ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
বাংলায় তুর্কি আক্রমণের পরে বাঙালির জাতীয় জীবনের আইডল, সুপারহিরো হিসাবে প্রতীকী ধারণা হিসাবে মূর্ত হয়ে উঠেছিলেন ‘শ্রীকৃষ্ণ’। শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর, হিন্দু দেবত্ববাদে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষের জাতীয় আত্মতুষ্টিকে মালাধরের বীররস সমৃদ্ধ শ্রীকৃষ্ণের ইমেজ এই অন্য স্তরে উন্নীত করেছিল। শ্রীকৃষ্ণ হোক বা রামচন্দ্র বাঙালির, আদর্শবান সুপারহিরোরা তথা মানববেশী ঈশ্বরদের অরিষ্টাসুর, কেশি বা রাবণ বধের প্রোটোটাইপ গড়ার মধ্য দিয়ে বাঙালির হাতে আশ্বস্তির চাবিকাঠি তুলে দিয়ে চেতনাগতভাবে তাকে খানিকটা আরাম দিলেও মানুষ মানুষকেই বেশি ভালো চেনে। তাই বীররসসমৃদ্ধ এই সমস্ত স্বর্গীয় সুপারহিরোরা থাকা সত্ত্বেও বাঙালি এক খাঁটি বাঙালির সন্ধানে ছিল বহুদিন ধরেই, যে সন্ধানের সমাপ্তি ঘটেছিল অবশেষে ষাটের দশকে, নারায়ণ দেবনাথের হাত ধরে। দিনের শেষে নিজের আয়নায় নিজেকে দেখব বলেই হ্য়তো আমরা সাদা-কালোর মিশেলে তৈরি চিত্রকল্পর আধারে বাঁটুলের যুদ্ধজয়, কেল্টুকে পরাজিত করে নন্টে-ফন্টের বীরমত্তা প্রদর্শন বা অতি বুদ্ধির অধিকারী রোগা পাতলা হাঁদাকে অবশেষে বোকা বানিয়ে মোটাসোটা গোবেচারা ভোঁদার জিতে যাওয়ার গল্পগুলোর কাছেই আমাদের বারবার ফিরে যেতে হয়। বাঁটুল এবং বাঁটুলের প্রতিদ্বন্দ্বীদ্বয় আজও সেই বিস্মিত বিশ্বের বাসিন্দা যেখানে বয়স, পেশা, জাত, ধর্ম ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের মানদণ্ড সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার কোনও প্রয়োজন বা মাথাব্যথা না আছে চরিত্রদের না আছে পাঠকদের। তারা বাঙালির হাফপ্যান্টের নস্টালজিয়াময় পৃথিবীতে অন্যতম সেরা টাইম ট্র্যাভেলার। কিন্তু চির নতুন এই টাইম ট্র্যাভেলারদের যাত্রাকে বাঙালির শুকতারাময় ছেলেবেলার ইতিহাসে চিরসবুজের দেশে পৌঁছে দিতে দিতে স্রষ্টা নিজেই সেই দেশের দিকে পা বাড়ালেন।
১৯২৫ থেকে ২০২২- নামপরিচয়ের সঙ্গে গ্রথিত এক দীর্ঘ সময়ের ‘অপর’ ঐতিহ্যের সমাপতন ঘটল। নারায়ণ দেবনাথ মানেই বাঙালি সংস্কৃতির এমন এক প্রত্যঙ্গ যে প্রত্যঙ্গ ৬০’ এর দশকে ১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধপ্রাঙ্গণে সমগ্র পৃথিবী যখন অন্য এক বিচ্ছিন্নতাবাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠিক সেই সময়ে এই প্রত্যঙ্গ হয়ে উঠছে এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ‘অপর’। ‘হাঁদা-ভোঁদা’-কে নারায়ণ দেবনাথ নিয়ে আসছেন এই বছরই, পাশাপাশি ১৯৬৫-তে ভারত-পাক যুদ্ধ, নারায়ণ যেন কল্পরাজ্যের দুনিয়া থেকে তুলে আনছেন ‘বাঁটুল দি গ্রেট’-কে। যুদ্ধের পৃথিবীতে এহেন বিশুদ্ধ কৌতুকরসের উদ্ভাবনা কি কেবলমাত্র