অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন নর্মাল স্কুলের ছাত্র। নিতান্তই বালক বয়সে তাঁর হয়েছিল এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা। সাহেবসুলভ উচ্চারণে ‘পুডিং’কে ‘পাডিং’ না বলে প্রবলভাবে তিরস্কৃত হয়েছিলেন। বকাঝকা নয়, সাহেব-মাস্টারমশায়ের সেই হৃদয়হীন প্রহার পিতা গুণেন্দ্রনাথেরও মর্মযন্ত্রণার কারণ হয়ে ওঠে৷ ঢের হয়েছে, আর স্কুলে নয়, ব্যবস্থা হয়েছিল গৃহশিক্ষার। অবনীন্দ্রনাথের নিজেই বলেছেন, ‘এক ‘পাডিং’-এই ইংরেজি বিদ্যে শেষ।’
স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলেও শেষ হয়নি ইংরেজির চর্চা। সে-চর্চা চলেছিল বাড়িতে। পিতার মৃত্যুর পর সেন্ট জেভিয়ার্সে নিয়েছিলেন ইংরেজির পাঠ। অচিরেই ইংরেজি ভাষাতেও অবনীন্দ্রনাথ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। শিল্পরসিক সাহেবসুবোর অভাব ছিল না। তাঁরা কেউ কেউ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের বন্ধুস্থানীয়। লাটসাহেবদের সঙ্গে তো ছিল রীতিমতো বন্ধুত্ব! হ্যাভেল, গিলডি ও পামারের সঙ্গেও বড় আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। শিল্পের হাল-হকিকত নিয়ে কত আলাপচারিতা! কথার পিঠে কথা বসে আড্ডা ক্রমেই দীর্ঘ হয়ে উঠত। সাহেবসুবোদের সঙ্গে এই গল্পগাছা যে সারাক্ষণই বাংলায় হত, তা নয়। মূলত ইংরেজিতে, কখনও কখনও অবশ্য বাংলারও স্বতঃস্ফূর্ত অনুপ্রবেশ ঘটত।
বালক-বয়সে নর্মাল স্কুলের নিদারুণ অভিজ্ঞতার পর ‘ইংরেজি বিদ্যে শেষ’ মনে হলেও পরবর্তীকালে অবনীন্দ্রনাথ ওই ভাষাটি যথেষ্টই আয়ত্ত করেছিলেন। ইংরেজির প্রতি বাড়তি আনুগত্য কখনও দেখাননি। বাংলা ভাষার প্রতি ছিল তাঁর হৃদয়-উৎসারিত ভালোবাসা।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সে-সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। এই বিদ্বান মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত তেজোময়। লোকে বলত ‘বাংলার বাঘ’। ইংরেজও তাঁকে সমীহ করে চলত। তিনি ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের বন্ধু। পরস্পরের মধ্যে ছিল সৌহার্দ্যের সম্পর্ক। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সক্রিয় ভূমিকা না নিলে অবনীন্দ্রনাথের ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’ বইটিই আমরা পেতাম না। শিল্পতত্ত্ব নিয়ে অবনীন্দ্রনাথের ভাবনা যে কত মৌলিক, তা আমাদের অজানাই থেকে যেত। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আন্তরিক আগ্রহে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি ‘বাগেশ্বরী অধ্যাপক’ হয়েছিলেন।
শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ যে ভারতীয় শিল্পকলার অধ্যাপক পদে যোগ্যতম, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মনে-প্রাণে তা বিশ্বাস করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পথে আসীন হওয়ার পর অবনীন্দ্রনাথ শিল্প নিয়ে উনতিরিশটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বক্তৃতাগুলি পরে ছাপা হয়েছিল ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায়। পত্রিকাটি মূলত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পুত্রদের দ্বারা পরিচালিত হত। বহু স্মরণীয় রচনা এই পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। শরৎচন্দ্রের অবিস্মরণীয় ‘মহেশ’ গল্পটি ‘বঙ্গবাণী’তেই প্রথম ছাপা হয়।
দিনের পর দিন বক্তৃতা দেওয়ার গুরুদায়িত্ব অবনীন্দ্রনাথ প্রথমে নিতে চাননি। এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে যেতে পারেননি। বন্ধু আশুতোষের অনুরোধ মেনে নিয়ে রাজি হতে হয়েছিল। ফাঁকি দিয়ে দায়সারা বক্তৃতা দেননি তিনি। বিস্তর পড়াশোনা করেছিলেন। অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঙ্গে মিশেছিল আপন মনের মাধুরী। এইসব বক্তৃতা নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ রানি চন্দকে বলেছিলেন, ‘কম খেটেছি এই প্রবন্ধগুলির জন্য?… কত বই, কত শাস্ত্র পড়তে হয়েছে, স্টাডি করতে হয়েছে। এই লেকচারগুলি তৈরি করা কি মুখের কথা ছিল?’
অবনীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দিয়েছিলেন বাংলায়। উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় অনুরোধেরও ইংরেজিতে বলেননি। আশুতোষ অবনীন্দ্রনাথকে জানিয়েছিলেন, তাঁর বক্তৃতা শুনতে আসতে চেয়েছেন লড রিচার্ড। আসবেন উচ্চপদস্থ ইংরেজ আমলারা। তাঁরা তো কেউ বাংলা বুঝবেন না, তাই ইংরেজিতে বললেই ভালো হয়!
বাংলা ভাষা কি কম সমৃদ্ধ! ছাত্র-ছাত্রীরা অধিকাংশই তো বাঙালি, তবে কেন ওই মুষ্টিমেয় কয়েকজন সাদা চামড়ার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বলতে হবে? স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই। অবনীন্দ্রনাথ সোজাসাপটা জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি কিছুতেই বাংলা ছেড়ে ইংরেজিতে বলবেন না!
কী আর করা যাবে! শেষে সাহেবসুবোদের আসতেই বারণ করতে হল। উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় একটু বিপাকে পড়লেন বটে, বন্ধু অবনীন্দ্রনাথের দাবি শেষ পর্যন্ত অবশ্য মেনে নিলেন। বন্ধু যা বলছেন, তা তো বাংলা ভাষাকে ভালোবেসেই বলছেন! এই ভালোবাসায় যে কোনও খাদ নেই, তা তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি নিজেও কি কম বাংলা ভাষাপ্রেমী!
স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলেও শেষ হয়নি ইংরেজির চর্চা। সে-চর্চা চলেছিল বাড়িতে। পিতার মৃত্যুর পর সেন্ট জেভিয়ার্সে নিয়েছিলেন ইংরেজির পাঠ। অচিরেই ইংরেজি ভাষাতেও অবনীন্দ্রনাথ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। শিল্পরসিক সাহেবসুবোর অভাব ছিল না। তাঁরা কেউ কেউ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের বন্ধুস্থানীয়। লাটসাহেবদের সঙ্গে তো ছিল রীতিমতো বন্ধুত্ব! হ্যাভেল, গিলডি ও পামারের সঙ্গেও বড় আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। শিল্পের হাল-হকিকত নিয়ে কত আলাপচারিতা! কথার পিঠে কথা বসে আড্ডা ক্রমেই দীর্ঘ হয়ে উঠত। সাহেবসুবোদের সঙ্গে এই গল্পগাছা যে সারাক্ষণই বাংলায় হত, তা নয়। মূলত ইংরেজিতে, কখনও কখনও অবশ্য বাংলারও স্বতঃস্ফূর্ত অনুপ্রবেশ ঘটত।
বালক-বয়সে নর্মাল স্কুলের নিদারুণ অভিজ্ঞতার পর ‘ইংরেজি বিদ্যে শেষ’ মনে হলেও পরবর্তীকালে অবনীন্দ্রনাথ ওই ভাষাটি যথেষ্টই আয়ত্ত করেছিলেন। ইংরেজির প্রতি বাড়তি আনুগত্য কখনও দেখাননি। বাংলা ভাষার প্রতি ছিল তাঁর হৃদয়-উৎসারিত ভালোবাসা।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সে-সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। এই বিদ্বান মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত তেজোময়। লোকে বলত ‘বাংলার বাঘ’। ইংরেজও তাঁকে সমীহ করে চলত। তিনি ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের বন্ধু। পরস্পরের মধ্যে ছিল সৌহার্দ্যের সম্পর্ক। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সক্রিয় ভূমিকা না নিলে অবনীন্দ্রনাথের ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’ বইটিই আমরা পেতাম না। শিল্পতত্ত্ব নিয়ে অবনীন্দ্রনাথের ভাবনা যে কত মৌলিক, তা আমাদের অজানাই থেকে যেত। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আন্তরিক আগ্রহে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি ‘বাগেশ্বরী অধ্যাপক’ হয়েছিলেন।
শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ যে ভারতীয় শিল্পকলার অধ্যাপক পদে যোগ্যতম, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মনে-প্রাণে তা বিশ্বাস করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পথে আসীন হওয়ার পর অবনীন্দ্রনাথ শিল্প নিয়ে উনতিরিশটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বক্তৃতাগুলি পরে ছাপা হয়েছিল ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায়। পত্রিকাটি মূলত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পুত্রদের দ্বারা পরিচালিত হত। বহু স্মরণীয় রচনা এই পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। শরৎচন্দ্রের অবিস্মরণীয় ‘মহেশ’ গল্পটি ‘বঙ্গবাণী’তেই প্রথম ছাপা হয়।
দিনের পর দিন বক্তৃতা দেওয়ার গুরুদায়িত্ব অবনীন্দ্রনাথ প্রথমে নিতে চাননি। এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে যেতে পারেননি। বন্ধু আশুতোষের অনুরোধ মেনে নিয়ে রাজি হতে হয়েছিল। ফাঁকি দিয়ে দায়সারা বক্তৃতা দেননি তিনি। বিস্তর পড়াশোনা করেছিলেন। অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঙ্গে মিশেছিল আপন মনের মাধুরী। এইসব বক্তৃতা নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ রানি চন্দকে বলেছিলেন, ‘কম খেটেছি এই প্রবন্ধগুলির জন্য?… কত বই, কত শাস্ত্র পড়তে হয়েছে, স্টাডি করতে হয়েছে। এই লেকচারগুলি তৈরি করা কি মুখের কথা ছিল?’
অবনীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দিয়েছিলেন বাংলায়। উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় অনুরোধেরও ইংরেজিতে বলেননি। আশুতোষ অবনীন্দ্রনাথকে জানিয়েছিলেন, তাঁর বক্তৃতা শুনতে আসতে চেয়েছেন লড রিচার্ড। আসবেন উচ্চপদস্থ ইংরেজ আমলারা। তাঁরা তো কেউ বাংলা বুঝবেন না, তাই ইংরেজিতে বললেই ভালো হয়!
বাংলা ভাষা কি কম সমৃদ্ধ! ছাত্র-ছাত্রীরা অধিকাংশই তো বাঙালি, তবে কেন ওই মুষ্টিমেয় কয়েকজন সাদা চামড়ার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বলতে হবে? স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই। অবনীন্দ্রনাথ সোজাসাপটা জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি কিছুতেই বাংলা ছেড়ে ইংরেজিতে বলবেন না!
কী আর করা যাবে! শেষে সাহেবসুবোদের আসতেই বারণ করতে হল। উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় একটু বিপাকে পড়লেন বটে, বন্ধু অবনীন্দ্রনাথের দাবি শেষ পর্যন্ত অবশ্য মেনে নিলেন। বন্ধু যা বলছেন, তা তো বাংলা ভাষাকে ভালোবেসেই বলছেন! এই ভালোবাসায় যে কোনও খাদ নেই, তা তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি নিজেও কি কম বাংলা ভাষাপ্রেমী!
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
উপাচার্যকে অবজ্ঞা, এমন ভেবে নিয়ে তাই ভুলেও আশুতোষ মুখোপাধ্যায় রুষ্ট হননি, বরং বন্ধুর বাংলা প্রীতি তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। অবনীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
প্রথম দিনের বক্তৃতা শুনে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় অনুভব করেছিলেন, মাতৃভাষা ছাড়া এত শক্ত কথা এমন সহজ করে বলা সম্ভব নয়। বাহবা দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথকে। ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ বইতে অবনীন্দ্রনাথ নিজে ফিরে গিয়েছেন অতীতে, জানিয়েছেন সে কথা, ‘লেকচার শেষ হল। চেয়ারের হাতল চাপড়ে বলে উঠলেন, ‘আমি এই-ই চাই। তুমি বাংলাতেই বলবে। ঠিক হচ্ছে, এমনটিই চেয়েছি।”
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রয়াণের পর তাঁর স্মরণসভায় ব্যথিত-হৃদয়ে সেদিনের এই প্রসঙ্গটি তুলে অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষার উপর কতখানি টান তাঁর মনে ছিল এই অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গিয়ে আমি অনুভব করলেম।’ এই স্মৃতিতর্পণে অবনীন্দ্রনাথ ফিরে গিয়েছেন ‘বাগেশ্বরী বক্তৃতা’-র দিনগুলিতে। ইংরেজিতে নয়, বাংলায় বলবেন শুনে যিনি একদিন বলেছিলেন, ‘দেখো, লাটসাহেবের ইচ্ছে—নিদেন প্রথম বক্তৃতাটা ইংরেজিতে হোক, কি বল?’…’লেকচারের পর তিনি আমায় কাছে ডেকে বললেন, ‘তুমি বাংলায় বলে ভালোই করেছো, আমি চাই এখানের সব ক’টা লেকচার বাংলায় হয়।’ সে সব শুনে অবনীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, ‘এমনি করে তিনি আমায় যাচিয়ে নিলেন, এরপর থেকে কোনদিন আর তেমন পরীক্ষায় আমায় পড়তে হয়নি।’
অবনীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য-শিল্প সম্পর্কে কতখানি খবর রাখতেন, তাঁর জ্ঞানের গভীরতা, সেসবও বক্তৃতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইংরজি বই পড়ে তিনি অপরিসীম জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। সাহেবসুবোদের উপস্থিতিতে অবনীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতেই পারতেন। বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে ইচ্ছে করেই দেননি। বাংলা ভাষার প্রতি এই ভালোবাসা আরোপিত নয়, ভেতর থেকে উঠে আসা। সারা জীবন ধরে তিনি বাংলা ভাষার চর্চা করেছেন। ছোটদের ভালোবেসে কত স্মরণীয় বই লিখেছেন। অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন বলেই বাঙালির শৈশব আজও কত বর্ণময়, আনন্দে ভরপুর! বাংলাভাষী ছোটদের সৌভাগ্য, এ ভাষায় অবনীন্দ্রনাথের মতো একজন লেখক আছেন!
