কিংবদন্তি চিত্রকর যামিনী রায় ও তাঁর শিল্পকর্ম। ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
রোববার সকালে শ্রদ্ধেয় যামিনী রায়ের বাড়িতে যাওয়া হবে একথা মিহিরদা আমাকে টেলিফোনে জানিয়ে দিলেন৷ জনা চার-পাঁচ ক্লাব সদস্যের নাম চূড়ান্ত হল৷ তাঁদের মধ্যে প্রয়াত ভজন নাগ, বেণীমাধব ভট্টাচার্য, প্রাণবন্ধু নাগ, শান্তিরঞ্জন সাহা, আমিও ছিলাম৷ মিহিরদার সাদা রঙের একটা ফিয়েট গাড়ি ছিল৷ নিজেই ড্রাইভ করতেন৷ ড্রাইভিং ছিল তাঁর প্যাশান৷ সিদ্ধান্ত হল, মিহিরদা তাঁর জাজেস কোর্ট রোডের এলআইসি-র ফ্ল্যাট থেকে সোজা ক্লাব অফিসে এসে আমাদের কয়েকজনকে গাড়িতে তুলবেন৷ তারপর একসঙ্গে বালিগঞ্জে যামিনী রায়ের বাড়িতে যাব৷ স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য ইতিমধ্যেই প্রচুর সাদা খাতা কেনা হয়েছিল৷ লম্বা ধরনের কয়েকশো পাতার বেশ মোটাসোটা একেকটা খাতা৷ তাতে ছাপানো—বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক৷ তেমনই একটা খাতা সঙ্গে নেওয়া হল যামিনী রায়ের স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্দেশে৷
কিংবদন্তি চিত্রকরের জীবনী অনেকেই কমবেশি জানেন৷ সংক্ষেপে কিছু কথা জানিয়ে রাখি৷ ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন যামিনী রায়৷ বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড় গ্রামে বাড়ি৷ উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে ওঠা৷ অন্তর্মুখী স্বভাবের ১৬ বছরের কিশোর কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হন৷ সেই সময় এই কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ কৃতী ছাত্র হিসেবে যামিনী রায়ের সুনাম ছিল৷ অবনীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্র৷
প্রথম জীবনে পাশ্চাত্য চিত্রকলায় প্রভাবিত হলেও একসময় সেই ঘরানা থেকে বেরিয়ে এসে ভারতীয় শিল্পের ভাবধারায় উৎসাহিত হন৷ ল্যান্ডস্কেপ ও পোর্ট্রেটে পেইন্টিং থেকে সরে এসে বাংলার লোকশিল্পের প্রতি আগ্রহ অনুভব করেন৷ প্রাচীন পটশিল্পকে অসাধারণ গুরুত্ব প্রদান করে তুলির টানে অনবদ্য সব চিত্রকর্ম জলরং আর মোটিফের সাহায্যে সৃষ্টি করেছেন৷ আলাদা করে তাঁর অগুনতি চিত্রকর্মের উল্লেখ স্বল্পপরিসরে সম্ভব নয়৷ আদিবাসী ও সাঁওতালি নাচ, গ্রামবাংলার সাধারণ জীবনযাত্রা, বাংলার বধূ, হিন্দু দেবদেবী, কালীঘাটের পট সবরকম চিত্রকর্মই উঠে এসেছে তাঁর সৃষ্টিতে৷ চিত্রকর নন, নিজেকে পটুয়া পরিচয় দিতেই পছন্দ করতেন যামিনী রায়৷ এই যে চিরাচরিত ফর্ম ভেঙে নতুন পথের আবিষ্কার, এখানেই শিল্পীর অনন্যতা৷
চিত্রস্রষ্টারূপে দেশ-বিদেশে খ্যাতিলাভ করেন যামিনী রায়৷ তাঁর সৃষ্টিকে আর্থিক মূল্যে বিচার করা যায় না৷ পেয়েছেন পদ্মভূষণ সম্মান, ভাইসরয় স্বর্ণপদক৷ ললিতকলা অ্যাকাডেমির ‘ফেলো’ হয়েছেন৷ আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করেছেন৷ সব থেকে বড় কথা হল, যিনি এত সম্মান পেয়েছেন, অর্থের প্রতি এতটুকুও মোহ ছিল না তাঁর৷ অনেক চিত্রকর্মই জলের দরে বিক্রি করেছেন মধ্যবিত্তদের কাছে৷ এরকম চিত্রস্রষ্টা বড় একটা দেখা যায় না৷ সব অর্থেই যামিনী রায় ছিলেন আত্মপ্রচারবিমুখ একজন সহজ-সাধারণ মানুষ৷ বালিগঞ্জ যাওয়ার পথে এরকম প্রবাদপ্রতিম একজন শিল্পীকে প্রথম সামনে থেকে দেখার সুযোগ পেতে চলেছি ভেবে মনের ভেতরে আশ্চর্য এক সুখানুভূতি অনুভব করেছিলাম৷
