ডাঃ দেবব্রত মজুমদার
হঠাৎ করেই যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না আপনার কাছের মানুষটিকে? কখনও তিনি হয়ে উঠছেন অস্বাভাবিক উত্তেজনাপূর্ণ, কখনও বা একেবারেই বিষাদগ্রস্ত? মানসিক এবং শারীরিকভাবে একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন? প্রিয় মানুষটি বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার নামক এক মানসিক রোগের শিকার নয় তো? এহেন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত? পরামর্শে বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ দেবব্রত মজুমদার।
সম্প্রতি আপনার চিরপরিচিত শান্ত, শৃঙ্খলাপরায়ণ মানুষটি কি হঠাৎ করেই হয়ে উঠেছেন অতিরিক্ত উত্তেজিত? বিশৃঙ্খলাপরায়ণ? ক্রমাগত বাড়ছে নিজেকে নিয়ে অজস্র ভ্রান্ত ধারণাও। ‘আমি’র প্রভুত্ববাদ বিস্তারের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তাঁর নিজের জীবনের সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা বাড়ছে তাঁর জীবনে থাকা মানুষজনদের জীবনেও? কেবল এটুকু হলেও হয়তো আপনি খানিকটা ঠান্ডা মাথায় গোটা পরিস্থিতিটা নিয়ে ভেবেচিন্তে মানুষটি সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করতেও পারতেন। কিন্তু এই অতিরিক্ত উত্তেজনাপূর্ণ টানা একটা সময় কাটানোর পরই যদি দেখেন যে তিনি মানসিক এবং শারীরিকভাবে একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন, এহেন পরিস্থিতিতে আপনার শঙ্কিত হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক।
এই পরিস্থিতিতে সর্বাগ্রে আপনার করণীয় হল, অবিলম্বে কোনও বিশষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া। কারণ আপনি হয়তো জানেনও না যে আপনার প্রিয় মানুষটি বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার নামক জটিলতম এক মানসিক রোগের শিকার।
বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার আসলে ঠিক কী? সাধারণ মানুষ কীভাবে লড়বেন এর বিরুদ্ধে?
এই বিষয়ে ডাঃ মজুমদারের বক্তব্য, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার একপ্রকার ‘মেজর মেন্টাল ইলনেস’ অর্থাৎ এমন একটি মানসিক রোগ। এর লক্ষণগুলি অত্যন্ত জটিল এবং যার প্রভাব অতিরিক্ত বেশি। আমাদের মেজাজ ভালো থাকা, খারাপ থাকা, বিষণ্ণ থাকা ইত্যাদি কিছু মানসিক পরিস্থিতি আমাদের প্রভাবিত করে থাকে খুব বেশিরকমভাবে। সেই প্রভাবপূর্ণ পরিস্থিতির গোটা ব্যাপারটিকে বলা হয় ‘মুড ডিজঅর্ডার’। বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার এরকমই একটি মুড ডিজঅর্ডার যার প্রাথমিকভাবে দুটি পোল বা মেরু থাকে যার কারণে এর নাম ‘বাইপোলার’ মুড ডিজঅর্ডার। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সকলেরই অবসাদ বা ডিপ্রেশন সংক্রান্ত কিঞ্চিৎ ধারণা রয়েছে। সেইসূত্রে আমরা কমবেশি সকলেই জানি অবসাদ হল এমন একটি মানসিক পরিস্থিতি, যে পরিস্থিতিতে এই রোগের শিকার হওয়া মানুষটির যেকোনও কাজে আগ্রহ ও শারীরিক শক্তি একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে, মানুষটি তার ভীষণ পছন্দের কাজেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
