শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল।

এসো আজ একটু তোমাদের অত্যন্ত প্রিয় একটি বিষয়ের জনককে নিয়ে একটু গল্প করি। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মূলত লকডাউনের পরে তোমাদের লেখাপড়া থেকে আরম্ভ করে জীবনের সমস্ত কিছু খুঁটিনাটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মোবাইল ফোন। মোবাইল ছাড়া আজ আর এক মুহূর্ত বাঁচার কথাও কেউ ভাবতে পারেন না। তোমরাও পারো না। তাই যে জিনিসটা ছাড়া আজ তোমরা থাকার কথা ভাবতেই পারো না সেই জিনিসটার নির্মাতা সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক, কী বলো?

না মোবাইল ফোন নয়, এই মানুষটি সর্বপ্রথম টেলিফোন নামক সেই অভাবনীয় বস্তুটির আবিষ্কারক, যে টেলিফোনের পরবর্তী রূপান্তরিত আধুনিকতম রূপ হল মোবাইল ফোন বা মুঠোফোন। এই মানুষটির নাম হল গ্রাহাম বেল, পুরো নাম আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল। ১৮৪৭ সালের ৩ মার্চ স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে জন্মগ্রহণ করেন গ্রাহাম বেল। এডিনবার্গের ১৬ চারলোটি স্ট্রিটের একটি বাড়িতে একটি পাথরের খোদাই থেকে মনে হয় সম্ভবত এটিই তাঁর পরিবারের জন্মস্থান ছিল। ছেলেবেলায় তাঁর নাম ছিল আলেকজান্ডার বেল, কিন্তু একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাবার কাছে আবদার জুড়লেন একটি মধ্যনামের জন্য। আবদারের কারণটিও কিন্তু মোটেই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। গ্রাহাম বেলের দুইজন ভাই ছিলেন—মেলভিল জেমস বেল এবং এডওয়ার্ড চার্লস বেল—যাঁরা দুজনই পরবর্তীকালে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। দুই ভাইয়ের মধ্যনাম আছে অথচ তার নেই! এ কেমন কথা! অতএব মধ্যনাম দাবি করে বসলেন বাবার কাছে। বাবাও দশ বছরের আদরের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে খুশি করার জন্য তাকে উপহার দিলেন একটি মনোমতো পছন্দসই মধ্যনাম। বেলের এগারোতম জন্মদিনে তার বাবা আলেকজান্ডার মেলভিল বেল তাঁরই এক কানাডিয়ান বন্ধুর নাম অনুসারে তাঁর ছোটছেলের মধ্যনাম রাখেন গ্রাহাম। এর পর থেকে তিনি আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল নামেই পরিচিত। তবে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুরা এলেক নামেই ডাকত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো গ্রাহাম বেলেরও প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি ছিল চরম অনীহা। ছেলেবেলায় বাবার কাছেই বহুদিন লেখাপড়া করার পর ভর্তি হন এডিনবার্গের রয়েল হাই স্কুলে। সেখানে তিনি চার ক্লাস পর্যন্তই পড়াশোনা করেন এবং মাত্র ১৫ বছর বয়সেই স্কুল ছেড়ে দেন। স্কুলে তার ফলাফল খুব একটা ভালো ছিল না এবং প্রায়শই স্কুল কামাই করার প্রবণতা ছিল তাঁর মধ্যে। বাবার শত উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ব্যর্থ প্রতিপন্ন করে তিনি স্কুলের পাঠ্যবিষয়গুলোকে দিব্যি কাঁচকলা দেখিয়ে সারাটা দিন কাটিয়ে দিতেন জীববিজ্ঞানের পেছনে। স্কুল ত্যাগ করার পর আলেকজান্ডার তাঁর দাদার সঙ্গে বসবাস করার জন্য লন্ডনে গমন করেন, আর সেখানেই তাঁর যথার্থভাবে শিক্ষাজীবন আরম্ভ হয়। দাদা আলেকজান্ডার বেলের যোগ্য শিক্ষানবিশ হয়ে ওঠেন নাতি গ্রাহাম বেল। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই আলেকজান্ডার শিক্ষানবিশ শিক্ষক হিসেবে স্কটল্যান্ডের ওয়েস্টন হাউস একাডেমিতে যোগদান করেন। যদিও তখন তিনি ল্যাটিন এবং গ্রিক ভাষার ছাত্র ছিলেন। গ্রাহাম তাঁর জীবনের প্রথম উপার্জন আরম্ভ করেন ১০ পাউন্ড দিয়ে। এর পরের বছর তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৮৬৮ সালে সপরিবারে কানাডা চলে যাওয়ার আগে সেখান থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন।

