পাবদা মাছ।
বাঙালির জীবনে যতই বিভিন্ন ও বিচিত্র পুরাণগাথা থাকুক না কেন, একটি পুরাণ ছাড়া কিন্তু বাঙালিজীবন এক্কেবারে অচল, আর সেটি হল বাঙালির মৎস্যপুরাণ। এই একটি পুরাণই দেশ-বিদেশে বাঙালির মাহাত্ম্য প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। আমাদের মৎস্যপুরাণে মাছের যাবতীয় পুরাণগাথা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে থাকবেন বিশিষ্ট মৎস্যবিজ্ঞানী ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায়।
আমাদের দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা করলে দেখা যাবে মূলত অসচ্ছল শিশু ও মহিলাদের প্রায় সকলেই অপুষ্টির কারণে বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। এর কারণ হিসেবে অনেকে বলে থাকেন, একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষ তাঁদের প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টির জোগান পান না, যার ফলে তাঁদের এই জাতীয় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় বারবার। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় এটাই একমাত্র কারণ নয়। পুষ্টির অভাবের কারণ হিসাবে কেবলমাত্র পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান ছাড়াও পুষ্টিগত বোধ সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাব এবং সংস্কারগত কারণকেও অন্যতম কারণ হিসাবে ধরা যায়। সম্প্রতি অপুষ্টি রোধ করার উদ্দেশ্যে ভারত সরকার ‘পোষণ অভিযান’ নামক একটি প্রকল্প আরম্ভ করেছে যার মূল উদ্দেশ্য ‘বায়োফর্টিফায়েড খাবার’-এর জোগান দেওয়া। বায়োফর্টিফায়েড অর্থে জিন প্রযুক্তায়নের মাধ্যমে প্রোটিন ও আয়রন সমৃদ্ধ খাবার তৈরি করা। এই জাতীয় খাবারের ক্ষেত্রে দুটি কথা প্রযোজ্য।
প্রথমত, এই ধরনের খাবারগুলি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয় না যেহেতু, সেহেতু সবক্ষেত্রে এর উপকারিতা নিয়ে সন্দেহমুক্ত হওয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত, আমাদের বাজারে সাধারণ ফুলকপি যদি ১০ টাকা দামে বিক্রি হয় তবে বায়োফর্টিফায়েড পদ্ধতিতে তৈরি ফুলকপি বিক্রি হয় ২০ টাকা দামে অর্থাৎ দ্বিগুণের বেশি দামে।
সুতরাং যে সমস্ত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষদের সবথেকে বেশি প্রয়োজন এই জাতীয় খাবারগুলি, অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে তাঁদের পক্ষেই তা কেনা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তার থেকে যদি আমাদের যে দেশি মাছের সম্ভার রয়েছে সেদিকে মনোযোগ দিই তাহলে দেখতে পাব যে আলাদা করে বায়োফর্টিফায়েড পদ্ধতিতে নির্মিত খাবারের ওপর ভরসা করে বসে থাকার কোনও প্রয়োজনই হচ্ছে না। আমাদের দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ মা ও সন্তানরা আয়রন এবং ভিটামিন-এ-এর অভাবের কারণে বিভিন্ন রোগের শিকার হয়ে থাকেন। বলে রাখা প্রয়োজন, মাছ থেকে কিন্তু খুব সহজেই এই সমস্যার সমাধান ঘটতে পারে। সম্প্রতি ইউরোপ মধ্যস্থ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলিতে এক ধরনের ডায়েটের বেশ প্রচলন হয়েছে। এই ডায়েটের নাম ‘পেসকেটেরিয়ান ডায়েট’। ইতালিতে মাছকে বলা হয় ‘পিসেস’। পিসেসের বিশেষণ হল পেসকেটেরিয়ান, অর্থাৎ মৎস্যনির্ভর ডায়েট। আমার বক্তব্য হল অনতিবিলম্বে আমাদের দেশেও এই ডায়েট মানুষজনের অনুসরণ করা উচিত। প্রতিদিন যত কমই হোক খাদ্যতালিকায় একটি করে মাছ থাকবে। তাতে কেবল শরীরে আয়রনের ঘাটতির সমস্যাই নয়, মুক্তি মিলবে স্থুলতা বা ওবেসিটির সমস্যা থেকেও। স্থুলতা হল দিনের পর দিন ভুল ডায়েট মেনে চলার ফসল, যা তৈরি হয় মূলত মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস বা অনুপুষ্টির ঘাটতির