পাশাপাশি তাঁর খিদে এবং ঘুম কমে যেতে পারে, যে কারণে ওজন কমে যায়। আবার কিছুক্ষেত্রে খিদে অতিরিক্ত বেড়ে গেলে ওজন বাড়ার প্রবণতাও দেখা যায়৷ মানুষটি শরীরিক ও মানসিকভাবে অত্যন্ত নিস্তেজ হয়ে থাকেন। তাঁর মধ্যে ধারাবাহিকভাবে মানসিক নৈরাশ্য এবং হতাশা ভীষণরকমভাবে বাড়তে থাকে, যে কারণে একটা সময়ের পর তিনি নিজের কোনও বড়সড় ক্ষতি পর্যন্ত করতে পারেন। বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারের ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন অর্থাৎ রোগীর মানসিক ও শারীরিকভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়ার পাশাপাশি এর ঠিক বিপরীত ও বিপ্রতীপ এক ধরনের পরিস্থিতিও ভীষণ প্রকট হয়ে ওঠে। ডাঃ মজুমদার বলছেন, এই পরিস্থিতিকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয়ে থাকে ‘ম্যানিক ফেজ বা হাইপো-ম্যানিক ফেজ’। এক্ষেত্রে মানুষটির যেকোনও কাজে আগ্রহ ও শারীরিক শক্তি অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে যায়। কাজের কোনও শৃঙ্খলা থাকে না। কোনও নির্দিষ্ট কাজে বেশিক্ষণ মনোনিবেশ করা সম্ভবপর হয় না। একটা কাজ করতে না করতেই আরেকটা উদ্ভট কোনও কাজ করার জন্য তিনি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন বা মগজে এমন কিছু চিন্তাভাবনা ভিড় করে আসতে থাকে যে চিন্তাভাবনাগুলো একেবারেই বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভবপর নয়৷ যদিও মানুষটি ভেবে থাকেন যে এই চিন্তাভাবনাগুলো খুব সহজেই তিনি বাস্তবায়িত করতে পারবেন। ডাঃ মজুমদার বলছেন, এই বিশেষ অবস্থাটিকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় ‘গ্র্যান্ডিওস ডিলিউশন’। মানে এমন এক পরিস্থিতি যে পরিস্থিতিতে মানুষের নিজস্ব বিচারবুদ্ধি একেবারেই তার আয়ত্তের মধ্যে থাকে না, যার ফলে সে নিজে বুঝে উঠতেও পারে না কীভাবে তার কাজকর্মকে স্বভাবিক বিচারবুদ্ধি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই সমস্যার পাশাপাশি মানুষটি অতিরিক্ত কথা বলে থাকে, কখনও কখনও কথা বন্ধ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। একে বলা হয় ‘প্রেসার অব স্পিচ’।
এছাড়া অন্যের কাজে নাক গলানো, অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করে বসা, যেকোনও মানুষের সঙ্গে অতিরিক্ত বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, এসব তো আছেই। পাশাপাশি দেখা যায় আরও দুটি বিষয়, যে বিষয় দুটি একটা সময়ের পর ভয়ানকরকমভাবে প্রতিক্রিয়াশীল আকার ধারণ করতে পারে। একটি হল, আমিকেন্দ্রিকতা এবং আরেকটি হল বেপরোয়া জীবনাচরণ, যে জীবনাচরণের ফলে মানুষটি হঠাৎ করেই টাকাপয়সা অতিরিক্ত খরচ করতে আরম্ভ করতে পারেন। জিনিসপত্র বিলিয়ে দেওয়া বা অপ্রয়োজনীয় জিনিসের পেছনে অতিরিক্ত খরচ করার প্রবণতাও দেখা যেতে পারে। এই প্রবণতা একটা সময়ের পর বন্ধ করতে পারা অসম্ভব হয়ে ওঠে আশপাশের মানুষেদের পক্ষে।
দ্বিতীয়ত বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার-এর শিকার হওয়া ব্যক্তির অতিরিক্ত আমিকেন্দ্রিকতা যে কেবল নিজের স্বার্থপূরণের জন্যই তৈরি হয় তা নয়, বরং সবক্ষেত্রেই ‘আমি শ্রেষ্ঠ’ এবং ‘আমাকে’ ছাড়া পৃথিবী চলবে না এই ধরনের ভ্রান্ত মনোভাব থেকে এক ধরনের প্রভুত্বপূর্ণ আচরণ তার মধ্যে দেখা যায়। এই ধরনের আচরণ অন্য মানুষের জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ‘ম্যানিক ফেজে’ মানুষটির মধ্যে অসংযমী যৌন আচরণ এবং মানুষকে অপ্রয়োজনে বিরক্ত করার প্রবণতাও বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই, অতিরিক্ত রকমভাবে ঘুম কমে যায়, কিন্তু ঘুমের জন্য কোনও আর্তি তার মধ্যে প্রকাশ পায় না। উপরন্তু না ঘুমোতে পারলেই ভালো হয় কারণ ঘুমোলে তার উত্তেজনায় ঘাটতি পড়বে কিছু সময়ের জন্য, যেটা ওই মুহূর্তে তার জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর বলে তিনি মনে করে থাকেন৷ দিনের পর দিন না ঘুমোনো সত্ত্বেও তাঁর কাজ করার আগ্রহ ও শারীরিক শক্তি অদ্ভুতরকমভাবে বাড়তে থাকে।
