শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


হেমা মালিনীর সঙ্গে লেখক

আমার ডাক্তারি জীবন গড়ে ওঠার দিনগুলোতে এমন একজন মানুষের সাহচর্য পেয়েছিলাম, যাকে না পেলে আজ আমি এই ‘আমি’ হয়ে উঠতে পারতাম না। তিনি হলেন এই রাজ্যে ক্যানসার চিকিৎসার প্রাণপুরুষ ডাক্তার সরোজ গুপ্ত। প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে ঠাকুরপুকুরে এই রাজ্যের প্রথম বেসরকারি ক্যানসার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। কীভাবে এই স্বপ্নদ্রষ্টা মহাপুরুষের সংস্পর্শে আমি এলাম, সেই গল্পটা এবার বলি।

আর জি কর হাসপাতালে হাউসস্টাফশিপ শেষ হবার পর তিন মাস এক্সটেনশন পেলাম। এটা ১৯৮৩ সালের গোড়ার দিকের কথা। এর মধ্যে কাজ খোঁজা শুরু করেছি। কারণ এরপর তো বেকার জীবন শুরু হবে। এক্ষুনি চেম্বার সাজিয়ে-গুছিয়ে বসব, তেমন আর্থিক সংস্থানও নেই। অভাব না থাকলেও সোনার চামচ মুখে নিয়ে তো জন্মাইনি আমি। ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়েছিলাম বলে ডাক্তারি পড়ার পঞ্চাশ ভাগ খরচ নিজেই বহন করতাম। বাকিটা জোগাত পরিবার। ডাক্তারি পাশ করেছি দু-বছর হয়ে গেছে। সামান্য কিছু স্টাইপেন্ড পেতাম আর জি কর হাসপাতালে কাজ করে। সেটা বন্ধ হয়ে গেলে আবার তো বাবার কাছে হাত পাততে হবে! কাজেই মরিয়া হয়ে কাজ খুঁজতে লাগলাম। আমাদের কিচেন ব্লক হস্টেলের রুমমেট পার্থদা খবর দিল, ঠাকুরপুকুর ক্যানসার রিসার্চ সেন্টারে জুনিয়র ডাক্তার নেবে। সেখানে পার্থদার একজন দাদা, ডাক্তার অরুণাভ সেনগুপ্ত সেই সময় কাজ করতেন। পার্থদার সুপারিশ নিয়ে অরুণাভদার সঙ্গে দেখা করলাম। এক বছরের জন্য সেখানে রেজিস্ট্রার হয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়ে গেলাম। আমি যোগ দিলাম ইএনটি বিভাগে, আর আমার সহপাঠী প্রবীরবিজয় কর যোগ দিল সার্জারি বিভাগে। শুরু হল আমার এক নতুন জীবন। এখানেই পেলাম ক্যানসার চিকিৎসা জগতের প্রবাদপুরুষ ডাক্তার সরোজ গুপ্তের সুযোগ্য নেতৃত্ব এবং অকৃপণ সান্নিধ্য।

কীভাবে গড়ে উঠেছিল এই ক্যানসার হাসপাতাল? স্যারের মুখেই শুনেছি সেসব গল্প। যেটুকু স্মৃতিতে আছে তাই বলছি। স্যার তখন চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলকাতায় তখন ওই একটিই ক্যানসার হাসপাতাল। প্রচুর রোগীর ভিড়। সময়মতো চিকিৎসা পান না অনেকেই। মৃত্যুহারও অনেক। এগুলো দেখে খুব কষ্ট পেতেন স্যার। মানুষটি বরাবরই খুব মানবিক ছিলেন। শুধু ভাবতেন এই অবস্থার কী করে পরিবর্তন করা যায়। এই রাজ্যে দরকার আরও অনেক অনেক ক্যানসার হাসপাতাল। সরকারি উদ্যোগে ক্যানসার চিকিৎসা তখনও তেমনভাবে শুরু হয়নি। স্যার ভালোবাসতেন লেখালেখি ও নাটক। নিজেই লিখলেন একটি নাটক ‘কর্কট লগ্ন’, অভিনয়ও করলেন তাতে একজন ক্যানসার রোগীর ভূমিকায়। স্যারের সংলাপ ছিল, এত বড় একটা শহর, এত বড় হাসপাতাল, এখানে আমার একটু জায়গা হবে না, আমার একটা বেড হবে না আপনাদের হাসপাতালে! সম্প্রতি আমার বন্ধু অরিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের তৈরি স্যারকে নিয়ে তথ্যচিত্রে ধরে রাখা একটি ভিডিও ক্লিপিংসে এই দৃশ্যটি দেখে চোখে জল চলে এল।