যামিনী রায় তার ড্রইংরুমে বসে ছিলেন। চারদিকের দেওয়ালে শিল্পীর আঁকা ফ্রেমিং করা সব অমূল্য ছবি। সকাল ন’টা। মিহিরদার পিছনে আমরা কয়েকজন। শিল্পীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রথমে মিহিরদা পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। তারপর আমরা। শিল্পী আমাদের মাথা ছুঁয়ে আশীর্বাদের পর বসতে বললেন। ঘরের এক কোণে চেয়ারে বসেছিলেন যামিনী রায়। পরনে ধুতি আর ফতুয়া। একদম সাদামাটা পোশাক। উজ্জ্বল দু’চোখ। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। উন্নত নাসা। মুখমণ্ডলে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। এমনই ব্যক্তিত্ব শিল্পীর সম্ভব নয়, মুহূর্তে শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়। আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা করে কথা বললেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক্সপ্লোরার ক্লাবের কাজকর্মের কথা মিহিরদার মুখে শুনে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। সকলের জন্য জলখাবারের ব্যবস্থা রেখেছিলেন।
কিংবদন্তি চিত্রকর স্মিত হেসে মিহিরদাকে বললেন, ‘এবার আসল কাজটা সেরে ফেলা যাক, কী বল মিহির? মিহিরদাও সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘হ্যাঁ স্যার, সর্বপ্রথম আপনার মূল্যবান স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আমাদের গণস্বাক্ষর অভিযান শুরু করব। আপনি আমাদের আশীর্বাদ করুন।’
মিহিরদা আমাকে বললেন, ‘সুমন, খাতাটা নিয়ে স্যারের কাছে একবার যাও। ওকে বলে দাও কোথায় স্বাক্ষর করবেন। শেষপর্যন্ত কিংবদন্তির অমূল্য স্বাক্ষর আমাকে সংগ্রহ করতে বলে মিহিরদা সেদিন যে স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছিলেন, সেই শুভ মুহূর্তের কথা ভাবলে ৫০ বছর পরেও নস্টালজিয়া এই লেখককে ঘিরে ধরে। যামিনী রায় স্বাক্ষর করেছিলেন বাংলায়। সাদা ধবধবে পাতায় কালো কালিতে করা ওই শৈল্পিক স্বাক্ষর যেন পাতাজুড়ে জ্বলজ্বল করছিল। ৮৪ বছর বয়সেও তার আঙুলগুলো ছিল একই রকম সচল। ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া এরকম হয় না। স্বাক্ষরের পরে শ্রদ্ধেয় চিত্র স্রষ্টা বলেছিলেন আজ মনে হল বাংলাদেশের মানুষের জন্য হয়তো একটা কাজের কাজ করতে।
যামিনী রায়ের স্বাক্ষর নেওয়া হচ্ছে, তার সঙ্গে আমার এরকম একটি অমূল্য সাদাকালো ফটো বন্ধু বেণীমাধবের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলাম। ফটোটা যতন করে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম এই বরণীয় মানুষকে নিয়ে কিছু লেখার সময় ওই ফটো ব্যবহার করব। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার এই যে, আজ যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিংবদন্তি চিত্রস্রষ্টাকে নিয়ে লিখতে বসেছি, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ফটোটা পেলাম না। এটা যে আমার কাছে কতটা বেদনাদায়ক তা আপনাদের বোঝাতে পারব না।
সেদিন শিল্পীর আতিথেয়তার কোথাও ভুলিনি। আমরা ঠিকমতো খাচ্ছি কি না তা দেখার জন্য যামিনী রায় ঠায় বসে রইলেন ড্রইংরুমে। আমরা বিদায় নেবার আগে আবারও প্রণাম করলাম। তিনি আগের মতোই প্রত্যেককে আশীর্বাদ করলেন। প্রসঙ্গত, এরপর এক্সপ্লোরার্স ক্লাবের ছেলেমেয়েরা দ্বিগুণ উৎসাহে গণস্বাক্ষর অভিযানে নেমে পরল। বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভারত স্বীকৃতি দেওয়ার আগে কয়েক মাস ধরে কয়েক লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলাম। এরপর কয়েকশো জাবদা খাতা ট্রাকে ভরে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠানো হয়। এ খবর কলকাতা ও দিল্লির বিভিন্ন দৈনিক খবরের কাগজে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি জানায় যথাক্রমে ভারত এবং ভুটান। এরপর স্বীকৃতি জানিয়েছিল পোল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। যামিনী রায়ের স্বাক্ষর