সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


মহানায়ক।

মানুষটি চলে গেছেন বিয়াল্লিশ বছর আগে। তবু তাঁকে নিয়ে চর্চা আজও হয়ে থাকে। বিশেষ করে ২৪ জুলাই, তার মৃত্যুদিন এলে। কিছু পত্রিকা আজও তাকে নিয়ে ওই সময় স্পেশাল ইস্যু করে। সেগুলো ভালো বিক্রিও হয়। সরকার মহানায়কের স্মৃতিতে পুরস্কারও দিয়ে থাকেন ফি-বছর।

প্রথমবার উত্তম-দর্শন হয়েছিল অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। চার বছর বাদে ১৯৭৮-এ আরেকবার সুযোগ পাওয়া গেল তাঁর ঘনিষ্ঠ হওয়ার। যার মাধ্যমে এই সুযোগ এল, তিনি সেই সময়ের একজন নামকরা চরিত্রাভিনেতা দিলীপ বসু। দিলীপদাকে প্রথম দেখেছিলাম তপন সিংহর ‘এখনই’ ছবিতে। বিখ্যাত হলেন মৌচাক সিনেমায় গুলবাজের অ্যাসিস্ট্যান্টের ভূমিকায় অভিনয় করে৷ পরবর্তীকালে ‘বাঘবন্দী খেলা’ সিনেমায় ঢাকার পোলার চরিত্রে অভিনয় করে। দিলীপদার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সেন্ট্রাল এভিনিউ কফি হাউসে। একজনের খোঁজে সেখানে গিয়েছিলাম একদিন। হঠাৎ চোখ আটকে গেল একটি টেবিলে। সেখানে কয়েকজনের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছেন উনি। সিনেমায় তখন বেশ পরিচিত মুখ দিলীপদা। আমার কৌতূহলী চোখ দেখে কাছে ডাকলেন, জিজ্ঞেস করলেন, কাকে খুঁজছেন। নাম এবং চেহারার বর্ণনা দিতেই বলে উঠলেন, ওটা একটা চিটিংবাজ, আপনি ওর পাল্লায় পড়লেন কী করে!

এভাবেই শুরু। কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আমার কৌতূহল ছিল সিনেমা জগৎ নিয়ে, আর দিলীপদার ছিল ডাক্তারি-জগৎ নিয়ে। আমি ওঁর কাছে সিনেমা জগতের গল্প শুনতাম, উনি শুনতে চাইতেন আমার জগতের গল্প। বিশেষ করে অ্যানাটমি হলের ডেডবডি সম্বন্ধে ওঁর ভীষণ কৌতূহল ছিল। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই অন্তত একদিন সেন্টাল এভিনিউ কফি হাউসে দিলীপদার সঙ্গে আড্ডা মারতে যেতাম। তখন থার্ড ইয়ারে পড়ি। কফি হাউসের উলটোদিকে হিন্দুস্থান বিল্ডিং-এ এলআইসি অফিসার ছিলেন উনি। এক ঘণ্টা অফিসে কাটিয়ে বাকি পাঁচ ঘণ্টা নাকি কফি হাউসেই কাটাতেন। সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াও একটি পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডও ওঁর ছিল, যে জন্য ছোট্টখাট্ট এই মানুষটিকে অনেকই সমীহ করে চলত। একদিন আমায় বলল, শ্যুটিং দেখবে? কাল জহর রায়, শমিত ভঞ্জ, জুঁই, চিন্ময় রায়ের সঙ্গে আমার শ্যুটিং আছে আলিপুর হর্টিকালচারে। দেখলে কাল দুপুর একটায় এখানে চলে এসো। আমার সঙ্গে গাড়িতে যাবে। কলেজ কেটে আমি আমার এক কলেজ বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম দিলীপদার শ্যুটিং দেখতে। দিলীপদার গেস্ট বলে কথা! বেশ খাতিরযত্ন পেলাম। চুটিয়ে শ্যুটিং দেখলাম। সবার সঙ্গে পরিচিতও হলাম। সিনেমাটির নাম ছিল, প্রেমের ফাঁদে। এই শ্যুটিং চলাকালীনই চিন্ময় এবং জুঁই প্রেমে পড়েন, পরবর্তীকালে যার পরিণতি হয় পরিণয়ে। চিন্ময় তখন প্রচণ্ড পপুলার আর্টিস্ট। পর্দায় যতই হাসি মশকরার রোল করুন না কেন, জুঁইয়ের ব্যাপারে দেখলাম প্রচণ্ড সিরিয়াস এবং পসেসিভ। পরে যখন চিন্ময় রায় আমার কাছে চিনুদা হয়ে গেছেন, তখন ওঁকে একবার বলেছিলাম, জুঁইদি আর আপনার মাখোমাখো প্রেমের কয়েক ঘণ্টার সাক্ষী আমি। সব ঘটনা শুনে বলেছিলেন, এমন কাজ কেউ করে, লুকিয়ে লুকিয়ে অপরের প্রেম দেখা! তোমার চরিত্র সেই বয়স থেকেই খারাপ। চিনুদা, দিলীপদা, জুঁই কেউ আর এখন বেঁচে নেই। কথাগুলো কিন্তু রয়েই গেছে।

