রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


সুরকার অনিল বিশ্বাসের রান্নাঘরে লতা মঙ্গেশকর। পাশে প্রখ্যাত অভিনেত্রী স্মৃতিরেখা বিশ্বাস। ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

মুম্বইয়ে একবার লতাজির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল আমার। সেই সময় আলোচনা হয়েছিল বিভিন্ন সংগীত পরিচালকের সুরে তাঁর গান গাইবার অভিজ্ঞতা নিয়ে। তাঁর সারাজীবনের কেরিয়ারে তিনি যে সমস্ত সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়াও শচীন দেব বর্মন, অনিল বিশ্বাস, সি রামচন্দ্র, নৌশাদ, মদনমোহন প্রমুখ সুরস্রষ্টার সঙ্গেও তাঁর সুন্দর সম্পর্ক ছিল। যদিও মাঝে একবার সি রামচন্দ্রের সঙ্গে গানসংক্রান্ত বিষয়েই কিছু মনোমালিন্য হয়েছিল৷ কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে তা মিটেও যায়৷ সত্যি কথা বলতে গেলে সেই সময় ছবির জগতে লতাজির কণ্ঠে গানের চাহিদা এতটাই বেশি ছিল যে কোনও সুরকারই তাঁর সঙ্গে সচরাচর বিবাদে জড়াতে চাইতেন না। সেই সময়ের ডাকসাইটে সব নায়িকা যেমন নার্গিস, মীনাকুমারী, মধুবালা বা বৈজয়ন্তীমালার মতো অভিনেত্রীদের লিপে পরিচালক এবং সুরকাররা সবসময় লতাজির কণ্ঠে গান চাইতেন৷ কারণ, লতাজির গান যেমন সেই সমস্ত ছবির নায়িকাদের সাফল্যের অন্যতম কার্যকরী ভূমিকা পালন করত, তেমনই এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত ছবির সামগ্রিক সাফল্যেও। এছাড়াও বাংলার সুরকারদের মধ্যে সলিল চৌধুরি, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্টজনদের সম্পর্কেও তিনি অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে লতাজির গাওয়া ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ গানটি সেই সময়ে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। লতাজি সতীনাথবাবুকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। এছাড়াও তিনি বিশেষভাবে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন শ্যামল মিত্রের প্রতিও৷ শ্যামল মিত্রের গায়কি ছিল তাঁর খুব পছন্দের। কিন্তু এতজনের মাঝেও হেমন্তদার পরে যদি আর কোনও সুরকারের সঙ্গে বিশেষ সখ্যপূর্ণ সম্পর্ক থেকে থাকে তবে তিনি হলেন সলিল চৌধুরি। কলকাতায় এলে লতাজি একবার হলেও যেতেন সলিলদার বাড়িতে। মুম্বইয়ে সলিল চৌধুরির বাড়িতে যখন গানের মহড়া বসত সেখানে মাঝে মাঝে উপস্থিত থাকতেন লতাজি। সুরকার এবং গীতিকার হিসাবে সলিল চৌধুরির গানের কথার সঙ্গে সুরের যে অপূর্ব মেলবন্ধন, গানের সুর নিয়ে তাঁর যে একের পর এক পরীক্ষানিরীক্ষামূলক কাজ তা বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছিল লতাজিকে। সলিল চৌধুরি এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জুটিতে সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক অনবদ্য বাংলা গান৷ গাঁয়ের বধূ, রানার, ধান কাটার গান, নৌকা বাওয়ার গান ইত্যাদি বাংলা গানের ইতিহাসে এক কালজয়ী অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল। সলিল চৌধুরির সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রানার, লতাজির ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত পছন্দের ছিল। লতাজি সলিল চৌধুরিকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে দিয়ে একবার গানটির রেকর্ডিং করানোর জন্য। মজার কথা হল লতাজির এই ইচ্ছের কথা শুনে হেমন্তদা প্রাথমিকভাবে খানিকটা ভয় পেয়েছিলেন। যদিও তিনি সর্বান্তঃকরণে চাইতেন যে লতাজির গলায় রানার গানটি সর্বাঙ্গীণ সাফল্যলাভ করুক৷ কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও যেন একটা সুপ্ত ভয় লুকিয়েছিল যে লতাজির মতো অনন্য এক প্রতিভা যদি এই গানটি করেন তাহলে কোথাও হয়তো মানুষ তাঁর গলায় গানটি আর আগের মতো শুনবে না। কিন্তু ঈশ্বরের লীলা বোঝা ভার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায় রানার গানটি যতটা জনপ্রিয়তালাভ করেছিল লতাজির গলায় ঠিক ততটা জনপ্রিয়তা কখনওই পায়নি। যদিও এই গানটিকে এক অন্য উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি৷

সলিল চৌধুরির কাছে গানের তালিম নিচ্ছেন সুরসম্রাজ্ঞী। ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে

সলিল চৌধুরির সঙ্গে লতাজির আরও একটি কালজয়ী কাজ হল হিন্দি ছবি ‘মধুমতী’৷ ১৯৫৮ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে বৈজয়ন্তীমালার লিপে লতাজির প্রত্যেকটি গান অপরিসীম সাফল্য পেয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই ছবির মুক্তির পরপরই তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে কমিউনিস্টদের ধরপাকড় শুরু হয়৷ কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন সলিল চৌধুরি গ্রেপ্তার এড়াতে বেশ কিছু দিনের জন্য আত্মগোপন করেন৷ যে কারণে বলিউডে তাঁর সৃষ্টি যে সাফল্য এনে দিতে পারত তা থেকে তিনি বঞ্চিত হন। এই নিয়ে লতাজির দুঃখ ছিল। তিনি বলেছিলেন, হিন্দি ছবিতে সলিলদার যতখানি সাফল্য পাওয়ার কথা ছিল তা তিনি পাননি।

এছাড়াও লতাজি সবসময় বলে এসেছেন, যে সমস্ত বাংলা আধুনিক গান তিনি গেয়েছেন, সলিল চৌধুরির কথা ও সুর করা গানগুলি যেমন ‘যা রে যা রে উড়ে যা রে পাখি’, ‘বুঝবে না কেউ বুঝবে না’, ‘ও মোর ময়না গো’ ইত্যাদি আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে৷

Skip to content