রাতের অন্ধকারে অরণ্যের পথে। আবিলো হঠাৎ লক্ষ্য করল গাছে জড়িয়ে আছে দু'- তিনটি বিষাক্ত ভাইপার।
প্রায় চার পাঁচ ঘণ্টা একটানা হেঁটে বেলা গড়িয়ে যখন প্রায় সূর্যাস্ত, আমরা এসে পৌঁছলাম এক ছোট্ট নদীর ধারে। বলাই বাহুল্য, সেদিনের ওই পথ পরিবর্তনের খাতিরে, সময় বাঁচানোর জন্য দুপুরের খাওয়াদাওয়ার আশা ত্যাগ করতে হয়েছে আমাদের। তাছাড়া, আবার যদি একই রকম কিছু ঘটনা ঘটে এবং আরও কিছু ঘণ্টা বেশি সময় লাগে তখন টান পড়বে মজুত খাবারে এবং জলে।
সূর্যাস্তের প্রাক্কালে যেখানে এসে দাঁড়ালাম, সেটা গহন অরণ্যের মধ্যে একটা জংলি নদী। নদী না বলে তাকে নালা বলাই ভালো। শীর্ণস্রোতা, অগভীর, হাঁটু অব্দি জল। তবে সে জল খুব পরিষ্কার। আঁজলা ভরে সেই জলই আমরা খেয়ে নিলাম তেষ্টা মেটাতে। তারপর ঝপাঝপ এক এক করে ডুব দিতে শুরু করলাম নদীতে। তার শীতল স্পর্শে একটানা এতটা হেঁটে আসার ক্লান্তি অনেকটাই কেটে গেল। তবে মনে সবসময়েই একটাই ভয়, হঠাৎ যদি ওই নদীতে জল খেতে চলে আসে কিছু অদ্ভুত দর্শন, হিংস্র শ্বাপদ, তখন কী হবে। যাই হোক, এ যাত্রায় আমাদের স্নান খাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটাতে আসেনি কেউই। বাদিয়া গাছের শুকনো ডাল এক জায়গায় করে জল গরম করে তাতে দিয়ে দিল শুকনো পাস্তা। রাতের খাবার। ডিম সেদ্ধ, শুকনো পাস্তা সঙ্গে টমেটো সস। আমি ভারতীয় ভঙ্গিতে ওই ডিমসেদ্ধ পাস্তায় মেখে খেতে লাগলাম। আমার দেখাদেখি অন্যরাও তাই করল। আপাতদৃষ্টিতে অরুচিকর খাবারে একটু নতুনত্বের ছোঁয়া বা ফাবিয়ানোর কথায় ‘আ পিঞ্চ অফ টুইস্ট’। তবে এটাই ভালো যে সবাই এই টুইস্টে বেশ খুশি। ফলস্বরূপ, জার্মান এবং বলভিয়ান নাগরিকগণের কাছে ভারতীয় খাদ্য প্রণালীর মাথা আরও একবার উন্নত হল।
সূর্যাস্তের প্রাক্কালে যেখানে এসে দাঁড়ালাম, সেটা গহন অরণ্যের মধ্যে একটা জংলি নদী। নদী না বলে তাকে নালা বলাই ভালো। শীর্ণস্রোতা, অগভীর, হাঁটু অব্দি জল। তবে সে জল খুব পরিষ্কার। আঁজলা ভরে সেই জলই আমরা খেয়ে নিলাম তেষ্টা মেটাতে। তারপর ঝপাঝপ এক এক করে ডুব দিতে শুরু করলাম নদীতে। তার শীতল স্পর্শে একটানা এতটা হেঁটে আসার ক্লান্তি অনেকটাই কেটে গেল। তবে মনে সবসময়েই একটাই ভয়, হঠাৎ যদি ওই নদীতে জল খেতে চলে আসে কিছু অদ্ভুত দর্শন, হিংস্র শ্বাপদ, তখন কী হবে। যাই হোক, এ যাত্রায় আমাদের স্নান খাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটাতে আসেনি কেউই। বাদিয়া গাছের শুকনো ডাল এক জায়গায় করে জল গরম করে তাতে দিয়ে দিল শুকনো পাস্তা। রাতের খাবার। ডিম সেদ্ধ, শুকনো পাস্তা সঙ্গে টমেটো সস। আমি ভারতীয় ভঙ্গিতে ওই ডিমসেদ্ধ পাস্তায় মেখে খেতে লাগলাম। আমার দেখাদেখি অন্যরাও তাই করল। আপাতদৃষ্টিতে অরুচিকর খাবারে একটু নতুনত্বের ছোঁয়া বা ফাবিয়ানোর কথায় ‘আ পিঞ্চ অফ টুইস্ট’। তবে এটাই ভালো যে সবাই এই টুইস্টে বেশ খুশি। ফলস্বরূপ, জার্মান এবং বলভিয়ান নাগরিকগণের কাছে ভারতীয় খাদ্য প্রণালীর মাথা আরও একবার উন্নত হল।
ঠিক হল ওখানেই আজ রাত্রি যাপন করা হবে। তাঁবু খাটানো হল কাছেই বিবসি গাছের তলায়। বলিভিয়ান আমাজনের এই বিবসি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং উঁচু গাছগুলোর মধ্যে পড়ে। গাছের শিকড়টাই মাটির ওপরে প্রায় ৬-৭ ফুট। তারই গায়ে পেরেক ঠুকে আর মাটিতে আংটা লাগিয়ে ক্যাম্প তৈরি হল; আর তার থেকেও জরুরি, মশারি খাটানো হল। শুকনো গাছের ডাল জোগাড় করা হয়েছিল খাওয়ার পরেই। অন্ধকার হতেই তার চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে দিলাম আমরা। আমাজনের