স্যার তখন খুঁজে বেড়াচ্ছেন একটুকরো জমি, যেখানে ক্যানসার চিকিৎসার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেন। তৎকালীন দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঠাকুরপুকুরে ৬ একর জমির সন্ধান পাওয়া গেল। যাঁদের জমি তাঁরা স্যারের এই মহৎ প্রচেষ্টার কথা শুনে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সেই জলাজমি স্যারকে দান করলেন। শুরু হল স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষটির এক অসম লড়াই। ১৯৭৩-এ প্রথমে ডে কেয়ার সেন্টার হিসেবে কাজ শুরু হয়েছিল অর্থাৎ কিছু ক্যানসার রোগীকে রোগ নির্ণয় করে সেখানে ভর্তি রেখে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের রেডিয়েশন দেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হত চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে। ২৫টি বেড নিয়ে শুরু হয়েছিল প্রথম এই হাসপাতাল, এখন বেডের সংখ্যা ৩১১। স্যারের প্রথম থেকেই লক্ষ্য ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ক্যানসার হাসপাতাল গড়ে তোলা। এজন্য তিনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে অর্থ সাহায্য প্রার্থনা করেন। বোম্বের অনেক চিত্রতারকা অর্থ সাহায্য করেন। যাঁদের মধ্যে হেমা মালিনী-ধর্মেন্দ্র সহ অনেকেই রয়েছেন। হেমা মালিনী অর্থ সাহায্যের জন্য কলকাতায় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে নাচের প্রোগ্রাম করে গেছেন। কলকাতার বিভিন্ন জগতের মানুষেরাও নানাভাবে সাহায্য করেছেন এই হাসপাতালকে গড়ে তুলতে। বহু গুণী মানুষের পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে এই হাসপাতাল, যার সাক্ষী আমি অনেক বার হয়েছি। জুনিয়রদের সঙ্গে স্যার বন্ধুর মতো মিশতেন, স্নেহ করতেন সবাইকেই। তবে আমি বুঝতাম আমার প্রতি স্যারের একটু অন্যরকম স্নেহ রয়েছে। তার কারণ সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ, যেটা স্যার বরাবর পছন্দ করতেন।

হঠাৎ হঠাৎ স্যারের ঘরে আমার ডাক পড়ত। প্রথম প্রথম ভাবতাম, নিশ্চয়ই কোনও উলটোপালটা কাজ করেছি, তাই ডিরেক্টর জরুরি তলব করেছেন। কিন্তু প্রায়ই গিয়ে দেখতাম স্যারের ঘরে বহু বিখ্যাত মানুষ বসে আছেন। স্যার পরিচয় করিয়ে দিতেন। এভাবেই শম্ভু মিত্র, রবি ঘোষ, কমল মিত্র, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, শেখর চট্টোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়, সুখেন দাস-সহ অভিনয় জগতের বহু মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হতে থাকে। এঁদের অনেকের সঙ্গেই পরবর্তীকালে আমৃত্যু আমার যোগাযোগ ছিল। যেমন কমল মিত্র, রবি ঘোষ, সুখেন দাস। মূলত নাট্যজগতের লোক হলেও এঁদের দেখে এবং হাসপাতালে বিভিন্ন সময়ে সিনেমার শুটিং দেখে আমার মাথায়ও সিনেমার পোকা ঘুরঘুর করতে শুরু করল। শুটিংয়ের সময় স্যার আমাকে দায়িত্ব দিতেন ওঁদের সঙ্গে থাকার জন্য। এভাবেই অজয় বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘কঙ্কাল’ নামে একটি ভৌতিক ছবিতে আমি দেবরাজ রায়ের সঙ্গে জুনিয়ার ডাক্তারের একটি চরিত্রে সুযোগ পাই। নিয়মিত স্টুডিও পাড়ায় যাতায়াত শুরু হয় আমার তখনই। সকাল থেকে বিকেল তিনটে অবধি কাজ করার পর ছ’টা পর্যন্ত ছিল আমাদের বিশ্রামের সময়। তারপর ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতাম। আমি সপ্তাহে দু-তিন দিন হাসপাতালের কোনও স্টাফের সাইকেল নিয়ে টালিগঞ্জ স্টুডিও চক্কর মেরে আসতাম। কোনওদিন যেতাম নিউ থিয়েটার্স, কোনওদিন টেকনিশিয়ান, কোনওদিন বা ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে। তখন সিরিয়ালের যুগ আসেনি। বিনোদন বলতে বড় পর্দার সিনেমা। সেসময় সিনেমায় যাঁরা অভিনয় করতেন, তাঁদের যথেষ্ট কৌলীন্য ছিল, পথে-ঘাটে তাদের দেখা পাওয়া ছিল সৌভাগ্যের ব্যাপার। তখন উত্তম-পরবর্তী যুগ। সুখেন দাস, অঞ্জন চৌধুরিরা একের পর এক ছবি বানাচ্ছেন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদারের মতো পরিচালকরাও কাজ করছেন।

