঢুকিয়ে নিলাম। রেডিওটি আজও সযত্নে আমার ড্রইংরুমের আলমারির শো কেসে শোভা পাচ্ছে। টিভিতে যখন হঠাৎ করে কমল মিত্রর অভিনয় দেখি, নিজের অজান্তেই চোখ চলে যায় ওদিকে। অনেক কথাই মনে পড়ে।

ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের সাহায্যার্থে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কমল মিত্রকে আমি রবীন্দ্র সদনে নিয়ে এসেছিলাম। উনি তখন বাড়ির বাইরে খুব একটা বেরোন না, কিন্তু আমার অনুরোধ ফেলতে পারেননি। সেই অনুষ্ঠানে প্রবাদপ্রতিম গায়ক জগন্ময় মিত্রকেও আমি নিয়ে এসেছিলাম। সে গল্প পরে শোনাব। পরবর্তীকালে উনি আমাকে তুমি বলেই ডাকতেন। সম্বোধন করতেন ‘এই ডাক্তার’ বলে। কিন্তু সেই সম্বোধনে গলার রাশভারী বাজখাঁই ব্যাপারটা একেবারেই থাকত না। বরং লেগে থাকত একটা স্নেহের সুর। আমার যখন ভরা যৌবন, ২৮-৩০ বছর বয়স, তখন অনেক বৃদ্ধ মানুষের স্নেহ সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। বিকাশ রায় ও কমল মিত্র ছাড়াও অভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিনেত্রী ভারতী দেবী, সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র ও বিমল কর, ডাঃ আবিরলাল মুখার্জি, ডাঃ মণীশ প্রধান, ডাঃ রণবীর মুখোপাধ্যায়, ডাঃ সুনীল ঠাকুর—সব নাম হয়তো মনেও নেই। একটা অসমবয়সি বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে যেত এঁদের সবার সঙ্গেই। কেমন করে হত কে জানে! এঁদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। প্রৌঢ়ত্বের দোড়গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছি আমি নিজেও। তবু এঁরা সবাই মাঝে মাঝে আমার মনের জানালায় আজও উঁকি দিয়ে যায়, আমাকে ছুঁয়ে যায়।

Skip to content