দিলীপদাকে বলেই রেখেছিলাম, সুযোগ থাকলে একবার উত্তমকুমারের শ্যুটিং দেখাবেন। বছর দেড়েক বাদে সুযোগ এল। যতদূর মনে পড়ে, সালটা ছিল ১৯৭৮। এরমধ্যে দিলীপদার মাধ্যমে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে মানিকতলায় কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে, ওঁর নাটক, নামজীবন দেখতে গিয়ে। সৌমিত্রদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বৃত্তের মধ্যেই ছিলেন দিলীপ বসু, সেই জন্যই সৌমিত্রদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠতে সময় লাগেনি। সৌমিত্র-পর্ব আরেকদিন হবে। উত্তম পর্বে ফিরি। ছবির নাম ছিল বাঘবন্দী খেলা, শ্যুটিং হয়েছিল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে। আমি আমার পাড়াতুতো বন্ধু ভৈরবকে নিয়ে সকাল ন’টার মধ্যে হাজির হলাম স্টুডিওতে। গেটে বলাই ছিল, কাজেই এবার আর দারোয়ানের প্রশ্ন-চক্ষুর সামনে পড়তে হল না। দিলীপদা মেকআপ করছিলেন, আমরা মেকআপ রুমে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করলাম। চা খাওয়ালেন, তারপর বললেন, তোমরা একটু ঘুরেফিরে বেড়াও, একটু বাদেই দাদা আসবেন। দাদা মানে মহানায়ক উত্তমকুমার। সেই সময় আমাদের পাড়ার ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠান সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শেষ থেকে শুরু’ নাটকটি করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম আমরা। সেই অনুষ্ঠানের জন্য একটি শুভেচ্ছাপত্র যদি উত্তমকুমারকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া যায়, সেই আশায় ছিলাম আমরা দুজনেই। দিলীপদাকে বলেও রেখেছিলাম। শুনে বলেছিলেন, তোমরা একটা ভালো করে লিখে নিয়ে যেও, উনি পড়ে সই করে দেবেন। ঘণ্টাখানেক বাদে স্টুডিও জুড়ে একটা গুঞ্জন উঠতেই বুঝলাম, তিনি আসছেন। পরিষ্কার মনে আছে, একটা হুড খোলা গাড়িতে মহানায়ক স্টুডিওতে ঢুকলেন বাঘবন্দী খেলার কস্টিউম-মেকআপ নিয়ে। সম্ভবত বাড়ি থেকেই সাজগোজ করে এসেছিলেন। গাড়ি থেকে নামতেই শুরু হল গুরু প্রণাম। তারপর শ্যুটিং। আগে থেকে সব রেডি করাই হয়েছিল। পরিচালক ছিলেন পীযূষ বসু। যে গাড়িতে করে এসেছিলেন সেই গাড়িতেই আবার শ্যুটিং জোনে ঢুকলেন বাঘবন্দী খেলা সিনেমার ভিলেন (হিরো) ভবেশ ব্যানার্জি। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর এই অংশটি এখন একটি স্কুল চত্বর। স্কুলের প্রেসিডেন্ট তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ছাত্র অভিভাবকেরা পিকেটিং করছেন। স্লোগান দিচ্ছেন ভবেশ ব্যানার্জি ফিরে যাও, ভবেশ ব্যানার্জির কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও ইত্যাদি। দিলীপদা আমাদের ডেকে বললেন, তোমরাও পিকেটিংয়ে ঢুকে যাও, স্লোগান দাও। আমাদের আর পায় কে! উত্তমকুমারের সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করব, ভাবতেই যে পারছি না! গলার শির ফুলিয়ে স্লোগান দিলাম। লং শটের পর ক্লোজ শট। ক্যামেরা প্যান করে আমাদের স্লোগানরত মুখগুলোকে ধরল। সিনেমাটি যখন হলে রিলিজ করল, তখন হলে গিয়ে দেখেছি। পরিষ্কার চেনা গিয়েছে আমাকে আর ভৈরবকে। কিন্তু কয়েক বছর আগে টিভিতে দেখলাম, সব ঝাপসা। আর এখন তো বাঘবন্দী খেলার কোনও ভালো প্রিন্টই পাওয়া যায় না শুনেছি।