ক্যানসার হাসপাতালের ডক্টর্স কোয়ার্টারে শনি-রবিবার বাদে পুরো সপ্তাহটাই থাকতাম। শনিবার বিকেলে বাড়ি যেতাম, আবার সোমবার সকালবেলা ফিরে আসতাম। ১৯৮৫ এবং ৮৬-তে আমি আমার তৎকালীন নাটকের দল নর্থ ক্যালকাটা থিয়েটার একাডেমির পক্ষ থেকে রবীন্দ্র সদন এবং শিশির মঞ্চে ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের সাহায্যার্থে দুটি বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করি প্রায় একক প্রচেষ্টায়। তবে স্যারের স্নেহ এবং প্রশ্রয়ের হাতটি সব সময় আমার মাথায় ছিল। স্যারের সুপারিশেই বিকাশ রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, কমল মিত্র, রবি ঘোষের মতো বিখ্যাত মানুষদের এই অনুষ্ঠানগুলোতে আমি আনতে পেরেছিলাম। রবীন্দ্র সদনের অনুষ্ঠানে আমি পার্থ ঘোষ-গৌরী ঘোষ, জগন্নাথ-ঊর্মিমালা, নীলাদ্রিশেখর-শুভ্রা বসু, আবৃত্তি ও শ্রুতিনাটক জগতের এই তিন জুটিকে প্রথম একসঙ্গে মঞ্চে হাজির করেছিলাম। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয়ার্ধে প্রবাদপ্রতিম শিল্পী মুম্বই প্রবাসী জগন্ময় মিত্রকে নিয়ে এসেছিলাম, ‘চিঠি’ এবং ‘সাতটি বছর’ গেয়ে যিনি অমরত্ব লাভ করেছিলেন জীবদ্দশাতেই। আমাকে ভালোবেসে শুধু বিমান ভাড়াটুকু ছাড়া তিনি এক টাকাও পারিশ্রমিক নেননি। দুটি অনুষ্ঠান থেকে আমি অল্প কিছু টাকা ডাঃ সরোজ গুপ্তর হাতে তুলে দিতে পেরেছিলাম আমার সংস্থার পক্ষ থেকে।

এমন অনেক স্মৃতির মণিমুক্তো ছড়িয়ে রয়েছে আমার ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতাল থাকাকালীন পাঁচ বছরের জীবন জুড়েই।
বিভিন্ন জগতের বহু বিখ্যাত মানুষকে আমি এই হাসপাতালে দেখেছি। কারও কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে। প্রথমেই বলি সেই সময়ের ড্রিম গার্ল অভিনেত্রী হেমা মালিনীর কথা। আগেই বলেছি, তিনি নাচের প্রোগ্রাম করে সেই সময় কয়েক লক্ষ টাকা আমাদের হাসপাতালে দান করেছিলেন। ওঁর বাবার নামে একটি ওয়ার্ডও আছে এখানে। স্যারের আমন্ত্রণে উনি একবার আমাদের হাসপাতালে এসেছিলেন। যথারীতি স্যার আমাকে ডেকে নিলেন এবং হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড তাঁকে ঘুরিয়ে দেখানো শুরু হল।

স্যারের পিছনে পিছনে আমিও হাঁটছি। হঠাৎ স্যারের কাছে রাইটার্স বিল্ডিং থেকে জরুরি ফোন এল। সেই সময় তো আর মোবাইল ছিল না, কাজেই স্যারকেই ছুটতে হল তাঁর ঘরে গিয়ে ল্যান্ডফোন ধরার জন্য। ভার দিয়ে গেলেন আমাকে হেমা মালিনীকে হাসপাতাল ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। মিনিট দশেক আমি ওঁকে নিয়ে দু-একটি ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ালাম। ইংরেজি-বাংলা এবং হিন্দি মিশিয়ে এক ককটেল ভাষায় ওঁর সঙ্গে কথা বলে গেলাম। হয়তো আমার ভাষা শুনে মোহিত হয়ে উনি তাড়াতাড়ি স্যারের ঘরে ফিরে যেতে চাইলেন।

সত্যজিৎ রায়কে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার সুযোগ পেয়েছিলাম এই হাসপাতালেই। ওঁর ইউনিটের আর্থিক দিকটা দেখতেন রঞ্জিত সেনগুপ্ত বলে একজন ইনকাম ট্যাক্স ল ইয়ার, যাঁর খাদ্যনালিতে ক্যানসার হয়েছিল। তাকেই দেখতে এসেছিলেন উনি। কথা বলার সুযোগও পেয়েছিলাম ওঁর সঙ্গে। এছাড়া আমার সাহিত্যগুরু সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এখানেই পরিচয় স্যারের মাধ্যমে। কবি শঙ্খ ঘোষ, সাংবাদিক-সাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, কমল মিত্র-সহ অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি শুধু স্যারের দয়ায়। ইন্দিরা গান্ধী এবং জ্যোতি বসুকেও আমি এই হাসপাতালেই প্রথম দেখি। ক্যানসার নিয়ে কাজ করার মানসিকতা এই হাসপাতালেই আমার প্রথম তৈরি হয়েছিল এখনও যা বর্তমান, আর তার পিছনে একজন মহান মানুষের অবদান আমৃত্যু মনে রাখব। তিনি হলেন ডাক্তার সরোজ গুপ্ত। প্রণাম জানাই তাঁকে।

Skip to content