শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


বাঁদিক থেকে প্রথম সারিতে আলপনা, লতা, সন্ধ্যা, বেলা, হেমন্ত ও ভানু।

লতা মঙ্গেশকর এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বন্ধুত্ব নিয়ে আগে একটি পর্বে কিছু কথা লিখেছিলাম। কিন্তু এই দুই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর সখ্য নিয়ে যত বলি ততই যেন কম মনে হয়।

একসময়কার কথা খুব মনে পড়ছে আজ এই প্রসঙ্গে। ছোটবেলায় আমি থাকতাম আলিপুরদুয়ার জংশনের অরবিন্দ কলোনির রেল কোয়ার্টারে। আমার বাবা রেলে চাকরি করতেন। আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটা গোলাকার চৌমাথার মতো জায়গা ছিল। প্রতিবছর শীত পড়ার ঠিক আগে ওখানে একটা সাইকেল প্রতিযোগিতা হত। আমাদের ছোটদের কাছে ওই প্রতিযোগিতা ছিল দারুণ আকর্ষণীয়। মনে পড়ে প্রতিযোগিতা উপলক্ষে মাইকে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গানগুলি বাজানো হত। ‘মধু মালতী ডাকে আয়’, ‘আর ডেকো না সেই মধু নামে’ ইত্যাদি৷ সেই সময় বন্ধু-বান্ধবদের খুব বলতে শুনতাম যে, লতা মঙ্গেশকরের জন্যই নাকি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মুম্বইতে জায়গা পাননি। পরবর্তীকালে সন্ধ্যাদিকে এই ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সন্ধ্যাদি বলেছিলেন, ‘লতা এবং আমার সম্পর্ক নিয়ে এমন ধারণা অনেক মানুষেরই আছে যে, লতা নাকি আমার বিরুদ্ধে পলিটিক্স করত। এই ধারণার কারণ আমি জানি না৷ কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে কখনও লতার তরফ থেকে কোনও অসহযোগিতা পাইনি বরং খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল আমাদের।’ সন্ধ্যাদি এমনটাও বলেছিলেন যে, ‘লতাকে কখনও কারও সম্পর্কে নিন্দা-মন্দ করতে শুনিনি। খুবই রসিক মানুষ লতা। দারুণ মিমিক্রি করতে পারে, মজার গান হোক বা সিরিয়াস গান, সব গানেই সমান দক্ষ।’

একবার মুম্বইয়ের এক সংবাদপত্রে তাঁকে এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখা একটি প্রতিবেদন সুরসম্রাজ্ঞীর চোখে পড়ে। প্রতিবেদনের একাংশ ছিল এরকম—‘সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মুম্বইমে আ গয়ি। লতা মঙ্গেশকর অব ক্যায়া করেগি? জ্বলেগি?’ লতাজি কাগজটি নিয়ে এসে সন্ধ্যাদিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমহি বতাও সন্ধ্যা ম্যায় জ্বলু কেয়া?’ প্রত্যুত্তরে সন্ধ্যাদি একটু হেসেছিলেন। এমনই ছিল তাঁদের সম্পর্ক।

একটা সময় ছিল যখন লতাজিকে দিনের পর দিন স্টুডিওয় স্টুডিওয় ঘুরতে হত। সংগীত পরিচালকদের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে ‘ইতনি পাতলি আওয়াজ! এ ক্যায়সে গায়েগি?’

প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী গীতা দত্ত। ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