অবসাদ এবং ‘ম্যানিক ফেজ’ উভয়ক্ষেত্রেই কিন্তু নেশাশক্তির প্রবণতাও বাড়তে পারে। ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে মানুষ সাধারণত অ্যালকোহল, অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ এই জাতীয় স্টিমুল্যান্ট ব্যবহার করে থাকেন মূলত সেলফ মেডিকেশন হিসাবে অর্থাৎ যাতে তাঁর মানসিক যন্ত্রণার কিছুটা উপশম ঘটে এবং ম্যানিক ফেজের ক্ষেত্রে মানুষটি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে থাকার কারণে বা বেপরোয়া মনোভাবের ফলেও হঠাৎ করে অতিরিক্ত নেশা করতে আরম্ভ করতে পারেন বা কখনও কখনও একেবারে যাতে ঘুমোতে না হয় তার জন্য নেশা করছেন কিংবা কোনও নির্দিষ্ট স্টিমুল্যান্টের প্রভাবে হয়তো তাঁর কাজ করার ক্ষমতা বেড়ে যায় বলে তিনি মনে করছেন তাই অনিয়ন্ত্রিতভাবে নেশা করছেন, আবার কেবল এক্সপেরিমেন্টের জন্য যেভাবে ইচ্ছা, যেমন ইচ্ছা বিভিন্নরকম স্টিমুল্যান্টে ব্যবহার করে যাচ্ছেন এমনটাও দেখা যায়। মোদ্দা কথা হল, ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে যে মানুষটি নেশার আশ্রয় নিচ্ছেন নিজেকে অবশ করে রাখার জন্য, নিস্তেজ করে রাখার জন্য, ম্যানিক ফেজে সেই মানুষটিই নিজেকে সক্রিয় করে রাখার জন্য নেশার আশ্রয় নিচ্ছেন। দুটো একেবারে বিপ্রতীপ মেরুর মধ্যে ঘোরাফেরা করে বলে এই জাতীয় মুড ডিজঅর্ডারকে বলা হয়ে থাকে বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার।
এই পরিস্থিতিতে সর্বাগ্রে আপনার করণীয় হল, অবিলম্বে কোনও বিশষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া। কারণ আপনি হয়তো জানেনও না যে আপনার প্রিয় মানুষটি বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার নামক জটিলতম এক মানসিক রোগের শিকার।
এই বিষয়ে ডাঃ মজুমদারের বক্তব্য, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার একপ্রকার ‘মেজর মেন্টাল ইলনেস’ অর্থাৎ এমন একটি মানসিক রোগ। এর লক্ষণগুলি অত্যন্ত জটিল এবং যার প্রভাব অতিরিক্ত বেশি। আমাদের মেজাজ ভালো থাকা, খারাপ থাকা, বিষণ্ণ থাকা ইত্যাদি কিছু মানসিক পরিস্থিতি আমাদের প্রভাবিত করে থাকে খুব বেশিরকমভাবে। সেই প্রভাবপূর্ণ পরিস্থিতির গোটা ব্যাপারটিকে বলা হয় ‘মুড ডিজঅর্ডার’। বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার এরকমই একটি মুড ডিজঅর্ডার যার প্রাথমিকভাবে দুটি পোল বা মেরু থাকে যার কারণে এর নাম ‘বাইপোলার’ মুড ডিজঅর্ডার। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সকলেরই অবসাদ বা ডিপ্রেশন সংক্রান্ত কিঞ্চিৎ ধারণা রয়েছে। সেইসূত্রে আমরা কমবেশি সকলেই জানি অবসাদ হল এমন একটি মানসিক পরিস্থিতি, যে পরিস্থিতিতে এই রোগের শিকার হওয়া মানুষটির যেকোনও কাজে আগ্রহ ও শারীরিক শক্তি একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে, মানুষটি তার ভীষণ পছন্দের কাজেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