সংগ্রহের পর দু-তিন মাস কেটে গিয়েছে। হঠাৎ মিহিরদা একদিন আমাকে বললেন, তুমি একবার বালিগঞ্জে গিয়ে যামিনী স্যারের সঙ্গে দেখা করে এসো। আমাদের ক্লাবের বাংলাদেশ-সংক্রান্ত কাজকর্মের কথাও একটু জানিয়ে এসো তাঁকে। ভাবছিলাম মিহিরদা তো নিজেই ফোন করে কথা বলতে পারেন বর্ষীয়ান শিল্পীর সঙ্গে। তাহলে আমাকে কেন পাঠাচ্ছেন? অবশ্য এর উত্তর জানার ধৃষ্টতা আমার ছিল না। তাঁর নির্দেশ আমি কোনওদিন অমান্য করিনি। যামিনী রায়ের সান্নিধ্য পাওয়া তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। একদিন শ্রদ্ধেয় শিল্পীর সঙ্গে খানিকক্ষণ কাটিয়েছিলাম। তিনি বাংলাদেশের নানান খবরাখবর জানতে চাইলেন। সস্নেহে বলেছিলেন, সময় করে আবার এসো। সেদিন তার কিছু শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার।
বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভারত স্বীকৃতি জানাবার পর গোটা দেশজুড়ে খুশির হাওয়া বয়ে গিয়েছিল। ৭ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে ফোন করে যামিনী রায়ের বাড়িতে ফুল আর মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখে হাসিমুখে বললেন, ‘ভারত তাহলে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দিল, কী বলো? আজ সত্যিই আমাদের আনন্দের দিন। তোমাদের জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচি সাফল্য লাভ করল। কথা বলতে বলতে সারা মুখে খুশির আভা ছড়িয়ে পড়েছিল প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর। তারপর ফুল মিষ্টি দেখে একটু কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, এসব আবার সঙ্গে আনতে গেলে কেন? বললাম, আমাদের ক্লাবের তরফ থেকে জট সামান্য উপহার আপনার জন্য। আপনি গ্রহণ করলে আমাদের ভালো লাগবে।
যামিনী রায়ের মতো এক কিংবদন্তির স্মরণীয় সঙ্গ আজও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। পরে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, যামিনী রায় সঙ্গে তাঁর কাজ বা ভারতীয় চিত্রকলা নিয়ে তোমার কোনও কথা হয়নি? তাদের কথা শুনে আমার হাসি পেয়েছিল। পাবে নাই-বা কেন? তখন আমার বয়স সবে আঠারো। ভারতীয় চিত্রকলা নিয়ে কীই-বা জানি! যামিনী রায়ের মতো এক প্রবাদপ্রতিমের স্নেহলাভ করেছিলাম সেটাই তো চিরসম্পদ আমার! ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি পরলোকগমন করেন।
কিংবদন্তি চিত্রকরের জীবনী অনেকেই কমবেশি জানেন৷ সংক্ষেপে কিছু কথা জানিয়ে রাখি৷ ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন যামিনী রায়৷ বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড় গ্রামে বাড়ি৷ উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে ওঠা৷ অন্তর্মুখী স্বভাবের ১৬ বছরের কিশোর কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হন৷ সেই সময় এই কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ কৃতী ছাত্র হিসেবে যামিনী রায়ের সুনাম ছিল৷ অবনীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্র৷
প্রথম জীবনে পাশ্চাত্য চিত্রকলায় প্রভাবিত হলেও একসময় সেই ঘরানা থেকে বেরিয়ে এসে ভারতীয় শিল্পের ভাবধারায় উৎসাহিত হন৷ ল্যান্ডস্কেপ ও পোর্ট্রেটে পেইন্টিং থেকে সরে এসে বাংলার লোকশিল্পের প্রতি আগ্রহ অনুভব করেন৷ প্রাচীন পটশিল্পকে অসাধারণ গুরুত্ব প্রদান করে তুলির টানে অনবদ্য সব চিত্রকর্ম জলরং আর মোটিফের সাহায্যে সৃষ্টি করেছেন৷ আলাদা করে তাঁর অগুনতি চিত্রকর্মের উল্লেখ স্বল্পপরিসরে সম্ভব নয়৷ আদিবাসী ও সাঁওতালি নাচ, গ্রামবাংলার সাধারণ জীবনযাত্রা, বাংলার বধূ, হিন্দু দেবদেবী, কালীঘাটের পট সবরকম চিত্রকর্মই উঠে এসেছে তাঁর সৃষ্টিতে৷ চিত্রকর নন, নিজেকে পটুয়া পরিচয় দিতেই পছন্দ করতেন যামিনী রায়৷ এই যে চিরাচরিত ফর্ম ভেঙে নতুন পথের আবিষ্কার, এখানেই শিল্পীর অনন্যতা৷