অন্ধকার এক দেখার মতো বা বলা ভালো না-দেখার মতো জিনিস। দীর্ঘকায় বনস্পতির ছায়ায় সূর্যের প্রবেশই যেখানে নিষেধ, সেখানে চাঁদ তারাদের আর কতটুকুই বা সাধ্যি। হয়তো সেদিন জ্যোৎস্না ছিল। আমরা সবাই বনেও ছিলাম। কিন্তু কবিগুরুর গান গাওয়ার আমেজ সে জ্যোৎস্না তৈরি করতে অক্ষম। সে অন্ধকারে ফ্ল্যাশলাইট বা আগুন না জ্বালালে নিজের শরীর ও দেখা যায় না। সে এক অন্য রকম অনুভূতি, বেশিরভাগটাই হয়তো বদ্ধতাজনিত ভীতির মতো আর ভয়মিশ্রিত শিহরন আর উত্তেজনা। তাঁবুর মধ্যে পাতা ছোট ছোট ক্যাম্প-খাট। এসবই আমাদের ভাড়া করতে হয়েছিল রারেনবাকে। আমি জিগ্যেস করলাম এইটুকু উঁচুতে কি আদৌ নিরাপত্তা বাড়ে। আবিলো বলল ওই যতটুকু হয় আর কী। বলাই বাহুল্য উত্তরে আমি মোটেও খুশি হলাম না। আমার মুখে তার অভিব্যক্তি দেখে হেসে ফেলল সবাই। মা-মাটি-মানুষে ঘেরা আপাত-সুরক্ষিত বঙ্গদেশে লখিন্দরের লোহার ঘরের মধ্যেও ঢুকে পড়েছিলেন তারা; আর এ তো শ্বাপদ-সংকুল অরণ্যে ঘেরা কাপড়ের তাঁবু, আর তাতেও হাজারটা ছিদ্র। তাই ভাবলাম, আর বেশি কু না গাওয়াই ভালো। মনে মনে একবার মা-মনসাকে স্মরণ করে নিলাম। আমি চাঁদসদাগর নই মা। আমি তোমায় বিশ্বাস করি মা। যত বছর দেশে ছিলাম, পাশের বাড়িতে প্রতি বছর তোমার পুজোয় জোগাড়যন্ত্র করতাম মা। তাতে কিছু দোষ করে থাকলে ক্ষমা করে দিয়ো মা। আজ রাতটুকু আমার প্রতি দয়া করে বিরূপ হয়ো না।
বিবসি: পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো এবং বড় গাছগুলির একটির নিচে আমি দাঁড়িয়ে।
এমনই তাঁবুর মধ্যে বসে সবাই গল্প করছিলাম। চারদিকে ঝিঁঝিপোকার ডাক। সবে ভাবছি ঘুমাতে যাব। এমন সময় বাইরে বেশ জোরে একটা খচরমচর শব্দে সন্দিহান হয়ে গেলাম সবাই। আমি ফাবিও আর ফ্রানজি চুপ করে বসে আছি। কী জানি কী বিপদ বাইরে এসে বসে আছে। প্রায় এক মিনিট প্রাণ হাতে নিয়ে বসে আছি প্রায়। আবিলো আর বাদিয়া মন দিয়ে শুনছে সে শব্দ। শেষমেশ ভয় ভাঙাল বাদিয়া। আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই একরকম আমাদেরকে জোর করে বাইরে নিয়ে এল ফ্ল্যাশ লাইটটা জ্বালিয়ে। বেরিয়ে এসে দেখি ওমা, বেশ এক পাল খরগোশ এসে গেছে আমাদের পড়ে থাকা পাস্তার অবশিষ্ট অংশ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে। চোখে আলো পড়তেই দুদ্দাড় করে যে যেদিকে পারল পালিয়ে গেল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, আর আমাদের শুকনো মুখ দেখে আবিলো আর বাদিয়ার সে কী হাসি! আমরাও বোকা বোকা হয়ে একটু হাসলাম নিজেদের ওপরেই। তারপর আবার চলে গেলাম তাঁবুর মধ্যে। ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় যেটুকু দেখা গেল পালিয়ে যাওয়ার আগে, তাতে দেখলাম যে এদের সারা গায়ে ধূসরের ওপর কালো সাদা ছোপ ছোপ বা ডোরাকাটা দাগ। যাই হোক, তারপর সারারাত ওই একই খচরমচর আওয়াজটা ছাড়া আর কোনও আওয়াজ পাইনি। অন্য সময় হলে কী হত জানি না, অমন শ্বাপদসংকুল অরণ্যে, প্রায়-নিরাপত্তাহীন এক তাঁবুতে ঘুম হয় কি না জানি না। কিন্তু, সারাদিনের পরিশ্রান্তিতে চোখ বুজে এল শুতে না শুতেই। শুধু ঘুমের গভীরে তলিয়ে যাওয়ার আগে একবার তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে স্মরণ করে প্রার্থনা করলাম যে কাল যেন এই পৃথিবীতেই আবার চোখ খুলি। বিষাক্ত সব সাপখোপ, পোকামাকড় ভর্তি জঙ্গলে কে যে কার দেবতা জানি না। তাই সবাইকে মনে করে নেওয়াই ভালো।—চলবে
ছবি সৌজন্য: লেখক
ছবি সৌজন্য: লেখক
বাইরে দূরে
লেখা পাঠানোর নিয়ম : এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com