শাস্ত্রীয় নৃত্যজগতের অন্যতম কাণ্ডারি বিরজু মহারাজজির সঙ্গে।
জীবন যেন বাক্যময়—চারপাশের জীবন বড় বেশি শব্দময়, তাকে কিছু বাক্যের লালিত্য দাও, দাও ধ্বনির ছান্দিক কৃষ্টি, শব্দে বাসা বাঁধুক বিশ্বমানবতাবাদ নামক দেবী শ্রী, কমললোচনে। জীবন হোক ছন্দপূর্ণ। কে দেবে জীবনকে এই ছন্দের আদর? মানুষ দেবেন নিশ্চিতভাবেই। কোন মানুষ দেবেন? যিনি আত্মিক অর্থেই ছন্দের কারিগর, শিল্প যার আত্ম এবং অপর উভয়ই তিনি দেবেন। দেবেন সেই নারী যিনি কেবল ধারণ করেন না, রোপণ করেন, প্রয়োজনে বিষোদগারও করেন নিজেকে এবং সামগ্রিক সমাজকে সুস্থ জীবনদানের আশায়। এমনই এক মানুষের গল্প আজ শুনি তবে যিনি নিজের উড়ানের সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে উপড়ে ফেলে প্রতিনিয়ত প্রাণদান করে চলেছেন ছন্দে, ছড়িয়ে দিচ্ছেন তার চর্চিত শিল্পকে দেশ থেকে দেশান্তরে, পৃথিবীর বুকে মাহাত্ম্য স্থাপন করেছেন অন্যতম সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উত্তর ভারতীয় সেই নৃত্যশৈলীকে, নাম যার ‘কথক’।
শিল্পীর নাম নয়নিকা ঘোষ (বিবাহ পরবর্তী জীবনে নয়নিকা ঘোষ চৌধুরি)। আর পাঁচটা প্রাণোচ্ছল শিশুর মতোই শৈশবটা আরম্ভ হয়েছিল তার। নৃত্য ছিল যেন তার জন্মান্তরের সঙ্গী। প্রাথমিকভাবে চার বছর বয়সে মায়ের উৎসাহেই স্কুলে আর পাঁচটা বাচ্চার মতো নাচের যাত্রা আরম্ভ করলেও, প্রতিভা নিজের যাত্রাপথ নিজেই তৈরি করে নেয়। স্কুলের অনুষ্ঠানেই তাই চোখে পড়লেন পণ্ডিত শম্ভু মহারাজজির সুযোগ্য শিষ্য গুরু জ্যোতিপ্রকাশ মিশ্রের (পৃথিবী যাকে চেনেন পণ্ডিত শ্যামল মহারাজজি নামে)। জহুরির চোখ যথার্থই চিনেছিলেন খাঁটি রত্নকে। জ্যোতিপ্রকাশজি নিজে এসে সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটির নৃত্য প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ফল মিলতে বেশ সময় লাগেনি। সেদিনের ছোট্ট নয়নিকা সিমলায় আয়োজিত সর্বভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য প্রতিযোগিতায় জুনিয়র লেভেলের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে ফিরলেন। ফেরার পর আরও জোরদারভাবে আরম্ভ হল প্রশিক্ষণ। এই ঘটনার এক থেক দেড় বছরের মধ্যেই বাবা নিয়ে গেলেন ক্যালকাটা স্কুল অব মিউজিকের অন্যতম কর্ণধার পদ্মশ্রী রানি কর্নার কাছে। আরম্ভ হল ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর স্নেহের ছত্রচ্ছায়ায় ‘মিস’-এর কাছে শিক্ষার এক অন্যতর যাত্রা। করলেন একের পর এক পারফরম্যান্স। এরপরেই এল জীবনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পদাতিক ডান্স সেন্টার আয়োজিত রাজ্যব্যাপী এক ডান্স ফেস্টিভ্যালে পারফর্ম করলেন নয়নিকা। পাশাপাশি প্রত্যক্ষ করলেন কথকের রথী-মহারথীদের নৃত্যকলা। কথকের পৃথিবীর এক অন্যতর দরজা যেন হাট হয়ে খুলে গেল চোখের সামনে। সাক্ষাৎ হল কথকের সম্রাট মহারাজা তথা পণ্ডিত বিরজু মহারাজের সঙ্গে।
