বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।

তিনি গুণবান, রূপবানও। তাঁর গুণের কথা বলে শেষ করা সহজ নয়। অথচ তিনি সেভাবে আলোকিত নন, আড়ালেই থেকেছেন। আমরা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কথা বলছি। রবীন্দ্রনাথের ‘নতুন দাদা’ তিনি। আদরের ‘রবি’ দিনে দিনে যে ফুলের মতো ফুটে উঠেছে, এই ফুটে ওঠার ক্ষেত্রে নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ভূমিকা সব থেকে বেশি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্নেহ-সান্নিধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন। উজ্জীবিত ও প্রাণিত হয়েছিলেন।

কত গুণ ! প্রকৃতই গুণবান। পেনসিলে ছবি আঁকতেন অনবদ্য। ঘরে বাইরে নানাজনের ছবি এঁকেছেন। লালন ফকিরকে সামনে বসিয়ে‌ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছবি এঁকেছিলেন। সে-ছবিই লালনের একমাত্র ছবি। ভালো পিয়ানো বাজাতেন। নতুন নতুন নানাবিধ সুর। রবীন্দ্রনাথকে সেই সুর কতখানি প্রাণিত করত, তা জানা যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্মৃতিচর্চায়। মুখে মুখে বলে গিয়েছিলেন, তা কাগজে কলমে ধরে রেখেছিলেন বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়। বলে যাওয়া স্মৃতিকথার একটি বইও প্রকাশিত হয়। সে-বইয়ের নাম ‘জীবনস্মৃতি’। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’তে আছে, ‘এই সময়ে আমি পিয়ানো বাজাইয়া নানাবিধ সুর রচনা করিতাম। আমার দুই পার্শ্বে অক্ষয়চন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ কাগজ পেন্সিল লইয়া বসিতেন। আমি যেমনি একটি সুর রচনা করিলাম, অমনি ইঁহারাই সেই সুরের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ কথা বসাইয়া গান রচনা করিতে লাগিয়া যাইতেন।’

ছিল আরও ‌কত গুণ। ভালো ফরাসি জানতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। জোড়াসাঁকোয় নাটক তো প্রায় নিয়মিতই অভিনীত হত। নাটকে অভিনয়ও করতেন‌ তিনি। লিখেছেনও তো কম নয়! ‘সাহিত্যসাধক চরিতমালা’য় ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ছেচল্লিশটি বইয়ের কালাক্রমিক তালিকা দিয়েছেন। গান-কবিতা ছাড়াও রয়েছে অনেকগুলি নাটক। সব নাটক অবশ্য মৌলিক নয়। গল্প-উপন্যাসের অনুবাদও করেছেন।

ভাবনা-চিন্তায় একেবারেই সেকেলে ছিলেন না, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা ছিল। তাঁর রকমারি কর্মব্যস্ততা পত্নী কাদম্বরীর আত্মহত্যার পর হঠাৎই থমকে গিয়েছিল। দেখা দেয় জীবন সম্পর্কে অদ্ভুত উদাসীনতা। রাঁচি চলে গিয়ে‌ মোরাবাদি-পাহাড়ে নির্জনে একটি ঘরে একা বসবাস করতেন। এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন তিনি, এরপর আর একলাইনও মৌলিক লেখা লেখেননি। সামান্য কিছু অনুবাদ করেছিলেন।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যুগের থেকে ঢের এগিয়েছিলেন। গঙ্গার ধারে বাগানবাড়িতে স্ত্রী কাদম্বরীকে নিয়ে বেড়াতে গিয়ে‌ একবার ছিলেন টানা বেশ ক’দিন। সেই সময় কাদম্বরীকে ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছিলেন। অশ্বারোহণ ছিল তাঁর প্রিয় শখ। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দু’টি আরবি ঘোড়া ছিল। একটি ঘোড়ায় চড়তেন কাদম্বরী, আরেকটিতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্বয়ং। টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে প্রতিদিন গড়ের মাঠে বেড়াতে যেতেন। তাঁদের ঘোড়া নিয়ে এই ঘোরাঘুরি ময়দান-চত্বরে সকলে অবাক বিস্ময়ে দেখত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’তে রয়েছে স্বীকারোক্তি, ‘ময়দানে পৌঁছিয়া দুইজনে সবেগে ঘোড়া ছুটাইতাম। প্রতিবাসীরা স্তম্ভিত হইয়া গালে হাত দিত। রাস্তার লোকেরা কৌতূহলে ও বিস্ময়ে মুখব্যাদান করিয়া চাহিয়া হতভম্ব হইয়া থাকিত। দারোয়ানেরা আমাদের পানে অবাক হইয়া চাইয়া থাকিত। সে সব দিকে আমার ভ্রূক্ষেপও ছিল না। আমি তখন উদ্দাম নব্যভাবের নেশায় উন্মত্ত।’

ঘোড়া নিয়ে নানা ঘটনা ঘটেছে। ঘোড়া-প্রিয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ‌ ঘোড়া নিয়ে‌ বেড়াতে বেরিয়ে কখনও বেকায়দায় পড়েছেন, আবার কখনও-বা আনন্দ-খুশিতে তাঁর মন ভরে উঠেছে।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কাদম্বরী, সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্ঞানদানন্দিনী।

সে-সময় ধনী পরিবারে ঘোড়া থাকত, এটাই ছিল স্বাভাবিক। ঘোড়ার পিঠে ঘোরাঘুরির মধ্যে লুকোনো আভিজাত্য রয়ে যেত। প্রকাশ্যে আভিজাত্য দেখানোর জন্য নাট্যমঞ্চেও ঘোড়া নিয়ে নায়ক হাজির হতেন। বাবু সম্প্রদায়ের আরও কেউ কেউ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতো ঘোড়াও কিনেছিলেন। উত্তর কলকাতায় ঘোড়া-দৌড়ের মাঠও ঠিক করা হয়েছিল। বেশ ক’বার সে-মাঠে ঘোড়াদৌড় হয়েছে। রাজা দিগম্বর মিত্রের পুত্র ঘোড়া থেকে পড়ে মারা যায়। সেই মর্মান্তিক মৃত্যু ঘোড়ায় চড়া নিয়ে ভয়-ভীতি সঞ্চার করলেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ অবশ্য তাঁর প্রিয় শখ ত্যাগ করেননি।

ভারতের ভাইসরয় লর্ড মেয়ো নানা জনহিতকর কাজে যুক্ত ছিলেন। আন্দামানের সেলুলার জেল পরিদর্শনকালে এক বন্দির ছুরিকাঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর মেয়োসাহেবের যত ঘোড়া ছিল, সব নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা হয়। সেই নিলামে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বেশ বড়সড় এক জাঁকালো ঘোড়া কিনে ফেলেছিলেন। যা-তা ঘোড়া নয়, লাটসাহেবের ঘোড়া, পছন্দ না হয়ে যায় না!

কিনে তো ফেললেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন সাহেব-ঘোড়ায়‌ কোনও খুঁত থাকবে না, দোষ থাকবে না, টগবগিয়ে ছুটবে! ক’দিন পরই টের পেলেন, ঘোড়াটি যাচ্ছেতাই, একেবারে ভিতুর ডিম!

ঘোড়ার পিঠে করে সেদিন গড়ের মাঠে বেড়াতে গিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। কেল্লায় তখন ব্যান্ড বাজছে। বেশ জোরেই বাজছিল! নজরে পড়ল, অনেক সাহেব ঘোড়া নিয়ে ব্যান্ড-স্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে শুনছেন হৃদয়-জুড়নো সুর-মূর্ছনা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কাছে গিয়ে শুনতে পারলেন না। যাবেনই বা কী করে! যেই ব্যান্ডের শব্দ শুনেছে, অমনি শুরু হয়েছে ঘোড়ার এলোমেলো লম্ফঝম্প! সেই লম্ফঝম্পের চোটে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়লেন মাটিতে, চিটপটাং। ঘোড়া তাঁকে ফেলে ভীষণ জোরে দিকবিদিকশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করল। কয়েকজন সাহেব জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে মাটি থেকে তুললেন।‌ খুব জোর বেঁচেছেন, তেমন লাগেনি। ধুলো ঝেড়ে উঠে পায়ে পায়ে খানিক দূরে গিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেখলেন, তাঁর ঘোড়াটি নির্জনে, নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে! সেখানে অবশ্য ব্যান্ডের শব্দ পৌঁছচ্ছে না।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পেন্সিলে আঁকা কাদম্বরী।

ঘোড়ায় চড়ার আর সাহস পাননি। কোনওরকমে ঘোড়াটিকে নিয়ে ভিড় কাটিয়ে লালবাজারের মোড় পর্যন্ত এসেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। লালবাজার পেরিয়ে চিৎপুরের রাস্তায় বেজায় ভিড়। লোকে লোকারণ্য। এক মুটের হাতে ঘোড়ার রাশ দিয়ে পালকি চড়ে জোড়াসাঁকোয় ফিরেছিলেন‌। পিছু পিছু ঘোড়া নিয়ে এসেছিল ওই মুটে।

অনেকক্ষণ বাড়ির বাইরে, ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছেন সেই কখন! দীর্ঘক্ষণ না ফেরায় বাড়ির সবাই মুখ ভার করে বসেছিলেন। দুর্ভাবনা তাঁদের চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
এই ঘোড়া-প্রীতির খেসারত জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে নানা সময় বারবার দিতে হয়েছে। বিপত্তির পর ‘ঢের হয়েছে, আর না’ বলে ঘোড়ায় চড়া ত্যাগ করেননি। ঘটনা-দুর্ঘটনা যা-ই ঘটুক না কেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঘোড়া-প্রীতি কমেনি, টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে আবারও বেরিয়ে পড়েছেন!

ঘোড়া নিয়ে একবার কী বিপত্তিই না ঘটেছিল! দার্জিলিং ছিল ঠাকুরবাড়ির প্রিয় ভ্রমণস্থান। পরিবারের অনেকেই পাহাড়ে ভ্রমণে গিয়ে ক’টা দিন আনন্দে কাটিয়ে এসেছেন। ভ্রমণে গিয়ে দার্জিলিং‌-পাহাড়ে ঘোড়া দেখে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের যথারীতি ঘোড়ায় চড়ার ইচ্ছে জেগেছে। চড়া মাত্র পাহাড়ের পথ ধরে ঘোড়া ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে শুরু করে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কিছুতেই ঘোড়ার রাশ বাগে আনতে পারেননি। দৌড়াতে দৌড়াতে একেবারে খাদের কিনারায়। খাদের গভীরতা নজরে পড়তেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শিহরিত হয়েছেন। ও-প্রান্তে পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা সামান্যও নেই, মৃত্যু অনিবার্য!‌ বরং এ-প্রান্তে, পাহাড়ের পথে পড়লে হয়তো-বা বাঁচার সম্ভাবনা রয়েছে। ঘোড়া যেভাবে খাদের ধার-বরাবর ছুটছে, তাতে বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবে!

রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।

খাদের ওপারে পড়ার থেকে এপারে পড়াই ভালো, এমন ভেবে নিয়ে ইচ্ছে করেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঘোড়ার পিঠ থেকে পাহাড়ি-পথে পড়লেন। আকস্মিক পড়া নয়, সচেতনভাবে পড়া, তাই তেমন আঘাত লাগেনি। একটুআধটু কেটে গিয়েছিল। মাথায় লাগে‌নি, এই বাঁচোয়া! তেমন জোরে লাগলে কী যে হত, তা বলা মুশকিল! জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘একটা খুব বড়ো পাগড়ি ছিল বলিয়া মাথায় কোনও আঘাত লাগে নাই।’

এরপরও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ঘোড়া-প্রীতি কমেনি! ঘোড়ার পিঠে ঘোরাঘুরিতে কী যে আনন্দ, তা তিনিই বুঝেছিলেন! ঠাকুরবাড়ির আর কেউ এভাবে ঘোড়ানুগত্য দেখাননি।

ছবি সৌজন্যে: লেখক

* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।

Skip to content