শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীশ্রী ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৷ তাঁর বাঁপাশে এই মন্দিরের সেবাইত প্রদীপকুমার চক্রবর্তী৷

সাহিত্য, সংস্কৃতি, রুচি, ঐতিহ্যবোধ—এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার বৈচিত্রময় পারস্পরিক সম্পর্ক অটুট। বৈচিত্রময় ওপার বাংলায় অসংখ্য মসজিদ এবং মাজারের পাশাপাশি কিন্তু ইতিহাসপ্রসিদ্ধ কিছু ঐতিহ্যবাহী মন্দির এবং দেবী সতীর একান্ন পীঠের অন্যতম কয়েকটি পীঠও পড়ছে এখানকার কিছু অঞ্চলে। এই তীর্থক্ষেত্রগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মধ্যেকার পারস্পরিক ধর্মীয় বিশ্বাসের আদানপ্রদানগত সম্পর্কের বৈচিত্রময় কাহিনিই এবার উঠে আসবে পরিব্রাজক লেখক ও সাংবাদিক সুমন গুপ্ত-র কলমে। তার ধারাবাহিক ‘বাংলাদেশের জাগ্রত মন্দিরে মন্দিরে’র মধ্য দিয়ে।

পর্ব-৩

ঢাকেশ্বরী দেবীকে নিয়ে আরেকটি অলৌকিক ঘটনার কথা শুনেছিলাম সেবাইতের মুখে৷ তাঁর ঠাকুরদা প্রতাপচন্দ্র চক্রবর্তী তখন মন্দিরের সেবাইত৷ ঘটনাটির কথা বলার আগে অন্য দু-চার কথা জানিয়ে রাখি৷ প্রদীপবাবুর প্রপিতামহ শ্রীযুক্ত বঙ্গচন্দ্র চক্রবর্তীর আদিবাড়ি ছিল বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার ষোলঘর গ্রামে৷

১৮৮৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর৷ সেদিন ভাওয়ালের স্বর্গীয় রাজা শ্রীযুক্ত রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়ের তিন পুত্র যথাক্রমে শ্রীযুক্ত কুমার রণেন্দ্রনারায়ণ রায়, শ্রীযুক্ত রমেন্দ্রনারায়ণ রায় এবং শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনারায়ণ রায় বঙ্গচন্দ্র চক্রবর্তীর পুত্র প্রতাপচন্দ্রকে একটি আইনসম্মত দলিল করিয়ে দেন৷ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাসে এটি নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা৷

ভাওয়ালের তিন রাজকুমারের সেই প্রাচীন মূল দলিল প্রদীপবাবুর কাছে এখনও সযত্নে রয়েছে৷ তারই ফোটোকপি আমি জোগাড় করতে পেরেছিলাম৷ দলিলের তারিখ ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৮৬৷ চাঁদ-তারার ছাপ দেওয়া ৩ টাকার স্ট্যাম্প পেপারের ওপর ১৩৭৪ নং-এর মোট ৭ পাতার এই দলিলটি রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল ঢাকার তৃতীয় মুনসেফি আদালতে৷ দলিলের বয়ান পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা৷ মহারানি ভিক্টোরিয়ার মুকুটের সিলমোহর দলিলে৷ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কেন চাঁদ-তারার ছাপ স্ট্যাম্প-পেপারে? কারণ, তখন ছিল নবাবি আমল৷

ভাওয়ালের ওই তিন রাজকুমার প্রতাপচন্দ্রকে বলেছিলেন, আপনি ব্রাহ্মণ মানুষ৷ সংসার প্রতিপালনের জন্য আপনাকে একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিতে চাই৷ ‘ক’ তপশিলে ঢাকেশ্বরী দেবীর সম্পত্তি ও মন্দিরের সীমানা উল্লেখ করা আছে৷ ‘খ’ তপশিলে বর্ণিত প্রতাপচন্দ্রের ভূ-সম্পত্তির পরিমাণ৷ প্রায় ১২৯ বছর আগেকার ওই দলিলের বয়ান এরকম—‘শ্রীপ্রতাপচন্দ্র চক্রবর্ত্তী পিতা মৃত বঙ্গচন্দ্র চক্রবর্ত্তী জাতি ব্রাহ্মণ ব্যবসা ঢাকেশ্বরী সেবায়িতি সাকিন ঢাকেশ্বরী বাড়ী থানা ও সাব রেজিস্টার সদর জিলা ঢাকা …২১৬৮ নং দাগভুক্ত মহান ঢাকেশ্বরী নামক স্থানে ঢাকেশ্বরী দেবী স্থাপিত আছেন ঐ দেবীর সেবা-পূজার কার্য্য…৷’

প্রতাপচন্দ্র চক্রবর্তীর ওয়ারিশগণ যে ঢাকেশ্বরী দেবীর নিয়মিত সেবা ও পুজোয় নিয়োজিত থাকবেন সেকথাও লিখিত রয়েছে দলিলে৷ এও লিখিত আছে যে, …ঢাকেশ্বরী দেবীর সম্পত্তি কিংবা উক্ত রূপ সেবা-পুজোর কার্য কিংবা তাহার স্বত্ব প্রতাপচন্দ্র অথবা তাঁর ওয়ারিশগণ কখনও হস্তান্তর করতে পারবেন না৷ তবে প্রতাপচন্দ্র অথবা তাঁর ওয়ারিশগণ ওই সেবা-পুজো করতে অক্ষম বা অশক্ত হলে, তাঁদের নিজ ব্যয়ে উপযুক্ত ব্রাহ্মণ নিযুক্ত করে ওই সেবা-পুজোর কাজ চালিয়ে যেতে হবে৷