বাংলা ভাষার প্রতি অন্তর উৎসারিত এই ভালোবাসা আমাদের মনেও ছড়িয়ে পড়ুক। সবাই মিলে আরও আরও বেশি করে বাংলা ভাষাকে যেন ভালোবাসতে পারি।
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
প্রথম দিনের বক্তৃতা শুনে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় অনুভব করেছিলেন, মাতৃভাষা ছাড়া এত শক্ত কথা এমন সহজ করে বলা সম্ভব নয়। বাহবা দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথকে। ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ বইতে অবনীন্দ্রনাথ নিজে ফিরে গিয়েছেন অতীতে, জানিয়েছেন সে কথা, ‘লেকচার শেষ হল। চেয়ারের হাতল চাপড়ে বলে উঠলেন, ‘আমি এই-ই চাই। তুমি বাংলাতেই বলবে। ঠিক হচ্ছে, এমনটিই চেয়েছি।”
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রয়াণের পর তাঁর স্মরণসভায় ব্যথিত-হৃদয়ে সেদিনের এই প্রসঙ্গটি তুলে অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষার উপর কতখানি টান তাঁর মনে ছিল এই অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গিয়ে আমি অনুভব করলেম।’ এই স্মৃতিতর্পণে অবনীন্দ্রনাথ ফিরে গিয়েছেন ‘বাগেশ্বরী বক্তৃতা’-র দিনগুলিতে। ইংরেজিতে নয়, বাংলায় বলবেন শুনে যিনি একদিন বলেছিলেন, ‘দেখো, লাটসাহেবের ইচ্ছে—নিদেন প্রথম বক্তৃতাটা ইংরেজিতে হোক, কি বল?’…’লেকচারের পর তিনি আমায় কাছে ডেকে বললেন, ‘তুমি বাংলায় বলে ভালোই করেছো, আমি চাই এখানের সব ক’টা লেকচার বাংলায় হয়।’ সে সব শুনে অবনীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, ‘এমনি করে তিনি আমায় যাচিয়ে নিলেন, এরপর থেকে কোনদিন আর তেমন পরীক্ষায় আমায় পড়তে হয়নি।’
অবনীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য-শিল্প সম্পর্কে কতখানি খবর রাখতেন, তাঁর জ্ঞানের গভীরতা, সেসবও বক্তৃতায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইংরজি বই পড়ে তিনি অপরিসীম জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। সাহেবসুবোদের উপস্থিতিতে অবনীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতেই পারতেন। বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে ইচ্ছে করেই দেননি। বাংলা ভাষার প্রতি এই ভালোবাসা আরোপিত নয়, ভেতর থেকে উঠে আসা। সারা জীবন ধরে তিনি বাংলা ভাষার চর্চা করেছেন। ছোটদের ভালোবেসে কত স্মরণীয় বই লিখেছেন। অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন বলেই বাঙালির শৈশব আজও কত বর্ণময়, আনন্দে ভরপুর! বাংলাভাষী ছোটদের সৌভাগ্য, এ ভাষায় অবনীন্দ্রনাথের মতো একজন লেখক আছেন!
বাংলা ভাষার প্রতি অন্তর উৎসারিত এই ভালোবাসা আমাদের মনেও ছড়িয়ে পড়ুক। সবাই মিলে আরও আরও বেশি করে বাংলা ভাষাকে যেন ভালোবাসতে পারি।
ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
* গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি (tagore-stories – Rabindranath Tagore) : পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Parthajit Gangopadhyay) অবনীন্দ্রনাথের শিশুসাহিত্যে ডক্টরেট। বাংলা ছড়ার বিবর্তন নিয়ে গবেষণা, ডি-লিট অর্জন। শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে চলেছেন। বাংলা সাহিত্যের বহু হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করেছেন। ছোটদের জন্য পঞ্চাশটিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্পাদিত বই একশোরও বেশি।