ছেঁড়া জুতো সেলাই করে পরেছেন লতাজি। রাতে বাড়ি ফিরে শাড়ি কেচে শুকনো করে ভাঁজ করা অবস্থায় বালিশের নীচে রেখে দিতেন যাতে ইস্ত্রি করা শাড়ির মতো দেখতে লাগে। ওই শাড়ি পরেই পরদিন বেরোতেন। সন্ধ্যাদিকে বলতে শুনেছি—‘কিন্তু দেখো লতাকে কিন্তু আটকানো যায়নি। ও হল ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা, নিজের পথ ও নিজেই তৈরি করে নিয়েছিল।’ সন্ধ্যাদি গল্প করেছেন—মুম্বইয়ে থাকাকালীন মাঝে মাঝে যেতেন লতাজির বাড়িতে। ওঁর বাড়িতে তখন সর্বসাকুল্যে দুটি মাত্র ঘর। একটি ঘরে থাকতেন লতাজির মা এবং তিন বোন সহ ওঁর ভাই। আরেকটি ঘরে লতাজি নিজে ঘুমোতেন। সন্ধ্যাদি যখন সকালের দিকে যেতেন তখন অধিকাংশ দিনই অনেক রাত অব্দি রেকর্ডিং করে এসে লতাজি ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছেন। সন্ধ্যাদি যাওয়ার পর উনি ঘুম থেকে উঠে সুন্দর করে এলাচ দিয়ে কফি করে খাওয়াতেন৷ তারপর দুজনে কিছুক্ষণ গল্প করে সন্ধ্যাদিকে এভারগ্রিন হোটেলে নামিয়ে দিয়ে নিজের কাজে চলে যেতেন লতাজি। সন্ধ্যাদি বলেছেন, ‘আমি আশ্চর্য হতাম লতার ভদ্রতাবোধ দেখে।’

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে শিল্পীর সঙ্গে লেখক।

লতাজিও প্রায় দিন আসতেন এভারগ্রিন হোটেলে। সারাদিন চলত গল্পগুজব, গান নিয়ে আলোচনা। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের শিষ্যা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। লতাজি খুব আগ্রহভরে দেখতেন সন্ধ্যাদি কীভাবে ক্ল্যাসিক্যাল গাইছেন। লতাজি প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গসংগীত গায়িকা রোশেনারা বেগমের খুব ভক্ত ছিলেন। মাঝে মাঝে এভারগ্রিন হোটেলে সন্ধ্যাদিকে রোশেনারা বেগমের গান গেয়ে শোনাতেন লতাজি৷ সন্ধ্যাদি নিজেও তারপর বাকি অংশটুকু গাইতেন। মুম্বইয়ে থাকাকালীন এমনভাবেই দিন কাটত তাঁদের৷ সন্ধ্যাদি রাখি পূর্ণিমায় কখনও মুম্বইয়ে থাকলে লতাজি তাঁর দাদার জন্য রাখি এবং মিষ্টি নিয়ে আসতেন। লতাজির এই ঘরোয়া আচরণ মুগ্ধ করত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। সেই সময় লতা মঙ্গেশকরের পাশাপাশি গীতা দত্ত হিন্দি ছবির প্লে-ব্যাক শিল্পী হিসেবে খুব নাম করেছেন। শামশাদ বেগম, রাজকুমারীও তখন গাইছেন। গীতা থাকতেন সান্তাক্রুজে। সন্ধ্যাদি মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতেন গীতা দত্তের বাড়িতে। তিনিও এভারগ্রিন হোটেলে আসতেন। সন্ধ্যাদি স্মৃতিরোমন্থন করে বলেছিলেন—‘আসলে সেই সময়টায় লতা আমি গীতা আমাদের নিয়ে বেশ জমে উঠেছিল। লতার সঙ্গে গীতারও ভালো সম্পর্ক ছিল। আরেকটা কথা, কারও জন্য আমি বম্বে ছেড়ে আসিনি। মাত্র দুটো বছর বম্বেতে ছিলাম। তারই মধ্যে গোটা পনেরো-কুড়ি ছবিতে গেয়ে ফেলেছিলাম। আসল কথা হল, বম্বে আমার ভালো লাগেনি। কলকাতায় তখন আমার প্রচুর কাজ। তাই কাউকে কিছু না জানিয়েই আমার প্রিয় শহরে ফিরে এসেছিলাম। একথা জানতে পেরে শচীন দেব বর্মন সম্ভবত আমার ওপর একটু অসন্তুষ্টই হয়েছিলেন। পরে আমার সঙ্গে দেখা হতে বলেছিলেন—ইস্ সন্ধ্যা, তুমি বম্বে ছেড়ে চলে এলে? ওখানে থাকলে তুমি কত কাজ করতে!’

Skip to content