শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

জনমেজয় আখ্যান শুনছেন। কখনও কখনও সৌতির যন্ত্রবত্‍ বলে যাওয়া গল্প তাঁকে পরিতৃপ্তি দেয় না। তিনি আরও প্রশ্ন করেন। জনমেজয় জানতে চান, শূদ্রাদাসীর গর্ভে বেদব্যাসের যে পুত্রের জন্ম হল, তিনি নাকি স্বয়ং ধর্মরাজ। কেন তাঁর এমন মনুষ্যজন্ম? কেনই বা এমন অসম্মানের পরিচয় তাঁকে বইতে হয়েছিল।

জনমেজয়ের প্রশ্ন শুনে সৌতি হয়তো মনে মনেই মৃদু হাসেন। রাজার মনের ভাব হয়তো তিনি কতকটা অনুধাবন করেন। তিনি এও জানেন যে, তিনি নিরূপায় গল্পকথক মাত্র। কতশত আখ্যান-এর ভার তিনি বয়ে নিয়ে চলেছেন। বিদ্বজ্জনসমাজে বলতে পারলে তাঁর লাভ বই ক্ষতি নেই। প্রশ্ন উত্তর আলোচনার মাধ্যমে হয়তো নিজের সংশয়েরও নিরসন সম্ভব! তবে রাজাকে তিনি নিরাশ করেন না। রাজার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ধর্মরাজের এমন মনুষ্যজন্মের কারণ তিনি নিজেই। জনমেজয়ের দুচোখে প্রশ্ন দেখে তিনি বলেন, সে অনেককাল আগের ঘটনা। মাণ্ডব্য নামে একজন ধর্মপরায়ণ, সত্যবাদী, নিজলক্ষ্যে অবিচল, তপস্বী ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি নিজের আশ্রমের দ্বারস্থিত এক গাছের অধোদেশে তপস্যা করছিলেন। কোনও একদিন মৌনী এই সাধকের আশ্রমে কয়েকটি চোর চুরি করে উপস্থিত হল। সেই চোরদের আবার পশ্চাদ্ধাবন করেছিল কয়েকজন রক্ষী। সে কথা চোরেরা টের পেয়ে মাণ্ডব্যের আশ্রমে চুরি করা ধন এনে রাখল। মাণ্ডব্য সমস্ত ঘটনাই প্রত্যক্ষ করলেন। কিন্তু তিনি মৌনী ছিলেন, তদুপরি তপোরত ছিলেন, তাই কোনও মন্তব্য করলেন না। এরপর রক্ষীরা চোরেদের পিছনে সেই আশ্রমে প্রবেশ করে লুকিয়ে থাকা চোরেদের খুঁজে বের করল আর চুরি যাওয়া ধনও খুঁজে পেয়ে গেল। তারা মাণ্ডব্যকে তপস্বী বলে চিনতে পারেনি। বরং তাঁকেও চোর মনে করে চোরেদের সঙ্গে ধরে বেঁধে নিয়ে গেল রাজার কাছে। মাণ্ডব্যমুনি তখনও নিরুত্তর। রাজা সব দেখেশুনে বিচার করে চোরেদের সঙ্গে সঙ্গে মাণ্ডব্যমুনিকে বধের আদেশ দিলেন। যথাসময় রাজপুরুষেরা চোরেদের সঙ্গে মাণ্ডব্যমুনিকে শূলে চড়িয়ে দিল। শূলে বদ্ধ চোরেদের মৃত্যু হলেও ধর্মপরায়ণ মাণ্ডব্য মুনি দীর্ঘকাল শূলবদ্ধ এবং অনাহারী অবস্থাতেও মৃত্যুবরণ করলেন না।