কারণে। মাছ থেকে আপনি পাবেন এমন কিছু অণুপুষ্টি যা অন্য কোনও খাবার থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। মাছে রয়েছে বিভিন্ন রকম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং প্রোটিন ছাড়া এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ, যার নাম হল ‘কোলিন’। এই ‘কোলিন’ এবং ভিটামিন-বি টুয়েলভ-এর মতো কিছু মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস আপনাকে স্থুলতার সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে খুব সহজেই।
অনেকেই বলেন যে পাঁচ বছর বয়সের পর আর নতুন স্নায়ু তৈরি হয় না। তাঁরা হয়তো এটা জানেন না, নতুন স্নায়ু তৈরি না হলেও স্নায়ুর প্রচুর শাখা-প্রশাখা কিন্তু তৈরি হতেই থাকে। এই নব্যনির্মিক স্নায়ুর শাখা-প্রশাখা স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। স্নায়ুর অতিরিক্ত শাখা-প্রশাখা তৈরি হওয়ার পেছনেও কিন্তু অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে মাছ। শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের ফলে আমাদের শরীরের বিভিন্ন ‘ফ্রি-রেডিকেলস’ তৈরি হয়। সেই ‘ফ্রি-রেডিকেলস’ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে তোলে ক্রমাগত। এ ‘ফ্রি-রেডিকেলস’ নির্মূল করার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আমরা পেতে পারি মাছের মাধ্যমে।
আমরা খুব গর্ব করে বলি, ‘বাঙালি মাছেভাতে৷’ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই প্রবাদের যথার্থতা প্রমাণ করতে পারিনি সবক্ষেত্রে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, বাংলার তুলনায় কিন্তু কেরালা এবং ত্রিপুরা মাছ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বহুগুণ এগিয়ে। আমার ব্যক্তিগত মত অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রতিবছর যেভাবে বৃক্ষসৃজন পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রয়োগ করা হয়, সেইভাবে আমাদের মৎস্যসৃজন পরিকল্পনাও গ্রহণ করা উচিত। আমাদের যে দেশি মাছের পর্যাপ্ত ভাণ্ডার রয়েছে তাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে এই রাজ্যের অধিকাংশ প্রান্তিক অবস্থানে থাকা মানুষজন বংশপরম্পরায় যে অপুষ্টির কারণে ভুগছেন, খুব সহজেই সেই অভাবের উচ্চমুখী গ্রাফটি সম্পূর্ণমাত্রায় নির্মূল করা না গেলেও অনেকাংশেই নিম্নমুখী হবে, সে বিষয়ে আমাদের কোনও সন্দেহ নেই। সুস্থ ভারত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মৎস্যনির্ভর ডায়েটের কিন্তু বিকল্প সত্যিই মেলা ভার।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।
প্রথমত, এই ধরনের খাবারগুলি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয় না যেহেতু, সেহেতু সবক্ষেত্রে এর উপকারিতা নিয়ে সন্দেহমুক্ত হওয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত, আমাদের বাজারে সাধারণ ফুলকপি যদি ১০ টাকা দামে বিক্রি হয় তবে বায়োফর্টিফায়েড পদ্ধতিতে তৈরি ফুলকপি বিক্রি হয় ২০ টাকা দামে অর্থাৎ দ্বিগুণের বেশি দামে।
সুতরাং যে সমস্ত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষদের সবথেকে বেশি প্রয়োজন এই জাতীয় খাবারগুলি, অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে তাঁদের পক্ষেই তা কেনা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তার থেকে যদি আমাদের যে দেশি মাছের সম্ভার রয়েছে সেদিকে মনোযোগ দিই তাহলে দেখতে পাব যে আলাদা করে বায়োফর্টিফায়েড পদ্ধতিতে নির্মিত খাবারের ওপর ভরসা করে বসে থাকার কোনও প্রয়োজনই হচ্ছে না। আমাদের দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ মা ও সন্তানরা আয়রন এবং ভিটামিন-এ-এর অভাবের কারণে