ভবিষ্যতে সরকার অথবা মিউনিসিপ্যালিটি থেকে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ওপর যে কর ধার্য করা হবে তা প্রতাপচন্দ্র ও তাঁর ওয়ারিশগণ দিতে বাধ্য থাকবেন৷ এমনকী এই মন্দিরের কোনও দালান-কোঠা তৈরি হলে কিংবা মেরামতির কাজকর্ম হলে তার খরচও বহন করবেন প্রতাপচন্দ্র ও তাঁর ওয়ারিশগণ৷ এক-দেড়শো বছর আগেও ঢাকেশ্বরী মন্দিরে তেমন ভিড় হত না৷ জলে-জঙ্গলে ঘেরা ছিল এই মন্দির৷ পথে চুরি-ডাকাতিরও বিস্তর ভয় ছিল তীর্থযাত্রীদের৷ ভাওয়াল রাজপরিবার সেবাইতকে আর্থিক সাহায্যও করতেন৷ ধীরে ধীরে মন্দিরে যাত্রীদের আসা-যাওয়া কিছুটা বাড়লে প্রতাপচন্দ্রের আর্থিক সাহায্য একসময় বন্ধ হয়ে যায়৷ কারণ, ভাওয়ালের রাজার সঙ্গে লিখিত চুক্তি অনুযায়ী মন্দিরে যাত্রী প্রণামির সমস্ত অর্থ প্রতাপচন্দ্রই পেতেন৷ সেই প্রথা অদ্যাবধি চালু রয়েছে৷

এবার ওই অলৌকিক ঘটনার কথা সরাসরি সেবাইত প্রদীপবাবুর মুখেই শোনা যাক৷—‘একদিন সন্ধ্যাবেলায় আমার ঠাকুরদা সন্ধ্যারতি ও পুজোর পর গর্ভমন্দিরের দরজা বন্ধ করে মন্দিরের লাগোয়া তাঁর বাসগৃহের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন৷ গোটা ঘটনাটা ঠাকুরদার কাছেই শুনেছিলাম৷ সেইসময় লন্ঠনের আবছা আলোয় এক বৃদ্ধাকে মন্দিরের দিকে আসতে দেখে ঠাকুরদা একটু অবাক হলেন৷ এ সময় তো লোকজন মন্দির থেকে চলে যায়৷ তাহলে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে বৃদ্ধা কেন আসছেন? ওই বৃদ্ধা সঙ্গে করে কিছু চাল, দুধ ও চিনি এনেছেন৷ ঠাকুরদার হাতে ওগুলো দিয়ে অনুরোধ করলেন কাল সকালে ঢাকেশ্বরী দেবীকে পায়েস করে দিলে তাঁর অনেকদিনের মনের সাধ পূর্ণ হয়৷ দেবীকে পায়েস খাওয়ানোর ইচ্ছা তাঁর৷

বৃদ্ধা তো চলে গেলেন৷ সেদিনই সন্ধ্যায় কোনও কারণে আমাদের গাভি দুধ দেয়নি৷ আমার বাবা তখন খুবই ছোট৷ ঠাকুরদা ভাবলেন, ছেলেকে বৃদ্ধার আনা সব দুধটুকু খাইয়ে দেবেন৷ রাতে তো আর পায়েস রান্না হচ্ছে না৷ সকালে গোরুর দুধের ব্যবস্থা হয়ে যাবে৷ আর ওই দুধেই পায়েস হবে৷ এদিকে পরদিন সাত সকালেই ওই বৃদ্ধা মন্দিরে এসে হাজির৷ ঠাকুরদাকে রীতিমতো অভিযোগের সুরে বললেন, দুধটা যে তুমি খাওইল্যা, করলাটা কী?

ঠাকুরদা তখন মনে মনে ভাবছেন—এ কথা বৃদ্ধা জানলেন কী করে! ভদ্রমহিলার আরও অভিযোগ তাঁর আনা চাল ও চিনিতে পিঁপড়ে লেগেছে৷ ঠাকুরদা হাতজোড় করে নিজের অপরাধ স্বীকার করলেন৷ তখন বৃদ্ধাই বললেন যে, ভোররাতে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন যেটুকু দুধ পায়েসের জন্য এনেছিলেন তা বামুনমশাই তাঁর শিশুপুত্রকে খাইয়ে দিয়েছেন৷ এরপর ভোরে ঘুম ভাঙতেই বৃদ্ধা সোজা মন্দিরে চলে এসেছেন৷

অবশেষে দুধের ব্যবস্থা হল৷ পায়েস রেঁধে ঢাকেশ্বরী দেবীকে নিবেদন করা হল৷ এরপর দুপুরের প্রসাদ খেয়ে বাড়িতে ফিরলেন সেই বৃদ্ধা৷ একে অলৌকিক ঘটনা ছাড়া কী-ই বা বলা যায়৷ ঢাকেশ্বরী দেবী যে খুবই জাগ্রত আমার বাপ-ঠাকুরদাকে প্রায়ই বলতে শুনেছি৷ আর এই মন্দিরে যাঁরা আসেন তাঁরাও এ কথা বিশ্বাস করেন৷’ —চলবে

সৌজন্যে দীপ প্রকাশন

Skip to content