শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


পরিচালক স্বপন সাহা।

রুপোলি পর্দার আড়ালে প্রতিনিয়তই ঘটে চলে কতশত বিচিত্র ও বৈচিত্রময় ঘটনা। সাধারণ দর্শকরা পর্দার সামনে ঘটতে দেখা ঘটনাপ্রবাহের পাশাপাশি কিন্তু অপেক্ষা করে থাকেন যদি সেই সমস্ত বৈচিত্রের টুকরো কিছু ঝলকের আভাসমাত্র পাওয়া যায় কোনওভাবে। এবার তাদের সেই অপেক্ষার অবসান হওয়ার পালা। টলিউডে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা সেই সমস্ত নানাবিধ বৈচিত্রের সমাহার নিয়েই এবার থেকে থাকছেন টলিউডের অন্যতম মুখ্য সহকারী পরিচালক বিভাসরঞ্জন বেরা। বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক ও আকর্ষণীয় ঘটনার কাহিনি নিয়েই থাকছে তার এই ধারাবাহিক ‘অচেনা টলিউড’

পর্ব-১

সময়টা নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী ১০ বছর ধরুন। তখন টেকনিশিয়ান স্টুডিওটাই ছিল স্বপন সাহার ঘরবাড়ি। আমরাও সকালে আসতে হবে জানতাম, কখন ফিরতে পারব জানতাম না। কোনওদিন দুটো তো কোনওদিন তিনটে ছবির শুটিং। কোন দিন কোন ছবি হবে সঠিক জানতামও না। ওটা উনি জানেন। তার ওপর ভরসা করে কলটাইম মেনে পুরো ইউনিট এসে হাজির হয়ে যেত। অনেক সময় বাড়ির লোকের কাছে বা স্টুডিওতে ঢোকার মুখে জিজ্ঞাসু লোকজনের কাছে বিব্রত হতে হয়েছে, যখন কেউ প্রশ্ন করেছে, আজ কোন ছবির শুটিং? বলতে পারিনি। বলেছি, গিয়ে জানতে পারব বা ওটা ডিরেক্টর জানে। উত্তর শুনে সবাই অবাক হয়ে ঠাট্টার সুরে বলেছে, সে কী! অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হয়ে শুটিংয়ে যাচ্ছ, জানো না কোন ছবির শুটিং! বাইরের লোকেদের কাছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক ঠেকতেই পারে কিন্তু ইউনিটের লোকজন, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাছে ছিল একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার।

কেউ জানতই না তো বলবে কী! কিন্তু জানত না-ই বা কেন? কী করে জানবে? একসঙ্গে একই ফ্লোরে একই সেটে কখনও দুটো কখনও তিনটে ছবির শুটিং। অভিনেতা- অভিনেত্রীরাও মোটামুটি এক। নায়কদের মধ্যে প্রসেনজিৎ চিরঞ্জিত তাপস পাল অভিষেক, নায়িকাদের মধ্যে ঋতুপর্ণা শতাব্দী অঞ্জু ঘোষ রচনা। এর বাইরে কেউ গেছে এসেছে সেগুলো ব্যতিক্রম। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার বাকি চরিত্রাভিনেতা মানে যাঁরা বাবা-মা বন্ধু গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করতেন তাঁরাও মোটামুটি এক। পুরুষ চরিত্রে শুভেন্দু চ্যাটার্জি বোধিসত্ত্ব মজুমদার দুলাল লাহিড়ী মনোজ মিত্র শুভাশিস মুখার্জি বিপ্লব চ্যাটার্জি কখনও-সখনও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আর মহিলা চরিত্রে অনামিকা সাহা অনুরাধা রায় বাসন্তী চ্যাটার্জি গীতা কর্মকার কিংবা কল্যাণী মণ্ডল। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও জানত না শুটিংয়ের দিন গিয়ে কোন ছবির সংলাপ বলতে হবে। তবু কোনও ক্ষোভ নেই বিরক্তি নেই। একই পরিচালক একাধিক ছবি, মাসের ৩০ দিনে ৩০ দিন শুটিং। কাজের পর কাজ দিচ্ছেন যিনি, তার উপর কীসের ক্ষোভ? সেই সময় চালু হয়েছে সিরিয়ালের মেগা রূপ ‘জননী’। বিপুল জনপ্রিয় সেই সিরিয়াল। ইন্ডাস্ট্রির লোকজন বলতে শুরু করল, সবাই সিরিয়ালের মেগা রূপ দেখেছে, এবার দেখছে ছবির মেগা রূপ। অবিশ্বাস্য সব কাণ্ড কারখানা। স্টুডিও পাওয়া যাবে কি না, অভিনেতা- অভিনেত্রীর ডেট পাওয়া যাবে কি না, এসব নিয়ে কোনও টেনশন নেই। শুটিং হবে। সবটাই স্বপনদার মাথায়।