শিশু চেতনাকে অন্যতর এক অভাবনীয় ফ্যানটাসিময় জগতের সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য? কখনও কখনও মনে হয় যেন সেই সময় যদি অমন একটা পৃথিবী নারায়ণ দেবনাথ তৈরি না করতেন ওই লাল কালো কমিক চরিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে তাদের চাল-চলন সম্পর্কের পারস্পরিক রসায়নের মাধ্যমে যে নিখুঁত বাঙালিজীবনের চাল-ছন্দ ধরা পড়ে তা যুদ্ধের বোমারু বিমানের আতঙ্কেই হয়তো ধীরে ধীরে কোথায় চাপা পড়ে যেত। আজকের দিনে হয়তো কোনও নব্য রিসার্চ স্কলার ‘পুরাতন বাঙালিআনার ইতিহাস’ বা ওই জাতীয় কোনও বিষয় নিয়ে গবেষণা কার্য চালিয়ে বাঙালিআনাকে মাটি ফুঁড়ে বের করে আনত হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়ো সভ্যতার মতন। আসলে পলায়নপ্রবৃত্তি মনে হলেও বাঙালির জীবনের নিজস্ব চালকি বাঁচিয়ে রাখতে সর্বোপরি নিজেদের মনন সুধাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে দিনের শেষে এমন এক আশ্রয়ের প্রয়োজন ছিল যে আশ্রয়ের কাছে ফিরে গিয়ে নিজের আবরণহীন চেহারাটা দেখে নিজেই খানিক মুচকি হেসে আরামবোধ করা সম্ভব হবে। আর বাঙালিকে সেই আশ্রয়ের দিশা দেখিয়েছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। কেবল বাঙালি তো নয়, পৃথিবীর সমস্ত জাতিরই যুদ্ধের মাঠ থেকে পালিয়ে আসার জন্য একটা নিজস্ব আশ্রয়স্থল প্রয়োজন ছিল এবং যতদিন পৃথিবীতে যুদ্ধ থাকবে ততদিনই এই প্রয়োজন বেঁচে থাকবে, নাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংকটাপন্ন পৃথিবীতে রাশিয়ার উপকণ্ঠে দাঁড়িয়ে বারংবার যুদ্ধের স্মৃতির সঙ্গে সমান্তরাল এক চলনের গতিতে এক কবি ছেলেবেলায় তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের সময়কার স্মৃতিতে কেন ফিরে যান? বারবার তাকে যুদ্ধের দ্বান্দ্বিক চেতনা থেকে সরে আসতে হয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কের দ্বান্দ্বিক সরণে। যুদ্ধ নামক বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে ব্যক্তি জীবনের বিচ্ছিন্নতাবাদ, তার মায়ের ক্রমাগত নিজের থেকে নিজের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার স্মৃতিকথা, যেন এক চিত্রমালায় গ্রথিত করে গড়ে তুলেছেন পরিচালক। ‘দ্য মিরর’ ছবির এই পটভূমিকায় আশ্রয়ের গোত্রটা ভিন্ন হলেও তারকভস্কি এটুকু বলে দিয়েছিলেন যে কখনও কখনও পাশ কাটানোটাও ভীষণ জরুরী, সমান্তরাল চলনেও পাশ কাটিয়ে যেতে হয় কখনও কখনও। তার ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রের স্মৃতির সরণ ঘটতে থাকে অনবরত যেমন যুদ্ধের ইমেজ থেকে শৈশবের একাকিত্বে, বাঙালির চেতনা তেমনই যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করে এসে মুখ গুঁজে দেয় লাল-কালো জগতে নির্ভেজাল কৌতুকরসে