পাশাপাশি তাঁর খিদে এবং ঘুম কমে যেতে পারে, যে কারণে ওজন কমে যায়। আবার কিছুক্ষেত্রে খিদে অতিরিক্ত বেড়ে গেলে ওজন বাড়ার প্রবণতাও দেখা যায়৷ মানুষটি শরীরিক ও মানসিকভাবে অত্যন্ত নিস্তেজ হয়ে থাকেন। তাঁর মধ্যে ধারাবাহিকভাবে মানসিক নৈরাশ্য এবং হতাশা ভীষণরকমভাবে বাড়তে থাকে, যে কারণে একটা সময়ের পর তিনি নিজের কোনও বড়সড় ক্ষতি পর্যন্ত করতে পারেন। বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারের ক্ষেত্রে ডিপ্রেশন অর্থাৎ রোগীর মানসিক ও শারীরিকভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়ার পাশাপাশি এর ঠিক বিপরীত ও বিপ্রতীপ এক ধরনের পরিস্থিতিও ভীষণ প্রকট হয়ে ওঠে। ডাঃ মজুমদার বলছেন, এই পরিস্থিতিকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয়ে থাকে ‘ম্যানিক ফেজ বা হাইপো-ম্যানিক ফেজ’। এক্ষেত্রে মানুষটির যেকোনও কাজে আগ্রহ ও শারীরিক শক্তি অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে যায়। কাজের কোনও শৃঙ্খলা থাকে না। কোনও নির্দিষ্ট কাজে বেশিক্ষণ মনোনিবেশ করা সম্ভবপর হয় না। একটা কাজ করতে না করতেই আরেকটা উদ্ভট কোনও কাজ করার জন্য তিনি ব্যস্ত হয়ে ওঠেন বা মগজে এমন কিছু চিন্তাভাবনা ভিড় করে আসতে থাকে যে চিন্তাভাবনাগুলো একেবারেই বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভবপর নয়৷ যদিও মানুষটি ভেবে থাকেন যে এই চিন্তাভাবনাগুলো খুব সহজেই তিনি বাস্তবায়িত করতে পারবেন। ডাঃ মজুমদার বলছেন, এই বিশেষ অবস্থাটিকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলা হয় ‘গ্র্যান্ডিওস ডিলিউশন’। মানে এমন এক পরিস্থিতি যে পরিস্থিতিতে মানুষের নিজস্ব বিচারবুদ্ধি একেবারেই তার আয়ত্তের মধ্যে থাকে না, যার ফলে সে নিজে বুঝে উঠতেও পারে না কীভাবে তার কাজকর্মকে স্বভাবিক বিচারবুদ্ধি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই সমস্যার পাশাপাশি মানুষটি অতিরিক্ত কথা বলে থাকে, কখনও কখনও কথা বন্ধ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। একে বলা হয় ‘প্রেসার অব স্পিচ’।
এছাড়া অন্যের কাজে নাক গলানো, অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করে বসা, যেকোনও মানুষের সঙ্গে অতিরিক্ত বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, এসব তো আছেই। পাশাপাশি দেখা যায় আরও দুটি বিষয়, যে বিষয় দুটি একটা সময়ের পর ভয়ানকরকমভাবে প্রতিক্রিয়াশীল আকার ধারণ করতে পারে। একটি হল, আমিকেন্দ্রিকতা এবং আরেকটি হল বেপরোয়া জীবনাচরণ, যে জীবনাচরণের ফলে মানুষটি হঠাৎ করেই টাকাপয়সা অতিরিক্ত খরচ করতে আরম্ভ করতে পারেন। জিনিসপত্র বিলিয়ে দেওয়া বা অপ্রয়োজনীয় জিনিসের পেছনে অতিরিক্ত খরচ করার প্রবণতাও দেখা যেতে পারে। এই প্রবণতা একটা সময়ের পর বন্ধ করতে পারা অসম্ভব হয়ে ওঠে আশপাশের মানুষেদের পক্ষে।
দ্বিতীয়ত বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার-এর শিকার হওয়া ব্যক্তির অতিরিক্ত আমিকেন্দ্রিকতা যে কেবল নিজের স্বার্থপূরণের জন্যই তৈরি হয় তা নয়, বরং সবক্ষেত্রেই ‘আমি শ্রেষ্ঠ’ এবং ‘আমাকে’ ছাড়া পৃথিবী চলবে না এই ধরনের ভ্রান্ত মনোভাব থেকে এক ধরনের প্রভুত্বপূর্ণ আচরণ তার মধ্যে দেখা যায়। এই ধরনের আচরণ অন্য মানুষের জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ‘ম্যানিক ফেজে’ মানুষটির মধ্যে অসংযমী যৌন আচরণ এবং মানুষকে অপ্রয়োজনে বিরক্ত করার প্রবণতাও বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই, অতিরিক্ত রকমভাবে ঘুম কমে যায়, কিন্তু ঘুমের জন্য কোনও আর্তি তার মধ্যে প্রকাশ পায় না। উপরন্তু না ঘুমোতে পারলেই ভালো হয় কারণ ঘুমোলে তার উত্তেজনায় ঘাটতি পড়বে কিছু সময়ের জন্য, যেটা ওই মুহূর্তে তার জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর বলে তিনি মনে করে থাকেন৷ দিনের পর দিন না ঘুমোনো সত্ত্বেও তাঁর কাজ করার আগ্রহ ও শারীরিক শক্তি অদ্ভুতরকমভাবে বাড়তে থাকে।