এদিকে শূলে বদ্ধ অবস্থাতেও মাণ্ডব্যমুনি মৌনী হয়ে তপোমগ্ন রইলেন। কিন্তু একথা কখনও কখনও তাঁরও মনে হল, কেন কীসের জন্যই বা এ দুঃখভোগ! তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল ছিলেন। তাই রাজা অথবা রাজপুরুষদের কিছু বললেন না। তারপর একসময় তিনি তাঁর বন্ধু অন্য মুনিদের স্মরণ করলেন মনে মনেই। তাঁর ডাক শুনে ছুটে এলেন তাঁরা। মাণ্ডব্যমুনির এ দুরবস্থা থেকে যুগপত্‍ হতবাক্‍ ও দুঃখিত হলেন। মৌনী দশাতেই মুনিদের সঙ্গে তাঁর ভাববিনিময় হল। মাণ্ডব্য জানালেন, তিনি তাঁর এই দশার জন্য কাউকেই দোষী সাব্যস্ত করতে চান না। ইতিমধ্যে নগররক্ষী রাজপুরুষদেরও চৈতন্যোদয় হল। কে ইনি? অন্য শূলবদ্ধ চোরেদের যেখানে তৎক্ষণাত্‍ মৃত্যু হয়েছে, ইনি কীভাবেই বা এখনও এমন দুঃসহ অবস্থায় জীবিত আছেন? তারা ডেকে নিয়ে এল রাজাকে। সব কথা জানাল। ততদিনে এত সময় পার হয়ে গেছে যে, রাজারও বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে সবকথা। এমন চুরির অপরাধ তো রাজ্যে কতই ঘটে। শাস্তিও পায় সকলে। কিন্তু এমন অদ্ভুত ঘটনা তো কখনও তিনি শোনেননি। রাজা তৎক্ষণাত্‍ পারিষদসহ মাণ্ডব্যমুনির কাছে এসে হাজির হলেন। করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন তিনি স্বকৃত দুর্ব্যবহারের জন্য। মাণ্ডব্যমুনি জানতেন, এ রাজার অপরাধ নয়। স্বভাবশান্ত মুনি ক্ষমা করলেন। রাজার আদেশে তাঁকে শূল থেকে তৎক্ষণাত্‍ নামানো হল আর শূলের ভাঙা টুকরো যা তখনও মাণ্ডব্যমুনির শরীরে বিদ্ধ হয়েছিল তা বের করবার চেষ্টা করা হল। কিন্তু কোনও মতে বার করা গেল না। অগত্যা রাজপুরুষেরা শূলের যে অংশ শরীরের বাইরে ছিল, তা কেটে দিল। মাণ্ডব্যমুনিও সেই শূলখণ্ড সঙ্গে নিয়েই ছাড়া পেলেন। এর পর থেকে অণী বা শূলাগ্র সঙ্গে থাকার জন্য লোকে তাঁকে অণীমাণ্ডব্য নামে অভিহিত করত।

মহাতপস্বী সেই ব্রাহ্মণ এরপর তপোবলে বহু সাধারণ জনদুর্লভ সুখ লাভ করলেন। শূলাগ্র সঙ্গে করে ভ্রমণ করতে করতে একদিন তাঁর মনে হল কেনই বা আমি বিনাদোষে এমন শাস্তি পাচ্ছি। এ কথার জবাব চাইতে তিনি ধর্মরাজের গৃহে এসে উপস্থিত হলেন। ধর্মরাজ তাঁর কথার উত্তরে জানালেন, মাণ্ডব্য যখন বেশ ছোট, তখন একবার দুষ্টুমির ছলে ফড়িং-এর লেজে নলখাগড়া দিয়ে আঘাত করেছিলেন। তাই তাঁকে এমন ফল ভোগ করতে হল। ছোটছেলের অবোধমনে করা দুষ্টুমি, আর তাকেই পাপ আখ্যা দিয়ে ধর্মরাজ এমন শাস্তি দিলেন? এ যাবৎকাল অবধি তাঁর এ দুর্দশার সঙ্গে যুক্ত সকলকে তিনি মাপ করেছেন, কারণ তিনি জানতেন, এ তাদের সকলের অনিচ্ছাকৃত শাস্তিপ্রদান। মাণ্ডব্য জানতে চাইছিলেন, কে রয়েছে এসবের নেপথ্যে! উত্তরও মিলল অবশেষে। ধর্মরাজের এহেন অবিচার মেনে নিতে পারলেন না মাণ্ডব্যমুনি। অভিশাপ দিলেন ধর্মরাজকে। আরও বললেন, এর পর থেকে জন্ম থেকে বারো বছর অবধি শিশু কোনও অন্যায় করলে সেটা আর অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না।

ধর্মরাজও নিজের ভুল বুঝলেন। মেনে নিলেন এ অভিশাপ। মহর্ষি মাণ্ডব্যের শাপেই ধর্মরাজের শূদ্রাদাসীর গর্ভে মনুষ্যজন্ম। বিদুরই হলেন ধর্মরাজ। মহাত্মা বিদুর ছিলেন ধর্মপরায়ণ, রাজনীতিতে দক্ষ এবং ক্রোধের লেশমাত্র ছিল না তাঁর মনে। হয়তো অনিচ্ছাকৃত সামান্য অপরাধে মুনিকে তিনি যে গুরু দণ্ড দিয়েছিলেন, তাতে তাঁর অনুশোচনা হয়, তাই এমন জীবন স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মাতা বৈবাহিক স্বীকৃতি পাননি বটে, কিন্তু তিনি কিন্তু নিজ বুদ্ধিমত্তা আর স্বভাবের গুণে পাণ্ডবদের সকলের প্রিয় এবং ভরসার আপনজন হয়ে ওঠেন।

Skip to content