চিত্রস্রষ্টারূপে দেশ-বিদেশে খ্যাতিলাভ করেন যামিনী রায়৷ তাঁর সৃষ্টিকে আর্থিক মূল্যে বিচার করা যায় না৷ পেয়েছেন পদ্মভূষণ সম্মান, ভাইসরয় স্বর্ণপদক৷ ললিতকলা অ্যাকাডেমির ‘ফেলো’ হয়েছেন৷ আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করেছেন৷ সব থেকে বড় কথা হল, যিনি এত সম্মান পেয়েছেন, অর্থের প্রতি এতটুকুও মোহ ছিল না তাঁর৷ অনেক চিত্রকর্মই জলের দরে বিক্রি করেছেন মধ্যবিত্তদের কাছে৷ এরকম চিত্রস্রষ্টা বড় একটা দেখা যায় না৷ সব অর্থেই যামিনী রায় ছিলেন আত্মপ্রচারবিমুখ একজন সহজ-সাধারণ মানুষ৷ বালিগঞ্জ যাওয়ার পথে এরকম প্রবাদপ্রতিম একজন শিল্পীকে প্রথম সামনে থেকে দেখার সুযোগ পেতে চলেছি ভেবে মনের ভেতরে আশ্চর্য এক সুখানুভূতি অনুভব করেছিলাম৷
যামিনী রায় তার ড্রইংরুমে বসে ছিলেন। চারদিকের দেওয়ালে শিল্পীর আঁকা ফ্রেমিং করা সব অমূল্য ছবি। সকাল ন’টা। মিহিরদার পিছনে আমরা কয়েকজন। শিল্পীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রথমে মিহিরদা পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। তারপর আমরা। শিল্পী আমাদের মাথা ছুঁয়ে আশীর্বাদের পর বসতে বললেন। ঘরের এক কোণে চেয়ারে বসেছিলেন যামিনী রায়। পরনে ধুতি আর ফতুয়া। একদম সাদামাটা পোশাক। উজ্জ্বল দু’চোখ। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। উন্নত নাসা। মুখমণ্ডলে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। এমনই ব্যক্তিত্ব শিল্পীর সম্ভব নয়, মুহূর্তে শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়। আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা করে কথা বললেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক্সপ্লোরার ক্লাবের কাজকর্মের কথা মিহিরদার মুখে শুনে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। সকলের জন্য জলখাবারের ব্যবস্থা রেখেছিলেন।
কিংবদন্তি চিত্রকর স্মিত হেসে মিহিরদাকে বললেন, ‘এবার আসল কাজটা সেরে ফেলা যাক, কী বল মিহির? মিহিরদাও সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘হ্যাঁ স্যার, সর্বপ্রথম আপনার মূল্যবান স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আমাদের গণস্বাক্ষর অভিযান শুরু করব। আপনি আমাদের আশীর্বাদ করুন।’
মিহিরদা আমাকে বললেন, ‘সুমন, খাতাটা নিয়ে স্যারের কাছে একবার যাও। ওকে বলে দাও কোথায় স্বাক্ষর করবেন। শেষপর্যন্ত কিংবদন্তির অমূল্য স্বাক্ষর আমাকে সংগ্রহ করতে বলে মিহিরদা সেদিন যে স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছিলেন, সেই শুভ মুহূর্তের কথা ভাবলে ৫০ বছর পরেও নস্টালজিয়া এই লেখককে ঘিরে ধরে। যামিনী রায় স্বাক্ষর করেছিলেন বাংলায়। সাদা ধবধবে পাতায় কালো কালিতে করা ওই শৈল্পিক স্বাক্ষর যেন পাতাজুড়ে জ্বলজ্বল করছিল। ৮৪ বছর বয়সেও তার আঙুলগুলো ছিল একই রকম সচল। ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া এরকম হয় না। স্বাক্ষরের পরে শ্রদ্ধেয় চিত্র স্রষ্টা বলেছিলেন আজ মনে হল বাংলাদেশের মানুষের জন্য হয়তো একটা কাজের কাজ করতে।
যামিনী রায়ের স্বাক্ষর নেওয়া হচ্ছে, তার সঙ্গে আমার এরকম একটি অমূল্য সাদাকালো ফটো বন্ধু বেণীমাধবের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলাম। ফটোটা যতন করে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম এই বরণীয় মানুষকে নিয়ে কিছু লেখার সময় ওই ফটো ব্যবহার করব। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার এই যে, আজ যখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিংবদন্তি চিত্রস্রষ্টাকে নিয়ে লিখতে বসেছি, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ফটোটা পেলাম না। এটা যে আমার কাছে কতটা বেদনাদায়ক তা আপনাদের বোঝাতে পারব না।