মহারাজজি নিজে এসে নয়নিকার অভিভাবককে প্রস্তাব দেন নয়নিকাকে পদাতিকে তাঁর সুযোগ্য শিষ্য পণ্ডিত বিজয়শঙ্করজির কাছে নৃত্যশিক্ষা লাভ করার জন্য। পণ্ডিত বিজয়শঙ্করজির হাত ধরেই আরম্ভ হল নয়নিকার নৃত্যজীবনের তৃতীয় অধ্যায়। পাশাপাশি বছরে একবার করে চলতে থাকল মহারাজজির কাছে ওয়ার্কশপ, পদাতিকের বৈচিত্রময় নৃত্যজগৎ তার সামনে যেন এক পৃথিবী সম্ভাবনার দরজা খুলে দিল। তিনি যেমন কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন বিক্রম ঘোষ, শঙ্কর ঘোষের সঙ্গে তেমনই কাজ করেছেন কথকের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিখ্যাত কনটেম্পোরারি নৃত্যশিল্পীদের সঙ্গেও। পাশাপাশি সমান তালে তাল মিলিয়ে চলেছে পড়াশোনাও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা নিয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃত্যে স্নাতকোত্তর হয়েছে। বর্তমানে গবেষণারত। পাশাপাশি অবিরত চলেছে শেখানোর যাত্রাও। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত নিজস্ব বিদ্যায়তন ‘নিনাদ ফাউন্ডেশান’-এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন কোনায় ছড়িয়ে পড়েছে তার সুযোগ্য শিষ্যরা। রাশিয়া, মালয়েশিয়ার কোয়ালামপুরে, সাউথ আফ্রিকায় বাংলাদেশে যেমন রয়েছেন তাঁর সুযোগ্য শিষ্যরা, তেমনই বিয়ের পরে মুম্বইয়ের ‘বালবিহারী পাব্লিক স্কুল’ ‘এপিজে স্কুল’ দিল্লির গুরগাঁওয়ে ‘সংগীত শ্যামলা স্কুল বসন্তবিহার’-এ শিক্ষকতা করেছেন বহু বছর।
শিল্পীর নাম নয়নিকা ঘোষ (বিবাহ পরবর্তী জীবনে নয়নিকা ঘোষ চৌধুরি)। আর পাঁচটা প্রাণোচ্ছল শিশুর মতোই শৈশবটা আরম্ভ হয়েছিল তার। নৃত্য ছিল যেন তার জন্মান্তরের সঙ্গী। প্রাথমিকভাবে চার বছর বয়সে মায়ের উৎসাহেই স্কুলে আর পাঁচটা বাচ্চার মতো নাচের যাত্রা আরম্ভ করলেও, প্রতিভা নিজের যাত্রাপথ নিজেই তৈরি করে নেয়। স্কুলের অনুষ্ঠানেই তাই চোখে পড়লেন পণ্ডিত শম্ভু মহারাজজির সুযোগ্য শিষ্য গুরু জ্যোতিপ্রকাশ মিশ্রের (পৃথিবী যাকে চেনেন পণ্ডিত শ্যামল মহারাজজি নামে)। জহুরির চোখ যথার্থই চিনেছিলেন খাঁটি রত্নকে। জ্যোতিপ্রকাশজি নিজে এসে সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটির নৃত্য প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ফল মিলতে বেশ সময় লাগেনি। সেদিনের ছোট্ট নয়নিকা সিমলায় আয়োজিত সর্বভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য প্রতিযোগিতায় জুনিয়র লেভেলের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে ফিরলেন। ফেরার পর আরও জোরদারভাবে আরম্ভ হল প্রশিক্ষণ। এই ঘটনার এক থেক দেড় বছরের মধ্যেই বাবা নিয়ে গেলেন ক্যালকাটা স্কুল অব মিউজিকের অন্যতম কর্ণধার পদ্মশ্রী রানি কর্নার কাছে। আরম্ভ হল ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর স্নেহের ছত্রচ্ছায়ায় ‘মিস’-এর কাছে শিক্ষার এক অন্যতর যাত্রা। করলেন একের পর এক পারফরম্যান্স। এরপরেই এল জীবনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পদাতিক ডান্স সেন্টার আয়োজিত রাজ্যব্যাপী এক ডান্স ফেস্টিভ্যালে পারফর্ম করলেন নয়নিকা। পাশাপাশি প্রত্যক্ষ করলেন কথকের রথী-মহারথীদের নৃত্যকলা। কথকের পৃথিবীর এক অন্যতর দরজা যেন হাট হয়ে খুলে গেল চোখের সামনে। সাক্ষাৎ হল কথকের সম্রাট মহারাজা তথা পণ্ডিত বিরজু মহারাজের সঙ্গে।
মহারাজজি নিজে এসে নয়নিকার অভিভাবককে প্রস্তাব দেন নয়নিকাকে পদাতিকে তাঁর সুযোগ্য শিষ্য পণ্ডিত বিজয়শঙ্করজির কাছে নৃত্যশিক্ষা লাভ করার জন্য। পণ্ডিত বিজয়শঙ্করজির হাত ধরেই আরম্ভ হল নয়নিকার নৃত্যজীবনের তৃতীয় অধ্যায়। পাশাপাশি বছরে একবার করে চলতে থাকল মহারাজজির কাছে ওয়ার্কশপ, পদাতিকের বৈচিত্রময় নৃত্যজগৎ তার সামনে যেন এক পৃথিবী সম্ভাবনার দরজা খুলে দিল। তিনি যেমন কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন বিক্রম ঘোষ, শঙ্কর ঘোষের সঙ্গে তেমনই কাজ করেছেন কথকের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিখ্যাত কনটেম্পোরারি নৃত্যশিল্পীদের সঙ্গেও। পাশাপাশি সমান তালে তাল মিলিয়ে চলেছে পড়াশোনাও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা নিয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃত্যে স্নাতকোত্তর হয়েছে। বর্তমানে গবেষণারত। পাশাপাশি অবিরত চলেছে শেখানোর যাত্রাও। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত নিজস্ব বিদ্যায়তন ‘নিনাদ ফাউন্ডেশান’-এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন কোনায় ছড়িয়ে পড়েছে তার সুযোগ্য শিষ্যরা। রাশিয়া, মালয়েশিয়ার কোয়ালামপুরে, সাউথ আফ্রিকায় বাংলাদেশে যেমন রয়েছেন তাঁর সুযোগ্য শিষ্যরা, তেমনই বিয়ের পরে মুম্বইয়ের ‘বালবিহারী পাব্লিক স্কুল’ ‘এপিজে স্কুল’ দিল্লির গুরগাঁওয়ে ‘সংগীত শ্যামলা স্কুল বসন্তবিহার’-এ শিক্ষকতা করেছেন বহু বছর।
উস্তাদ জাকির হুসেন সঙ্গে শিল্পী নয়নিকা।
সবই চলছিল ঠিকঠাকভাবে কিন্তু জীবন যেখানে বাক্যময় সেখানে এলোপাথাড়ি শব্দের গতি মাঝেমাঝেই সব সাজানো ছন্দকে নস্যাৎ করে দেয়। তেমনই এক ভয়াবহ অধ্যায় আরম্ভ হল শিল্পীর জীবনে। সহজ বড় সহজ নয় এ জীবন—বছর দুয়েক আগে মারণরোগ ক্যানসারের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় নয়নিকার জীবন। তাঁর কাছ তো জীবন মানে কেবল শ্বাস নিয়ে জৈবিক প্রত্যয় সম্পন্ন করে বেঁচে থাকা নয়। শিল্পীর জীবনে তাঁর জীবনের অপর নাম তা নাচ, তাঁর পরিবার, তাঁর সন্তান। আরম্ভ হল লড়াই, ধ্বংসের সঙ্গে সৃষ্টির লড়াই। কেমো থেরাপি চলাকালীনই ২০২০ সালে নিজে উদ্যোগী হয়ে আয়োজন করেছেন বিশ্বব্যাপী এক অনুষ্ঠানের