ছেলেবেলা থেকেই খুব ভালো একজন পিয়ানোবাদক ছিলেন গ্রাহাম, ছিলেন মূকাভিনয়েও যথেষ্ট পারদর্শী। শব্দবিজ্ঞান নিয়ে তাঁর পড়াশোনা আরম্ভ হয় তাঁর মায়ের দৌলতেই। গ্রাহামের মায়ের ক্রমবর্ধমান বধিরতার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য গ্রাহাম এমন কিছু সাংকেতিক ভাষা রপ্ত করেন যার মাধ্যমে তিনি কথা না বলেও মায়ের সঙ্গে যোগাযোগসূত্রটি বজায় রাখতে পারবেন। ধীরে ধীরে তাঁর বাবার অভিভাবকত্বে এই বিষয়ে তিনি এতটাই পারদর্শী হয়ে ওঠেন যে, কোনওরকম পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং উচ্চারণজ্ঞান ছাড়াই ল্যাটিন, স্প্যানিশ, স্কটিশ, গেলিক কিংবা সংস্কৃত যেকোনও ভাষাই তিনি সংকেতের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারতেন। শব্দবিজ্ঞানের ওপর এই প্রবল দক্ষতাই তাঁকে টেলিফোন আবিষ্কার করার কাজে অনেকটা সাহায্য করেছিল। তাঁকে ডাকা হত ‘দ্য ফাদার অফ দ্য ডেফ’ নামে। তাঁর বাবা, দাদা এবং ভাই সবাই একক অভিনয় ও বক্তৃতায় ছিলেন পারদর্শী এবং তাঁর মা ও স্ত্রী উভয়েই ছিলেন বোবা। এ কারণেই বোবাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে তিনি প্রভূত গবেষণামূলক কাজ করেছেন। টেলিফোন উদ্ভাবনের আগে থেকেই তিনি শ্রবণ ও কথন সংশ্লিষ্ট গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। সেইজন্যেই তাঁকে বধিরদের জনকের উপাধিতে ভূষিত করা হয়ে থাকে। ১৮৭৬ সালে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলকে টেলিফোনের প্রথম মার্কিন পেটেন্টের সম্মানে ভূষিত করা হয়।

টেলিফোন ছাড়াও গ্রাহাম বেলের পরবর্তী জীবনে করা আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকার্যের মধ্যে রয়েছে উড়ো নৌকা এবং বিমানচালনবিদ্যা। ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বেল। তবে সবথেকে মজার বিষয় হল, তাঁর সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন যে টেলিফোন, সেটিকেই তিনি একটি উটকো ঝামেলা বলে মনে করতেন আর ঠিক সেই কারণেই তাঁর নিজের গবেষণা ও অধ্যয়নকক্ষে তিনি আমৃত্যু কোনও টেলিফোন রাখেননি। বেল মারা যাওয়ার পর তাঁর প্রতি সম্মাননা প্রদর্শনস্বরূপ আমেরিকার সকল টেলিফোনে এক মিনিটের জন্য অবিরাম রিং বাজানো হয়েছিল।
তো বন্ধুরা তোমরা মোবাইল ব্যবহার তো করো, কিন্তু যোগাযোগ মাধ্যমের আবিষ্কর্তার জীবনের গল্প এতদিন জানতে কি? না জানলে এক্ষুনি জেনে নাও। তোমাদের জন্যই আজ রাখা রইল টেলিফোনের উদ্ভাবক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের বিস্মিত বিশ্বের গল্পকথা৷

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

Skip to content