সেদিন শিল্পীর আতিথেয়তার কোথাও ভুলিনি। আমরা ঠিকমতো খাচ্ছি কি না তা দেখার জন্য যামিনী রায় ঠায় বসে রইলেন ড্রইংরুমে। আমরা বিদায় নেবার আগে আবারও প্রণাম করলাম। তিনি আগের মতোই প্রত্যেককে আশীর্বাদ করলেন। প্রসঙ্গত, এরপর এক্সপ্লোরার্স ক্লাবের ছেলেমেয়েরা দ্বিগুণ উৎসাহে গণস্বাক্ষর অভিযানে নেমে পরল। বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভারত স্বীকৃতি দেওয়ার আগে কয়েক মাস ধরে কয়েক লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলাম। এরপর কয়েকশো জাবদা খাতা ট্রাকে ভরে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠানো হয়। এ খবর কলকাতা ও দিল্লির বিভিন্ন দৈনিক খবরের কাগজে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি জানায় যথাক্রমে ভারত এবং ভুটান। এরপর স্বীকৃতি জানিয়েছিল পোল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। যামিনী রায়ের স্বাক্ষর সংগ্রহের পর দু-তিন মাস কেটে গিয়েছে। হঠাৎ মিহিরদা একদিন আমাকে বললেন, তুমি একবার বালিগঞ্জে গিয়ে যামিনী স্যারের সঙ্গে দেখা করে এসো। আমাদের ক্লাবের বাংলাদেশ-সংক্রান্ত কাজকর্মের কথাও একটু জানিয়ে এসো তাঁকে। ভাবছিলাম মিহিরদা তো নিজেই ফোন করে কথা বলতে পারেন বর্ষীয়ান শিল্পীর সঙ্গে। তাহলে আমাকে কেন পাঠাচ্ছেন? অবশ্য এর উত্তর জানার ধৃষ্টতা আমার ছিল না। তাঁর নির্দেশ আমি কোনওদিন অমান্য করিনি। যামিনী রায়ের সান্নিধ্য পাওয়া তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। একদিন শ্রদ্ধেয় শিল্পীর সঙ্গে খানিকক্ষণ কাটিয়েছিলাম। তিনি বাংলাদেশের নানান খবরাখবর জানতে চাইলেন। সস্নেহে বলেছিলেন, সময় করে আবার এসো। সেদিন তার কিছু শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার।
বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভারত স্বীকৃতি জানাবার পর গোটা দেশজুড়ে খুশির হাওয়া বয়ে গিয়েছিল। ৭ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে ফোন করে যামিনী রায়ের বাড়িতে ফুল আর মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখে হাসিমুখে বললেন, ‘ভারত তাহলে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দিল, কী বলো? আজ সত্যিই আমাদের আনন্দের দিন। তোমাদের জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচি সাফল্য লাভ করল। কথা বলতে বলতে সারা মুখে খুশির আভা ছড়িয়ে পড়েছিল প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর। তারপর ফুল মিষ্টি দেখে একটু কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, এসব আবার সঙ্গে আনতে গেলে কেন? বললাম, আমাদের ক্লাবের তরফ থেকে জট সামান্য উপহার আপনার জন্য। আপনি গ্রহণ করলে আমাদের ভালো লাগবে।
যামিনী রায়ের মতো এক কিংবদন্তির স্মরণীয় সঙ্গ আজও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। পরে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, যামিনী রায় সঙ্গে তাঁর কাজ বা ভারতীয় চিত্রকলা নিয়ে তোমার কোনও কথা হয়নি? তাদের কথা শুনে আমার হাসি পেয়েছিল। পাবে নাই-বা কেন? তখন আমার বয়স সবে আঠারো। ভারতীয় চিত্রকলা নিয়ে কীই-বা জানি! যামিনী রায়ের মতো এক প্রবাদপ্রতিমের স্নেহলাভ করেছিলাম সেটাই তো চিরসম্পদ আমার! ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি পরলোকগমন করেন।