যেখানে উপস্থিত থেকেছেন, পারফর্ম করেছেন দেশের বিশ্বের বিভিন্ন প্রথিতযশা শিল্পী, লাগাতার ছ-মাস ব্যাপী চলেছে এই অনুষ্ঠান। পাশাপাশি তুলে আনতে চেয়েছেন আগামী প্রজন্মের প্রতিভাদের। নিনাদ ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘নির্মাণ’ প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে বিকশিত করতে চেয়েছেন বস্তিতে বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভার, পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে আয়োজিত ‘লহো রে বৈঠক’ প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে তুলে আনতে চাইছেন আগামী প্রজন্মের ভাবি সম্ভাবনাদের। নিজে মঞ্চে উঠতে না পারলেও নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের এগিয়ে দিয়েছেন আলোর পথে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও রয়ে গিয়েছেন নাচের মধ্যে। ‘কাজই যে একমাত্র জীবনীশক্তি, নিজেকে না পারলে নিজের কাজকে ছড়িয়ে দাও আগামী প্রজন্মের মধ্য, মানুষের জন্য বাঁচো, মানুষের জন্য কাজ করো, জীবন তোমার দিকে মুখ ফেরাতে বাধ্য।’ এই জীবনীশক্তিকে অবলম্বন করেই লড়ে যাচ্ছেন এখনও পর্যন্ত, লড়ে চলেছেন অনবরত।
বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে—জীবনের পরম বন্ধু তিনি, কার্যত জীবনের আরেক নাম নয়নিকা ঘোষ চৌধুরি। বর্তমানে যুক্ত রয়েছেন আইসিসিআর এবং প্রসার ভারতী দূরদর্শন কেন্দ্রের সঙ্গে। পারফর্ম করেছেন গিরনার মহোৎসব, কটক মহোৎসব, ৯৭তম আলি আকবর খানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মাইহারে অনুষ্ঠিত ফেস্টিভ্যালে। দীর্ঘ শিল্পীজীবনে পেয়েছেন ইন্সপায়ারিং উওম্যান অ্যাচিভার্স অ্যাওয়ার্ড ২০২১ (Inspiring Woman Achievers Award 2021)৷ কটক মহোৎসবে পেয়েছেন ‘নৃত্য শিরোমণি’ (Nritya-Shiromani) উপাধি। সত্যভামা যুব নৃত্য উৎসবে পেয়েছেন ‘সত্যভামা’ (Satyabhama) অ্যাওয়ার্ড। সারা বাংলা নৃত্য প্রতিযোগিতায় পেয়েছেন ‘অদ্বিতীয়া’ (ADWITIYA) উপাধি। এছাড়াও পেয়েছেন চণ্ডীগড় প্রাচীন কলা কেন্দ্র থেকে ‘নৃত্য বিশারদ’ (Nrirya-Visharad) title উপাধি, ‘বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ (Begum Rokea Memorial Award) প্রভৃতি। তিনি প্রকৃত অর্থেই জীবন-মৃত্যুর ঊর্ধ্বে উন্নীত করতে পেরেছেন নিজের আত্মকে, শুদ্ধিকরণ ঘটেছে তার শিল্পসত্তার। তাই শিল্পীর এই উড়ানে আমরা আজ তার উদ্দেশ্য কেবল এইটুকুই বলতে পারি—
‘মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ, দুঃখ হয় সে দুঃখের কূপ
তোমা হতে যবে হইয় বিমুখ আপনার পানে চাই
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে, যতদূরে আমি ধাই।’
তোমা হতে যবে হইয় বিমুখ আপনার পানে চাই
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে, যতদূরে আমি ধাই।’