বিভিন্ন রোগের শিকার হয়ে থাকেন। বলে রাখা প্রয়োজন, মাছ থেকে কিন্তু খুব সহজেই এই সমস্যার সমাধান ঘটতে পারে। সম্প্রতি ইউরোপ মধ্যস্থ ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলিতে এক ধরনের ডায়েটের বেশ প্রচলন হয়েছে। এই ডায়েটের নাম ‘পেসকেটেরিয়ান ডায়েট’। ইতালিতে মাছকে বলা হয় ‘পিসেস’। পিসেসের বিশেষণ হল পেসকেটেরিয়ান, অর্থাৎ মৎস্যনির্ভর ডায়েট। আমার বক্তব্য হল অনতিবিলম্বে আমাদের দেশেও এই ডায়েট মানুষজনের অনুসরণ করা উচিত। প্রতিদিন যত কমই হোক খাদ্যতালিকায় একটি করে মাছ থাকবে। তাতে কেবল শরীরে আয়রনের ঘাটতির সমস্যাই নয়, মুক্তি মিলবে স্থুলতা বা ওবেসিটির সমস্যা থেকেও। স্থুলতা হল দিনের পর দিন ভুল ডায়েট মেনে চলার ফসল, যা তৈরি হয় মূলত মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস বা অনুপুষ্টির ঘাটতির কারণে। মাছ থেকে আপনি পাবেন এমন কিছু অণুপুষ্টি যা অন্য কোনও খাবার থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। মাছে রয়েছে বিভিন্ন রকম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং প্রোটিন ছাড়া এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ, যার নাম হল ‘কোলিন’। এই ‘কোলিন’ এবং ভিটামিন-বি টুয়েলভ-এর মতো কিছু মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস আপনাকে স্থুলতার সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে খুব সহজেই।
অনেকেই বলেন যে পাঁচ বছর বয়সের পর আর নতুন স্নায়ু তৈরি হয় না। তাঁরা হয়তো এটা জানেন না, নতুন স্নায়ু তৈরি না হলেও স্নায়ুর প্রচুর শাখা-প্রশাখা কিন্তু তৈরি হতেই থাকে। এই নব্যনির্মিক স্নায়ুর শাখা-প্রশাখা স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। স্নায়ুর অতিরিক্ত শাখা-প্রশাখা তৈরি হওয়ার পেছনেও কিন্তু অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে মাছ। শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণের ফলে আমাদের শরীরের বিভিন্ন ‘ফ্রি-রেডিকেলস’ তৈরি হয়। সেই ‘ফ্রি-রেডিকেলস’ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে তোলে ক্রমাগত। এ ‘ফ্রি-রেডিকেলস’ নির্মূল করার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আমরা পেতে পারি মাছের মাধ্যমে।
আমরা খুব গর্ব করে বলি, ‘বাঙালি মাছেভাতে৷’ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই প্রবাদের যথার্থতা প্রমাণ করতে পারিনি সবক্ষেত্রে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, বাংলার তুলনায় কিন্তু কেরালা এবং ত্রিপুরা মাছ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বহুগুণ এগিয়ে। আমার ব্যক্তিগত মত অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রতিবছর যেভাবে বৃক্ষসৃজন পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রয়োগ করা হয়, সেইভাবে আমাদের মৎস্যসৃজন পরিকল্পনাও গ্রহণ করা উচিত। আমাদের যে দেশি মাছের পর্যাপ্ত ভাণ্ডার রয়েছে তাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে এই রাজ্যের অধিকাংশ প্রান্তিক অবস্থানে থাকা মানুষজন বংশপরম্পরায় যে অপুষ্টির কারণে ভুগছেন, খুব সহজেই সেই অভাবের উচ্চমুখী গ্রাফটি সম্পূর্ণমাত্রায় নির্মূল করা না গেলেও অনেকাংশেই নিম্নমুখী হবে, সে বিষয়ে আমাদের কোনও সন্দেহ নেই। সুস্থ ভারত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মৎস্যনির্ভর ডায়েটের কিন্তু বিকল্প সত্যিই মেলা ভার।
* বাঙালির মৎস্যপুরাণ (Bangalir Matsya Purana – Fish) : ড. প্রতাপ মুখোপাধ্যায় (Pratap Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান মৎস্যবিজ্ঞানী, ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ, ভারত সরকার।