পরবর্তী শটের প্রস্তুতি শুরু হল। একটা ফাঁকা চেয়ার দেখে আমি আর ভৈরব শেয়ার করে বসলাম। হঠাৎ দেখি উত্তমকুমার আমাদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালেন, তারপর একটু অন্যমনস্কভাবে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন প্রায় আমাদের কাছে, আমরা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, উনি খেয়াল না করেই আবার চলে গেলেন আগের অবস্থানে। একটু বাদে আবার ফিরে এলে আমরা আবার উঠে দাঁড়ালাম। এবার উনি লক্ষ করলেন। বললেন, বসুন বসুন। আবার দূরে চলে গেলেন। কিছু একটা ভাবছিলেন উনি। আবার দেখলাম উনি এগিয়ে আসছেন। আমাদের প্রবল অস্বস্তি শুরু হল, আমরা চেয়ারটা নিয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে বসলাম ওঁর দৃষ্টির আড়ালে। একবার দিলীপদার সঙ্গে দেখা হল। বললেন, দাদার সঙ্গে কথা হয়েছে, যখন লাঞ্চ ব্রেক হবে তখন তোমাদের নিয়ে যাব। আমরা একটু ঘুরে ফিরে বেড়ালাম।

দিলীপ বোস।

দুপুর দেড়টা নাগাদ লাঞ্চ ব্রেক হল। দিলীপদা আমাদের ডাকতেই, আমরা ওঁর পিছু পিছু উত্তমকুমারের পার্সোনাল মেকআপ রুমের দিকে এগোলাম। ঘরে ঢুকে দেখলাম, উত্তমকুমার এক বিরাট আরামকেদারায় গা এলিয়ে চোখ বুজে আছেন। পরনে ধুতি আর স্যান্ডো গেঞ্জি। একজন ম্যাসাজ করছেন। আমাদের পদশব্দে চোখ মেলে বললেন, বল দিলীপ, কী করতে হবে? দিলীপদা গদোগদো কণ্ঠে বললেন, তোমাকে যাদের কথা বলেছিলাম দাদা, আমার এই ভাই অমিতাভ ভট্টাচার্য, ডাক্তারি পড়ে, ওদের গ্রুপের নাটক আছে। উত্তমকুমার একটু মুচকি হেসে বললেন, তুই তো বোস, তোর ভাই ভটচাজ হল কী করে! দিলীপদা তো ক্লিন বোল্ড। আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করলেন। মহানায়ক পাত্তা না দিয়ে বললেন, আমাকে শুভেচ্ছা লিখে দিতে হবে, তাই তো! একটা কথা আপনাদের বলি, আমি কিন্তু লিখতে টিখতে পারি না। আপনারাই বরং এখানে বসে সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখে নিন, আমি সই করে দিচ্ছি। কথাগুলো বলে আবার চোখ বুঝলেন তিনি। এমনটা যে ঘটবে দিলীপদা আগেই বলে দিয়েছিলেন। দিলীপদা চোখের ইশারা করলেন। আমি তিন-চার মিনিট ধরে ডায়েরিতে যা লিখে এনেছিলাম তার উপরেই কলম বুলিয়ে গেলাম। এমন ভাব করলাম যেন ওখানে বসেই লিখছি। তারপর দিলীপদা গ্রিন সিগন্যাল দিতেই বললাম, স্যার হয়ে গেছে। গুরু চোখ মেললেন। একজন