পান চিবোতে চিবোতে চেয়ারে হেলান দিয়ে পা দোলাতে দোলাতে প্ল্যান ভেজে যাচ্ছেন কাল কী হবে পরশু কী হবে। আমরা ইউনিটের লোকরা নিশ্চিত থাকতাম ছোট-বড় খুচরো যেকোনও অভিনেতা-অভিনেত্রী যাকে পাবেন তাকে নিয়ে শুটিং তিনি করবেনই। আমরা ছিলাম পাঁচজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। ওঁকে সাহায্য করাই আমাদের কাজ। কিন্তু সবটাই অর্ধেক অর্ধেক জানি। সাহায্য করব কীভাবে? ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত হোক কোনও কিছুই খোলসা করতেন না। এটার দু’রকম কারণ থাকতে পারে। এক উনি সবাইকে অন্ধকারে রেখে নিজের গুরুত্ব বাড়িয়ে রাখতেন। দুই, সহকারীদের ওপর পূর্ণ ভরসা করার সাহস দেখাতেন না। তবে স্বপনদা পুরোটা একা সামলেও নিতেন। ছবির শুটিং থেকে মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত সবটাই মাথায় রাখতেন। টেকনিশিয়ানরা বলত ওঁর ‘কম্পিউটার ব্রেইন’। আমি আড়াই বছরে একুশটা ছবিতে কাজ করেছি।

আমরা পাঁচজন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রত্যেকেই আশঙ্কা করতাম, এত ছবি শুটিং একসঙ্গে চলছে কোনও না কোনও ভুল হবে এবং রি-শুট করতে হবে। কিন্তু কখনও তা করতে হয়নি। ইন্ডাস্ট্রির চালু ধারণা আছে, কোনও ছবির শুটিং-এর আগে মিনিমাম এক মাসের প্রি-প্রোডাকশনের প্রয়োজন। ওঁর সিস্টেমের কাছে মনে হবে, সেগুলো সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। ওঁর কাছে গল্পটাই ছিল আসল। দেখতেন সেটা মানুষের মনকে ছুঁতে পারছে কি না। বাকি সব নিয়ে ওঁর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। উনি বুঝতেন দর্শকরা কী চায়। সে বোঝাটা সঠিক ছিল বলেই ওঁর সাকসেস রেট অনেক নামকরা পরিচালকদের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। অল্প বাজেটে কীভাবে একটার পর একটা ছবি ‘হিট’ দেওয়া যায় টলিউড দেখেছে। অনেক গরিব প্রোডিউসার বড়লোক হয়েছেন তার কাঁধে ভর করে। অনেক হারিয়ে যাওয়া প্রোডিউসার আবার শিরোনামে এসেছেন ওঁর দয়ায়। এখনকার জেনারেশনের অনেকেই হয়তো বাংলা সিনেমায় তার অবদান সম্পর্কে অবহিত নয়। অনেকেই জানে না প্রায় একশোর কাছাকাছি ছবি পরিচালনা করে যে মানুষটি ‘গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’এ নাম তোলার দাবি রাখে তার নাম স্বপন সাহা।

 


Skip to content