যেখানে ভারত-পাক যুদ্ধচলাকালীন ভারতের সমর্থনে জাতীয়তাবোধের উজ্জীবনও এমনভাবে ঘটে যাতে মনে মনে বলতে ইচ্ছা করে ‘সবাই ভালো থাকুক’। এমন এক জাতীয়তাবোধই তো আমরা চেয়েছিলাম যা ভাঙতে শেখায় না কেবল, সহাবস্থানে বাঁচতে শেখায়। তারকভস্কির ছবির চরিত্র ক্রমাগত বিশ্বযুদ্ধ থেকে আত্মযুদ্ধের পথে যাতায়াত করে আর বাঙালির চেতনা বীভৎসরস থেকে কৌতুকরসের পথে চলাফেরা করতে চায়, পার্থক্য এইটুকুই কেবল। কিন্তু যুদ্ধের পৃথিবীতে মানবজাতির সাময়িক পলায়ন অবশ্যম্ভাবী নাহলে এতদিনে অচিরেই মানুষকে চেতনাগতভাবে আবার প্রস্তরযুগে ফিরে যেতে হত হয়তো।
বাঙালির এহেন আশ্রয় নির্মাণকারী, তৃতীয় বিশ্বের মূক যন্ত্রণার পটভূমিকায় এক ‘অন্য পৃথিবী’র ইমেজ নির্মাণ করতে করতে শেষমেশ তার কলমের মুখ খোলা রেখেই বিদায় নিলেন শারীরিকভাবে। বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত ছিলেন নারায়ণ দেবনাথ গত কয়েক বছর ধরেই, বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তিও হতে হয়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর রক্তাল্পতা ও তীব্র শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে বেশ সংকটজনক অবস্থাতেই ভর্তি হন হাসপাতালে। ১৩ই জানুয়ারি হাসপাতালের বেডে শুয়েই গ্রহণ করেন পদ্মশ্রী সম্মান, সেখানেই মানপত্র গ্রহণ করেন। তার একদিন পর থেকেই শারীরিক অবনতি শুরু হয়, শনিবার ভেন্টিলেশনে দেওয়ার পর মঙ্গলবার সকাল থেকে আরম্ভ হয় হৃদযেন্ত্রর সমস্যা, সওয়া দশটায় দেউটি অন্ধকার করে বাংলা সাহিত্যজগতের একটি নক্ষত্র নিভে যায় চিরতরে। বিকেলে হাওড়ার শিবপুর শ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। বাঙালির সন্তান আজ টিনটিন, ফ্যানটম, হ্যারি-পটার বা স্পাইডারম্যানে বুঁদ হয়ে বাঁচে কিন্তু তাতে কি আদতে কিছু আসে যায়? বিশ্বায়নের বিশ্ব ছোট থেকে শিশুদের গ্লোবাল হতে যেমন শিখিয়েছে তেমনই এখনও ভুলতে ভুলতে না ভোলা শেকড়টুকু বেঁচে যে আছে তার প্রমাণ তো নারায়ণবাবু নিজেই। আর্জে, গোসিনি বা লি ফকের মতো পরিকাঠামো ছাড়া শিবপুরের চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরে কলেজ স্ট্রিট থেকে সংগ্রহ করা আঁকার সামগ্রী দিয়ে লেখা, ইলাস্ট্রেশান একা হাতে দিব্যি সামলেছেন নারায়ণ, আর এখানেই নারায়ণ দেবনাথ নিজেই এক আস্ত শিকড়ের ধারণাবাহী রক্ত-মাংসের প্রতিভূ হয়ে থেকে যান। শিকড় আমদের এখনও বেঁচে আছে, দিব্যি বেঁচে আছে আমাদের কেবল তাতে সার জল দেওয়ার কাজটুকু করে যেতে হবে। সার জল প্রাপ্ত ফলাফল যদি ছড়িয়ে দেয়ার যায় হাত খুলে তাহলেই সেই ‘অন্য পৃথিবী’ দরজা হাট হয়ে খুলে যাবে চোখের সামনে, আর আবার আমরা সংকটের দিনে বলতে পারব:
Dear God! the very houses seem asleep;
And all that mighty heart is lying still !