অবসাদ এবং ‘ম্যানিক ফেজ’ উভয়ক্ষেত্রেই কিন্তু নেশাশক্তির প্রবণতাও বাড়তে পারে। ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে মানুষ সাধারণত অ্যালকোহল, অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ এই জাতীয় স্টিমুল্যান্ট ব্যবহার করে থাকেন মূলত সেলফ মেডিকেশন হিসাবে অর্থাৎ যাতে তাঁর মানসিক যন্ত্রণার কিছুটা উপশম ঘটে এবং ম্যানিক ফেজের ক্ষেত্রে মানুষটি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে থাকার কারণে বা বেপরোয়া মনোভাবের ফলেও হঠাৎ করে অতিরিক্ত নেশা করতে আরম্ভ করতে পারেন বা কখনও কখনও একেবারে যাতে ঘুমোতে না হয় তার জন্য নেশা করছেন কিংবা কোনও নির্দিষ্ট স্টিমুল্যান্টের প্রভাবে হয়তো তাঁর কাজ করার ক্ষমতা বেড়ে যায় বলে তিনি মনে করছেন তাই অনিয়ন্ত্রিতভাবে নেশা করছেন, আবার কেবল এক্সপেরিমেন্টের জন্য যেভাবে ইচ্ছা, যেমন ইচ্ছা বিভিন্নরকম স্টিমুল্যান্টে ব্যবহার করে যাচ্ছেন এমনটাও দেখা যায়। মোদ্দা কথা হল, ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে যে মানুষটি নেশার আশ্রয় নিচ্ছেন নিজেকে অবশ করে রাখার জন্য, নিস্তেজ করে রাখার জন্য, ম্যানিক ফেজে সেই মানুষটিই নিজেকে সক্রিয় করে রাখার জন্য নেশার আশ্রয় নিচ্ছেন। দুটো একেবারে বিপ্রতীপ মেরুর মধ্যে ঘোরাফেরা করে বলে এই জাতীয় মুড ডিজঅর্ডারকে বলা হয়ে থাকে বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার।
ডাঃ মজুমদারের বক্তব্য অনুযায়ী, আমাদের স্নায়ুতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক (নিউরোট্রান্সমিটার) রয়েছে৷ এই রাসায়নিকগুলির মধ্যে মূলত সেরাটোনিন, ডোপামিন, নর-অ্যাড্রে নালিনের নামক এই তিনটি রাসায়নিক যখন মস্তিষ্কে কোনও অস্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপের সৃষ্টি করে তখনই উৎপত্তি হয় এই মুড ডিজঅর্ডারগুলির। মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় তাদের কয়েকটি মূলত। সেরাটোনিনের কম কাজ করার জন্যই তৈরি হয় ডিপ্রেশন এবং ম্যানিক ফেজের ক্ষেত্রে ডোপামিন সংক্রান্ত গোলযোগ থেকে এই সমস্যার উদ্রেক হয়। এছাড়াও জিনগতভাবে এই সমস্যা আসতে পারে কোনও মানুষের মধ্যে, তবে ডাঃ মজুমদার বলছেন, নির্দিষ্টভাবে এখনও সেরকম কোনও জিনের কথা জানা যায়নি যে জিনটি স্বতন্ত্রভাবে বাইপোলারিটির জন্ম দিতে পারে। ডাক্তারি পরিভাষায় বাইপোলার হল: ‘মাল্টিফ্যাকটোরিয়াল’ অর্থাৎ যেকোনও একটা ফ্যাক্টর-এর উৎস হিসেবে কাজ করে না। ধরা যাক, পরিবারের এক বা একাধিক সদস্যের মধ্যে বাইপোলার বা অন্য কোনও মুড ডিজঅর্ডার রয়েছে অথবা বাবা-মা কিংবা ভাই-বোনেদের কারওর মধ্যে বাইপোলার রয়েছে, সেখান থেকে এই রোগের সম্ভাবনা বাড়তে পারে, পাশাপাশি রোগী কতটা স্ট্রেসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন ধারাবাহিকভাবে, তাঁর জীবনের সামগ্রিক ঘটনাক্রম কীভাবে তাঁর মানসিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে বা তার আগে থেকেই অতিরিক্ত মাদকাসক্তি ছিল কি না তার ওপরেও কিন্তু নির্ভর করে এই রোগ কত তাড়াতাড়ি পরিপূর্ণভাবে রোগীর মস্তিষ্ককে দখল করে বসছে। তবে কেবলমাত্র অবসাদ স্ট্রেস থেকে কিন্তু বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার হয় না।