চশমা এগিয়ে দিল। চশমা পরে আমার ডায়েরিটা নিয়ে ভালো করে পুরো লেখাটা পড়লেন। লেখার প্রথম দু-তিনটে লাইন আমার এখনও মনে আছে। অন্ন-বস্ত্র, তৈল-তন্ডুলের সন্ধানে আপনি একাই ঘুরে মরছেন না, ঘুরে মরছি আমরা সবাই। তবু বসন্ত এল ঠিক সময়েই, বয়ে নিয়ে এল একরাশ আনন্দ। সেই আনন্দ পূর্ণতা পাবে ভ্রাতৃসংঘ আয়োজিত নাট্য সন্ধ্যায়। ইত্যাদি ইত্যাদি। উত্তমকুমার লেখাটির নীচে সই করে ডায়েরিটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ভালোই তো লিখেছেন। সাহিত্যচর্চা করেন নাকি! আমি লজ্জা এবং উত্তেজনায় একেবারে মাটিতে মিশে গিয়ে বললাম, ওই স্যার একটু-আধটু। প্রশ্রয় পেয়ে উত্তমকুমারকে একটা অনুরোধ করে বসলাম, স্যার আপনার সঙ্গে একটু ফটো তোলার ব্যবস্থা করে দেবেন? উত্তমকুমার দিলীপদাকে বললেন, দিলীপ আমাদের স্টিল ফটোগ্রাফারকে ডেকে নিয়ে আয় তো। একটু বাদে ফটোগ্রাফার এল, আমরা উত্তমকুমারের সঙ্গে গোটা তিনেক গ্রুপ ফটো তুললাম। ফটোগ্রাফারকে বলে দিলেন, ওদের দুটো করে প্রিন্ট করে দেবে ফটোগুলো, টাকা নেবে না, আমি দেব টাকা। দিলীপদাকে নির্দেশ দিলেন, ওদের লাঞ্চ খাইয়ে ছাড়বি।

এতক্ষণ যা বললাম, তার কোনওটিই কিন্তু মিথ্যা কথা নয়, অতিরঞ্জিতও নয়। এই ঘটনাগুলো আমি বহুজনকে বহুবার বলেছি। কাজেই স্মৃতিতে আজও অমলিন হয়ে গেঁথে রয়েছে সবটাই। মাঝখানে কেটে গেছে চুয়াল্লিশটি বছর। ভাবলে অবাক লাগে, মানুষটি শুধু মহানায়ক ছিলেন তাই নন, মহান মানুষও ছিলেন। আসলে বড় মনের মানুষ না হলে বড় অভিনেতা হওয়া যায় না, মহানায়ক তো অনেক পরের কথা। উত্তমকুমার সেটা পেরেছিলেন বলেই আজও তিনি মহানায়কই রয়ে গেলেন, তাকে ছুঁতে পারলেন না কেউই। একটা দুঃখের কথা জানিয়ে শেষ করি। সেই ফটোগ্রাফার কিন্তু ফটোগুলো আমাদের আর দেননি। বারদুয়েক ওঁর সঙ্গে স্টুডিওতে এসে দেখাও করেছিলাম, ওঁর পার্সোনাল স্টুডিওতেও গিয়েছিলাম। বোধ হয় ভেবেছিলেন, আমরা তো টাকা দিতে পারবই না, আর উনিও মহানায়কের কাছে গিয়ে টাকাটা চাইতেও পারবেন না। সেই ফটোগ্রাফার কিন্তু আজও বেঁচে আছেন, ওঁর নামটাও মনে আছে আমার, যদিও এখন আর তিনি ফটো তোলেন না। তবে সেই প্রথম যৌবনের এক দুর্লভ স্মৃতি থেকে উনি আমাদের বঞ্চিত করেছিলেন সেদিন, সেই ক্ষোভ আমার আজও কিন্তু যায়নি।

ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

Skip to content