১৯২৫ থেকে ২০২২- নামপরিচয়ের সঙ্গে গ্রথিত এক দীর্ঘ সময়ের ‘অপর’ ঐতিহ্যের সমাপতন ঘটল। নারায়ণ দেবনাথ মানেই বাঙালি সংস্কৃতির এমন এক প্রত্যঙ্গ যে প্রত্যঙ্গ ৬০’ এর দশকে ১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধপ্রাঙ্গণে সমগ্র পৃথিবী যখন অন্য এক বিচ্ছিন্নতাবাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠিক সেই সময়ে এই প্রত্যঙ্গ হয়ে উঠছে এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ‘অপর’। ‘হাঁদা-ভোঁদা’-কে নারায়ণ দেবনাথ নিয়ে আসছেন এই বছরই, পাশাপাশি ১৯৬৫-তে ভারত-পাক যুদ্ধ, নারায়ণ যেন কল্পরাজ্যের দুনিয়া থেকে তুলে আনছেন ‘বাঁটুল দি গ্রেট’-কে। যুদ্ধের পৃথিবীতে এহেন বিশুদ্ধ কৌতুকরসের উদ্ভাবনা কি কেবলমাত্র শিশু চেতনাকে অন্যতর এক অভাবনীয় ফ্যানটাসিময় জগতের সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য? কখনও কখনও মনে হয় যেন সেই সময় যদি অমন একটা পৃথিবী নারায়ণ দেবনাথ তৈরি না করতেন ওই লাল কালো কমিক চরিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে তাদের চাল-চলন সম্পর্কের পারস্পরিক রসায়নের মাধ্যমে যে নিখুঁত বাঙালিজীবনের চাল-ছন্দ ধরা পড়ে তা যুদ্ধের বোমারু বিমানের আতঙ্কেই হয়তো ধীরে ধীরে কোথায় চাপা পড়ে যেত। আজকের দিনে হয়তো কোনও নব্য রিসার্চ স্কলার ‘পুরাতন বাঙালিআনার ইতিহাস’ বা ওই জাতীয় কোনও বিষয় নিয়ে গবেষণা কার্য চালিয়ে বাঙালিআনাকে মাটি ফুঁড়ে বের করে আনত হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়ো সভ্যতার মতন। আসলে পলায়নপ্রবৃত্তি মনে হলেও বাঙালির জীবনের নিজস্ব চালকি বাঁচিয়ে রাখতে সর্বোপরি নিজেদের মনন সুধাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে দিনের শেষে এমন এক আশ্রয়ের প্রয়োজন ছিল যে আশ্রয়ের কাছে ফিরে গিয়ে নিজের আবরণহীন চেহারাটা দেখে নিজেই খানিক মুচকি হেসে আরামবোধ করা সম্ভব হবে। আর বাঙালিকে সেই আশ্রয়ের দিশা দেখিয়েছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। কেবল বাঙালি তো নয়, পৃথিবীর সমস্ত জাতিরই যুদ্ধের মাঠ থেকে পালিয়ে আসার জন্য একটা নিজস্ব আশ্রয়স্থল প্রয়োজন ছিল এবং যতদিন পৃথিবীতে যুদ্ধ থাকবে ততদিনই এই প্রয়োজন বেঁচে থাকবে, নাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংকটাপন্ন পৃথিবীতে রাশিয়ার উপকণ্ঠে দাঁড়িয়ে বারংবার যুদ্ধের স্মৃতির সঙ্গে সমান্তরাল এক চলনের গতিতে এক কবি ছেলেবেলায় তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের সময়কার স্মৃতিতে কেন ফিরে যান? বারবার তাকে যুদ্ধের দ্বান্দ্বিক চেতনা থেকে সরে আসতে হয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কের দ্বান্দ্বিক সরণে। যুদ্ধ নামক বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে ব্যক্তি জীবনের বিচ্ছিন্নতাবাদ, তার মায়ের ক্রমাগত নিজের থেকে নিজের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার স্মৃতিকথা, যেন এক চিত্রমালায় গ্রথিত করে গড়ে তুলেছেন পরিচালক। ‘দ্য মিরর’ ছবির এই পটভূমিকায় আশ্রয়ের গোত্রটা ভিন্ন হলেও তারকভস্কি এটুকু বলে দিয়েছিলেন যে কখনও কখনও পাশ কাটানোটাও ভীষণ জরুরী, সমান্তরাল চলনেও পাশ কাটিয়ে যেতে হয় কখনও কখনও। তার ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রের স্মৃতির সরণ ঘটতে থাকে অনবরত যেমন যুদ্ধের ইমেজ থেকে শৈশবের একাকিত্বে, বাঙালির চেতনা তেমনই যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করে এসে মুখ গুঁজে দেয় লাল-কালো জগতে নির্ভেজাল কৌতুকরসে যেখানে ভারত-পাক যুদ্ধচলাকালীন ভারতের সমর্থনে জাতীয়তাবোধের উজ্জীবনও এমনভাবে ঘটে যাতে মনে মনে বলতে ইচ্ছা করে ‘সবাই ভালো থাকুক’। এমন এক জাতীয়তাবোধই তো আমরা চেয়েছিলাম যা ভাঙতে শেখায় না কেবল, সহাবস্থানে বাঁচতে শেখায়। তারকভস্কির ছবির চরিত্র ক্রমাগত বিশ্বযুদ্ধ থেকে আত্মযুদ্ধের পথে যাতায়াত করে আর বাঙালির চেতনা বীভৎসরস থেকে কৌতুকরসের পথে চলাফেরা করতে চায়, পার্থক্য এইটুকুই কেবল। কিন্তু যুদ্ধের পৃথিবীতে মানবজাতির সাময়িক পলায়ন অবশ্যম্ভাবী নাহলে এতদিনে অচিরেই মানুষকে চেতনাগতভাবে আবার প্রস্তরযুগে ফিরে যেতে হত হয়তো।
বাঙালির এহেন আশ্রয় নির্মাণকারী, তৃতীয় বিশ্বের মূক যন্ত্রণার পটভূমিকায় এক ‘অন্য পৃথিবী’র ইমেজ নির্মাণ করতে করতে শেষমেশ তার কলমের মুখ খোলা রেখেই বিদায় নিলেন শারীরিকভাবে। বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত ছিলেন নারায়ণ দেবনাথ গত কয়েক বছর ধরেই, বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তিও হতে হয়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর রক্তাল্পতা ও তীব্র শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে বেশ সংকটজনক অবস্থাতেই ভর্তি হন হাসপাতালে। ১৩ই জানুয়ারি হাসপাতালের বেডে শুয়েই গ্রহণ করেন পদ্মশ্রী সম্মান, সেখানেই মানপত্র গ্রহণ করেন। তার একদিন পর থেকেই শারীরিক অবনতি শুরু হয়, শনিবার ভেন্টিলেশনে দেওয়ার পর মঙ্গলবার সকাল থেকে আরম্ভ হয় হৃদযেন্ত্রর সমস্যা, সওয়া দশটায় দেউটি অন্ধকার করে বাংলা সাহিত্যজগতের একটি নক্ষত্র নিভে যায় চিরতরে। বিকেলে হাওড়ার শিবপুর শ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। বাঙালির সন্তান আজ টিনটিন, ফ্যানটম, হ্যারি-পটার বা স্পাইডারম্যানে বুঁদ হয়ে বাঁচে কিন্তু তাতে কি আদতে কিছু আসে যায়? বিশ্বায়নের বিশ্ব ছোট থেকে শিশুদের গ্লোবাল হতে যেমন শিখিয়েছে তেমনই এখনও ভুলতে ভুলতে না ভোলা শেকড়টুকু বেঁচে যে আছে তার প্রমাণ তো নারায়ণবাবু নিজেই। আর্জে, গোসিনি বা লি ফকের মতো পরিকাঠামো ছাড়া শিবপুরের চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরে কলেজ স্ট্রিট থেকে সংগ্রহ করা আঁকার সামগ্রী দিয়ে লেখা, ইলাস্ট্রেশান একা হাতে দিব্যি সামলেছেন নারায়ণ, আর এখানেই নারায়ণ দেবনাথ নিজেই এক আস্ত শিকড়ের ধারণাবাহী রক্ত-মাংসের প্রতিভূ হয়ে থেকে যান। শিকড় আমদের এখনও বেঁচে আছে, দিব্যি বেঁচে আছে আমাদের কেবল তাতে সার জল দেওয়ার কাজটুকু করে যেতে হবে। সার জল প্রাপ্ত ফলাফল যদি ছড়িয়ে দেয়ার যায় হাত খুলে তাহলেই সেই ‘অন্য পৃথিবী’ দরজা হাট হয়ে খুলে যাবে চোখের সামনে, আর আবার আমরা সংকটের দিনে বলতে পারব:
Dear God! the very houses seem asleep;
And all that mighty heart is lying still !