যেকোনও বয়সের মানুষের মধ্যেই এই সমস্যা দেখা যেতে পারে, বিশেষ করে পনেরো থেকে পঁয়ত্রিশ, এই বয়ঃক্রমের মধ্যে বেশি এই রোগের প্রবণতা দেখা যায়। ডাঃ মজুমদার স্পষ্টতই আমাদের জানালেন যে এই ধরনের লক্ষণ কোনও মানুষের মধ্যে দেখা গেলে প্রথমেই কিছু করার আগে যেটা করা একেবারেই বারণ সেটা হল মানুষটির আচরণের সাপেক্ষে বা বিপক্ষে তাঁর সঙ্গে কোনও যুক্তি-তর্কমূলক আলোচনা করতে যাওয়া। মনে রাখা প্রয়োজন ওই মুহূর্তে মানুষটির মগজ যুক্তি বুদ্ধির থেকে লক্ষ-কোটি-যোজন দূরে, যদি তা না হত তাহলে এই জাতীয় আচরণগত সমস্যার মুখোমুখি তাঁকে হতে হত না। সুতরাং নিজে আগ বাড়িয়ে কাউন্সেলিং করতে যাওয়া, হুটহাট করে কোনও মন্তব্য করে বসা বা তাঁকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে যাওয়া প্রথমেই বন্ধ করুন। এবার আসছি কী করবেন সেই প্রশ্নে৷ কিছুই করবেন না, শান্তভাবে রোগীর দিকে লক্ষ রাখবেন যে তাঁর মধ্যে নিজের বা আশপাশের মানুষজনদের কারওর কোনও শারীরিক ক্ষতি করার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে কি না। এই বিষয়ে সবসময়ে সচেতন থাকতে হবে যেন সে তার নিজের বা আশপাশের কারওর কোনও শারীরিক ক্ষতি করতে না পারে। এই কাজ করা ছাড়া আপনার এক এবং অন্যতম আবশ্যিক কর্তব্য হল, চুপচাপ মাথা ঠান্ডা করে একজন মনোবিদের সাহায্য নেওয়া৷ কারণ আপনার একটি ভুল পদক্ষেপও কিন্তু আপনার কাছের মানুষটির জীবনে এক দীর্ঘ সময়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি করে দিতে পারে। কেবলমাত্র মানসিক সমস্যাই নয়, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারের কারণে যেহেতু ঘুম ও খিদে কমে যায় সেহেতু ওজন হ্রাস হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও অধিক সময়ে না খেয়ে থাকার ফলে গ্যাসট্রাইটিসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যাঁদের কো-মরবিডিটির সমস্যা আছে অর্থাৎ উচ্চ-রক্তচাপ বা রক্তে শর্করার মাত্রা যাঁদের বেশি তাঁরা যদি দুর্ভাগ্যবশত বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারের শিকার হন তাহলে কিন্তু এমনটা হতেই পারে যে বহুদিন ঠিকমতো চিকিৎসা না করানোর জন্য ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া না করার জন্যে, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের জন্য, রোগীকে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই সমস্ত শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্যেও একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যিক।
শরীরের মতো আপনার মানসিক স্বাস্থ্যও কিন্তু আপনাকে এক সুন্দর জীবন উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, তাই এক সুন্দর জীবন আপনাকে উপহার দেওয়ার জন্য আপনার মন যেমন আপনার খেয়াল রেখে এসেছে আজন্ম, তেমনই আপনারও কিন্তু সমান কর্তব্য বর্তায় সময়ে, অসময়ে আপনার মনের খেয়াল রাখার, তার পাশে থাকা। শরীরের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যেরও খেয়াল রাখুন৷
ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে